Saturday, 21 August 2021

বিশেষ আলোচনা। ধনু থেকে জ্যোতিরিন্দ্র । ২১.০৮.২০২১. Vol -471. The blogger in literature e-magazine.

ধনু থেকে জ্যোতিরিন্দ্র। 



ছোটবেলার ধনু, বড় হয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী নামে লিখলেন, ‘আজ আমি বুঝি তখনও আমার ভাল লাগার বোধ জন্মায়নি। …কোন‌্ দৃশ্য, কোন‌্ শব্দ— কিসের গন্ধ আমাকে আনন্দ দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল তখনও জানতে পারিনি, বুঝতে পারিনি।’ আর সেই না বোঝাকেই আজীবন বুঝতে চেয়েছিলেন লেখক জ্যোতিরিন্দ্র, একের পর এক লেখায়। কখনও তাঁকে বলা হয়েছে যে তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখেন, কখনও বলা হয়েছে লেখার মাধ্যমে আদর্শ প্রচার করছেন। কিন্তু সে সব কিছুকে প্রবল ভাবে অস্বীকার করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুধু বিশ্বাস করেছেন, ‘মনে হয়, কোনো রচনাই ‘নিখুঁত’ হল না ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর’ হল না— আরও ভাল করে লেখা উচিত ছিল।’

প্রাতঃভ্রমণের নেশা ছিল ঠার্কুদার। ঠার্কুদার হাত ধরে রেললাইন পার হয়ে একদম শহরের শেষ সীমায় এক খালের কাছে সে দিন চলে গিয়েছিল ধনু। তারপর সেখান থেকে খালের ধারে হেলিডি সাহেবের বাংলোর কাছে এক ফুলবাগানে। বুড়ো দারোয়ান ঠার্কুদাকে খুব ভালবাসতেন। দারোয়ান গেট খুলে দিলেন। কিন্তু বাগানে ঢুকেই চমকে উঠল ধনু। এই, এই বুঝি সেই অবিশ্বাস্য! ধনুর মাথার সামনে একটা গাছের দুটো ডালে দুটো সদ্য ফোটা গোলাপ। একটু একটু শিশির লেগে রয়েছে পাপড়ির গায়ে। সূর্য উঠছে সবে। তার রক্তাভ আলো এসে পড়েছে পাপড়িতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি নীল প্রজাপতি একটা কলির বোঁটায় এসে বসল। পলক পড়ছে না ধনুর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভিতরটা কী রকম করছে যেন।

জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘ভাললাগা কাকে বলে, ভাল দৃশ্য কী সেদিন প্রথম টের পেলাম। আর গন্ধ। নির্জন ঊষার সেই বাগানে গোলাপের মৃদু কোমল গন্ধে আমার বুকের ভিতর ছেয়ে গেল। সেই গন্ধ বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। যেন একটা আশ্চর্য সম্পদ আহরণ করে বাড়ি ফিরলাম।’

বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা প্রকৃতির গন্ধের সঙ্গে সেই যে সম্পর্কের শুরু, তা আজীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। আমৃত্যু। আসলে এক এক জনের স্মৃতি এক এক জিনিসের অনুরণন নিজের মতো করে ধরে রাখে। কখনও কোনও দৃশ্য, কখনও গন্ধ, কখনও আবার রং, এক এক জনের ক্ষেত্রে স্মৃতির অনুষঙ্গের বিষয়গুলি এক এক রকম। জ্যোতিরিন্দ্রের কাছে তা ছিল গন্ধ। তিনি প্রয়োজন মতো সেই সব স্মৃতির অনুষঙ্গে ডুব দিয়েছেন। ডুব দিয়ে কখনও ‘ভাদ্র মাসে জলে ডোবানো পাটের পচা গন্ধ থেকে বা অঘ্রাণের পাকা ধানের গন্ধ থেকে বা কখন আবার পুঁটি, মৌরলা মাছের আঁশটে গন্ধ’ থেকে সৃজনের প্রয়োজনীয় উপকরণটুকু নিয়ে উঠে এসেছেন। সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে বসে পড়েছেন নিজের লেখার খাতার সামনে। তার পর পাতা জুড়ে জন্ম নিয়েছে একের পর এক দৃশ্যাবলি। ‘বুটকি-ছুটকি’, ‘গিরগিটি’, ‘বনের রাজা’-সহ অনেক গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে ছোটবেলার নানা রকম গন্ধের স্মৃতি। জ্যোতিরিন্দ্রের নিজের কথায়, ‘সব ক’টা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সেই শৈশব থেকে আমার নাকটা অতিমাত্রায় সজাগ সচেতন।

পরবর্তী জীবনে সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে এই গন্ধ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’ তিনি নিজের বিয়ের মেয়ে দেখতে গিয়ে তাও চমকপ্রদ।বিলাসিতা নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, আড্ডা নেই, অহেতুক সময় নষ্ট নেই। অন্তর্মুখী অথচ স্পষ্টবক্তা, গভীর অথচ সূক্ষ্ম রসবোধ রয়েছে, যাঁরা জ্যোতিরিন্দ্রকে কাছ থেকে চিনতেন, তাঁদের কাছে এমন ভাবেই ধরা দিতেন তিনি। যেমন বিয়ের জন্য পাত্রী (পারুল নন্দী) দেখতে গিয়েছেন। পাত্রী দেখা শেষের মুখে। হঠাৎ কোনও রকম ভনিতা ছাড়াই পাত্রীর দাদাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমি কত মাইনে পাই জানতে চাইলেন না তো!’’ পাত্রীর দাদা একটু বিব্রত। কিন্তু তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নিজেই বলে দিলেন, ‘‘আমি মাইনে পাই একশো তিরিশ টাকা।’’ মেয়ের বাড়ির সকলে একটু অবাকই হয়েছিলেন। কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেননি জ্যোতিরিন্দ্র। সাদামাটা মানুষ তিনি। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, বিয়ে করতে গিয়েছেন তিনি। একরাশ ঝাঁকড়া চুল, সাজগোজের মধ্যে শুধু লন্ড্রি থেকে কাচানো নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি। ব্যস, ওইটুকুই। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনিই বর!বিবাহ ও কর্মজীবনতখন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কলকাতার জে ওয়ালটার থমসন-এ কর্মরত। কামিনীকুমার ধরচৌধুরী ও ক্ষীরোদাদেবীর মধ্যম কন্যা পারুলের সঙ্গে ১৯৪৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিয়ে হয়। ইংরেজ আমলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছিলেন পারুল, ভাল বাঁশি ও সেতার বাজাতে পারতেন।

বিয়ের আগে পারুলদেবীকে দেখতে গেলেন গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। সঙ্গে নিয়ে গেলেন বন্ধু গণেশ দত্তকে। গণেশবাবুর গায়ের রং ছিল মিশমিশে কালো। বিয়ের পরে তিনি পারুলদেবীকে বলেছিলেন— ও পাশে থাকলে আমায় একটু দেখতে ভাল লাগবে, তাই নিয়ে গিয়েছিলাম গণেশকে।

লেখার সময় আধশোওয়া হয়ে বসতেন আরাম কেদারায়। সামনের দক্ষিণ দিক পুরো খোলা। সেখান থেকে প্রচুর আলো এসে পড়ছে ছিপছিপে একহারা চেহারায়। তিনি ভাবছেন আর লিখছেন। হঠাৎ করেই হয়তো মেয়ে বা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘অমুক চরিত্রের কী নাম দেওয়া যায় বলো তো?’’ তাঁরা হয়তো নাম বলতেন দু’-একটা। কিন্তু কোনওটাই মনঃপূত হতো না তাঁর। স্ত্রী হয়তো জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ওই গল্পটার নাম কী দিলে?’’ নিরাসক্ত গলায় উত্তর আসত, ‘‘সে পরে দেখবে’খন।’’ আসলে নিজের লেখা নিয়ে আগাম কিছু বলাটা মোটেই পছন্দ করতেন না তিনি।

স্ত্রী পারুল নন্দীর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গ,—‘তারপর যখন লেখাটা ছাপা হল, দেখলাম ফাইনাল চেহারাটা কী দাঁড়িয়েছে। বারান্দায় ঝুকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হঠাৎ বললেন, একটা ভাল প্লট মাথায় আসছে জান। ব্যস, ঐটুকুই। তারপর শুধু লেখা।’

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বিখ্যাত উপন্যাস “বারো ঘর এক উঠোন”। এই উপন্যাস লেখার একটা পটভূমি আছে। এই উপন্যাস লেখার জন্য জ্যোতিরিন্দ্র বেছে নিয়েছিলেন বস্তি এলাকা। এমনিতে সারা জীবনে সাত-সাত বার ভাড়া বাড়ি পাল্টেছিলেন। চাকরি পাল্টেছেন একাধিক বার। কিন্তু যেখানে গিয়েছেন সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন সৃজনী-উপকরণ। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, মেয়ের বয়স তখন মাত্র চার বছর। বেলেঘাটার বারোয়ারিতলায় একটা বস্তি দেখে এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। হঠাৎ করেই স্ত্রীকে এসে বলেছিলেন, ‘‘ওই বস্তিতে থাকতে হবে আমাদের। লেখার প্রয়োজনে।’’ তারপরে লেখার তাগিদেই থাকা শুরু ওই বস্তিতে। বাড়ির মাঝখানে বড় উঠোন। ভাড়াটে সব মিলিয়ে মোট এগারো ঘর। সকলের ব্যবহারের জন্য ওই একটিই উঠোন। কেউ কাজ করতেন দোকানে, কেউ আবার ছিলেন নার্স। বেশির ভাগই ছিলেন পূর্ববঙ্গের। ওখানে থাকাকালীনই সকলের হাবভাব খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলেন। দেখতে থাকলেন আচার-আচরণ, জীবনযাত্রা। সে সব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি তার পরে হ্যারিকেনের আলোয় বসে বসে লিখেছিলেন। জন্ম নিয়েছিল ‘বারো ঘর এক উঠোন’ নামের তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।

সাদামাঠা ওই ভাব আজীবন সঙ্গী ছিল তাঁর। যেমনটা সঙ্গী ছিল নিয়মানুবর্তিতা। চূড়ান্ত আর্থিক কষ্ট, অনটনেও নিয়মানুবর্তিতায় কোনও খাদ ছিল না। সে এক মেয়ে ও দুই ছেলের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনই হোক কিংবা লেখাই হোক না কেন। লেখা আসুক আর না আসুক, রোজ নিয়ম করে লেখার খাতার সঙ্গে তাঁর সময় কাটানো চাই-ই চাই। পারুল নন্দীর স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, ‘লেখার সময়ও ছিল অত্যন্ত বাঁধা। যখনই মনে হল তখনই লিখতে বসলাম একদম পছন্দ করতেন না। যখনই মনে হল রাতে বাড়ি ফিরলাম একদমই পছন্দ করতেন না। আমার স্বামী নিজেই ঘড়ি হয়ে যেন নিজেকে এবং সেই সঙ্গে সংসারটিকে চালনা করতেন।’

সকালে ও বিকেলে দু’বেলা নিয়ম করে হাঁটতে যেতেন। কিন্তু ওই হাঁটার সময়ে খুব একটা কথাবার্তা পছন্দ করতেন না। মনে করতেন, সাধারণ কথা-গল্পের চেয়ে ওই সময়ে যদি কোনও গল্প-উপন্যাসের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে, তাতেই অনেক লাভ! লেখার জন্য এ ভাবেই নিজেকে একা করেছেন, বিযুক্ত করেছেন সকল কিছুর থেকে। ফেসবুক-ধ্বস্ত এ সময়ে লেখার জন্য নিজেকে নিঃসঙ্গ করার এই কৃচ্ছ্রসাধনের রীতি প্রায় বিরল।

১৯৩৬ সাল। কলকাতায় চলে এলেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুরু হল লেখকজীবন। পাইস হোটেলে খাওয়া, পড়া, দু’-একটা টিউশন আর লেখা— এই ছিল নিত্যদিনের রুটিন। সিনেমা নয়, খেলা দেখা নয়, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা নয়। প্রত্যেক দিন শুধু নিয়ম করে লেখা চলত। পড়িয়ে আয় হত ওই বাইশ-তেইশ টাকা। হোটেলে থাকা-খাওয়া বাবদ বারো-তেরো টাকা দিতে হত। ধোপা-নাপিত-বিড়ি-পান সব মিলিয়ে যা আনুষঙ্গিক খরচ, ওই আয়ের মধ্যেই হয়ে যেত। প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজের সাপ্তাহিক পত্রিকায় জ্যোতিরিন্দ্রের বেশ কয়েকটি ছোট গল্প ছাপলেন। ‘পূর্বাশা’ ও ‘অগ্রগতি’তেও ছোটগল্প বেরোল। তার মধ্যেই এক সংবাদপত্রে সাব-এডিটরের চাকরি পেয়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্র। অল্প কয়েক দিনের চাকরি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ‘দেশ’ পত্রিকায় আরও একটি গল্প বেরোল। একে একে ‘মাতৃভূমি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পরিচয়’-সহ একের পর এক পত্র-পত্রিকায় গল্প বেরোতে থাকল। বন্ধুদের মধ্য থেকে দাবি উঠল উপন্যাসের। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র তখনও প্রস্তুত নন। তাঁর কাছে ‘উপন্যাস তো এক অধরা। তবু্ উপন্যাস লিখলকাশ হওয়ার পরে তা নিয়ে প্রশংসা জুটল, নিন্দা জুটল তার চেয়েও বেশি। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র থামলেন না। ‘সূর্যমুখী’র পরে ‘মীরার দুপুর’, তার পর ‘বারো ঘর এক উঠোন’। ‘বারো ঘর এক উঠোন’ তাঁকে খ্যাতি দিল, পরিচিতি দিল, প্রতিষ্ঠা দিল। তবে অনেক সমালোচক জানালেন, লেখক ওই উপন্যাসে শুধু অন্ধকারই দেখেছেন। নিজে যেমন আলো দেখতে পাননি, তেমনই একটি চরিত্রকেও আলোয় উত্তরণ করাতে পারেননি।

সমালোচকদের যাবতীয় আক্রমণ, নিন্দাপর্ব মেটার পরে, ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর হয়ে কলম ধরেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। লিখেছিলেন, ‘আলো দেখাবার জন্য উত্তরণ দেখাবার জন্য আমি এ-বই লিখিনি। কেননা আমার দেখা একসময় সাগরময় ঘোষ ছোটগল্প চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রকে। সঙ্গে লিখলেন— ‘এবার উপন্যাসে হাত দাও।’ ব্যস! জ্যোতিরিন্দ্র লাফিয়ে পড়লেন উপন্যাসে। এত দিন ছোটগল্প লিখে তিল তিল করে যে শব্দবিন্যাস তৈরি করেছেন, তাই উজাড় করে দিলেন নিজের প্রথম উপন্যাসে। ‘সূর্যমুখী’ সম্পূর্ণ হল। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিতও জানা চরিত্রগুলির মধ্যে এমন একটি মানুষও ছিল না, যে এদের মধ্যে উপস্থিত থেকে মহৎ জীবনাদর্শের বাণী শোনাতে পারত। বিপন্ন, বিপর্যস্ত, অবক্ষয়িত সমাজের মানুষগুলি শুধু বেঁচে থাকার জন্য, কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কতটা অন্ধকারে, কতটা নিচে নেমে যেতে পারে আমি তাই দেখিয়েছি।’বিয়ের পরে নবদম্পতি বসবাস শুরু করল কলেজ স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। সেখান থেকে প্রথমে রূপবাণী সিনেমার কাছে রামচাঁদ লেনের বাড়ি, তার পর বেলেঘাটার বারোয়ারিতলা লেনের ‘এগারো ঘর বাসিন্দা’-র বাড়িতে বসবাস করেন তাঁরা। বেলেঘাটার বস্তি, বাগমারি রোডের ভাড়াবাড়ি, তিলজলার সরকারি ফ্ল্যাট— মোট সাত বার বাড়ি পাল্টান জ্যোতিরিন্দ্র। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন তিলজলা হাউজিং-এই (ব্লক এল/এ, ফ্ল্যাট ফোর

তাঁর ছোট গল্পের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর লেখা’ আ’ম কাঁঠালের ছুটি’গল্পটিতে তিনি একটি বর্দ্ধিষু পরিবারের ধ্বংসের কাহিনী সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। সবাই মারা গেছে, বেঁচে আছে শুধু আঁশি বছরে পুত্র শিবনাথ ও তার বুড়ো মা। মায়ের বয়স নব্বইয়ের উপরে। এক সময় বাড়িতে কত আনন্দ ছিল। বিয়ে,অন্নপ্রাশন, নবজাতকের আগমন লেগেই থাকতো। তারা সবাইকে অকালে মরে যেতে দেখেছেন। এখন বুড়ো মা ও ছেলে সেই সব মৃত্যুর বেদনাদায়ক স্মৃতি বহন করে কালাতিপাত করছে।গিরগিটি গল্পের কথা বলা যেতে পারে। বৃদ্ধের ছিল সৌন্দর্যপ্রিয়তা। সে দেখত রূপ। আর তার চোখের ভিতর দিয়ে মায়া দেখত নিজেকে। বৃদ্ধ যে তাকে দ্যাখে তা কি মায়া জানত না? গাছের পাতা, শালিখ, ফড়িংও তাকে দ্যাখে সেই কুয়োতলায় স্নানের সময়। বৃদ্ধের দেখা সেই রকম। নদী ও নারী, বনের রাজা, মঙ্গল গ্রহ, সমুদ্র, সামনে চামেলি, তারিনীর বাড়ি বদল, চোর, খালপোল ও টিনের ঘরের চিত্রকর, রাইচরণের বাবরি… কত গল্পের কথা বলব। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আমাদের সাহিত্যে ছোট গল্পের এক বিরল শিল্পী।

‘পাঠকদের সমাদর বেশি পাননি বলে মনে মনে হতাশা ছিল কিনা বলতে পারব না। স্বভাবটা ছিল ভীষণ চাপা। এতদিন পাশে-পাশে থেকেও হতাশা-টতাশা কিছুই বুঝি নি। কেউ হয়ত বাড়ি এসেছেন কথায় কথায় তাঁকে বললেন, অ্যা—আমার বই টই বিক্রিই হয় না, আমি আর কি লিখব! তবু ভিতরে একটা আগুন ছিল নিশ্চয়ই, নইলে সারাজীবন এত লিখলেন কি করে?’ মৃত্যুর আগে নিজের স্বামীর সম্পর্কে এমনটাই লিখে গিয়েছিলেন পারুল দেবী। আগুন, সেই সঙ্গে চূড়ান্ত নিরাসক্তি। সাফল্য এবং ব্যর্থতা, উভয়ের প্রতিই নিরাসক্তি। হয়তো এই নিরাসক্তিই ছিল তাঁর চালিকাশক্তি। বর্তমানে যেখানে যে কোনও সৃষ্টিই যেমন ‘ফিফটিন মিনিটস অব ফেম’-এর আলোকবৃত্তে নিয়ে আসতে পারে কাউকে বা অশালীন আক্রমণ শুরু হয়ে যেতে পারে ওই সৃষ্টি ঘিরে— সেখানে জ্যোতিরিন্দ্র বহু কাল আগে যে কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন, তা এখনও ভীষণ ভাবে সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক। জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘যুগটা বড় বেশি মুখর। অনেক কাগজ অনেক পাঠক অনেক মতবাদের সামনে আপনাকে অহরহ দাঁড়াতে হচ্ছে। …একই সময়ে নিন্দা প্রশংসার ঝড়ের সামনে আপনাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। …শিল্পীর জীবনে এ এক অভিশাপ। আবার পরীক্ষাও। আমি তাই মনে করি। পরীক্ষা হচ্ছে শিল্পী তাঁর নিজের সৃষ্টিক্ষমতার উপরে অকাট্য বিশ্বাস রেখে তাঁর পরবর্তী রচনায় হাত দিচ্ছেন কিনা। …প্রত্যয়ের হাত শক্ত করে ধরে হাজার রকম মতামতের ঢেউয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া শিল্পীর আর কিছু করার আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।’

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বাংলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নরনারীর জীবন চিত্র অঙ্কন করছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে তার জন্য বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে অমর হয়ে থাকবেন।।

আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন লেখকই হবেন। শুধু মাত্র লেখার প্রয়োজনে বস্তিতে থাকতে পর্যন্ত কার্পণ্য করেননি। তিনি বাস্তব অভিজাতার আলোকে সব কিছু উপলব্ধি করেন তা আমরা তাঁর লেখা থেকে পাই।

জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে সোনার বাংলা ও ঢাকার থেকে প্রচারিত বাংলার বাণী পত্রিকায় তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। কলকাতায় এসে তিনি সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে আসেন ও দেশ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্প রাইচরণের বাবরি। মাতৃভূমি, ভারতবর্ষ, চতুরঙ্গ, পরিচয় পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নজরে আসে জ্যোতিরিন্দ্রর লেখা। তাঁর লেখা ছোটগল্প ভাত ও গাছ, ট্যাক্সিওয়ালা, নীল পেয়ালা, সিঁদেল, একঝাঁক দেবশিশু ও নীলফুল এবং বলদ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়। 

১৯৪৮ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস সূর্যমুখী প্রকাশিত হয়। 

 জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ১৯৬৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সুরেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ও ১৯৬৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হন। তাকে কল্লোল যূগের অন্যতম শ্রেষ্ট ছোটগল্পকার বলে মনে করা হয়।

 তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ২০টি ও 

গল্পগ্রন্থ আছে তিপান্নটি।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...