২০, জুলাই ১৮৯২ খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা সত্যচরণ সেনগুপ্তের কর্মস্থল রংপুরে তিনি শিক্ষালাভ করেন। সেখানে বিপ্লবী প্রফুল চাকী ছিলেন তাঁর সহপাঠী। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়ে শচীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয় বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে তিনি বিএ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি কটক মেডিক্যাল স্কুলে চিকিৎসাবিদ্যা ও ময়মনসিংহে কবিরাজি শেখেন।
কর্মজীবনের শুরুতে শচীন্দ্রনাথ কিছুদিন একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন; পরে সাংবাদিকতায় যান। তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু দৈনিক কৃষক ও ভারত পত্রিকায় সহসম্পাদকরূপে।
এছাড়া তিনি
সাপ্তাহিক হিতবাদী, বিজলী ( বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠিত), আত্মশক্তি প্রভৃতি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন।
শচীন্দ্রনাথ বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন নাটক রচনায়। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটকের মূল প্রতিপাদ্য দেশাত্মবোধ। সামাজিক নাটক রচনায়ও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বাণী তাঁর নাটকের অপর বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসনিষ্ঠায়, কাহিনীর দৃঢ় সংবদ্ধতায় ও শক্তিশালী সংলাপে শচীন্দ্রনাথের নাটক সমৃদ্ধ। তাঁর উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটকগুলি হলো: গৈরিক পতাকা (১৯৩০), দেশের দাবি (১৯৩৪), রাষ্ট্রবিপ্লব (১৯৪৪), সিরাজুদ্দৌলা (১৯৩৮), ধাত্রীপান্না (১৯৪৮), সবার উপরে মানুষ সত্য (১৯৫৭), আর্তনাদ ও জয়নাদ (১৯৬১)। তাঁর ঐতিহাসিক নাটক সিরাজদ্দৌলা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত রাষ্ট্রবিপ্লব নাটকটিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
রক্তকমল (১৯২৯), ঝড়ের রাতে (১৯৩১), নার্সিংহোম (১৯৩৩), স্বামী-স্ত্রী (১৯৩৭), তটিনীর বিচার (১৯৩৯), মাটির মায়া, কাঁটা ও কমল, প্রলয়, জননী প্রভৃতি তাঁর সামাজিক নাটক। এসব নাটকে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের বিচিত্র জটিলতা ও সমস্যা বিধৃত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর রচিত কিশোরদের নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও অনুবাদ গ্রন্থ আছে। বেসরকারি সাংস্কৃতিক দলের নেতা হিসেবে তিনি রাশিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, চীন, সিংহল প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
তিনি তাঁর নাটকে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের বিচিত্র জটিলতা ও সমস্যা তুলে ধরেছন। তাছাড়াও তিনি কিশোরদের জন্য নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহি্নি ও অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেছেন। শচীন্দ্রনাথের নাট্যকৃতিত্বের মধ্যে আমরা বিষয়বস্তুর নানা স্তর দেখতে পাই। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক রচনা করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং নানা আলোচনা উপদেশ, গঠনমূলক কাজ ও নাট্যকার ও নাট্য প্রযোজকদের মধ্যে সংঘশক্তি উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে নাট্য আন্দোলনকে পরিপুষ্ট করে তোলেন। শেষ জীবনে তাঁর চিন্তাশীল তাত্ত্বিক দিকটা বড় হয়ে ওঠার জন্য সরস সৃষ্টির ধারা খানিকটা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমাজ ও রাজনীতির বহু অনাচার-অবিচার, বিপথগামীতা তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর সমাধানের পথ পান নি। সবরকম জটিলতা ও বিভিন্নতার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন প্রীতির পথ ও মৈত্রীর পথ।
১৯৬১ সালের ৫ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।
======={===={{{{===={{{{=={{=={{{{{{{=={=
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল।
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান-
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে-
দিল-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-
অন্তর হোক রত্ন-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষান দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।
কিশোর মোরা ঊষার আলো, আমরা হাওয়া দুরন্ত
মনটি চির বাঁধন হারা পাখির মত উরন্ত।
আমরা আসি এই জগতে ছড়িয়ে দিতে আনন্দ,
সজীবতায় ভরিয়ে দিতে এই ধরণীর আনন তো।
আমরা সরল কিশোর শিশু ফুলের মত পবিত্র,
অন্তরেতে গোপন মোদের শিল্প, গীতি, কবিত্ব।
জাগাই যদি, লাগাই তাদের এই দুনিয়ার হিতার্থ,
ভবিষ্যতের নবীন ধরা হবেই তবে কৃতার্থ।
যে বীজ আছে মনের মাঝে চায় যে তারা আহার্য,
ফসল লয়ে ফলবে সে বীজ একটু পেলে সাহায্য।
একান্ত যার ইচ্ছা আছে, দাম আছে তার কথার তো,
এই জগতে অবশ্য সে মানুষ হবে যথার্থ।
শোনরে কিশোর ভাইরা আমার, সত্য পথের শরণ নে,
হারিয়ে তোরা যাস নে যেন অমানুষের অরণ্যে।
সুনির্মল বসু
সারাজীবন তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন এবং শিশুদের মনন ও বিকাশে কাজ করেছেন। ছোটদের জন্য তার লেখা ছড়া-কবিতার বিষয়-আশয় ছিল বিচিত্র। শিশুর কল্পনা, স্বপ্ন, হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রূপ, স্বদেশপ্রেম, প্রকৃতি, ঋতু, ফুল-পাখি ও নদীর নানা বর্ণনার কথা তুলে এনেছেন তার লেখার মাধ্যমে। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। ১৯৫৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি শিশুদের প্রিয় লেখক সুনির্মল বসু না ফেরার দেশে পাড়ি দেন।
১৯০২ সালের ২০ই জুলাই বিহারের গিরিডি নামক স্থানে পিতার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের মালখানগর। পিতার নাম পশুপতি বসু। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন তার পিতামহ এবং বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিলেন তার মাতামহ। ছোটবেলা সাঁওতাল পরগণার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর মনে কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা জাগায়। রচিত প্রথম কবিতা 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রধানত সরস শিশু সাহিত্য রচনাকেই সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিতা রচনা ছাড়াও কিশোর বয়স থেকে চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন।
পিতার কর্মস্থল পাটনার গিরিডি স্কুল থেকে ১৯২০ সালে সুনির্মল বসু ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু ১৯২১ সালে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলেজ ত্যাগ করেন। এরপর অবনীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজে ভর্তি হন।
ছড়া, কবিতা, গল্প, কাহিনি, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি,রূপকথা, কৌতুকনাট্য প্রভৃতি শিশু ও কিশোরদের উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আর তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে ছিল ছন্দের চমৎকারিত্ব ও মিলপ্রয়োগের কুশলতা।
গ্রন্থতালিকা
হাওয়ার দোলা (১৯২৭)
ছানাবড়া
বেড়ে মজা
হৈ চৈ
হুলুস্থূল
কথাশেখা
পাততাড়ি, ছন্দের টুংটাং (১৯৩০)
আনন্দ নাড়ু
শহুরে মামা
কিপটে ঠাকুরদা (১৯৩৩)
টুনটুনির গান
গুজবের জন্ম
বীর শিকারী
লালন ফকিরের ভিটে
পাতাবাহার
ইন্তিবিন্তির আসর (১৯৫০)
পাহাড়ে জঙ্গলে
এছাড়া তিনি আত্মজীবনী লিখেছিলেন "জীবনখাতার কয়েক পাতা"। এটি লিখেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
পুরস্কার
১৯৫৬ সালে তিনি ভুবনেশ্বরী পদক লাভ করেন।
তিনি ১৯৫৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment