প্রসঙ্গ : রাখী বন্ধন
ভাই-বোনের সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতেই রাখি উত্সব পালন করে থাকি আমরা। রাখির সুতোয় আরও গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয় ভাই-বোনের সম্পর্ক।
পুরাণে এই বিষয়ে একাধিক গল্প পাওয়া যায়। ইতিহাসেও রাখির বন্ধনের উল্লেখ আছে অনেকবার।
রাখিকে ভাই-বোনের উত্সব হিসেবে মনে করা হলেও ইতিহাসে কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে পুরুষকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতীক হিসেবে তার কবজিতে সুতো বেঁধে দিতেন মহিলারা। এটাই পরে রাখি বন্ধন উত্সবের চেহারা নেয়.
*** ইন্দ্রদেব ও শচীদেবী
পুরাণ বলছে একবার দেবতা ও রাক্ষসদের যুদ্ধে দেবতারা তখন প্রায় পরাজয়ের মুখে, দেবরাজ ইন্দ্র তখন তাঁর গুরু বৃহস্পতির সাহায্য চান। বৃহস্পতির পরামর্শ মতো শ্রাবণ পূর্ণিমায় ইন্দ্রের স্ত্রী সচী একটি মন্ত্রপূত রাখির ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দেন। তারপরই যুদ্ধে জয়লাভ করেন দেবতারা।
"""" যম ও ভগিনী যমুনা
যমের অমরত্বের প্রার্থনা করে তাঁর বোন যমুনা তাঁর হাতে একটি রাখি পরিয়ে দেন। এরপরই যমরাজ কথা দেন যে যাঁর হাতে তাঁর বোন হাতে রাখি পরিয়ে দেবেন, তাকে তিনি স্বয়ং রক্ষা করবেন।
**** কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী
মহাভারতেও রাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজসূয় যজ্ঞের সময় শিশুপালকে হত্যার পরে কৃষ্ণের একটি আঙুল কেটে রক্ত পরতে থাকে। দ্রৌপদী তখন নিজের শাড়ি ছিড়ে ক্ষতস্থানে বেঁধে দেন। এর পরিবর্তে কৃষ্ণ তাঁকে সবরকম বিপদে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
*** বালি ও লক্ষ্মীদেবী
আবার অনেকে বলে থাকেন শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিনে হতদরিদ্র নারীর বেশে বালির কাছে আশ্রয় চান লক্ষ্মী। বালি নিজের প্রাসাদের দরজা খুলে দেন তাঁর জন্য। খুশি হয়ে লক্ষ্মী, কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন বালির হাতে।
*** গণেশ ও সন্তোষীমা
কথিত আছে গণেশের দুই পুত্র, শুভ ও লাভ বায়না ধরেছিল নিজেদের বোনের হাতে তারা রাখি পরতে চায়। কিন্তু কোনও উপায় নেই। শেষে গণেশের দুই স্ত্রী, ঋদ্ধি ও সিদ্ধির অন্তর থেকে নির্গত অগ্নি সৃষ্টি করা হয় সন্তোষীকে। তার হাত থেকে রাখি বাঁধে গণেশ পুত্ররা।
*** আলেকজান্ডার ও পুরু
৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দার ও পুরুর যুদ্ধের পরেও রাখি বন্ধনের উদাহরণ পাওয়া যায়। তাঁর স্বামীর প্রাণ সংশয় হতে পারে, এই আশঙ্কা করে আলেকজান্দারের স্ত্রী পুরুর কাছে যান এবং তাঁর হাতে রাখি বেঁধে দেন। তার পরিবর্তে পুরু আলেকজান্দারের কোনও ক্ষতি করবেন না বলে কথা দেন।
**** হুমায়ুন ও কর্মাবতী
ইতিহাসের আরও এক বিখ্যাত রাখি বন্ধনের কথা মেলে রাজস্থানের মাটিতে। চিতৌরের রানি কর্মাবতী গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহের আক্রমণের আগাম খবর পেয়ে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়ে সাহায্যের অনুরোধ করেন। রাখি পেয়ে হুমায়ুন চিতৌরের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু তিনি পৌঁছতে একটু দেরি করে ফেলেন। হুমায়ুন চিতৌর পৌঁছনোর আগেই সম্মান বাঁচাতে জওহর প্রথা অনুযায়ী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন কর্মাবতী ও তাঁর সঙ্গীনীরা।
রবীন্দ্রনাথ ও রাখিবন্ধন
১৯০৫-এর ১৯ জুলাই। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করলেন। অবিভক্ত বাংলাকে শোষণ করা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ক্রমশ। তাই প্রশাসনিক কারণে ইংরেজ শাসকরা ঠিক করলেন, ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ভাগ করা হবে বাংলাকে। হিন্দু জনসংখ্যার আধিক্যযুক্ত অঞ্চল আলাদা করা হবে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলা থেকে। বাংলার মুসলিমদের এমন মগজ ধোলাই ততক্ষণে হয়ে গেছে, তাঁরা প্রায় খুশি মনেই মেনে নিয়েছেন প্রস্তাব।তখনকার অবিভক্ত বাংলা মানে কিন্তু বাংলা, বিহার, আসাম, শ্রীহট্ট সবটা মিলে। তত দিনে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে বাংলা। ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে ভাগ করে দিয়ে বিদ্রোহের গতি কমিয়ে আনা। অতএব পাশ হয়ে গেল বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব। তখন শ্রাবণ মাস। ১৬ আগস্ট। কাকতালীয় ভাবে সেটা ছিল রাখি পূর্ণিমা। হিন্দু ঘরের মেয়েরা তাদের ভাই-এর হাতে পরাবে রাখি। অন্যরকম রাখি বন্ধনের কথা মাথায় এল রবীন্দ্রনাথের। ভাই-বোনের নয়, রাখিবন্ধন হয়ে উঠল হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতি উৎসব। এ ধর্মের মানুষ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে হাতে রাখি পরিয়ে দিচ্ছে যার হাতে, তার ধর্ম আলাদা। হাতে হাত রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হল প্রতীকী প্রতিবাদ। একটা মানুষের ডাকে ধর্ম নির্বিশেষে সারা বাংলা এক হয়েছিল সে দিন। প্রতিবাদের ভাষা, চরিত্র বদলেছে ক্রমশ .
বঙ্গভঙ্গের আইনের বিরুদ্ধে সকলকে একযোগে করে রুখে দাঁড়াতে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ বসু, শ্রী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল ডাক দিয়েছিলেন ঐক্যবন্ধনের। শহরজুড়ে বিলি হয়েছিল প্রচারপত্র। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর, ৩০শে আশ্বিন বাঙালির ঐক্যবন্ধনের দিন ঘোষিত হয়েছিল। সকলের হাতে রাখি পরিয়ে সংযম গ্রহণের ডাক দিয়েছিলেন। প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল,"ঐ দিন সমস্ত বাংলাদেশের কোথাও কোন গৃহে রন্ধন হইবে না। আমরা বাঙালিরা সেদিন উষ্ণ দ্রব্য ভোজন করিব না। বন-ভোজনের পারণের ন্যায় চিড়া মুড়কী, ফলাদি আহার করিয়া থাকিব৷ কেবল শিশুর জন্য দুগ্ধ জ্বাল দিতে অন্যত্র অগ্নি জ্বালিব চুল্লি জ্বালিব না। ঐ দিনকেই প্রতি বৎসর বাঙালির রাখি বন্ধনের দিন করিয়া স্মরণীয় করিয়া রাখিব।"
রানী চন্দ সম্পাদিত 'ঘরোয়া'-তে 'রবিকাকা'র সেই লড়াইকে ব্যক্ত করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কথায়, "রবিকাকা একদিন বললেন, রাখিবন্ধন-উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখি পরাতে হবে। ঠিক হল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখি পরাব। এই সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানে যাব— রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে— মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম – যেন একটা শোভাযাত্রা দিমুও ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে of মিছিল চলল— বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥" রবীন্দ্রনাথের সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি কেউ।
অবনী ঠাকুরের কথায়, "ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চার দিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হল— সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল এক গাদা রাখি। সবাই এ ওঁর হাতে রাখি পরালুম। অন্যরা যারা কাছাকাছি ছিল তাদেরও রাখি পরানো হল। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখি পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিসকে হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন রবিকাকা। রাখি পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তো হতভম্ব। হঠাৎই রবিকাকার খেয়াল গেল চিৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখি পরাবেন। হুকুম হল, চলো সব। রওনা হলুম সবাই। গেলুম মসজিদের ভিতরে, মৌলবীদের হাতে রাখি পরিয়ে দিলুম। ওরা একটু হাসলে মাত্র।"
রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায় এই রাখি উৎসবের মন্ত্র বাতলে দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর। শুধু তাই নয়, এই রাখিবন্ধন উৎসবকে সেই সময় পঞ্জিকাতেও স্থান দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন। যদিও পরবর্তীতে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সেই দিন মুছে যায়। তবু শ্রাবণের রাখি উৎসবেই বারবার ফিরে আসে রবিপ্রসঙ্গ। কারণ ভাই-বোনের সম্পর্কের বাইরেও সমাজকে একসুতোয় বাঁধার উৎসবই যেন রাখিবন্ধন।
রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন সেদিন। সৌভ্রাতৃত্ব-সম্প্রীতিকে রাখির সুতোয় বাঁধতে পেরেছিলেন সকলকে। আগামী রবিবার শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা। শহরে ছেয়েছে নানা রঙের রকমারি রাখিতে। তবে কি কেবলই তা উৎসব হয়ে থাকবে দামী রঙিন সুতোর আড়ালে? না কি ধর্মকে গৌণ রেখে, সম্প্রীতি সৌহার্দ্যের বন্ধনই মুখ্য হয়ে থাকবে আজ ও আগামীতে.
রবীন্দ্রনাথ এই দিনটির উদ্দেশে একটি গান লিখেছিলেন।
"বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা –
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন –
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।"
উৎসবের মন্ত্র অনুষ্ঠান সব জোগাড় করা আবশ্যক। ছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর, রোজ কথকতা করিতেন আমাদের বাড়ি, কৃষ্ণবর্ণ পৃথুল তিলভাণ্ডেশ্বরের ন্যায় চেহারা। তাঁহাকেই ধরা হইল, রাখীবন্ধন উৎসবের একটা অনুষ্ঠান বাতলাইয়া দিতে হইবে। তিনি খুব খুশী ও উৎসাহী হইয়া উঠিলেন।
বাংলার মাটি
বাংলার জল
পুণ্য হউক
পুণ্য হউক হে ভগবান।
ঘাটে সকাল হইতে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখিবার জন্য আমাদের চারিদিকে ভিড় জমিয়া গেল। স্নান সারা হইল। সঙ্গে নেওয়া হইয়াছিল অনেকগুলি রাখী, সবাই একে অন্যের হস্তে রাখীবন্ধন করিল। অন্যরা যাহারা কাছাকাছি ছিল, তাহাদেরও রাখী পরানো হইল। হস্তের নিকট ছেলেমেয়ে যাহাকেই পাওয়া যাইতেছে, কেহ বাদ পড়িতেছে না। তাবৎ জনতাকে রাখী পরানো হইতেছে। গঙ্গাঘাটে সে এক ব্যাপার।
পাথুরিয়াঘাটা দিয়া আসিতেছি, দেখিলাম বীরু মল্লিকের অশ্বশালে কয়েকজন সহিস ঘোড়ার গাত্র মর্দন করিতেছে। অকস্মাৎ রবিকাকারা ধাঁ করিয়া বাঁকিয়া তথায় প্রবেশ করিলেন। অশ্ব-পরিচারকদের হস্তে রাখী পরানো হইল। ভাবিলাম, রবিকাকারা করিলেন কী, উহারা যে বিধর্মী, তাহাদের রাখী পরাইলে এইবার হাঙ্গামা শুরু হইয়া যাইবে। হাঙ্গামা আর হইবে কী? রাখী পরাইয়া আবার কোলাকুলিও হইল। সহিসগণ কাণ্ড দেখিয়া হতভম্ব।
ফিরিয়া আসিতেছি, সহসা রবিকাকার খেয়াল হইল চীৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়া সবাইকে রাখী পরাইবেন। সেই মর্ম্মে হুকুম হইল। প্রমাদ গনিলাম। মসজিদের ভিতরে গিয়া রাখী পরাইলে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড না হইয়া যায়। আমি করিলাম কী, আর উচ্চবাচ্য না করিয়া যেই আমাদের গলির মোড়ে মিছিলখানি পৌঁছাইল, আমি সট করিয়া একেবারে নিজের হাতার মধ্যে প্রবেশ করে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। রবিকাকার খেয়াল নাই। সোজা অগ্রসর হইলেন মসজিদের দিকে, সঙ্গে ছিল দিনু, সুরেন, আরো কিছু সাহসী লোকজন। বাড়িতে আসিয়া এই সংবাদটি প্রদান করিলাম। বলিলাম, কী কাণ্ড হয় দেখো।
আমরা সব বসিয়া ভাবিতেছি। এক ঘন্টা কি দেড় ঘন্টা পরে রবিকাকারা সবাই ফিরিয়া আসিলেন। আমরা দৌড়াইয়া যাইলাম। সুরেনকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, কী কী হল সব তোমাদের? সুরেন বলিল, কী আর হইবে? যাইলাম। মসজিদের ভিতরে মৌলবী-টৌলবী যাঁহাদেরই পাইলাম, হস্তে রাখী পরাইয়া দিলাম। আমি বলিলাম, আর হাঙ্গামা? সুরেন বলিল, হাঙ্গামা কেন হইবে? ওঁরা একটু হাসিলেন মাত্র।""
No comments:
Post a Comment