অমৃতা প্রীতম। " ১৯৬৩ সালে লিখেছিলাম 'জলের দাগ'। পরের বছর যখন তা দিনের আলো দেখল , জোর গুজব .. পঞ্জাব সরকার নাকি এই লেখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেবে। কিছুই তেমন হল না কিন্তু। বরং ১৯৬৫ তে হিন্দিতে অনুবাদ হল, ১৯৬৬ তে উর্দুতে। তখন মনে মনে ভাবনা চিন্তা করছি, ছায়াছবির সম্ভাবনা কতটা।কিন্তু কিছুই হল না, কারণ রেবতী শরণ শর্মা খুব স্পষ্ট আর অকপট উপদেশ দিয়েছিলেন, 'না! এই উপন্যাসিকা সময়ের চেয়ে এগিয়ে আছে অন্তত এক শতক। আমাদের মন , ভারতবাসীর মন এখনো সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়নি। 'বিংশ শতাব্দীর এই কবি ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তের উভয় দিকের মানুষেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন। ছয় দশকের দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কবিতা, কল্পকাহিনী, জীবনী, প্রবন্ধ, লোক সঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় দুইশোটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়।অমৃতা কউর ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৩১ আগষ্ট পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কর্তার সিং হিতকরি ব্রজ ভাষার একজন পণ্ডিত, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিখ ধর্মের একজন প্রচারক ছিলেন। অমৃতার বয়স যখন এগারো বছর বয়স, তখন তারা মাতার মৃত্যু হয়। এরপরেই তিনি ও তার পিতা লাহোর শহরে বসবাস শুরু করেন। মাতার মৃত্যুর পরে একাকীত্বের কারণে তিনি লিখতে শুরু করেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ অমৃত লেহরেঁ প্রকাশিত হয়। এই বছর তিনি প্রীতম সিং নামক একজন সম্পাদককে বিবাহ করেন ও স্বামীর নামে নিজের নাম পরিবর্তন করে অমৃতা প্রীতম রাখেন।
একজন রোমান্টিক কবি হিসেবে লেখা শুরু করলেও শীঘ্রই তিনি অঞ্জুমন তরক্কি পসন্দ মুসান্নাফিন-এ-হিন্দ নামক প্রগতিশীল লেখক সংঘে যোগ দেন, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তার লোক পীড় নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি রচিত হয়, যেখানে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পরে যুদ্ধ বিধ্স্ত অর্থনীতিকে সরাসরি সমালোচনা করা হয়। ভারতের স্বাধীনতার পরে তিনি লাহোর থেকে ভারতে চলে আসেন। স্বাধীনতার পরে দিল্লি শহরে গুরু রাধা কিষণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম জনতা গ্রন্থাগার নির্মাণে তিনি সহায়তা করেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এই সময় কবি সাহির লুধিয়ানভির সঙ্গে তার প্রণয় ঘটে,কিন্তু পরে কণ্ঠশিল্পী সুধা মালহোত্রার সঙ্গে সাহিরের প্রেম গড়ে উঠলে অমৃতা লেখক ইমরোজের সান্নিধ্যে জীবনের শেষ চল্লিশ বছর অতিবাহিত করেন।
তিনি অজ্জ আখাঁ ওয়ারিস শাহ নূ নামক একটি বিষাদধর্মী কবিতা রচনা করেন, যেখানে ভারতের বিভক্তির সময়কার বিপর্যয়ের প্রতি তার ক্ষোভ ও রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ঔপন্যাসিক হিসেবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হল পিঞ্জর নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাস, যেখানে তিনি পারো নামক একটি স্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টি করেন, যাকে তিনি নারীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার, মানবতা লঙ্ঘন এবং অস্তিত্ববাদের প্রতি সমর্পণের বিরুদ্ধে একটি মূর্ত প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে এই উপন্যাস থেকে পিঞ্জর নামক একটি হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার রচিত সুনেহে নামক দীর্ঘ কবিতার জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার কাগজ তে ক্যানভাস নামক উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার জয় করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পদ্মশ্রী, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মবিভূষণ ও সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপ লাভ করেন।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর, ছিয়াশি বছর বয়সে নতুন দিল্লি শহরে অমৃতার মৃত্যু ঘটে।
কবিতা পাঠ।
সূর্য’র বরং আজ অস্বস্তিতে ছিল
তারপর বন্ধ করেছে মেঘের জানালা
তারপর সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে নেমে গেছে।
আকাশের ভ্রূ-তে
ঘামের বিন্দু পুঁতির মতো ঝুলে আছে
তারার বোতাম খুলে দিয়েছে
তুলে নিয়েছে চাঁদের শার্ট।
আমি নগ্ন হয়ে এক কোনে বসেছিলাম
তোমার স্মৃতি আমার কাছে এলো
ভেজা কাঠের
ভারি ও তিতকুটে ধোঁয়ার মতো।
শত শত চিন্তা ভিড় জমালো
শুকনো কাঠের
আগুনের লাল দীর্ঘশ্বাসের মতো
আমি দুটো কাঠের তৃষ্ণা মেটাই।
পুরোনো যুগের কয়লা ছড়ানো চারদিক
কোনোটা তৃপ্ত করি। কোনোটা নয়
সময় যখন তাদের মুছে নিতে চায়
আঙ্গুলের ডগা পুড়ে যায়।
রান্না হাঁড়ি তোমার হাত থেকে পড়ে যায়
এবং ভেঙ্গে যায়
আমরা ইতিহাসকে ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছি
ক্ষুধার্ত থেকেই তিনি চলে গেছেন।
একটি গল্প
খাঁটি দুধের মতো আমার ভালোবাস,
বহু বছরের পুরোনো চালের মতো ভালোবাস
হৃদয়ের মাটির পাত্রে কচলানো এবং ধুয়ে রাখা।
পৃথিবী পুরাতন সিক্ত খড়ির মতো
সবকিছু ধোঁয়াতে অনুজ্জ্বল
রাতটা পেতলের পাত্রের মতো
চাঁদের রূপোর পোশাক ছেঁড়া ফাড়া
কল্পনা মলিন হয়ে এসেছে
স্বপ্ন পচা দুর্গন্ধময়
ঘুম হয়ে গেছে তিতকুটে।
জীবনের আঙ্গুলে
ঝামেলার আংটির মতো স্মৃতিগুলো চেপে ধরে আছে
যেন সময়ের স্বর্ণকারের হাত থেকে
স্বর্ণরেণু ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
ভালোবাসার শরীর সঙ্কুচিত হচ্ছে
সঙ্গীতের জামা আমি কেমন করে সেলাই করব?
আমার কল্পনার সুতোতে জট লেগে গেছে
আমার কলমের নিব ভেঙ্গে গেছে
আর সমস্ত গল্পটা হারিয়ে গেছে।
প্রতিশ্রুতি
যন্ত্রণার রেখা খোদাই করা
আমার করতল একটি প্রতিশ্রুতি দেয়,
বিশ্বাসের রেখা
বয়সের রেখাকে ছাপিয়ে যায়।
তোমার জানতে ইচ্ছে করে
আমার ভালোবাসা কতোদিন টিকে থাকবে
অভ্যাসবশত বক্তৃতার ভালোবাসার কথা শেখাবে না
কেমন করে শুনতে হয় এখনো তা যে শিখেনি।
শব্দের ঐশ্বর্য ছাড়াই ভালোবাসার সমৃদ্ধি ঘটে।
আমার শরীরের দয়ার উপর আমার নিঃশ্বাস
যে কোনো সময় তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে
কিন্তু সময়ের বক্ষদেশে
আমাদের ভালোবাসার লিখন
কখনো মোছা যাবে না।
হির তো লায়লার নকল কেউ নয়
কিংবা মজনুও নয় রানঝার মডেল
প্রেম তার কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করে না
প্রতিটি পৃষ্ঠাই তাজা এবং তুলনাহীন।
যন্ত্রণার তীর
আমার করতল ও আঙ্গুলের ডগায় বিদ্ধ হয়
কিন্তু জখম হওয়া আঙ্গুলে কোথাও না কোথাও
একটি আশা জীবনকে জাগিয়ে তুলছে।
(পাঞ্জাবের হির ও রানঝা কাহিনী লাইলি মজনুর সমান্তরাল মনে করা হয়)
সুন্দরী ও মেধাবী অমৃতার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত লেহরান’ (অমর ঢেউ) যখন প্রকাশিত হয় তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অমৃতা হিন্দি ও পাঞ্জাবি দু’ভাষাতেই লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস ২৪টি, কাব্যগ্রন্থ ২৩, গল্প সংকলন ১৫, তিনি ভারতের সর্বাধিক অনূদিত সাহিত্যিকদের একজন। জ্ঞানপীঠ, পদ্মবিভূষণ, আকাদেমিসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
আমার ঠিকানা
আজ আমি আমার বাড়ির নম্বর
মুছে ফেলেছি
আমার রাস্তার কপালের যে চিহ্ন দিয়ে
সনাক্ত করা হয় আমি মুছে ফেলেছি
আর আমি সব রাস্তার দিক নির্দেশক
তুলে ফেলেছি
তুমি যদি সত্যিই আমার সাথে
দেখা করতে চাও
তাহলে সব দেশের সব শহরের
সব রাস্তার সব দরোজায় টোকা দিও
যেখানে স্বাধীন আত্মার এক ঝলক
দেখতে পাবে
সেটাই হবে আমার বাড়ি।
নেড়ে কুকুর
ব্যাপারটা অতীত থেকে আনা
যখন কোনো খেদ ছাড়াই
তুমি আর আমি ছাড়াছাড়ি করছিলাম
মাত্র একটা ব্যাপার তখন ঠিক বুঝতে পারিনি...
আমরা যখন পরস্পরের কাছ থেকে
বিদায় নিচ্ছিলাম
বাড়িটাও বেচে দিতে তৈরি
শূন্য পাত্র বাসন কোসন আঙিনায় ছড়িয়ে ছিল
সম্ভবত ওরা আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল
যেগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল
সম্ভবত আমাদের কাছ থেকে মুখ লুকোচ্ছিল।
দরজার ওপর একটি মলিন আঙ্গুরলতা
হয়তো আমাদের কিছু বলতে চেয়েছে সঙ্গোপনে
কিংবা মেজাজ খারাপ করেছে পানির নলের ওপর
এ ধরনের কোনো কিছু
আমার মনে আসেনি
কেবল একটা কিছু বারবার মনে পড়েছে
একটি নেড়ে কুকুর ঘ্রাণ পেয়ে
কেমন করে শূন্য কক্ষে ঢুকে পড়ল
তার পেছনে তালা পড়ল।
তিনদিন পর
যখন বাড়ি হাতবদল হলো
নগদ টাকার জন্য আমরা চাবি তুলে দিই
নতুন মালিকের কাছে আমাদের প্রত্যেকের তালার
তাকে দেখাই একটার পর একটা কক্ষ
একটি কক্ষের ঠিক মাঝখানে পাই
সেই কুকুরের গলিত শব...
একবারও তাকে ঘেউ ঘেউ করতে শুনিনি।
আমি কেবল তার দুর্গন্ধটা পেয়েছি
এবং এখনো হঠাৎ সেই দুর্গন্ধ শুঁকি
বিভিন্ন জিনিস থেকে গন্ধটা আমার কাছে উঠে আসে।
হস্তপাঠ
বিশ্বস্ততার রেখা
কেমন করে পাঠ করতে হয় কেউ জানে না
আমি জানি আমার হাতে
বিশ্বস্ততার একটি রেখা আছে
বিশ্বস্ততার রেখা।
আমি জানি না কেমন করে এর সংজ্ঞা দেব
কেমন করে বলব
এর সীমাবদ্ধতা কী
চিন্তা কতদূর স্বাধীন হবে, বেপথু হবে
এবং কোথায় বিপদ লুকিয়ে আছে।
অন্যের ঠোঁটের কতটা কাছাকাছি
কথাবার্তার আন্তরিকতার কতটুকু
বিশ্বস্ততার ধারণার সাথে যায়,
বিশ্বস্ততার রেখা।
কেমন করে একে গভীর করে
এবং শক্তিশালী
যখন কারো ওষ্ঠ থেকে
এত প্রতিশ্রুতি বেরোয়
যেন শব্দ তাকে মাপতে পারে।
আমি জানি বিশ্বস্ততার রেখা আছে
আমার হাতে
এটা অদৃশ্য হতে পারে
কিন্তু আমি রেখাটা দেখি
সবচেয়ে লম্বা ও সবচেয়ে গভীর রেখাটাই
আমার ছোট্ট হাতে ওপর।
আর এই হচ্ছে পাঁচ আঙুল
পাঁচটি অনুভূতি
পাঁচটি ঈশ্বর
সাক্ষ্য দেয়
বিশ্বস্ততার রেখার।
মিলন ও বিচ্ছেদ
সাদা পাথুর উপত্যাকার ওপর দিয়ে
আমাদের চোখ থেকে অশ্রুর ঝর্ণা বয়ে যায়
এই উপত্যকায় কোনো কিছু জন্ম নেয় না।
সকল প্রেমিক অভিশপ্ত
কোনো সৌন্দর্য বিজয়ী হয় না
সকল রাত সাক্ষী থাকে
অপেক্ষমান চোখ, তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই নাটকের অভিনেতা বদলায়
নতুন করে বলা নাটক মঞ্চে নিয়ে আসে।
গল্প কিন্তু একই
অতীতের ট্র্যাজিক কাহিনী।
এটা আমি জানি তবুও আমি চাই
অজীবন টিকে থাকুক তোমার প্রেম
ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাক কিছু ঐশ্বর্য
পাছে তোমার শব্দ হারিয়ে যায়।
কাউকে এমন সেবা দেওয়া হয়নি
এমন কারো সাথে দেখা হয়নি, মনে হয়
মিলন ও বিচ্ছেদ... দুটো একসাথে
অশ্রু আলিঙ্গন করে অশ্রুকে।
আজকে আমি আমার বাসার নাম্বার মুইছা ফেললাম,
আমি গলির মোড়ে যে রাস্তার নামটা লেখা ছিল, সেইটাও মুইছা ফেললাম।
কিন্তু যদি তুমি আমারে সত্যি সত্যি খুঁইজা পাইতে চাও
তাইলে নক কইরো
সব দেশের, সব শহরের
সব রাস্তার সব দরজায়।
এইটা একটা অভিশাপ, একটা আর্শীবাদও
আর যেইখানে তুমি দেখবা
ফ্রি স্পিরিটের একটা কণা
-জানবা, অইটা আমার ঘর।
তুমি আসলা না
বসন্ত জাইগা উঠলো আর ছড়ায়া দিলো তার হাত
ফুলগুলা বুনতে থাকলো অদের নরোম পাঁপড়িগুলা
রংয়ের উৎসবের লাইগা।
তুমি আসলা না।
বিকালগুলা দীর্ঘ হয়া উঠলো
লাল রং ছুঁইয়া গেলো আঙুরগুলারে
কাস্তেগুলা চুমা খাইলো গমের ক্ষেতে।
তুমি আসলা না।
মেঘগুলা জমতে লাগলো।
জমিন তার হাত খুইলা দিলো
ড্রিংক করার লাইগা আকাশের উদারতা।
তুমি আসলা না।
ঋতুগুলা পইরা নিলো অদের সৌন্দর্য্য।
রাত তার কপালে রাখলো
একটা চান্দের রাজমুকুট।
তুমি আসলা না।
তারাগুলা আবার কইলো আমারে
যে, আমার শরীরের ঘরে
সৌন্দর্য্যের একটা মোমবাতি এখনো জ্বলতেছে।
তুমি আসলা না।
সূর্যের সবগুলা রশ্মি সেজদা দেয়
সেই রশ্মি এখনো জাইগা আছে
রাতের মরণ ঘুমের ভিতরে।
তুমি আসলা না।