Saturday, 28 August 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে (Johann Wolfgang von Goethe) ২৮.০৮.২০২১. Vol - 478/1. The blogger in literature e-magazine.


  ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে। (Johann Wolfgang von Goethe,)


গ্যোটের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় -প্রেম. প্রেমিকা তার চেয়ে বয়সে বেশ বড়। নাম আনা ক্যাথারিনা শোনোকোপফ।গ্যোটে তার প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু খেতে লাগলেন। এ যেন কাব্যের মোক্ষম উপাদান! শত শত কবিতা আর চিঠি লিখতে থাকলেন আনা ক্যাথারিনাকে নিয়ে। ধীরে ধীরে সেই প্রেমকাহিনী এক মহাকাব্যে পরিণত হলো। গ্যোটের অমর সৃষ্টি 'ফাউস্ট' কাব্যগ্রন্থটির প্রধান উপজীব্য তাদের এই প্রেমকাহিনী। কিন্তু ফাউস্ট প্রকাশের পর বেশি দিন আর তাদের প্রেম টিকলো না। বিয়ের আলোচনা তো কখনো আসেইনি। গ্যোটে নতুন নতুন প্রেমিকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করতে লাগলেন। সেই সাথে সাহিত্য তো আবিষ্কার হচ্ছেই!

গ্যোটের জীবনের বহু প্রেমের মাঝে একটি প্রেম অবশেষে বিশেষ হয়ে উঠলো। ক্রিস্টিনা ভলপিয়াস নামের এক নারীর সাথে তার দীর্ঘদিনের প্রেম ছিল। তার সাথে বিয়ে হলো। সংসারও টিকে ছিল তার সাথে। কিন্তু যখন বিয়ে হলো, তখন তাদের প্রথম সন্তানের বয়স ১৭ বছর। আর প্রেমের বয়স ২০ বছর। গ্যোটের বয়স ৫৭ বছর। গ্যোটে মোট ৫ সন্তানের জনক হয়েছিলেন। কিন্তু সকল সন্তানই তার জীবদ্দশায় মারা যান, স্ত্রী-ও তার জীবদ্দশায় মারা যান।


গ্যেটের জন্ম জামনির ফ্রাঙ্কফুট শহরে। তারিখটি ছিল ১৭৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট। গ্যেটের প্রপিতামহ ছিলেন কামার, পিতামহ দজি। পিতামহ চেয়েছিলেন সম্ভ্রান্ত নাগরিক হিসেবে ছেলেকে গড়ে তুলতে। গ্যেটের পিতা যোহান ক্যাসপর পড়াশেুসা শেষ করে উচ্চপদস্থ কমচারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। যোহান ছিলেন যেমন শৃঙ্খলাপরায়ণ তেমনি সুপণ্ডিত। অন্যদিকে গ্যেটের মা ছিলেন সহজ সরল উদার হদয়ের মানুষ। গ্যেটেন পিতা এবং মাতা দুজনেরই ছিল ব্যাপক প্রভাব। গ্যেটে লিখেছেন, আমার জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল পিতার কাছ থেকে মায়ের কাছে পেয়েছিলাম সৃষ্টির প্রেরণা।

ছেলেবেলা থেকেই গ্যেটে ছিলেন এক ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। পিতা যোহান ক্যাসপার চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর মতই একজন উচ্চপদস্থ রাজকমচারী হবে। চার বছর বয়সে গ্যেটেকে স্কুলে ভতি করে দেওয়া হল। কিন্তু স্কুলের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে অল্পদিনেই গ্যেটের প্রাণ হাঁপিয়ে উঠল। মাস্টারদের শাসন, অন্য ছেলেদের দুষ্টামি, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার বেড়াজালে কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেন না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়ে পিতা তাঁকে বাড়িতে এনে গৃহশিক্ষক রেখে পড়াবার ব্যবস্থা করলেন। একদিকে চলতে লাগল ল্যাটিন, গ্রীক, ইটালিয়ান, ইংরাজি ভাষা শিক্ষা, অন্যদিকে ছবি আকাঁ, গান শেখা। এরই মধ্যে শৈশব কালেরই গ্যেটের মনে গড়ে উঠেছিল এক ভিন্ন জগৎ। যা প্রচলিত জীবন পথ তেকে স্বতন্ত্র, ছ বছর বয়সে ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন গ্যেটে। দুচোখ ভরে দেখতেন প্রকৃতির অপরুপ শোভো। মানুষজন বাড়িঘর জীবনের নানা রুপ। যা কিছু একবার দেখেতেন জীবনের স্মৃতিপটে তা অক্ষয় হয়ে থাকত। কৈশোরের এই অভিজ্ঞতা পরবতীকালে তাঁর নানান রচনায় মূর্ হয়ে উঠেছে। কৈশোরেই শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্য জীবনের হাতেখড়ি। তিনি নিজের সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘‘যখন আমার দশ বছর বয়স তখন আমি কবিতা লিখতে শুরু করি যদিও জানতাম না সেই লেখা ভাল কিম্বা মন্দ। কিন্তু উপলব্ধি করতে পারতাম অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করবার ক্ষমতা আমার মধ্যে রয়েছে।” প্রকৃতপক্ষে জন্ম থেকেই তিনি কবি। কবিতা ছিল তাঁর সত্তায় আর সেই সত্তার সাথে মিশে ছিল তাঁর প্রেম। যে প্রেমের শুরু মাত্র পনেরো বছর বয়সে। শেষ প্রেম চুয়াত্তর বছর বয়সে।

ইয়োহান ক্যাস্পার আইন ব্যবসায় ব্যর্থ হলেও তার ইচ্ছা ছিল সন্তান গ্যোটে তার সেই অভাব পূরণ করবেন। বড় আইনজীবী হবেন। সেজন্য সন্তানকেও লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি করলেন। সেই সূত্রে গ্যোটের ফ্রাঙ্কফুর্ট জীবনের অবসান ঘটলো। তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরুর আগেই, অর্থাৎ ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকাকালীন সময়ে বাবার লাইব্রেরির বই পড়ে গ্যোটে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ছয়টি ভাষা; জার্মান, হিব্রু, ল্যাটিন, ইতালী, ফরাসি ও ইংরেজি রপ্ত করেন। শুধু তা-ই নয়, ছবি আঁকা, নৃত্য কৌশল, অসি চালনা ও কবিতার ব্যাকরণসহ নানা বিষয়ে এই অল্প বয়সেই তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ঠিক যেন সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই 'ইন হরফন মৌলা' বা সকল কাজের কাজি।

গ্যোটের আইন পড়তে ভালো লাগে না। ভালো লাগে সাহিত্য পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বাদ দিয়ে সাহিত্যের জগতে ডুবে থাকেন। বিষয়টি আর গোপন থাকলো না, শিক্ষকরাও টের পেয়ে গেলেন। শিক্ষকদের বারবার সতর্কতার মুখে গ্যোটের আইন পড়া চলছিল বটে, কিন্তু নিজে ডুবে গেলেন সাহিত্যের মহাসমুদ্রে। 


সাহিত্য সাধনা করতে গিয়ে তিনি সন্ধান পেলেন বিশিষ্ট সাহিত্য গবেষক ও ইতিহাসবেত্তা হেবেংকেলমানের। গ্যোটে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তার কাছ থেকে সাহিত্যের নানা দিক শিখতে লাগলেন। ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্য অধ্যয়ন করতে থাকলেন। এমন সময় জার্মানিতে বিখ্যাত একটি নাট্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলো, নাম 'লাওকোন'; লেখক গোটহোল্ড ইফ্রেইম লেসিং।

বইটি গ্যোটের হস্তগত হওয়ার পর নিমিষেই পড়ে ফেললেন। তিনি লেখকের প্রেমে পড়ে গেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক এই লেখককে খুঁজে বের করে তার সহচর্য নিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, গোটহোল্ড ইফ্রেইম লেসিং ড্রেসডেন শহরে বসবাস করেন।গ্যোটে লিপজিগ ছেড়ে ড্রেসডেনে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে প্রথমে এক মুচির ঘরে আশ্রয় নিয়ে শহরের আনাচে কানাচে শিল্প-সাহিত্য ও লেখকদের খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। গোটহোল্ড ইফ্রেইমের সাথেও সাক্ষাৎ ঘটে গেল। পাশাপাশি আরও অনেক সাহিত্যিকের সাথে সেখানে তিনি পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।

একপর্যায়ে গ্যোটে আবার লিপজিগে তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসলেন। তবে এখন তার মাথায় একটি শিল্পবোধ জন্ম নিয়েছে। তিনি চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, সবাই সুন্দর সুন্দর পোশাক পরেন, অথচ তার পোশাক অনেক মলিন। সাথে সাথে তিনি দর্জিখানায় গিয়ে একটি ফিটফাট পোশাক তৈরি করে নিলেন। তারপর থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে রুচিশীল ছেলে হিসেবে গণ্য হলেন।

আইনের ছাত্রের যখন কবি কবি ভাব, তখন তো কত প্রেমিকাই জুটে যাওয়ার কথা! কত প্রেমিকা যে গ্যোটের জীবনে এসেছে তার হিসেব খোদ তার জীবনীকাররাও সঠিকভাবে বের করতে পারেন     .

গ্যোটের আইনের পড়ালেখা সাফল্যের সাথে শেষ হলো। ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফলে তিনি লিপজিগ ত্যাগ করে ফের বাবা-মায়ের কাছে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে চলে গেলেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন উচ্চতর শিক্ষার জন্য। এখানে আরও বছর দেড়েক পড়ালেখা করলেন। এই ফাঁকে আইন ব্যবসার জন্য আদালতের অনুমতিও পেয়ে গেলেন। কিন্তু আইন ব্যবসা তার আর তেমন করা হয়নি। উল্টো এ সময়ে তিনি বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান নিয়ে পড়া বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলেন। তাদের সাথে চুপিচুপি ক্লাসও করতে থাকলেন।পরিস্থিতি দেখে গ্যোটের বাবা বুঝতে পারলেন, ছেলে এখানে থাকলে তাকে দিয়ে আর আইন ব্যবসা হবে না। তাই তিনি পরামর্শ দিলেন উইটর্জলার শহরে গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করতে। বাবার আদেশ বলে কথা। মানসিকভাবে রাজি না হলেও বাবার আদেশ মেনে উইটর্জলার শহরে গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করলেন গ্যোটে।

সেখানে এক বৃদ্ধের সাথে তার পরিচয় ঘটলো, নাম আমটমান বুফ। স্ত্রী মারা যাওয়ায় বৃদ্ধের দুঃখের জীবন চলে যাচ্ছে প্রায় এক ডজন ছেলেমেয়ে নিয়ে। এর মধ্যে বড় মেয়ের নাম চার্লট লোটে বফ। বৃদ্ধের কাছে আসা যাওয়ার ফাঁকে প্রেমিক পুরুষ গ্যোটের প্রেমে পড়ে গেলেন লোটে। কিন্তু এ এক জটিল প্রেম। কারণ, ইতিমধ্যেই লোটের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আরেক ছেলের সাথে। সেই ছেলেটির নাম কেশটন।গ্যোটের প্রেম শেষপর্যন্ত তাদের বিয়ে ঠেকাতে পারল না। প্রেমের মাস ছয়েক পরে সেই কেশটনের সাথেই লোটের বিয়ে হয়ে গেল। তবে আজীবন গ্যোটের সাথে যোগাযোগ ছিল তার। দেখা করতেন, একসাথে ঘুরতেন, চিঠি আদান-প্রদান করতেন। কেশটন বিষয়টিকে একভাবে মেনে নিয়েছিলেন আর কী! 

কিন্তু কথায় আছে, কবিদের প্রেমিকা আসলেও কবির ভালো, আবার চলে গেলেও কবির ভালো! কারণ উভয় অবস্থাতেই কবির কবিতা আসে। গ্যোটে তো একজন কবি। তাই প্রেমিকা লোটেকে মনের মতো করে না পেলেও তিনি তার লেখার উপাদান পেয়েছিলেন ঠিকই। সেই দুঃখবোধ নিয়ে ১৭৭৪ সালে রচনা করলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস 'দি সরও অফ ইয়াং ওয়ার্থার' বা 'যুবক ওয়ার্থারের কষ্ট'। 

এরপরও গ্যোটের জীবনে বহু প্রেম এসেছে, পাশাপাশি সাহিত্য সাধনাও অব্যাহত ছিল। তার সুখ্যাতি ইতিমধ্যেই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৭৭৪ সালের শেষের দিকে একটি ভিন্ন ঘটনা ঘটলো। তার কাছে উইম্বার রাজদরবারের এক প্রতিনিধি আসলো। সাথে দুই রাজকুমারও আছেন। তারা সবাই মিলে গ্যোটেকে তাদের রাজদরবারে নিমন্ত্রণ জানালো। দরবারে গেলে প্রথমে তাকে সাহিত্যিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। তারপর তার উপরে আসলো মন্ত্রিত্বের ভার। তিনি যথাক্রমে কৃষি, খনিজ সম্পদ, অর্থ ও সামরিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে ফের তিনি বিজ্ঞান চর্চায় মনোযোগী হন। ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়ে যায়। তবুও সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন তিনি।উপন্যাস লিখলেও গ্যেটে অনুভব করেছিলেন উপন্যাসে নয়, নাটকেই তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটা সম্ভব । একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুললেন নাটকের দল লিটলট থিয়েটার । এই দলের প্রয়োজনে কয়েকটি অসাধারণ নাটক রচনা করেছিলেন । প্রথম পর্বের নাটকে দেখা যায় তারুণ্য আর যৌবনের উদ্দামতা । তার Stella নাটকে দেখা যায় নায়ক তার স্ত্রীর সাথে বাস করে, অন্যদিকে তার প্রেমিকাকেও ভালবাসে । তিনজরেন মধ্যে গড়ে উঠেছে এক পারস্পারিক সম্পর্ক । এ পরোক্ষভাবে দুই পত্নী গ্রহণের মতবাদ । এর বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে । নিরুপায় হয়ে গ্যেটে নাটকের শেষ অঙ্কের পরিবর্তন ঘটালেন । নায়ক স্থির করতে পারে না কাকে বেছে নেবে স্ত্রী না প্রেমিকাকে? মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে ।

কিন্তু ক্রমশেই গ্যেটের মধ্যেকার এই বিদ্রোহ মনোভাব প্রশমিত হয়ে আসে । যৌবনের উদ্দমতায় যিনি বিদ্রোহী হয়ে সব কিছুকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, এখন হয়ে ওঠেন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক, যিনি সব কিছুর মধ্যে অন্বেষণ করেন সৌন্দরযের প্রজ্ঞার, তিনি জানতেন অভিজাদের বাইরের সৌন্দরযের মধ্যে প্রকৃত সৌন্দর্যকে খুঁজে পাওয়া যাবে না । একদল কয়লা খনির শ্রমিক, রুটি তৈরির কারিগরকে দেখে বলেছিলেন তথাকথিত এই নিচু সমাজের মানুষেরাই ঈশ্বরে চোখে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে সুন্দর ।

গ্যেটের জীবনের আরেকটি ঘটনা, কবি শীলারের সাথে পরিচয় । এই পরিচয় অল্পদিনের মধ্যেই গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হল । যদিও দু’জনে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের মানুষ । গ্যেটের বয়স তখন ৪৫, শীলারের ৩৫ । গ্যেটে  প্রাণবন্ত সজীব, শীলার অসুস্থ । ধর্মের প্রতি গ্যেটের কোন আগ্রহ ছিল না তিনি বিশ্বাস করতেন অন্তরের প্রকৃতির সৌন্দরযে । অন্যদিকে শীলার ছিলেন ধর্মভীরু, তিনি বিশ্বাস করতেন ন্যায়বিচার । গ্যেটে পেয়েছেন ভাগ্যের অকৃপণ সহায়তা, নারীর প্রেম কিন্তু শীলার পেয়েছেন শুধু দারিদ্র্য আর বঞ্চনা । এত বৈষম্য সত্ত্বেও দু’জনের বন্ধুত্ব ছিল অকৃত্রিম । এই বন্ধুত্ব দু’জনের সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহদণ করেছিল । শীলার Horen নামে একটি পত্রিকা সম্পাদন করতেন । গ্যেটে এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন । এই সময় তাঁদের লেখার একাধিক বিরূপ সমালোচনা হতে থাকে । দু’জনে সরস বুদ্ধিদীপ্ত কবিতায় তার জবাব দিতে থাকেন । ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে যৌথ উদ্যেগে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ  Musen Almanach ।

১৮০৫ সালে যখন শীলারের মৃত্যু হয়, গ্যেটে শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন । এক বন্ধুকে লিখেছিলেন আমার অর্ধেক অস্তিত্ব চলে গেল ।

মাত্র ৪৫ বছর বয়সে বন্ধু দেহরক্ষা করলেও ঈশ্বরের আশীর্বাদে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন গ্যেটে । ১৭৪৯-১৮৩২ প্রায় তিরাশি বছর এই সুদীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে তাঁকে প্রিয় বন্ধু, আদরের বোন, প্রিয়তমা স্ত্রী, একমাত্র সন্তান । এত বেদনার মধ্যেও তাঁর জীবনের অপ্রতিহত গতি কখনো রুদ্ধ হয়নি । তিনি তাঁর সমস্ত যন্ত্রণা বেদনাকে ব্যর্থতাকে রূপান্তর ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে । এমন বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভা মানব ইতিহাসে দুর্লভ । কি ছিলেন না তিনি? কবি, নাট্যকার, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক । তিনি প্রায় ৬০টি বই লিখেছেন – এর মধ্যে আছে গাথা, গীতকবিতার ব্যঙ্গনাটক, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, মজাদার কাহিনী, ভূত-দৈত্যাদানবের গল্প । তাঁর এই বহুব্যাপ্ত প্রতিভার নির্যাস দিয়ে সমস্ত জীবন ধরে সৃষ্টি করেছেন ফাউস্ট, যার প্রথম খণ্ড লিখতে লেগেছিল ত্রিশ বছর, দ্বিতীয় খণ্ড শেষ করতে লেগেছিল পঁচিশ বছর ।

বৃদ্ধ হয়েও যৌবনের মত তারুণ্যের দীপ্তিতে ভরপুর হয়ে থাকতেন গ্যেটে । শোনা যায় ভাইমারের যুদ্ধের পর যখন নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনী জার্মানি দখল করে, নেপোলিয়ন আদেশ দিয়েছিলেন গ্যেটের প্রতি সামান্যতম অমর্যাদা যেন না করা হয় । তিনি গ্যেটেকে আমন্ত্রণ করেছিলেন তাঁর প্রাসাদে ।

গ্যেটে যখন এলেন, নেপোলিয়ন বিস্ময়ভরা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, একটা মানুষ আপনি! বৃদ্ধ গ্যেটের ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন নেপোলিয়ন । তাঁর সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন । বহু বিষয়ে গ্যেটে নেপোলিয়নের মতের সাথে একমত হতে পারেননি । গ্যেটে স্পষ্টভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করেছিলেন । গ্যেটে যখন চলে যান, নেপোলিয়ন গভীর শ্রদ্ধায় আবার বলেছিলেন একটা মানুষ বটে । গ্যেটে সম্বন্ধে নেপোলিয়নের এই মন্তব্য যথার্থই সত্য । একজন পরিপূর্ণ মানুষ । জীবনের অন্তিম লগ্নে এসেও এই মানুষটি বিস্মৃত হননি তিনি মানুষ, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ জীব, যে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে উত্তরণ করে চলেছে অন্ধকার থেকে আলোকে ।

তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে চারটি উপন্যাস, মহাকাব্য ও গীতিকাব্য, গদ্য ও গদ্যকাব্য, নাটক, স্মৃতিকথা, একটি আত্মজীবনী, সাহিত্যিক ও নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচনা এবং উদ্ভিদবিদ্যা, শারীরবিদ্যা ও রং বিষয়ক রচনা। এর পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক খণ্ডরচনা, ১০ সহস্রাধিক চিঠি এবং প্রায় ৩ হাজার চিত্রকর্ম.

উল্লেখযোগ্য রচনাবলি :  

ফাউস্ট ,ডি লাইডেন ডেস ইউঙেন ভেরটার্স ,Wilhelm Meister's Apprenticeship,Elective Affinities,Prometheus,Zur Farbenlehre,Italienische Reise,West–östlicher Divan। Etc

দাম্পত্যসঙ্গী : ক্রিস্টিয়ানা ভাল্পিয়াস (বি. ১৮০৬; মৃ. ১৮১৬)


সন্তান :৫ (চারজন বাল্যকালে প্রয়াত)

অগাস্ট ফন গ্যোটে

জুলিয়াস অগাস্ট ভাল্টার (১৭৮৯–১৮৩০)

এমন শোকার্ত গ্যোটে ১৮৩২ সালের মার্চে হঠাৎ ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। এর কয়েকদিন পর, ২২ মার্চ, তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তার কফিন রাখা হয় উইম্বার রাজদরবারের সংরক্ষিত স্থানে। আজও তা জার্মানিতে সংরক্ষিত আছে।




============∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆=======


No comments: