১. তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা
◆ পটভূমি ◆
রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রহ্মসমাজ ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়লে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ১৮৩৯ খ্রি ৬ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন – তত্ত্বরঞ্জিনী সভা।
এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার নতুন নামকরণ করেন তত্ত্ববোধিনী সভা।
এই সভার মুখপত্র হিসাবে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রকাশ হয়।
◆ প্রথম প্রকাশ ◆
১৬ই আগষ্ট, ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১লা ভাদ্র, ১২৭০ বঙ্গাব্দ) তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র স্বরূপ ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার কন্ঠে “একমেবাদ্বিতীয়ং” বাক্যটি মুদ্রিত থাকত।
◆ প্রথম সংখ্যা ◆
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় সূচী –
১) পত্রিকা প্রকাশের তাৎপর্য্য
২) মহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ভট্টাচার্য্য মহাশয় কর্ত্তৃক বর্ত্তমান শকের (১৭৬৫) গত ৪ বৈশাখে ব্রহ্মসমাজে ব্যাখ্যাত হয়।
৩) মহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ভট্টাচার্য্য মহাশয় কর্ত্তৃক বর্ত্তমান শকের গত ১ জ্যৈষ্ঠে ব্রহ্মসমাজে ব্যাখ্যাত হয়।
৪) তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা
৫) মহাত্মা শ্রীযুক্ত রাজা রামমোহন রায় কর্ত্তৃক বাজসনেয়সংহিতোপনিষদের ভাষা বিবরণের ভূমিকার চূর্ণক।
◆ প্রচ্ছদ ◆
● প্রথম প্রকাশের সময় থেকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার কোনো মলাট বা প্রচ্ছদ ছিল না। প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা ছাপা হত।
● ১৮৮৪ খ্রি থেকে কালচে সবুজ রঙের প্রচ্ছদ পত্র সংযোজিত হয়।
● প্রচ্ছদের মতো অনুপস্থিত থাকত সম্পাদকের নামও। তরুণ রবীন্দ্রনাথ এই রীতির পরিবর্তন করেন।
● পরবর্তীকালে প্রতিটি সংখ্যায় প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদে পত্রিকার নাম, সম্পাদকের নাম ছাপা হতে থাকে। সূচিপত্রও মুদ্রিত হত।
◆ পত্রিকা পরিচালনা ◆
● অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন ১২ বছর, যথাক্রমে ৩০, ৪৫ ও ৬০ টাকার বেতনে।
● অক্ষয়কুমার দত্তের পর নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, সীতানাথ ঘোষ, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব সামলেছেন।
● তবে, পত্রিকার সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
● রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় কমিটিকে একটি মুদ্রণ যন্ত্র দান করেছিলেন।
◆ প্রকাশ্য বিষয় ◆
ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও বাংলা গদ্যের সুসংগঠনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার অবদান অনস্বীকার্য।
● অক্ষয়বাবুর চেষ্টায় পত্রিকায় ধর্ম ছাড়াও সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ও প্রকাশিত হত।
● পত্রিকায় প্রকাশিত বিষয়গুলির মান ঠিক রাখার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির অনুসরণে দেবেন্দ্রনাথ পাঁচ জনের একটি প্রবন্ধ নির্বাচনী সভা সংস্থাপন করেছিলেন, যাঁরা প্রকাশ্য বিষয় মনোনীত করতেন।
● বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমুখ পত্রিকার পাতাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
● এছাড়া পত্রিকায় ধর্মতত্ত্ব , তার ব্যাখ্যা ও বেদ বেদান্তের অনুবাদের ভার নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
● জ্ঞান বিজ্ঞান বিষয়ক তত্ত্বকথা প্রচারে দায়িত্ব নিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত।
◆ পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা একসময় ৭০০ পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
◆ পত্রিকাটি ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। ক্ষিতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
--------------------০০০০০---------------------
২ প্রবাসী পত্রিকা
প্রবাসী বাঙালির মুখপত্র ছিল প্রবাসী পত্রিকা। আর এর জন্মদাতা হলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। অধ্যাপনা জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনভাবে পত্রিকা সম্পাদনার কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রামানন্দ। ধর্মযুদ্ধ, দাসী, কায়স্থ সমাচার, প্রদীপ প্রভৃতি নানা বাংলা ইংরাজী পত্রিকার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিয়ে সম্পাদনা করলেন – প্রবাসী পত্রিকা।
◆ পত্রিকা প্রকাশ ◆
● এলাহবাদ থেকে বৈশাখ, ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (এপ্রিল,১৯০১) প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় সচিত্র পত্রিকা প্রবাসী।
● রামানন্দ সম্পূর্ণ এককভাবে পত্রিকাটি সম্পাদনা করলেও তাঁকে অপরিসীম সাহায্য করেছিলেন – ইন্ডিয়ান প্রেসের স্বত্বাধিকারী চিন্তামণি ঘোষ।
● পত্রিকার নাম ‘প্রবাসী’ এই মর্মে রাখা হয়েছিল –
“আমরা যে স্বাধীনতা হারিয়ে নিজের ঘরে পরাশ্রিতদের মতো বাস করে প্রবাসী হয়ে আছি, এই অর্থটাই প্রধান হল।”
● পত্রিকার প্রথমে মুখবাণী ছিল টেনিসনের পঙক্তি –
“Beauty, Good and Knowledge
are three sisters
to look on the noble forms
makes noble thro the sensors organism
that which is higher.”
● ১৩১৪ বঙ্গাব্দে আষাঢ় মাসে এর সঙ্গে যোগ হয় – সংস্কৃত দুটি বাক্য –
“সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম”
“ন্যায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ” (মুন্ডকোপনিষদ)
● ১৩২২ বঙ্গাব্দে মুখবাণীতে প্রকাশ পেল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতির মর্মবেদনা –
“নিজ বাসভূমে, পরবাসী হলে
পর দাস খতে সমুদায় দিলে।
পরহাতে দিয়ে, ধনরত্ন সুখে
বহ লৌহবিনির্মিত হার বুকে
পর ভাষণ, আসন, আনন রে
পর দীপশিখা নগরে নগরে
তুমি যে তিমিরে তুমি সে তিমিরে।”
– গোবিন্দ চন্দ্র রায়
● প্রবাসী পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ ছিল – স্বদেশের সংস্কৃতি ও ধর্মের সমন্বয়ে এক চিত্র।
◆ প্রথম সংখ্যা ◆
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ প্রকাশিত হয়-
১) সূচনা
২) আবাহন(কবিতা) – শ্রী দেবেন্দ্রনাথ সেন
৩) প্রয়োগধামে কমলাকান্ত – শ্রী কমলাকান্ত শর্মা
৪) আদর্শ কবি (ক্রমশ:) – ঐ
৫) অজন্তা গুহাচিত্রাবলী (সচিত্র) – সম্পাদক
৬) প্রবাসী (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭) জীববিদ্যা – শ্রী যোগেশচন্দ্র রায়
৮) ক্ষীরাৎকুম্ভ (সচিত্র) – শ্রী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
৯) শর্করা বিজ্ঞান (ক্রমশ:) – শ্রী নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়
১০) বিবিধ প্রসঙ্গ – সম্পাদক
১১) ভিতরে পূর্ণ পৃষ্ঠা ছবি – জয়পুরের মহারাজা ও দেওয়ান কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
● সূচনায় সম্পাদক লিখেছিলেন –
“সর্ব্বসিদ্ধিদাতা পরমেশ্বরের নাম লইয়া আমরা ‘প্রবাসী’ প্রকাশ করিতেছি।…প্রারম্ভের আড়ম্বর অপেক্ষা ফল দ্বারাই কার্য্যের বিচার হওয়া ভাল। এইজন্য আমরা আপাতত আমাদের আশা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নীরব রহিলাম।”
◆ প্রকাশ্য বিষয় ◆
প্রবাসীর সূচিপত্র ছয় মাস অন্তর প্রকাশিত হত। বৈশাখ সংখ্যায় বৈশাখ থেকে আশ্বিন এবং কার্তিক সংখ্যায় কার্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রকাশিত হত।
● চিত্রপরিচয় – ১৩০৯ বঙ্গাব্দ থেকে এই বিভাগ শুরু হয়। দেশি বিদেশি চিত্রকরদের আঁকা বিখ্যাত তিনটি করে ছবি থাকত। আর সেই চিত্রের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা থাকত।
চিত্রসূচী পত্রিকায় পৃথকভাবে প্রকাশ পেত।
● বিবিধ প্রসঙ্গ – প্রথম সংখ্যা থেকেই সাময়িক রাজনীতি, সমাজনীতি, সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ নামে সম্পাদকীয় বক্তব্য প্রকাশ পেত। তার কোনো শিরোনাম ছিল না তখন পরবর্তীকালে নাম হয় ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’।
● পঞ্চশস্য – আর একটি জনপ্রিয় তথ্যসমৃদ্ধ বিভাগ হল পঞ্চশস্য। জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা খবর এখানে প্রকাশ পেত। ১৩২০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় এই বিভাগটি। এই বিভাগের সংবাদগ্রাহকদের মধ্যে ছিলেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলচন্দ্র হোম। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের পরে এই বিভাগটি বন্ধ হয়ে যায়।
● কষ্টিপাথর – সমকালীন পত্র পত্রিকা থেকে বিভিন্ন রচনার সংক্ষিপ্তসার অথবা পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হত কষ্টিপাথর বিভাগ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ভারত মহিলা, বঙ্গদর্শন, ভারতী, সবুজপত্র, নারায়ণী, সন্দেশ, প্রাচী, মাসিক বসুমতী, সৌরভ, আয়ুবিজ্ঞান, নমঃশূদ্র হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচিত হত। ১৩১৬ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল বিভাগটি।
● দেশে বিদেশের কথা – দেশে বিদেশের কথা (সচিত্র) বিভাগটি শুরু হয়েছিল ১৩২৮ বঙ্গাব্দ থেকে। এর আগে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে ‘দেশের কথা’ নামে বিভাগটি চালু হয়েছিল। পরে বিদেশের খবর অন্তর্ভূক্ত করে এর নাম হয় ‘দেশে বিদেশের কথা’। পঞ্চশস্য বিভাগের সদস্যরাই খবর সংগ্রহ করতেন এই বিভাগের জন্য।
● মহিলা মজলিশ – ১৩২৮ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল এই বিভাগটা। বিভিন্ন মহিলাদের সংবাদ ও তাদের সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীদের নানা কৃতিত্ব নিয়ে এই বিভাগে খবর প্রকাশিত হয়। আবার শোকসংবাদও থাকত।
● ছোটদের পাততাড়ি – এই বিভাগে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য দেশ বিদেশের গল্প, রূপকথা, বিজ্ঞান, জীবজন্তুদের কথা, শরীর ও স্বাস্থ্য এবং নানা আকর্ষণীয় ও কৌতূহলোদ্দীপক রচনা থাকত। তবে, এই বিভাগটি পতরিকার প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ পেত না।
● আলোচনা – রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রদীপ’ পত্রিকার মতই ‘প্রবাসী’তে আলোচনা বিভাগ ছিল। এখানে যেকোনো রচনা সম্বন্ধে পাঠকের মতামত ছাপানো হত। অনেক সময় মূল লেখকের উত্তরও সঙ্গে দেওয়া থাকত।
● বেতালের বৈঠক – বেতালের বৈঠক বিভাগটি শুরু হয়েছিল ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে। এই বিভাগে পাঠকদের বিভিন্ন বিষয়ের জিজ্ঞাসা ও পরবর্তী সংখ্যায় সেইসব জিজ্ঞাসার উত্তর প্রকাশ পেত। এর উত্তর পাঠকও দিতে পারতেন। উত্তরের পাশে উত্তরদাতার নামও লেখা থাকত।
● হারামণি – ‘হারামণি’ প্রবাসীর একটি নতুন সংযোজিত বিভাগ। ১৩২২ বঙ্গাব্দ থেকে এই বিভাগের শুরু হয়। বহু পুরানো ও হারিয়ে যাওয়া গান যেমন বাইল, দরবেশ, ফকির, তর্জ্জাওয়ালা প্রভৃতি গায়কের এই বিভাগে প্রকাশ পেত।
● সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ সমালোচনা – প্রবাসী র একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হল সমসাময়িক পত্রিকা ও গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ। ১৩০৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ইংরাজি গ্রন্থের প্রশংসাসূচক সমালোচনা – হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’ নামে বেরিয়েছে। ১৩১৩ আশ্বিন সংখ্যায় ‘সমালোচনা’ শিরোনামে কিছু গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে। তবে এই সমালোচনা তখনও নিয়মিত হয়নি। ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে ‘পুস্তক পরিচয়’ নামে নিয়মিত বিভাগের শুরু হয়।
এছাড়া গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রকাশ পেয়েছে এবং এর পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, ভৌগলিক বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে নানা সময়।
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রবাসী পত্রিকা ◆
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার প্রাণপুরুষ। তাঁর অসংখ্য কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস প্রবাসী পত্রিকার পাতাকে সমৃদ্ধ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
গোরা (ভাদ্র, ১৩১৪ – ফাল্গুন, ১৩৩৬)
শেষের কবিতা ( ভাদ্র, ১৩৩৫)
মুক্তধারা ( বৈশাখ, ১৩৩৯)
অচলায়তন ( ভাদ্র, ১৩১৯)
রক্তকরবী ( আশ্বিন, ১৩৩০)
এছাড়া তোতাকাহিনী, প্রথম চিঠি, অতিথি, পণরক্ষা, কর্ত্তার ভূত ইত্যাদি ছোটগল্পও প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসীর পাতায়। তবে, পরবর্তীকালে সবুজ পত্র পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় প্রবাসীর থেকে দূরত্ব তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথের লেখা যেমন বেরিয়েছে প্রবাসীর পাতায় তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নানা লেখা বেরিয়েছে, যেমন –
১) রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা – অজিতকুমার চক্রবর্ত্তী (আশ্বিন, ১৩১৯)
২) রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (মাঘ, ১৩৩৬)
৩) রবীন্দ্রনাথ – নলিনীকান্ত গুপ্ত ( জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৮)
৪) রবীন্দ্রনাথ ও মৃত্যু – শান্তা দেবী (অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮)
৫) রবীন্দ্রচিত্রের ভূমিকা – বিমলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী (মাঘ, ১৩৫৪) ইত্যাদি।
দীর্ঘ ৪২ বছর রামানন্দ ‘প্রবাসী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর অগ্রহায়ণ, ১৩৫০ বঙ্গাব্দ থেকে পত্রিকার হাল ধরেন পুত্র কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়।
------------------------০০০০০------------------------
৩. সবুজপত্র
এটি মূলত: একটি মাসিক সাময়িকী/পত্রিক।
বিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগে বাংলা ভাষায় অন্যতম প্রধান সাময়িক পত্রিকা ছিলো সবুজ পত্র। প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হতো। এর প্রথম প্রকাশ বাংলা ১৩২১ সালে (ইংরেজি: ১৯১৪ খ্রি.)। সবুজ পত্রে কখনো কোনো বিজ্ঞাপন এবং ছবি প্রকাশিত হয় নি। প্রমথ চৌধুরী সাময়িকীটিকে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষনীয় রূপ প্রদানের জন্যে কোনো চেষ্টা করেননি বরং তিনি এর মান এবং আদর্শ সমুন্নত রাখার প্রতি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাই সবুজ পত্র সাধারণ পাঠক ও লেখকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেনি। প্রথম পর্যায়ে এটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দ(১৯২২ সাল)পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সবুজ পত্রের প্রকাশনা শুরু হয় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ থেকে। সাময়িকীটি শেষ পর্যন্ত ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে (১৯২৭ সালে) বন্ধ হয়ে যায়।
এটি মূলত: একটি মাসিক সাময়িকী/পত্রিকা। এটি প্রথম প্রকাশিত বৈশাখ ১৩২১ (১৯১৪ খ্রি.)। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। কোলকাতার ৩ নং হেষ্টিংস্ ষ্ট্রীট থেকে এটি প্রকাশিত হতো। এর বার্ষিক মূল্য ছিলো দুই টাকা ছয় আনা।স্মর্তব্য, পত্রিকাটির নাম ছিল 'সবুজ পত্র', 'সবুজপত্র' নয়।
বাংলা সাহিত্যে প্রভাব
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে 'সবুজ পত্র' এক বিশেষ অবস্থান দখল করে আছে। বাংলা সাহিত্যের নানান বিষয়ের উত্থান ঘটাতে এর অপরিসীম অবদান চিরস্মরনীয় হয়ে আছে; উদাহরণ স্বরূপ সাহিত্যপত্র পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু যা বলেছেন তার উদ্ধৃতি দেয়া যায়:
... এর প্রথম দান প্রমথ চৌধুরী বা বীরবল। দ্বিতীয় দান চলিত ভাষার প্রতিষ্ঠা। তৃতীয় - এবং হয় তো বা মহত্তম দান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রমথ চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথ, এ দুজনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো সবুজ পত্রের, প্রথম জনের আত্মপ্রকাশের জন্য, দ্বিতীয় জনের নতুন হবার জন্য।...
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবুজপত্র কেবলমাত্র বাংলা ভাষাকে সাধু ভাষার প্রভাব মুক্ত করে চলিত তথা কথ্য ভাষাকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যই অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।[৩]
লেখকবৃন্দ
সবুজ পত্রের প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সম্পাদকের নিজের লেখা সন্নিবেশিত হয়। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, বরদাচরণ গুপ্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, হারীতকৃষ্ণ দেব, কিরণশঙ্কর রায় সবুজ পত্রে লিখতেন। কান্তিচন্দ্র ঘোষ, অমিয় চক্রবর্তী এবং সুরেশ চক্রবর্তী কবিতা লিখতেন।
-----------------------০০০০০------------------------
৪. কল্লোল পত্রিকা
বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা আনার ক্ষেত্রে কল্লোলের ভূমিকা বাংলা সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই পত্রিকাটির বীজ নিহিত ছিল ফোর আর্টস ক্লাবের মধ্যে।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুন গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, মণীন্দ্রলাল বসু ও সুনীতি দেবী – চার বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছিলেন এই প্রতিষ্ঠান – ফোর আর্টস ক্লাব। তবে ১৯২২ খ্রি: এই ক্লাবের অস্তিত্ব বিপন্ন হলেও সেই তরুণ কবি সাহিত্যিকরা নতুন কিছু করার আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণরূপ দিতেই কল্লোল পত্রিকার জন্ম।
◆ পত্রিকা প্রকাশ ◆
দীনেশ দাসের দুইটাকা এবং গোকুল নাগের দেড় টাকা – সাড়ে তিন টাকায় ছাপানো হয় হ্যান্ডবিল। ১৩২৯ সালের চৈত্র সংক্রান্তিতে জেলেপাড়ার সং দেখানোর জন্য ভিড় জমানো মানুষের মধ্যে হ্যান্ডবিল ছড়িয়ে ঘোষণা করা হল কল্লোল পত্রিকা প্রকাশিত হবে।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ কল্লোল পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দীনেশ দাসের মেজদা বিভুরঞ্জনের বাড়ি ১০/২ পটুয়াটোলা লেনের দুটি ঘরকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল কল্লোলের প্রথম অফিস।
কল্লোল পত্রিকার পাতায় সম্পাদক হিসাবে নাম থাকত দীনেশরঞ্জন দাশ, সহকারী সম্পাদক ছিলেন – গোকুল নাগ।
কল্লোল পত্রিকার প্রচ্ছদ আঁকতেন দীনেশ দাশ। কল্লোল পত্রিকার প্রচ্ছদ ৫ বার পরিবর্তন করা হয়েছে, তবে প্রতিবারই ফুটে ঊঠেছে তরুণ সমুদ্র হৃদয়ের সংঘাত, উচ্ছ্বাস ও সীমাহীন কল্পনাভিসার।
◆ প্রথম সংখ্যা ◆
১) কল্লোল (কবিতা) – দীনেশরঞ্জন দাশ
২) বীণা (গল্প) – সুনীতি দেবী
৩) মা (গল্প) – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৪) কল্লোল (কথিকা) – বিজয়চন্দ্র মজুমদার
৫) রিক্তা (গল্প) – কেতকী দেবী
৬) সংগ্রহ (সুভাষিত সংগ্রহ)
৭) পুঁটেরাম (গল্প) – নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
৮) পথিক (উপন্যাস) – গোকুলচন্দ্র নাগ
৯) ফুলের আকাশ (গল্প) – দীনেশরঞ্জন দাশ
১০) ভাঙাবাড়ী (গল্প) – অমলেন্দু সেনগুপ্ত
১১) বিড়ালের স্বর্গ (অনুবাদ গল্প) –
মূল রচয়িতা – এমিল জোলা
অনুবাদক – পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়
১২) বসন্ত বিলাপ (কবিতা) – দীপঙ্কর
(কালিদাস নাগ)
◆ প্রকাশিত বিভাগ ◆
কল্লোল পত্রিকা নানা বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল।
● সংগ্রহ – এখানে গল্প উপন্যাস থেকে নির্বাচিত সুভাষিতাবলী।
● আলোচনা – এই বিভাগটি ছিল পুস্তক পরিচয় বা সাহিত্য ভাবনা সংক্রান্ত।
● সমাচার – দেশে বিদেশের নানা সংবাদ নিয়ে প্রকাশিত হত।
● ছবি – এই বিভাগটি ছিল শিল্পীদের শিল্পকর্মের বিষয় নিয়ে আলোচনা।
● ডাকঘর – এই বিভাগের প্রত্যাবর্তন করেন দীনেশরঞ্জন দাশ পরবর্তীকালে একক সম্পাদনায়। সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা এই বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল। পরে এটি উঠে গিয়ে ‘প্রবাহ’ বিভাগের অন্তর্ভূক্ত হয়।
● কাহিনী – এখানে থাকত দেশ বিদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। এর লেখক ছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।
◆ মূল্য ◆
● কল্লোলের প্রতি সংখ্যার দাম – ৪ আনা
পরে হয় – ৫ আনা।
● বার্ষিক সডাক মূল্য – সাড়ে তিন টাকা।
● পত্রিকার সাইজ ছিল প্রথমে ডিমাই,
পরে চতুর্থ বর্ষ থেকে কল্লোল ডবল ক্রাউন সাইজে পরিবর্তিত হয়।
◆ ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত হয়ে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের পৌষ – মোট ৭ বছরে ৮১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।
৮১টি সংখ্যায় ১১টি উপন্যাস ও ১৬৬টি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল।
একটি মাত্র সংখ্যা কার্তিক, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ ছাড়া বাকি ৮০টি সংখ্যাতেই কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।
এছাড়াও প্রায় ৫০টি অনূদিত গল্প প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোলের পাতায়।
--------------------০০০০০০--------------------_---
৫. কালিকলম
কল্লোল পত্রিকার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল মূরলীধর বসুর। কল্লোলের জন্য লেখা সংগ্রহে তার তৎপরতার অভাব ছিল না। কিন্তু তাঁর নিজস্ব পত্রিকা ‘সংহতি’ বন্ধ হয়ে গেলে একটা নতুন পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন, আত্মপ্রকাশ ঘটল কালিকলম পত্রিকার।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তরর কথায় –
“কল্লোল ও কালিকলম যেন একই মুক্ত বিহঙ্গের দুটি দীপ্ত পাখা।”
◆ পত্রিকা প্রকাশ ◆
● কালিকলম একটি সচিত্র মাসিক সাহিত্য পত্রিকা।
● পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ বৈশাখ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।
● পত্রিকাটি মুরলীধর বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হত।
এদের সঙ্গী ছিলেন বরদা এজেন্সীর কর্ণাধর শিশির কুমার নিয়োগী। সাহিত্যপ্রাণ শিশির কুমার পত্রিকার জন্য অর্থ যোগাতেন।
● কালিকলম পত্রিকা প্রকাশিত হত কলেজস্ট্রিটের মার্কেটের বরদা এজেন্সি থেকে।
● কালিকলম পত্রিকার প্রতি সংখ্যার দাম ৪ আনা। বার্ষিক ডাক মাশুল – সাড়ে ৩ টাকা।
● পত্রিকাটি প্রতি মাসের ৩০ তারিখ প্রকাশিত হত।
◆ প্রকাশ্য বিষয় ◆
● কালিকলমকে সচিত্র মাসিক পত্র হিসাবে আখ্যাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকার শুরুতে তৃতীয় বর্ষের দ্বাদশ সংখ্যা পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত পাতা জোড়া ছবি ছাপা হয়েছে। সেখানে কখনো আলোক চিত্র বা হাতে আঁকা ছবি প্রকাশ পেয়েছে।
● চয়নিকা নামে একটি বিভাগ ছিল যেখানে অন্যান্য পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে প্রথিতযশা লেখকদের লেখা সংকলিত হত।
● আবার অনেক গানের সঙ্গে গানের স্বরলিপিও প্রকাশ পেত কালিকলমের পাতায়।
● এছাড়া প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস প্রকাশিত হত কালিকলমের পাতায়।
● প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জীবনানন্দ দাশের ১৭টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল কালিকলমের পাতায়।
◆ কালিকলম পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে প্রথমে প্রেমেন্দ্র মিত্র পরে শৈলজানন্দ সরে যান।
১৩৩৩ বঙ্গাব্দে পত্নী নীলিমা বসুর অকাল প্রয়াণে মুরলীধর নিঃসঙ্গ হয়ে যান, প্রবল অর্থ সংকটে পড়েন।
অবশেষে, ক্ষীণতনু কালিকলম পত্রিকা চতুর্থ বর্ষে অর্থাৎ ১৩৩৬ এ চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
জগদীশ গুপ্ত লিখেছিলেন,
“কালিকলমের অকালমৃত্যুর মাঝে আমার নিজেরও সমাধি হইয়াছে এইরূপ অনুভব করিতেছি।”
=============∆∆∆∆∆============
No comments:
Post a Comment