"রবীন্দ্রনাথের কাছে জ্ঞানের চেয়ে আনন্দের মূল্য বেশি ছিল। সেজন্য তিনি চেয়েছিলেন আমাদের দেশের কচি ছেলেগুলোকে অবাধ আনন্দের মধ্যে ছেড়ে দিতে। গানে ও আনন্দে রসিয়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার সিলেবাস । জ্ঞানের পাল্লা যদি কিছু কমতি হয় তাতে তিনি ভীত হতেন না, ভীত হতেন আনন্দের পাল্লা হালকা হয়ে গেলে। "
রবীন্দ্র স্নেহধন্য বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র, কবি ঔপন্যাসিক নাট্যকার সমালোচক ও প্রাবন্ধিক প্রমথনাথ বিশী। যিনি সর্বদা প্র.না.বি বলে খ্যাত বা স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই জুন নাটোর জেলার জোয়াড়ি গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নলিনীনাথ বিশী ও মাতা সরোজবাসিনী দেবী, স্ত্রী সুরুচি দেবী।
১৯১০ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে এক নাগাড়ে সতের বছর অধ্যয়ন করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক পাস করেন। মেধা, প্রখর বুদ্ধি, অধ্যয়ননিষ্ঠা, কবি-প্রতিভা ইত্যাদি গুণাবলির জন্য রবীন্দ্রনাথের স্নেহ লাভ করেন।১৯৩২ সালে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন। তারপর রিপন কলেজ। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ওই সময় তাঁর কবিতার বই দেওয়ালী প্রকাশ পায়। তিনি প্র-না-বি, ছাড়া বিষ্ণুশর্মা, স্কট টমসন , কমলাকান্ত শর্মা ছদ্মনামে লিখতেন।
১৯২৪ সালে শান্তিনিকেতনের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম উপন্যাস লিখেন "দেশের শত্রু"। এরপর পদ্মা (১৯৩৫), জোড়াদিঘীর চৌধুরী পরিবার (১৯৩৮), কেশবতী (১৯৪১), নীলমণির স্বর্গ (১৯৫৪), সিন্ধুদেশের প্রহরী (১৯৫৫) উপন্যাসগুলো রচনা করেন। তবে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস "কেরী সাহেবের মুন্সি" (১৯৫৮)। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৬০ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। তাাঁর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস "লাল কেল্লা" (১৯৬৩)। এছাড়া তিনি একজন ছোটগল্পকার ও নাট্যকারও ছিলেন। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও বটে।
প্রবন্ধ গুলি :
রবীন্দ্র কাব্য প্রবাহ ,মাইকেল মধুসূদন : জীবন ভাষ্য, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন , বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য, রবীন্দ্র কাব্য নির্ঝর, বাঙালির জীবন সন্ধ্যা, চিত্র -চরিত্র, রবীন্দ্র নাট্য প্রবাহ ,বাংলার লেখক, জহরলাল নেহেরু : ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, বিচিত্র উপল, বাংলা সাহিত্যের নর-নারী , রবীন্দ্র বিচিত্রা, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, নানারকম, বাংলার কবি, মহারাষ্ট্র ও রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সরণি, কমলাকান্তের জল্পনা, বঙ্কিম সরণি, বঙ্কিম সাহিত্য বিচার, গান্ধী জীবন ভাষ্য, শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র ও উত্তরকাল ,পুরনো সেই দিনের কথা প্রভৃতি।
আলোচনা :
রবীন্দ্র সান্নিধ্যলাভ ও রবীন্দ্র প্রতিভার সংস্পর্শে এসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই জগৎ ও জীবনের মায়া। যে মায়ার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন জাগতিক আনন্দ ও সৌন্দর্যের প্রতীক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য তিনি উল্লেখ করেছেন - মানবমুখিতা, এই মানবমুখী হইয়া মানব অন্তঃপুরে প্রবেশের অবিরত প্রয়াস ও প্রয়াসের সীমাবদ্ধতা এবং প্রকৃতি সম্প্রীতি। রবীন্দ্র কাব্যের আলোচনায় তিনি মূলত চারটি পর্বে বিন্যস্ত করেছেন - সন্ধ্যাসংগীত পর্ব, সোনারতরী পর্ব, খেয়া পর্ব ও বলাকা পর্ব। মূলত তিনি রবীন্দ্র প্রতিভা প্রথাগত মূল্যায়ন না করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আলোচনা সমালোচনা করেছেন। "মাইকেল মধুসূদন : জীবন ভাষ্য "গ্রন্থের ভূমিকায় মধুসূদন সম্পর্কে বলেছেন -" আমি মধুসূদনের সমগ্র সত্তার পরিচয় দিতে বসিয়়াছি, সেই সমগ্র তার মধ্যে ভালো-মন্দ ছোট-বড় সব মিশিয়া আছে। তাহার মধ্যে মাইকেল শব্দটাও অন্যতম।"
"প্রকৃত নায়ক কেহ থাকেন তবে তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।আর তাহার সঙ্গে আছে বিশ্ব প্রকৃতির যেরূপ শান্তিনিকেতনের মাঠে অবারিত। " "রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন "গ্রন্থে এমন করে মানুষটি কে আবিষ্কার করেছেন তিনি. বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কাব্য নির্ঝর ও নাট্য প্রবাহ সেই অর্থে উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ রবীন্দ্র আকরগ্রন্থ নামে পরিচিত। দেশ-বিদেশের নানা ঘটনা ও তথ্য সমন্বিত বেশ কয়েকটি রচনা তাঁর প্রাবন্ধিক প্রতিভার পরিচয় বহন করে। কমলাকান্তের জল্পনা গ্রন্থটি লঘু রসের প্রবন্ধ সংকলন হলেও ব্যক্তিজীবনের নানান রসময়তা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। প্রাবন্ধিক হিসেবে বিশেষ করে তিনি - সাহিত্যবোধ, মার্জিত রুচি, কল্পনাধর্মীতা, নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি ,রসবোধ ও ভাষা ব্যবহারের অসাধারণত্ব দেখিয়েছেন। এদিক থেকে তিনি মননশীল ও প্রাঞ্জ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী একজন সফল প্রাবন্ধিক। এছাড়া তিনি কবি ঔপন্যাসিক নাট্যকার ও বটে। পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে।তার উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত পত্রিকা শান্তিনিকেতন। তৎকালীন বহুল প্রচলিত দেশ-বিদেশের নানা পত্রিকায়় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। বিশেেষ করে ভারত বর্ষ প্রবাসী বিচিত্রা সবুজপত্র শনিবারের চিঠি আনন্দবাজার পত্রিকা দেশ বঙ্গদর্শন বঙ্গভারতী কথাসাহিত্য প্রভৃতি।
জীবনের যশ ও কৃতিত্ব রেখে অমর লোকে যাত্রা করলেন তিনি ১০মে, ১৯৮৫ সালে কলকাতায় । বাংলার সাহিত্যাকাশে নক্ষত্র পতন হলো।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment