Friday, 27 August 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। স্বর্ণকুমারী দেবী। ২৮.০৮.২০২১. Vol -478. The blogger in literature e-magazine.

 

স্বর্ণকুমারী দেবী।


কলকাতার তখনকার বিদ্বান পন্ডিত মানুষেরা উপন্যাসের ভাষা আর বিষয়বস্তুর তাৎপর্য দেখে অবাক হয়েছিলেন। তাঁর লেখা উপন্যাস প্রশংসিত হয়েছিল হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দ্যা ক্যালকাটা রিভিউতে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ইংল্যান্ডে থাকায় তার কাছে সেই উপন্যাসের এক কপি পৌঁছায়। তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি যে একজন মহিলা এই রকম একটি উপন্যাস লিখতে পারেন। তিনি ভেবেছিলেন উপন্যাসটি ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছদ্মনাম ব্যবহার করে লিখেছে। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে তাকে চিঠি লিখেছিলেন “জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে?

১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। তার আগে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস তাঁর ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক। গল্প কবিতা লেখা দিয়ে তার সাহিত্যে হাতে খড়ি হতে না হতেই মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ লেখা।  বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশের এক দশকের মধ্যে বাংলা ভাষাতে লেখা কোন মহিলার প্রথম উপন্যাস.

ভাবনায় দীপনির্বাণ ছিল জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত একটি উপন্যাস। এরপর স্বর্ণকুমারী দেবী অনেক উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি অসংখ্য গানও রচনা করেছিলেন। সে যুগের প্রেক্ষিতে স্বর্ণকুমারী দেবী মহিলা সাহিত্যিক হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবীদার।  

রচনা কর্ম -

উপন্যাস :
  • দীপনির্বাণ (১৮৭৬),
  • মিবার-রাজ (১৮৭৭),
  • ছিন্নমুকুল (১৮৭৯),
  • মালতী (১৮৭৯),
  • হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭),
  • বিদ্রোহ (১৮৯০),
  • স্নেহলতা (১৮৯২),
  • কাহাকে (১৮৯৮),
  • ফুলের মালা (১৮৯৫),[১]
  • বিচিত্রা (১৯২০),
  • স্বপ্নবাণী (১৯২১),
  • মিলনরাতি (১৯২৫)।[১১]
  • সাব্বিরের দিন রাত [১৯১২]


  • নাটক
  • বিবাহ-উৎসব (১৮৯২),
  • বসন্ত-উৎসব (১৮৭৯)
  • রাজকন্যা,
  • দিব্যকমল
  • দেবকৌতুক,
  • কনেবদল,
  • যুগান্ত,
  • নিবেদিতা । 

  • কাব্যগ্রন্থ
  • গাথা,
  • গীতিগুচ্ছ


  • বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ।
  • পৃথিবী

১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ভারতী চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এই পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত। এর ভাষাও ছিল সহজ সরল। সমালোচকেরা এই পত্রিকার উচ্চ প্রশংসা করতেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর আট বছর স্বর্ণকুমারী দেবী আবার এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তারপর নয় বছরের ব্যবধানে আবার স্বর্ণকুমারী দেবী এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। এরপর দুই বছর সম্পাদনার পর তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। এই ভাবে ভারতী পত্রিকা প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী প্রকাশিত হয়।

ভারতী যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র ষোলো। প্রথম সংখ্যা থেকেই এই পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। আসলে এই পত্রিকার চাহিদাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত লিখতে বাধ্য করত এবং বহু বছর তিনি এক নাগাড়ে এই পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠিয়ে এসেছিলেন

দেশের মানুষের নৈতিক অবনতি আর আত্মকলহের সুযোগে বিদেশি শত্রু বারবার আমাদের দেশকে আক্রমণ করেছে, কেড়ে নিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। সেই গ্লানি আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শুধুমাত্র নিজেদের কারণেই। স্বর্ণকুমারী এই কথাই বলেছেন তাঁর ‘দীপনির্বাণ’ উপন্যাসে। এই বক্তব্যের ওজন যুগের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটিকে  এত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। এই নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে তা হচ্ছে, প্রথমে উপন্যাসে লেখকের নামের জায়গায় লেখা ছিল জনৈক লেখিকা। এদেশে তখন স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। অনেক মহিলাই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। সে সময় কোন মহিলার উপন্যাস লেখাটা ছিল বেশ শক্ত কাজ।
শুধু তাই নয় ১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য বসন্ত উৎসব রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর অনুজ রবীন্দ্রনাথ ওই ধারাতেই একের পর এক গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন। উল্লেখ্য; ১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ভারতী চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকা স্বতন্ত্র্য চরিত্র পেয়েছিল এবং ভারতী পত্রিকা প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার চাহিদাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত লিখতে বাধ্য করত এবং বহু বছর তিনি এক নাগাড়ে এই পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠিয়ে এসেছিলেন।
্স্বর্ণকুমারী সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে পণ্ডিতা রামাবাই, রামাবাই রানাড ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি অহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জন্মেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ২৮ আগস্ট, ১৮৫৫।স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তার তিন দিদির নাম ছিল সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী। তার ছোটোবোনের নাম ছিল বর্ণকুমারী। সৌদামিনী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম যুগের ছাত্রী। ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যেরা তাকে অনুসরণ করলেও, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রধানত বাড়িতেই লেখাপড়া শিখেছিলেন।[২] তিনি তার অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন সে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের সৃষ্টিশীলতা তাঁকেও স্পর্শ  করেছিল। অন্য মেয়েদের মতো তাঁরও বিয়ে হয় অল্প বয়সে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়,  তাঁর স্বামী জানকীনাথ যখন ইংল্যান্ডে যান তখন স্বর্ণকুমারী অনেকদিন বাপের বাড়িতেই ছিলেন। ওই সময়ে স্বর্ণকুমারীর সঙ্গীত চর্চা, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা, ও ভালোভাবে ইংরেজি সাহিত্য পাঠের সুযোগ হয়েছিল। তাছাড়া তিনিও দাদাদের সঙ্গে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজেও মেতে ওঠেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন পরিবারের প্রাচীন প্রথাগুলিকে নারী স্বাধীনতার পথ হিসেবে প্রশস্ত করছিলেন তখন স্বর্ণকুমারী নিজের সাহিত্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন।
১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। ঠাকুর পরিবার ছিল পিরালী থাকভুক্ত ব্রাহ্মণ। পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাকে বিবাহ করার জন্য জানকীনাথ পরিবারচ্যূত হয়েছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা জানকীনাথ ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজস্ব এক জমিদারি গড়ে তুলে "রাজা" উপাধি অর্জন করেন।তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী (থিওজফিস্ট) এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।  তথা আদি যুগের সক্রিয় সদস্য।

জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিন সন্তান ছিলেন। এঁরা হলেন হিরন্ময়ী দেবী (১৮৭০ – ১৯২৫),জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল (১৮৭১ – ১৯৬২) ও সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২ – ১৯৪৫)।জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পশ্চিম ভারতে কর্মে বহাল হয়েছিলেন

সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে, স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। এইমেলায় ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের হস্তশিল্প এবং বহির্বঙ্গের কাশ্মীরমোরাদাবাদবারাণসীআগ্রাজয়পুর ও বোম্বাইয়ের হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়।[১৮] তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই যুগে এই মেলা কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

১৯০৬ সাল পর্যন্ত সখীসমিতি সক্রিয় ছিল। তারপর হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রয় এর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বরানগরে একটি বিধবা আশ্রম চালু করেন। এই আশ্রমের নাম ছিল "মহিলা বিধবা আশ্রম"। হিরন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর এই আশ্রমটিরই নতুন নামকরণ হয় "হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম"। মহিলা বিধবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যনির্বাহী সমিতিতে ছিলেন স্বর্ণকুমারী, ময়ূরভঞ্জের মহারানি সুচারু দেবী, কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী (উভয়েই ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা), লেডি হ্যামিলটন, প্রিয়ংবদা দেবী, শ্রীমতী চ্যাপম্যান ও শ্রীমতী সিংহ। হিরন্ময়ী দেবী ছিলেন আশ্রমের সচিব। হিরন্ময়ী দেবীর কন্যা তথা আশ্রমের পরিচালিকা কল্যাণী মল্লিকের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালেও এই আশ্রম সফলভাবে চালু ছিল।

"সখীসমিতি" নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সরলা রায়ের অনুরোধে সখীসমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ "মায়ার খেলা" নৃত্যনাট্যটি লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন.

মৃত্যু - ৩ জুলাই, ১৯৩২।‌‌‌‌।   

=========[[[[[[={{{{{{{{{{{{{{{{{[{{========={{{{{{(

No comments: