"শ্রাবণ মাস, সম্মুখেই ঝুলন পূর্ণিমা। শুক্লপক্ষের মেঘাচ্ছন্ন বর্ষণমুখর একটি রাত্রি…মেঘাবরিত চাঁদের জ্যোৎস্নার স্বচ্ছ প্রভার মধ্যে অবিরাম ধারাপাতের ঝরঝর ধারা কুহেলীর মতো দেখা যাইতেছিল। রাত্রিটি কমলের বড় মধুর লাগিল। আকাশ নিচে নামিয়া শ্যামা ধরণীকে আলিঙ্গন করিতে চায়, কিন্তু বাতাস নিয়তির মতো পথরোধ করিয়া হা-হা করিয়া হাসে, তাই আকাশ যেন কাঁদিয়া সারা”।
১৯৩৪ সালে প্রকাশিত তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচিত ‘রাইকমল’ একটি হ্রস্ব দৈর্ঘ্যের উপন্যাস, একে নভেলা বা উপন্যাসিকাও বলা চলে। পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চলে অজয় নদীর তীরের গল্প এটি। এখানে এককালে বহু বৈষ্ণবের বাস ছিল। এখন সে স্থান মিশ্রতা পেয়েছে চাষী, ভিখারি, বৈষ্ণব, মুসলমান ফকিরের। কিন্তু আজো একটি সুরেই তাদের জীবন বাজে, যশোদা-রাধা-কৃষ্ণের আখ্যানে নিয়মিত চোখের জল ফেলে তারা। নির্দিষ্ট অঞ্চল ও সেখানকার মানুষদের নিয়ে করার ফলে এটি আঞ্চলিক উপন্যাসের উপাধি পেতে পারে। সংলাপের ক্ষেত্রে এতে বহুবার বাউল গান, বৈষ্ণব কীর্তন ব্যবহৃত হয়েছে। তারাশঙ্করের নিজস্ব জীবনদর্শন গড়ে দিয়েছে রাইকমলের ছাঁচ। তিনি নিজেও রাঢ়বঙ্গের মানুষ। তাঁর সাহিত্যজীবনের প্রথম দিককার উপন্যাস এটি। অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এত আলোচনা পায়নি এটি। শ্রী চৈতন্যদেবের ভাবধারা প্রভাবিত নবদ্বীপকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব অজয়ের তীরেও ছিল। রাইকমল সে সংস্কৃতিপ্রসূত ভাবরসে রচিত। কৃষ্ণপ্রেমে উজ্জীবিত এ অঞ্চলের মানুষেরা। রাইকমলকে তিনি চিরবিরহিনী রাধার আদলে গড়েছেন, কিন্তু “তার যোগ্য কৃষ্ণ কে?” এ প্রশ্নের উত্তর অধরাই রয়ে যায়। ১৯৫৫ সালে সুবোধ মিত্রের পরিচালনায় এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘রাইকমল’ নির্মিত হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
হরিদাস মহান্তের আখড়া রয়েছে এই অজয় নদীর তীরে ছোট একটি গ্রামে, লোকের মুখে তা নাম পেয়েছে ‘মা-বিঠীর আখড়া’। মা কামিনী ও মেয়ে কমলিনী সেখানে এখন বাস করে। বোষ্টমের সংসার, ক্ষুদ্র গৃহস্থালী, গানই তাদের জীবিকা। বয়ঃবৃদ্ধ বাউল রসিকদাস ভাগ্যক্রমে এসে জুটেছে এদের সাথে। রসিকের আগমন ঘটে “আমি পথের মাঝে পথ হারালেম ব্রজে চলিতে” গানের সাথে। ব্রজে যাবার উদ্দেশ্যে পথচলা বাউল ঘর খুঁজলো মা-বিঠীর আখড়ায়। প্রথম দর্শনে কমলিনীকে দেখে সে নাম দেয় ‘রাইকমল’-
“ফুটলো রাইকমল বসলো কৃষ্ণভ্রমর এসে।
লোকে বলে নানা কথা তাতে তার কী যায় আসে?
কুল তো চায় না কমল চায় না বৃন্দে মাঝজলেই হাসে ভাসে”
রাইকমল যেন তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা এক লতাগুল্ম। বাধ্য অবাধ্যতা সত্যিই আকর্ষণীয় একটি রূপ, যা তার মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া চোখে স্বপ্ন বোনা মিষ্টি একটি কিশোরী সে, ক্রম বিবর্তনে যে হয়ে উঠবে রহস্যময়ী ‘নারী’। সে জীবন থেকে পাঠ নেবে, প্রিয় মানুষগুলোর জন্য বিসর্জন দেবে সুখ এবং পাঠকমনকে চমকে দেবে বেশ কয়েকবার।
বোষ্টম কিশোরী কমলিনীর সাথে খেলা করে মোড়লবাড়ির রঞ্জন। পুতুলখেলার সঙ্গী, প্রতিদিনকার তার পছন্দের বর। একে হলো লঙ্কা, তো অপরে চিনি! রসিকদাস তাদের মধ্যে যেন রাসলীলা দেখতে পায়। জাতপাতের দেয়াল এসে একসময় এসে হানা দেয় এই দুই কিশোরমনে। এই জায়গায় এসে তেমন কোনো অভিনবত্ব দেখা যায় না। এ যেন গতানুগতিক প্রেমের গল্পের মতোই ধনী-গরিব, জাতপাত, শ্রেণীভেদের খলনায়ক হবার গল্প। এক্ষেত্রে রাইকমলের হঠাৎ করে পরিপক্বতা পাওয়া এবং বাস্তবটা বুঝে ফেলে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চাওয়ার মধ্যেও গতানুগতিকতার ছাপ স্পষ্ট। প্রকাশ শৈলীতে রাইকমলের এই আচরণের রূপান্তর প্রকাশ পেয়েছে তার মায়ের ভাবনার মধ্যে, “মেয়েটি তাহার সেই মেয়েই বটে, কিন্তু হাসিটি তো তাহার নয়!” মা কামিনী মেয়ের জন্য অন্তঃপ্রাণ, কিন্তু কখনো কখনো পিতা-মাতার জীবনে এমন সময় আসে যখন তার বুক ফেটে গেলেও সন্তানের সুখ বিসর্জন দিতে হয়। সামাজিক গণ্ডির আগ্রাসী রূপের কাছে কামিনীকেও তা-ই করতে হয়েছে। তাকে চোখের জ্বলে মেনে নিতে হয়েছে একমাত্র সন্তানের দুঃখ এবং সেই দুঃখ বুকে নিয়েই সে পরলোকে যাত্রা করে। তবে মৃত্যুর আগে কামিনীর শেষ ইচ্ছাও উপন্যাসিকার কাহিনীতে বিশেষ মাত্রা যোগ করে, যার জন্য কেউই প্রস্তুত থাকে না।
প্রগলভ রঞ্জনের আচরণও এখানে অনেক পূর্বানুমিত। তবে মূল কিছু জায়গায় রঞ্জনের চরিত্রটি অনেক বেশি চমক দেয় এবং কাহিনীর মোড় সবচেয়ে বেশি ঘুরিয়ে দেবার কাজটিও এই চরিত্রটিই করে। দ্বিধাগ্রস্ত রঞ্জন আসলে কী চায়, সে নিজেই জানে না। উপন্যাস জুড়ে ছড়ানো মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের জাল তাকেও গ্রাস করে।
এ উপন্যাসিকায় দেখা মেলে আরেক প্রধান পার্শ্বচরিত্র কাদুর। সে রাইকমলের সখী। বন্ধুত্বের অনবদ্য এক ছবি আঁকে সে। গৃহস্থ ঘরের মেয়ে হয়ে বোষ্টমকন্যা কমলিনীর জন্য বহুবার কাদুর প্রাণ কাঁদে। প্রকৃতার্থেই সে রাইকমলের সহমর্মী।
রসিকদাস রসময় হয়ে উঠতে পারেনি, আক্ষেপে তাই পঙ্করসে গা ডুবিয়েছে- এমনটিই ব্যাখ্যা তার নিজের সম্পর্কে। ভাসমান এক পরাগরেণুর মতোই সে যুক্ত হয় কামিনী ও কমলিনীর সঙ্গে।
নস্টালজিয়াকে তারাশঙ্কর খুব কাছ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। উপন্যাসের স্বল্প দৈর্ঘ্যের মধ্যে পরতে পরতে চমক এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের দেখা মেলে। আঞ্চলিক বিবৃতির উপাদান, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কিছু নিয়মিত অভ্যেস, তাদের ভক্তির বিস্তৃতি ও গভীরতা, জীবনের ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা এ সবকিছু মিলে উপন্যাসটিকে করে তুলেছে বহুমাত্রিক। প্রতিটি চরিত্র স্ব স্ব মহিমায় বিরাজিত। এদের মিথস্ক্রিয়া প্রশংসনীয়। সংলাপের মধ্যে রয়েছে রসাত্মক দিক এবং বিষণ্ণতার প্রচ্ছন্ন আভাস। প্রকৃতির বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে পরিমিত ও সাবলীল রূপে, শব্দচয়নে রয়েছে যথেষ্ট মাধুর্য।
আকাশের কষ্টের সঙ্গে কমলিনী যেন নিজের নিয়তির মিল দেখতে পায়, তাই আকাশটি তার এত আপন মনে হয়। প্রকৃতিরূপ ও মানবমনের মধ্যে এই সাবলীল সম্পর্ক স্থাপনে তারাশঙ্কর ব্যক্তিমনের গণ্ডি পেরিয়ে তাকে সীমাহীন বিস্তৃতি দান করেছে। এতে করে না চিন্তার আপোস ঘটে, না ভাবনার অভাব।
মূল চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে যেন মানবমনের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে একের পর এক। কোন পরিবেশে কে যে কী আচরণ করবে কিংবা খুব চেনা কাউকে যখন আগন্তুকের চাইতেও অজানা মনে হয় তখন প্রতিক্রিয়াটি কেমন হয়, এসবই ধীরে ধীরে ঘটনাবহুল কাহিনীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
কে জেতে, কে হারে? সম্পর্কের এই অদ্ভুত লড়াইয়ে সবাইই হেরে যায় যেন। তবে কি পরাজয়ের গল্প রাইকমল? নাকি রাইকমলের অবিরত অনুসন্ধান তাকে জীবনের গূঢ় সত্যটা বুঝিয়ে দেয়? অবিনশ্বর বলতে কিছু নেই এ জগতে, সম্পর্ক ধ্বংস হয়, ধ্বংস হয় চেনা মুখের আদলও। তার উপর ভিত্তি করেই বদলায় আমাদের চাওয়া-পাওয়ার নিয়মগুলোও। সবশেষে সত্য হয়ে থাকে জীবনের অস্তিত্ব, ঝাপসা হয়ে যায় অন্য সবকিছু।
“সুখ দুখ দুটি ভাই, সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি, দুখ যায় তারই ঠাঁই”।
এখানে মুদ্রার দুই পিঠই চির ঘূর্ণায়মান, কখন কোন পিঠ কতক্ষণ স্থায়ী হবে, তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই।
লাভপুরের মমতাময়ী মাটির স্নেহ আদুরে পরিবেশ রচনা যার সৃষ্টিকে ঘিরে আজন্ম আদুড় পরিবেশ রচনা করে, সেই মহান স্রষ্টার অনবদ্য বৈষ্ণবীয় ভাবনার প্রতীকী চরিত্র রাইকমল। রাইকমল যেন লেখকের অপরিণত মনোভাবের অনবদ্য জীবন রূপ। ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে উপন্যাসের কাহিনী র অনবদ্য মিল আমরা খুঁজে পাই। রাইকমল লেখকের মানস রূপ প্রতিমা।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment