নন্দলাল
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ –
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল, ‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?’
নন্দ বলিল, ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।’
নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তারে কেবা!
সকলে বলিল, ‘যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা’
নন্দ বলিল, ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, -কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারিদিক’
তখন সকলে বলিল- ‘হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক।’
নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির,
গালি দিয়া সবে গদ্যে, পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির;
পড়িল ধন্য দেশের জন্য নন্দ খাটিয়া খুন;
লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ;
খাইতে ধরিল লুচি ও ছোকা ও সন্দেশ থাল থাল,
তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।’
নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;
সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;
নন্দ বলিল, ‘আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,
কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?
বলো কি’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা।’
তখন সকলে বলিল – ‘বাহবা বাহবা বাহবা বাহা!’
নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়;
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল- ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’
ধনধান্য পুষ্পভরা
ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি তিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা!
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে!
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে, ওঠে পাখির ডাকে জেগে,
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়;
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
–ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।"
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
জন্ম ১৯; জুলাই ,১৮৬৩ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে।তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (১৮২০-৮৫) ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। সে বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত।কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। তাঁর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যস্রষ্টা।
১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন।এরপর কিছুদিন ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারিতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind। এই বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কর্মে নিযুক্ত হন দ্বিজেন্দ্রলাল। কিন্তু তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে তাকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয় সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজ দ্বারা।
ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আন্দুলিয়া নিবাসী প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন ১৮৮৭ সালে। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারি চাকরি হতে অবসর নেন।
তাঁর দুই অগ্রজই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল। এরকম একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্ণিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল।তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। পাঠান-মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে দেশের ভারতীয় মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বার বার তাঁর নাটকগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে।
স্ত্রীর চেয়ে কুমির ভাল বলেন সর্বশাস্ত্রী, ধরলে কুমির ছাড়ে বরং, ধরলে ছাড়ে না স্ত্রী।’ এই কথা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের(Dwijendralal roy) নিজের। বাস্তবেও এমনটাই হয়েছিল। স্ত্রীয়ের ভালোবাসায় তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছিল প্রচুর রোম্যান্টিক গান(romantic)। মৃত্যু পাগল করে দিয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে। তবে বানিয়েছিল নতুন দ্বিজেন্দ্রলালকে। নাট্যকার রূপে মহাপ্রকাশ ঘটে।
স্ত্রীয়ের নাম ছিল সুরবালা (surabala)। তাঁর প্রেমেই একের পর এক প্রেমের গান বেরিয়েছিল হাত থেকে। সন্তানসম্ভবা ছিলেন সুরবালা। সেই অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রাণ কাড়ে তাঁর। এই ঘটনা পাগল করে দেয় দ্বিজেন্দ্রলালকে। বহু সন্তান, তবু বেঁচেছিল মাত্র দু’জন। ছেলে দিলীপকুমার(dilip kumar) ও মেয়ে মায়া। তাঁদের আগলে ধরে। কিন্তু তাও মন মানছিল না। কালাপানি পেরিয়ে যখন কৃষিবিজ্ঞান পড়তে গিয়েছিলেন সেখানে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। অনেক দূর গড়িয়েছিল সম্পর্ক। বিয়ে হতে হতে হয়নি। সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিলেন সুরবালা। তার মৃত্যুতে জীবনের সুর কাটে দ্বিজেন্দ্রলালের।
পানাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। হঠাৎ এল পরিবর্তন। নাটক লিখতে শুরু করলেন। নাটক মূলত ইতিহাসাশ্রিত, স্বদেশি চেতনায় ভরপুর। প্রতিবাদের , আন্দোলনের। ১৯০৫ সালে শুরু ‘প্রতাপ’ দিয়ে। নাটকে যোগ হতে থাকে স্বদেশি গান। লিখলেন ‘মেবার পাহাড়’। শুনে মুগ্ধ হলেন জগদীশচন্দ্র বসু। ধীরে ধীরে ‘কীসের দুঃখ কীসের দৈন্য কীসের লজ্জা কীসের ক্লেশ’ এর মত গান। শোনা যায় এই গান তাঁকেই উত্তেজিত করে দিত। বলতেন ‘ও গানটা গায়িতে গেলে আমার কেন জানি না, ভয়ানক মাথা গরম হয়ে উঠে।’ শোনা যায় নাকি ওই গান গাইতে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপে বহু বার অসুস্থও হয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের উল্লেখযোগ্য নাটক একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয়।
সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায় ‘FRAS’ এবং ‘MRAC’ ও ‘MRAS’ ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডেই প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। নাম লিরিক্স অফ ইন্ড। এরপর দেশে ফিরে সরকারি কাজে নিযুক্ত হন। সঙ্গে চলতে থাকে সাহিত্য চর্চা। তারপরে যা হয়েছে তা ইতিহাস।
গ্রন্থতালিকা
কাব্যগ্রন্থ
আর্যগাথা, ১ম খণ্ড (১৮৮৪)
The Lyrics of India (ইং থাকাকালীন রচিত) (১৮৮৬ )
আর্যগাথা, ২য় খণ্ড (১৮৮৪)
আষাঢ়ে (১৮৯৯)
হাসির গান (১৯০০)
মন্দ্র (১৯০২)
আলেখ্য (১৯০৭)
ত্রিবেণী (১৯১২)
উল্লেখযোগ্য নাটক-
(১) প্রহসন বা লঘু রসাশ্রয়ি নাটক- সম্পাদনা
একঘরে (১৮৮৯)
কল্কি অবতার (১৮৯৫)
বিরহ (১৮৯৭)
এ্যহস্পর্শ বা সুখী পরিবার (১৯০১)
প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২)
পুনর্জন্ম (১৯১১)
আনন্দ-বিদায় (১৯১২)
(২) ইতিহাসাশ্রয়ী নাটক-
তারাবাঈ (১৯০৩)(প্রথম ঐতিহাহাসিক নাটক)
রানা প্রতাপসিংহ (১৯০৫)
দুর্গাদাস (১৯০৬)
সোরার রুস্তম (১৯০৮)
নূরজাহান (১৯০৮)
মেবার পতন (১৯০৮)
সাজাহান (১৯০৯)(সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক)
চন্দ্রগুপ্ত (১৯১২)
সিংহল বিজয় (১৯১৫)
(৩) পৌরাণিক নাটক-
পাষাণী (১৯০০)(প্রথম পৌরাণিক নাটক)
সীতা (১৯০৮)(শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটক)
ভীষ্ম (১৯১৪)
(৪) সামাজিক নাটক
পরপারে (১৯১২)
বঙ্গনারী (১৯১৬)
দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ৫০০। দ্বিজেন্দ্রলালের গানের দুটি ভিন্ন ধারা বিদ্যমান - একটি ধারা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুসারী, অপর ধারাটিতে তিনি ইউরোপীয় ধ্রুপদি সঙ্গীতের "মুভমেন্টস" ব্যবহার করেছেন।[২] ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদ ও খেয়াল শাখা দুটি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল; কিন্তু ঠুংরি গানের রীতি তিনি গ্রহণ করেননি ; বাউল, ভাটিয়ালি ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের ধারাতেও তিনি গান রচনা করেননি। তবে তার কয়েকটি কীর্তনাঙ্গ গান রয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রলালের পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় যত্ন সহকারে গান শিখেছিলেন ; তার কণ্ঠ ছিল সুমধুর।কার্তিকেয়চন্দ্র নিজে ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট টপ-খেয়াল গায়ক। এই কারণে ছেলেবেলা থেকেই এক সাঙ্গীতিক পরিবেশে প্রতিপালিত হন দ্বিজেন্দ্রলাল; যা তার পরবর্তী সঙ্গীত জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন, "দ্বিজেন্দ্রলাল যে বার-তের বৎসর বয়সে গুণীসমাজে গায়ক হিসাবে আদৃত হতেন, সে বিষয়ে আমি সাক্ষ্য দিতে পারি।" এছাড়া ভাগলপুরের প্রসিদ্ধ টপ-খেয়াল গায়ক সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন তার বন্ধু ও আত্মীয়। তার কাছ থেকেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল।
দ্বিজেন্দ্রলাল তার কাব্যসঙ্গীতগুলিকে বিভিন্ন রাগের আদর্শে সুরারোপিত করেন। যেমন- "নীল আকাশের অসীম ছেয়ে" (দেশ), "প্রতিমা দিয়ে কি পূজিব তোমারে" (জয়জয়ন্তী), "তোমারেই ভালবেসেছি আমি" (দরবারি কানাড়া), "মলয় আসিয়া কয়ে গেছে কানে" (নটমল্লার) ইত্যাদি। আবার তার জনপ্রিয় স্বদেশী গানগুলিকেও তিনি বিভিন্ন রাগের ঠাটে নিবদ্ধ করেছিলেন। যেমন- "ধনধান্যপুষ্পভরা" (কেদারা), "যেদিন সুনীল জলধি হইতে" (ভূপ-কল্যাণ), "মেবার পাহাড় মেবার পাহাড়" (ইমনকল্যাণ) ইত্যাদি।[২] আবার হাসির গানগুলিতে তিনি ইংরেজি, স্কটিশ ইত্যাদি গানের সুর সংযোজিত করেন। রঙ্গব্যঙ্গ বা বিদ্রুপাত্মক হওয়ায় এই গানগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বাংলা সঙ্গীতের হাসির গানের সম্ভারে দ্বিজেন্দ্রলালের অবদানই সর্বাধিক।
দ্বিজেন্দ্রলাল নিজে ছিলেন সুগায়ক।[৪] প্রথম জীবন থেকেই বিভিন্ন সভাসমিতিতে তিনি স্বরচিত গান শোনাতেন পিতামহ কার্তিকেয়চন্দ্র ও পিতা দ্বিজেন্দ্রলালের ন্যায় পুত্র দিলীপকুমার রায়ও ছিলেন সুগায়ক ও সঙ্গীতস্রষ্টা। দ্বিজেন্দ্রলালের গান সাধারণত ভাবগম্ভীর; হাসির গান ছাড়া অন্য গানে তিনি কখনই চটুলতাকে আশ্রয় করেননি। বাংলা সঙ্গীতে সমবেত কণ্ঠে গীত বা সম্মেলক গান (কোরাস) প্রবর্তন করেন দ্বিজেন্দ্রলালই। এই ধারাটিই তাকে পরবর্তীকালে প্রভূত জনপ্রিয়তা দিয়েছিল।স্বদেশী আন্দোলনের সময় দ্বিজেন্দ্রলালের গান সমাজ মানসে বিশেষ উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল।
সুরের বৈচিত্র্যে অসাধারণ একটি গানের নমুনা এরকম, –
এসো এসো বঁধু বাঁধি বাহুডোরে, এসো বুকে ক’রে রাখি।
বুকে ধরে মোর আধ ঘুম ঘোরে সুখে ভোর হ’য়ে থাকি।
মুছে থাক চোখে এ নিখিল সব,
প্রাণে প্রাণে আজ করি অনুভব
মিলিত হৃদির মৃদু গীতিরব – আধ নিমীলিত আঁখি।
বহুক বাহিরে পবন বেগে,
করুক গর্জ্জন অশনি মেঘে,
রবি শশী তারা হ’য়ে যাক্ হারা, অাঁধারে ফেলুক ঢাকি।
আমি তোমার বঁধু, তুমি আমার বঁধু, এই শুধু নিয়ে থাকি,
বিশ্ব হ’তে সব লুপ্ত হ’য়ে যাক আর যা রহিল বাকি।
প্রেমের উচ্ছ্বাস, আবেগ কত প্রাণবন্ত হলে এমন অনুভূতি প্রকাশ করা যায় গানটি তার একটি উদাহরণ.
গানটির প্রচলিত সম্পূর্ণ পাঠটি উদ্ধৃত করছি –
আজি তোমার কাছে
ভাসিয়া যায় অন্তর আমার
আজি সহসা ঝরিল :
চোখে কেন বারিধার?
স্মৃতি-জোয়ারে দু’-কূল ছেয়ে,
দশ বরষ উজান বেয়ে
চলেছে প্রাণ তোমারই কাছে
মানে না বাধা আর।
আজি আমার কাছে
বর্তমান ভেঙে ও ভেসে যায়,
আজি আমার কাছে
অতীত হয় নূতন পুনরায়।
আজি আমার নয়ন পাশে,
এ কি অাঁধার ঘেরিয়া আসে,
আজি পাষাণ – ভার চাপিয়া ধরে
হৃদয়ে বারেবার।
গানটি রচনার উপলক্ষ মৃত পত্নী অথবা বিদেশিনী প্রেমিকার স্মৃতি এ-বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও গভীর এক অনুভূতি।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যে প্রথম যৌবনে সখ্য গড়ে ওঠার মূল কারণ ছিল একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধ। দু’জনেরই ছিল উচ্চকুলজাত আভিজাত্য। তা ছাড়া কবিতা, গান রচনা এবং নাট্যপ্রীতি উভয়কে কাছে টেনেছিল। দু’জনেই বিলেতে প্রবাস-জীবন কাটিয়েছেন, ইংরেজি ও আইরিশ গানে মেতেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর অনুরাগ। তাঁর আর্যগাথা, মন্দ্র, আষাঢ়ে— কাব্য ও হাসির গানের বড় সমর্থক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘বিরহ’ নাটক উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ‘পূর্ণিমা মিলন’, ‘খামখেয়ালি সভা’য় দ্বিজেন্দ্রলাল হাসির গানের বন্যা বইয়ে দিতেন। তাতে গলা মেলাতেন রবীন্দ্রনাথ আর অন্যতম সহায়ক ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন।
দিজেন্দ্রলাল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ
‘‘দ্বিজেন্দ্রলাল যখন বাংলার পাঠকসাধারণের নিকট পরিচিত ছিলেন না তখন হইতেই তাঁহার কবিত্বে আমি গভীর আনন্দ পাইয়াছি এবং তাঁহার প্রতিভার মহিমা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হই নাই। দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সত্য, অর্থাৎ আমি যে তাঁর গুণপক্ষপাতী, এইটেই আসল কথা এবং এইটেই মনে রাখিবার যোগ্য। আমার দুর্ভাগ্যক্রমে এখনকার অনেক পাঠক
রবীন্দ্রনাথ। —ফাইল চিত্র।দ্বিজেন্দ্রলালকে আমার প্রতিপক্ষশ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া কলহের অবতারণা করিয়াছেন। অথচ আমি স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারি এ কলহ আমার নহে এবং আমার হইতেই পারে না। পশ্চিম দেশের আঁধি হঠাৎ একটা উড়ো হাওয়ার কাঁধে চড়িয়া শয়ন বসন আসনের উপর এক পুরু ধুলা রাখিয়া চলিয়া যায়। আমাদের জীবনে অনেক সময়ে সেই ভুল-বোঝার আঁধি কোথা হইতে আসিয়া পড়ে তাহা বলিতেই পারি না। কিন্তু উপস্থিতমতো সেটা যত উৎপাতই হোক্ সেটা নিত্য নহে এবং বাঙালি পাঠকদের কাছে আমার নিবেদন এই যে, তাঁহারা এই ধুলা জমাইয়া রাখিবার চেষ্টা যেন না করেন, করিলেও কৃতকার্য হইতে পারিবেন না। কল্যাণীয় শ্রীমান দেবকুমার তাঁহার বন্ধুর জীবনীর ভূমিকায় আমাকে কয়েক ছত্র লিখিয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছেন। এই উপলক্ষে আমি কেবলমাত্র এই কথাটি জানাইতে চাই যে, সাময়িক পত্রে যে-সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয় তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব-সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি এবং আমার লেখায় বা আচরণে কখনো তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই। — আর যাহা-কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র, তাহার সম্পূর্ণ কারণ নির্ণয় করিতে আমি তো পারিই না, আর কেহ পারেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না।’’
১৯১৩ সালের ১৭ই মে তারিখে কলকাতায় দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনাবসান ঘটে।
========{========{========={=======
বনফুল তখন বিহারের সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলের ছাত্র। সেই সময়ে ‘বিকাশ’ নামে হাতে লেখা পত্রিকায় কবিতা লেখালিখি চলত। পরে ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছাপা হল। সকলেই খুশি। শুধু এক জন বাদে। স্কুলের হেডপণ্ডিত রামচন্দ্র ঝা।
পণ্ডিতমশাইয়ের ধারণা, সংস্কৃতে বলাই একশো পাওয়ার যোগ্য। পাচ্ছেন না ওই কবিতার কারণে। তাই নির্দেশ, ‘কবিতা লেখা চলবে না’। মহা ফাঁপরে পড়ল কিশোর বনফুল। উপায় বাতলালেন অগ্রজস্থানীয় সুধাংশুশেখর মজুমদার। সেই ছদ্মনাম নেওয়া ‘বনফুল’। কিন্তু ছদ্মনামে লিখেও শেষ রক্ষা হল না। ধরা পড়েই গেলেন পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে।
‘নির্দেশ অমান্য কেন?’ জানতে চাইলেন পণ্ডিতমশাই। বলাইয়ের জবাব, ‘না লিখে পারি না যে’! এ বার আর পণ্ডিতমশাই বাধা দিলেন না। তবে কয়েকটা ‘টাস্ক’ দিলেন, কিছু সংস্কৃত শ্লোক অনুবাদ করার। ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’-তে তা ছাপাও হল। কবিতা লিখেও অবশ্য ১৯১৮-য় বনফুল ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন প্রথম বিভাগেই, স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়ে।
জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে। বলাইচাঁদের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার শিয়ালখালায়। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার। মাতা মৃণালিনী দেবী।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯১৮) এবং হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২০) পাশ করেন। একই বছরে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। তবে তিনি যখন ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণিতে পড়েন, তখন বিহারের পাটনায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিহার থেকে আসা ছাত্র হিসেবে তিনি এ নব প্রতিষ্ঠিত কলেজে স্থানান্তরিত হন এবং সেখান থেকে এমবিবিএস (১৯২৮) পাস করেন।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে। পরে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার পদে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি ভাগলপুরের খলিফাবাগে নিজ উদ্যোগে The Secro-Bactro Clinic নামে একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতিমান ডাক্তার হিসেবে পরিচিত হন। তিনি ১৯৬৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।
ছোটবেলা থেকেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লক্ষ করা যায়। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে কবিতা রচনা করেন। সম্পাদনা করেন বিকাশ (১৯১৫) নামে হাতে-লেখা একটি সাহিত্যপত্রিকা। তাতে প্রকাশিত হতো প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, অনুবাদ প্রভৃতি। এ সময় থেকে তাঁর সাহিত্যবিষয়ক রচনা প্রকাশিত হয় ভারতী (১৮৭৭), প্রবাসী (১৯০১), কল্লোল (১৯২৩) প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রিকায়। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতার নিখুঁত ছন্দ এবং গল্পের বিষয় নির্বাচন ও ভাষার ওপর দক্ষতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় নিসর্গ চেতনা, প্রেম ও আত্ম-উপলব্ধি। কবিতার আঙ্গিক বিবেচনায় লক্ষ করা যায়, তিনি লিখেছেন দীর্ঘকবিতা, গদ্যপদ্যের মিশ্রণজাত কবিতা, সনেট, হাইকু প্রভৃতি। বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার সঙ্গে তাঁর কোনো সংযোগ ছিল না; তিনি ছন্দমিলের পুরানো ধাঁচেই কবিতা লিখেছেন। বনফুলের কবিতা (১৯৩৬), অঙ্গারপর্ণী (১৯৪০), চতুর্দশী (১৯৪০), আহবনীয় (১৯৪৩), করকমলেষু (১৯৪৯), বনফুলের ব্যঙ্গ কবিতা (১৯৫৮), নতুন বাঁকে (১৯৫৯) প্রভৃতি তাঁর কাব্য সংকলন।
সাহিত্যসাধনায় বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব কথাশিল্পে। নতুন ধারা ও বিচিত্র ধরণের কাহিনী নির্মাণে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উপন্যাস লিখেছেন একষট্টিটি, গল্প ছয়শত। তাঁর উপন্যাসের বিষয়- ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, চিকিৎসাবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, প্রেম প্রভৃতি। তাঁর উপন্যাসগুলিতে লক্ষ করা যায় মানব জীবনের নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ। যথার্থ শিল্পীর বেদনাবোধ তাঁর সৃজনী প্রতিভায় বিদ্যমান। তিনি বিপুল কৌতূহলী মনে ও সহমর্মিতায় মানব জীবনকে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস- তৃণখন্ড (১৯৩৫), জঙ্গম (তিন খন্ড, ১৯৪৩-১৯৪৫), অগ্নি (১৯৪৬), ডানা (তিনখন্ড, যথাক্রমে ১৯৪৮, ১৯৫০ ও ১৯৫৫), স্থাবর (১৯৫১), অগ্নীশ্বর (১৯৫৯), হাটেবাজারে (১৯৬১), ত্রিবর্ণ (১৯৬৩), ভুবনসোম (১৯৬৩), প্রচ্ছন্ন মহিমা (১৯৬৭), উদয় অস্ত (দুই খন্ড, ১৯৫৯ ও ১৯৭৪) প্রভৃতি। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের গঠনভঙ্গি স্বতন্ত্র এবং অভিনব। তিনি কাহিনী বর্ণনা করেন কখনও নাটকীয় সংলাপে, কখনও স্বগতোক্তিতে, কখনও কবিতায়। তিনি উপন্যাসের গঠনরীতি এবং কথন-কৌশলে যেসব পরীক্ষা করেন, তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি কিছু ইংরেজি উপন্যাস অনুবাদ করেন যা দেশজ পটভূমি ও চরিত্রের বিন্যাসে অলঙ্কৃত। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূবনসোম।
সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করা ছিল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের ব্রত। এক্ষেত্রে ডাক্তারি ছিল তাঁর অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এ সেবাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সাধারণ, নিরন্ন, অবহেলিত, শ্রমজীবী মানুষের জীবন অাঁকতে চেয়েছেন শিল্পে। তাঁর কাছে এর এক অসাধারণ মাধ্যম ছিল ছোটগল্প। ছোটগল্প রচনায় তিনি তুলনাহীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে মানবজীবনের বিচিত্ররূপের সমাবেশ ঘটেছে- যেমন গল্পের বিষয়বস্ত্ততে, তেমনি ব্যাপক সৃজনশীলতায়। তাঁর ছোটগল্পে মানবজীবনের নানা স্ববিরোধিতা, দুর্জ্ঞেয় রহস্য, আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। ছোটগল্প পরিকল্পনায় তাঁর মৌলিকতা, তীক্ষ্ম মননশীলতা ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের উপস্থাপন পাঠকের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। আবার এ ধারাতেই তাঁর গল্প জীবনের অভিজ্ঞতায় সরস, গভীর ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবনায় স্বাতন্ত্র্য। তাঁর গল্পের অন্য বিশেষত্ব ও অভিনবত্ব হচ্ছে স্বল্প অবয়ব। তাঁর অধিকাংশ গল্প এ সূত্রে বাঁধা বলে এগুলিকে বলা হয় অনুগল্প। বলা যেতে পারে ছোটগল্প রচনায় তাঁর প্রতিভা সম্যকরূপে বিকাশ লাভ করে। ছোটগল্প কত ছোট হতে পারে, খন্ডিত বা আকস্মিকতাজনিত অসমাপ্তির বোধ কীভাবে সৃষ্টি না হয় তার পরীক্ষা তাঁর গল্পগুলিতে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে গভীর চিন্তা ও জটিল অভিজ্ঞতার নিপুণ প্রকাশ তাঁর ছোটগল্পগুলিকে এক অসাধারণত্ব দান করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ-বনফুলের গল্প (১৯৩৬), বিন্দুবিসর্গ (১৯৪৪), অদৃশ্যলোকে (১৯৪৬), তন্বী (১৯৪৯), অনুগামিনী (১৯৫৮), দূরবীণ (১৯৬১), মণিহারী (১৯৬৩), বহুবর্ণ (১৯৭৬), বনফুলের নতুন গল্প (১৯৭৬) প্রভৃতি।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নাটক রচনাতেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রহসন, একাঙ্কিকা, চিত্রনাট্য, নাটিকা ছাড়াও তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনচরিত অবলম্বন করে নাটক রচনা করেন, যাতে পাওয়া যায় তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার অপর একটি ভিন্ন রূপের পরিচয়। উনিশ শতকের দুই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা তাঁর নাটক, শ্রীমধুসূদন (১৯৪০) ও বিদ্যাসাগর (১৯৪১)। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এ দুটি নাটকের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে এঁদের ব্যাপকভাবে ও যথার্থরূপে পরিচিত করিয়ে দেন। বাংলা সাহিত্যে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে বলা যেতে পারে এ ধারার নাটক রচনার পথিকৃৎ।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যোগদান ও সভাপতিত্ব করে যেসব অভিভাষণ প্রদান করেন, সেগুলি গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। উত্তর (১৯৫৩), মনন (১৯৬২), ভাষণ (১৯৭৮), দ্বিজেন্দ্রদর্পণ (১৯৮৭) প্রভৃতি তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। রবীন্দ্রস্মৃতি (১৯৬৮) ও মর্জিমহল (১৯৭৭) গ্রন্থ দুটি তাঁর ডায়েরি জাতীয় রচনা। তাঁর আত্মজীবনী পশ্চাৎপট প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি রচনা করেন শোকোচ্ছ্বাসমূলক উপন্যাস লী (১৯৭৮)। তিনি ছোটদের জন্য লেখেন দুটি বই মায়াকানন (১৯৭৭) ও রাজা (১৯৭৭)।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় আছে সুস্থ জীবনের আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবোধের চেতনা, অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে ধিক্কার। তাঁর রচনারীতি সুমিত ও সংক্ষিপ্ত, তাঁর দৃষ্টি নির্মোহ ও নিরাসক্ত; জীবনের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, তুচ্ছ ও বিরাট সবকিছুর মধ্য থেকে শিল্পের উপাদান সংগ্রহের ক্ষমতা তাঁর রচনাকে দিয়েছে বৈচিত্র্য এবং গভীরতা।
সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় লাভ করেন শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে; ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পান পদ্মভূষণ উপাধি (১৯৭৫)।
বনফুলের ‘মানুষের মন’ গল্পটি পড়ে ভারী খুশি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। চাইলেন, অনুজ লেখককে কিছু একটা উপহার দিতে। বনফুলের আবদার, উপহার হিসেবে গুরুদেবের গায়ে দেওয়া একটি পুরনো জামা। রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই দেবেন না। বনফুলও নাছোড়। শেষমেশ এক দিকে দামি পশম, অন্য দিকে রেশম দেওয়া একটি প্রকাণ্ড জোব্বা উপহার মিলল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মতান্তরও ঘটেছে। বনফুলের ‘তৃণখণ্ড’-য় কিছু কবিতা রয়েছে। সেগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত, ‘ডাক্তারের ক্লিনিকে ওরা ভান করা সৌখিন রোগী’। বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ নাটকের কিছু অংশও রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি। বদলানোর পরামর্শ দিলেও, বনফুল তা করেননি।
বনফুলের সাহিত্যে রাজনীতি দেখে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন বনফুলের ‘পলিটিক্স্’-এর দিকে ঝোঁক আছে কি না। ‘নেই’ শুনে কবির স্বগতোক্তি, ‘সাহিত্যিক পলিটিকস করলে পলিটিকসও হয় না, সাহিত্যও মার খায়। আমি পলিটিকস করতে গিয়ে ঘা খেয়েছি।’ রবীন্দ্রনাথ এ ভাবেই বনফুলের কাছে নিজের নানা কথা জানিয়েছেন, নিজস্ব ভঙ্গিতে। এই রবীন্দ্রনাথই আবার চিঠিতে ‘নির্মোক’ উপন্যাসের প্লট দেন বনফুলকে। যদিও এর মধ্যে আজিমগঞ্জের হাসপাতালে কিছু দিন থাকার অভিজ্ঞতারও মিশেল দিয়েছেন বনফুল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বনফুলের জাগতিক সম্পর্কের শেষ, ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। রেডিয়োয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে শোনা গেল ‘সমস্ত দেশের বুক ফাটা হাহাকার’, মহাকবির প্রয়াণ-সংবাদ। এই প্রয়াণ নাড়িয়ে দিল বনফুলকেও। কবির উদ্দেশে কবিতায় প্রশ্ন রাখলেন স্নেহধন্য বনফুল, ‘আবন্ধনলোকে তুমি লভিবে নির্বাণ?’
১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment