উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
"রাজার ঘরে যে ধন আছে
টুনটুনির ঘরেও সে ধন আছে!
বড় মজা বড় মজা
রাজা খেলেন ব্যাঙ ভাজা!
এক টুনিতে টুনটুনাল
সাত রানির নাক কাটাল!
নাক-কাটা রাজা রে
দেখ তো কেমন সাজা রে! "
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ মে, ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার মসূয়া গ্রামে। হ্যাঁ, এই কিশোরগঞ্জ মহকুমাই এখন কিশোরগঞ্জ জেলা হয়ে গেছে। তার বাবার নাম শ্যামসুন্দর রায়চৌধুরী, আর মায়ের নাম জয়তারা রায়চৌধুরী। মানে, তাদের পারিবারিক পদবী ছিলো ‘রায়চৌধুরী’। তবে তাদের এই পদবী নিয়ে আবার একটা মজার গল্প আছে।
আসলে তাদের পরিবারের পদবী ছিল ‘দেব’। কিন্তু পাড়া-পড়শিরা তাদেরকে ‘দেব’ বলতো না, বলতো ‘রায়’। এভাবে তাদের পরিবারের পদবী একবার পাল্টে ‘দেব’ থেকে হলো ‘রায়’।
বাংলার বিখ্যাত ১২ জমিদার, মানে বার ভূঁইয়াদের সবচেয়ে বিখ্যাত জমিদার ছিলেন ঈশা খাঁ। ১৬ শতকের শেষ দিকে এই ঈশা খাঁর জমিদারির এক কাছারিতে কাজ করতেন তাদের এক পূর্বপুরুষ। মূলত হিসেব লেখার কাজ করতেন। ঈশা খাঁ তাকে ‘খাসনবিশ’, ‘মজুমদার’ উপাধি দিয়েছিলেন। এই ‘মজুমদার’ আবার পাল্টে হয়ে গেল ‘চৌধুরী’। সবমিলিয়ে, মানে আগের ‘রায়’ আর পরের ‘চৌধুরী’ মিলিয়ে, তাদের পরিবারের পদবী হয়ে গেল ‘রায়চৌধুরী’।
তবে উপেন্দ্রকিশোরের বিখ্যাত পুত্র আর পৌত্র, মানে ছেলে সুকুমার আর নাতি সত্যজিত কিন্তু পুরো পদবী ব্যবহার করেননি। তারা কেবল ‘রায়’ পদবী ব্যবহার করতেন। অন্য ক্ষেত্র বাদ দিলেও, কেবল শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রেও তারা কোনো অংশেই উপেন্দ্রকিশোরের চেয়ে কম যাননি।
উপেন্দ্রকিশোরের নাম নিয়ে আরো একটা মজা আছে; ছোটবেলায় তার নাম উপেন্দ্রকিশোর ছিলোই না। তার নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। ওদিকে মসূয়ার, মানে তাদের গ্রামের যে জমিদার, হরিকিশোর রায়চৌধুরী, তিনি সম্পর্কে তাদের আত্মীয় হতেন। তার আবার কোনো ছেলে ছিল না। কিন্তু তার বিষয়-সম্পত্তিও তো দেখভাল করা দরকার। কাজেই তিনি শ্যামসুন্দরের ছেলে কামদারঞ্জনকে নিজের কাছে রেখে নিজের ছেলের মতো আদরে-যত্নে মানুষ করতে শুরু করলেন। তখন হরিকিশোরের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হলো উপেন্দ্রকিশোর। তখন কামদারঞ্জন, থুড়ি উপেন্দ্রকিশোরের বয়স ছিলো মোটে ৫ বছর।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বছর দুইয়ের ছোট, জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ মে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু। বয়সে খানিকটা বড়, জন্ম ১৮৫৮ সালে। রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী স্বামী বিবেকানন্দেরও জন্ম ১৮৬৩ সালে। ভাবলে বেশ অবাক হতে হয়, খানিকটা আগে-পিছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে হলেও এ চার বাঙালির সবাই জগৎ মাতিয়েছিলেন। আর জগৎজয়ের আয়ুধ তাঁরা অর্জন করেছিলেন নিজ দেশে বসেই, সীমিত সুযোগ-সুবিধাকে অবলম্বন করে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিরও ১০ বছর আগে ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্ম বিষয়ে আলোড়ন তোলা বক্তব্য দিয়ে বিশ্বখ্যাতি পান স্বামী বিবেকানন্দ। জগদীশচন্দ্র বসু বেতারযন্ত্র বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতেই, এর পরবর্তী সময়ে তাঁর আরও আবিষ্কার বিশ্ববিজ্ঞান মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কাছাকাছি সময়ে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর খুবই সাধারণ মানের লেটারপ্রেস ছাপাখানায় বসে রঙিন ছবি মুদ্রণের যুগান্তকারী উন্নতি ঘটিয়ে পাশ্চাত্যজগৎকে তাক লাগিয়ে দেন। ইউরোপের তখনকার মুদ্রণবিষয়ক সব পত্রিকায় তাঁর প্রশংসাসুলভ নিবন্ধ ছাপা হয়ে তাঁকে মুদ্রণজগতে আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী করে। সে এক আশ্চর্য সময় ছিল বটে।
এ চারজনের সবার মধ্যেই একাধিক প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখা গেছে। তবে বৈচিত্র্যময় বিবিধ প্রতিভার সমাহারে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরই উপেন্দ্রকিশোরের স্থান।
উপেন্দ্রকিশোরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয় ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। আর ওই স্কুলেও তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষত চিত্রকর মানে ছবি-আঁকিয়ে আর বাঁশি-বাজিয়ে বেহালা-বাজিয়ে হিসেবে। তিনি নাকি সারাদিন বাঁশি আর বেহালা নিয়েই থাকতেন। সবার ধারণা ছিল, এই ছেলে এন্ট্রান্স পাসই করতে পারবে না। কিন্তু তিনি ঠিকই এন্ট্রান্স পাস করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিলেন।
তখন হরিকিশোর আর শ্যামসুন্দর পরামর্শ করে উপেন্দ্রকিশোরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন মেট্রোপলিটন কলেজে। পরে এই কলেজেরই নাম বদলে হয়েছে বিদ্যাসাগর কলেজ। ১৮৮৪ সালে এখান থেকেই উপেন্দ্রকিশোর বিএ পাস করেন।
পরের বছর, ১৮৮৫ সালে, বিয়ে করলেন উপেন্দ্রকিশোর। কনের নাম বিধুমুখী। বিয়ের পরে উঠলেন ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাসায়। তখন তিনি ছবি এঁকে আর ফটোগ্রাফি করে আয়-রোজগার করতেন। উপেন্দ্রকিশোর-বিধুমুখীর ছিল দুই ছেলে-তিন মেয়ে: সুখলতা, সুকুমার, পূণ্যলতা, সুবিনয় ও শান্তিলতা।
এই সুকুমারই আরেক কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়। আর তারই ছেলে সত্যজিত রায়- ফেলুদা আর শঙ্কুর স্রষ্টা। এই সত্যজিতই পরে দাদা উপেন্দ্রকিশোরের গল্প ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেন সিনেমা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।
মাঝে অনেকবার ঠিকানা বদলে উপেন্দ্রকিশোর শেষমেশ ওঠেন ২২ নম্বর সুফিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে। এখন এই সড়কটির নাম কৈলাস বোস স্ট্রিট। এই বাড়িটি কিন্তু বেশ বিখ্যাত। কারণ, এই বাড়ি থেকেই ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হতে শুরু করে। আর এই সন্দেশের হাত ধরেই তার তো বটেই, আসে তার পুত্র সুকুমার রায়ের হাতিমি, বকচ্ছপ, হাঁসজারুসহ যাবতীয় শিশুসাহিত্য। এমনকি সত্যজিতের প্রায় সব শিশুদের-কিশোরদের রচনাও এই সন্দেশেই প্রথম ছাপা হয়।
১৯১৪ সালে আবার বাড়ি বদলালেন উপেন্দ্রকিশোর, এবার উঠলেন ১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়িতে। এই বাড়িটা শুধু যে তার নিজস্ব বাড়ি ছিল তাই না, এই বাড়ির নকশাও তিনি নিজেই করেছিলেন। নিজের নকশা করা এই বাড়িটিতে উঠতে না-উঠতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কলকাতার বাঘা-বাঘা সব ডাক্তারদের দেখানো হলো, লাভ হলো না কিছুই।
তখন সবাই ভাবলো, হাওয়া বদলে দেখা যাক। তাকে পাঠানো হল গিরিডিতে। কিন্তু তাতে ফল হলো উল্টো, তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে আবার কলকাতায় নিয়ে আসা হল। লাভ হচ্ছে না দেখেও চিকিৎসকরা তাকে সুস্থ করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন প্রাণপণ।
শেষ পর্যন্ত সে লড়াইয়ে হেরে জেতে হলো দ্রুতই। পরের বছরেই, ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় মারা গেলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মারা গেলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের অবিস্মরণীয় অগ্রপথিক।
উপেন্দ্রকিশোর কিন্তু তার লেখক-জীবনের শুরুতে ঠিক ছোটদের জন্য লিখতেন না। প্রথম দিকে তিনি লিখেছিলেন অনেক কিছুই, কিন্তু ঠিক যেন নিজের মনের মতো লিখতে পারছিলেন না। জীব-জন্তু কীট-পতঙ্গ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন, এমনকি ‘সখা’ নামের পত্রিকায় একটা উপন্যাসও লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ওই যাকে বলে, নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত নিজেকে খুঁজে পেলেন, যখন ছোটদের জন্য লিখতে শুরু করলেন। তখন যতো শিশু-কিশোর পত্রিকা বের হতো, সবগুলোতেই লিখেছিলেন তিনি; লিখেছিলেন সখা, মুকুল, সন্দেশ-এ। লিখেছেন গল্প, নাটক, রূপকথা, উপকথা, বিজ্ঞান-প্রবন্ধ, ছড়া- স-অ-ব।
শুধু যে লিখতেন, তাই নয়, আঁকতেনও। স্কুলে থাকতেই তিনি আঁকিয়ে হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। পরে ছোটদের জন্য লেখার পাশাপাশি, সে সব লেখার জন্য ছবিও নিজেই আঁকতে শুরু করেন তিনি। তার প্রায় সব বইয়ের প্রচ্ছদ তো বটেই, ভেতরের ছবিগুলোও তিনি নিজেই এঁকেছিলেন।
তার বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ‘ছেলেদের রামায়ণ’ আর ‘টুনটুনির বই’। এই বই দুটি জীবদ্দশাতেই তাকে ভীষণ জনপ্রিয় করে তোলে। জীবদ্দশাতে ছোটদের জন্য তিনি ৬টি বই বের করেন। তার মৃত্যুর পরে তার অগ্রন্থিত রচনা নিয়ে আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়। পরে তো তার লেখা নিয়ে আরও অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জীবদ্দশায় প্রকাশিত গ্রন্থ
- ছেলেদের রামায়ণ (১৮৯৬)
- সেকালের কথা (১৯০৩)
- ছেলেদের মহাভারত (১৯০৮)
- মহাভারতের গল্প (১৯০৯)
- টুনটুনির বই (১৯১০)
- ছোট্ট রামায়ণ (১৯১১)
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পরপর প্রকাশিত গ্রন্থ
- আরও গল্প (১৯১৭)
- পুরাণের গল্প (১৯১৯
- উপেন্দ্রকিশোর একদিকে ছিলেন একনিষ্ঠ ধার্মিক ও অধ্যাত্মবাদী, অন্যদিকে তাঁর মন ছিল প্রবলভাবে অনুসন্ধিৎসু ও বিজ্ঞানমনস্ক। ভূমণ্ডল ও তার জীবজগৎ এবং মহাবিশ্বের যাবতীয় রহস্য বিষয়ে তাঁর ছিল অপার কৌতূহল এবং এসব বিষয়ে উত্তর খুঁজেছেন তিনি যুক্তি ও প্রমাণের ভেতরে, অধ্যাত্মবাদে নয়। শিশু ও কিশোরমনের উপযোগী করে যেমন তিনি পুরাণ ও উপকথা রচনা করেছেন তেমনি বিজ্ঞানের নানা তথ্য ও কাহিনিও পরিবেশন করেছেন একেবারে স্বতন্ত্র নিজস্ব এক ভাষায়। ভেবে অবাক হতে হয়, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রবল আধিপত্য ও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈকট্য সত্ত্বেও উপেন্দ্রকিশোরের লেখায় রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রভাবই নেই, তাঁর সৃজনজগৎ একেবারেই ভিন্ন মসলায় গড়া।
No comments:
Post a Comment