Monday, 30 August 2021

বিশেষ প্রতিবেদন। জন্মাষ্টমী তিথিতে। কৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী গীতা ও হিন্দুধর্ম । ৩০.০৮.২০২১. Vol -480 The blogger in literature e-magazine


কৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী গীতা ও হিন্দুধর্ম ।  



হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল গীতা। মহাভারতের যুদ্ধ শুরুর সময় অর্জুনকে গীতার বাণী শুনিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু অর্জুন প্রথম নন, তার আগেও গীতার জ্ঞান তিনি অন্য কাউকে দান করেছিলেন। কে তিনি?অর্জুন ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের মুখ থেকে গীতা শুনেছিলেন সঞ্জয় (তিনি যুদ্ধের ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন), হনুমান (তিনি অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে ছিলেন) ও ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরিক যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সব ঘটনা দেখেছিলেন -
  
 *** 
  • হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে যখন এই জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, তখন একাদশী তিথি ছিল।
  • দিনটি ছিল সম্ভবত রবিবার।
  • প্রায় ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এই জ্ঞান দিয়েছিলেন তিনি।
  • গীতায় কৃষ্ণ ৫৭৪, অর্জুন ৮৫, সঞ্জয় ৪০ ও ধৃতরাষ্ট্র ১টি শ্লোক বলেছিলেন।
কেউ মরে না, আর কেউ কাউকে মারে না, সকলেই নিমিত্ত মাত্র…সমস্ত প্রাণী জন্মের পূর্বে শরীর ছাড়া ছিল। মৃত্যু পর শরীর ছাড়াই থাকবে। এর মধ্যবর্তী পর্যায়ে এঁদের শরীর থাকে, তা হলে কেন এঁদের জন্য শোক করা হয়। -- কৃষ্ণ. 
            গীতা-কে গীতোপনিষদ বলা হয়। অর্থাৎ, গীতা উপনিষদ্‌ বা বৈদান্তিক সাহিত্যের অন্তর্গত। "উপনিষদ্‌" নামধারী ধর্মগ্রন্থগুলি শ্রুতিশাস্ত্রের অন্তর্গত হলেও, মহাভারত-এর অংশ বলে গীতা স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত।আবার উপনিষদের শিক্ষার সারবস্তু গীতা-য় সংকলিত হয়েছে বলে একে বলা হয় "উপনিষদ্‌সমূহের উপনিষদ্‌"।গীতা-কে মোক্ষশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়।
ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের রচনাকাল হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত যে কোন সময়ের মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। অধ্যাপক জিনিন ফাউলারের মতে এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী বলে মনে করলেও ] গীতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কাশীনাথ উপাধ্যায় মহাভারত, ব্রহ্ম সূত্র ও অন্যান্য গ্রন্থ পর্যালোচনা করে প্রমাণ যে, গীতা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল।

শ্রীমদ্ভগবত গীতায় এমনই উক্তি করেছেন বাসুদেব কৃষ্ণ। হিন্দু ধর্মের একমাত্র গ্রন্থ বেদ। ঋগ, যজু, সাম ও অথর্ব— এই চারটি বেদ রয়েছে। বেদের সারমর্মকে বেদান্ত বা উপনিষদ বলা হয়। উপনিষদের সার রয়েছে গীতার মধ্যে। গীতা সম্পর্কে একাধিক চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে—


১. কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। এটি শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুন সংবাদ নামে বিখ্যাত।
২. গীতা কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন। কিন্তু কৃষ্ণের মাধ্যমে বিশ্বকে গীতার জ্ঞান দিয়েছিলেন পরমেশ্বর। কৃষ্ণ সে সময় যোগারূঢ় ছিলেন।

৩. গীতার চতুর্থ অধ্যায় কৃষ্ণ জানান, পূর্বে এই যোগ তিনি বিবস্বানকে জানিয়েছিলেন। বিবস্বান মনুকে জানান। মনু ইক্ষ্বাকুকে বলেন। এ ভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরম্পরাগত ভাবে এই জ্ঞান অর্জন করে আসছেন রাজর্ষিরা। কিন্তু কালান্তরে এই যোগ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সেই পুরনো যোগই অর্জুনকে পুনরায় জানাচ্ছেন। পরম্পরাগত ভাবে সবার আগে বিবস্বান (সূর্য) এই জ্ঞান পেয়েছিলেন। তাঁর পুত্র ছিলেন বৈবস্বত মনু।

৪. কৃষ্ণের গুরু ছিলেন ঘোর অঙ্গিরস। ঘোর অঙ্গিরস কৃষ্ণকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সেই একই উপদেশ অর্জুনকে দেন কৃষ্ণ। ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণ ঘোর অঙ্গিরসের শিষ্য ছিলেন। তার কাছ থেকে কৃষ্ণ এমন জ্ঞান অর্জন করেন, যার পর অন্য কিছু জ্ঞাতব্য থাকে না। দ্বাপর যুগে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দিলেও, এর প্রাসঙ্গিকতা এখনও বর্তমান।

৫. গীতায় ভক্তি, জ্ঞান ও কর্মের পথের আলোচনা করা হয়েছে। তাত যম-নিয়ম ও ধর্ম-কর্মের বিষয় জানানো রয়েছে। গীতা মতে ব্রহ্ম (ঈশ্বর) একটি। বার বার গীতা পড়লে এর জ্ঞানের রহস্য উন্মোচিত হবে। গীতার মাধ্যমে সৃষ্টি উৎপত্তি, জীব বিকাসক্রম, হিন্দু সন্দেবাহক ক্রম, মানব উৎপত্তি, যোগ, ধর্ম, কর্ম, ঈশ্বর, ভগবান, দেবী, দেবতা, উপাসনা, প্রার্থনা, যম, নিয়ম, রাজনীতি, যুদ্ধ, মোক্ষ, অন্তরিক্ষ, আকাশ, পৃথিবী, সংস্কার, বংশ, কুল, নীতি, অর্থ, পূর্বজন্ম, জীবনযাপন, রাষ্ট্র নির্মাণ, আত্মা, কর্মসিদ্ধান্ত, ত্রিগুণ সংকল্পনা, সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে মৈত্রী ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়।


৬. গীতা যোগশ্বর কৃষ্ণের বাণী। এর প্রতিটি শ্লোকে জ্ঞানের প্রকাশ রয়েছে। যা প্রস্ফুটিত হলেই অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়। জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম যোগ মার্গের বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এখানে। এই পথে চললে ব্যক্তি নিশ্চিত ভাবেই পরমপদের অধিকারী হতে পারবে।

৭. ৩১১২ খ্রীষ্টপূর্বে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। কলিযুগ শুরু হয়েছিল শক সম্বৎ ৩১৭৭ বছর আগের চৈত্র শুক্লের প্রতিপদায়। আর্যভট্টের মতে, ৩১৩৭ খ্রীষ্টপূর্বে মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধের ৩৫ বছর পর দেহত্যাগ করেন কৃষ্ণ। তখন থেকেই কলিযুগের সূচনা মনে করা হয়। মৃত্যুকালে কৃষ্ণের বয়স ছিল ১১৯ বছর। আর্যভট্টের গণনা অনুযায়ী ৫১৫৪ বছর আগে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দিয়েছিলেন কৃষ্ণ।

৮. হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে যখন এই জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, তখন একাদশী তিথি ছিল। দিনটি ছিল সম্ভবত রবিবার। প্রায় ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এই জ্ঞান দিয়েছিলেন তিনি। গীতায় কৃষ্ণ ৫৭৪, অর্জুন ৮৫, সঞ্জয় ৪০ ও ধৃতরাষ্ট্র ১টি শ্লোক বলেছিলেন।

৯. উপনিষদে গীতার গণনা করা হয়। তাই একে গীতোপনিষদও বলা হয়। এটি মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের অংশ। মহাভারতের কিছু স্থানে হরিগীতা নামে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।


১০. অর্জুন যখন কর্তব্য বিমুখ হয়ে সন্যাসী ও বৈরাগীর মতো আচরণ করে যুদ্ধ ত্যাগ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন, তখন তাঁকে গীতার জ্ঞান দেন কৃষ্ণ। অর্জুন ছাড়া সঞ্জয় গীতার জ্ঞান শোনেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে শোনান।
১১. গীতা এমন একটি গ্রন্থ, যার অনুবাদ, ব্যাখ্যা, টিপ্পণী, গবেষণাপত্র নানান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আদি শঙ্করাচার্য, রামানুজ, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, নিম্বার্ক, ভাস্কর, বল্লভ, শ্রীধর স্বামী, আনন্দ গিরি, মধুসূদন সরস্বতি, সন্ত জ্ঞানেশ্বর, বালগঙ্গাধর তিলক, পরমহংস যোগানন্দ, মহাত্মা গান্ধী, মহর্ষি অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তি গীতার ওপর প্রবচন দিয়েছেন।

কে বা কারা, কখন মহাভারত থেকে গীতাকে পৃথক করে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রুপে প্রকাশিত করেছে, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না।


====={{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}====



No comments: