অজিতকুমার চক্রবর্তী
২০শে আগস্ট, ১৮৮৬ বাঙালি সাহিত্যিক। ফরিদপুরের মঠবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদ করে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করে তোলেন। তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা এবং সুকন্ঠ গায়ক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সদ্য বিএ পাশ করেছেন তখন। বিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি, বাংলা ও ভূগোলের শিক্ষক। পাশাপাশি নাট্যাভিনয়, পত্রিকা সম্পাদনা, লেখালিখি। সঙ্গীতশিক্ষকের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। রবীন্দ্র-সহযোগী হয়েছেন নানা গ্রন্থ প্রকাশের কাজেও। এরই ফাঁকে বিলেত যাত্রা। চার মাস আগে বিয়ে করেছেন আশ্রমকন্যা লাবণ্যলেখাকে। বিলেতে গিয়ে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় মাস চারেকের মাথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশে ফিরে আসতে হয়। এসে শুরু করেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ বইটির কাজ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বইটিকে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রথম প্রবেশক বলে উল্লেখ করেছেন। ‘আত্মপরিচয়’ আর ‘জীবনস্মৃতি’র মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ বইটি, লেখা হচ্ছে ‘জীবনস্মৃতি’র সমসময়ে। ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয় ১৩১৮ সালের আষাঢ়-শ্রাবণে। বই হয়ে বেরোয় পরের বছর পৌষে। ভাদ্র ১৩১৮ থেকে ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত হয় ‘জীবনস্মৃতি’।
অজিতকুমারের বিবাহোত্তর জীবনে সপরিবার শান্তিনিকেতনে বাস, পরে স্থানাভাবের কারণে গিরিডিতে স্থানান্তর, আশ্রমের কাজকর্ম ও আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত কিছু অনুযোগ, পুনরায় অজিতকুমারকে রবীন্দ্রনাথ ও আশ্রমের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে। স্ত্রী লাবণ্যলেখাকে লিখিত একটি পত্রে মনের সেই ক্ষোভ অজিতকুমার সোজাসুজি জানিয়েছেন— মূল নিবন্ধে শ্রীভট্টাচার্য তা উল্লেখও করেছেন। পত্রের অন্য একটি অংশে অজিতকুমার তাঁর প্রতি অ্যান্ড্রুজ়ের প্রবল বিরাগ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে পরে জানাচ্ছেন, ‘‘...আমি অবশ্য গুরুদেবকে তখনি লিখলাম যে আমাকে বিদ্যালয় থেকে সরাবার ইচ্ছা হলে স্পষ্ট বলাই ভালো... যেদিন আমায় জানাবেন যে তোমায় চাইনা, সেদিনই চলে যাব। গুরুদেবের সঙ্গে কথাবার্ত্তাও তারপর হয়ে গিয়েছে— আমি বলেছি— আমি হতভাগ্য— অযোগ্য আমায় যদি আপনি ভুল বুঝবেন এই সম্ভাবনাই থাকে তাহলে আমায় বিদায় করে দিন। তিনি শুধু বললেন— আমি ভুল বুঝেছিলুম।’’
রবীন্দ্রনাথ সত্যিই ভুল বুঝেছিলেন কি না সে তথ্য পাওয়া মুশকিল, কিন্তু অজিতকুমার যে আশ্রম ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন তা অত্যন্ত স্পষ্ট হতে থাকে। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির প্রতিটি ছত্র জুড়ে ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রণালী সম্পর্কে ক্ষোভ, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ ভাবের লোকের সমাবেশ জানিয়ে অভিযোগ ইত্যাদি এবং মন্তব্য— ‘‘আমার চিত্ত কিছুতেই ইহার সঙ্গে সায় দিতে পারে না।’’ অজিতকুমারের এই চিত্তবিক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। তিনি যথেষ্ট হতাশ হয়েই অজিতকুমারকে লিখেছেন— ‘‘কখনো কোনো অবস্থায় তোমার মন যেন সংসারের ওকালতি করে নিজেকে না ভোলায়। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি সংসার আমাদের আইডিয়ালকে যখন খর্ব করার চেষ্টা করে তখন তার মত সঙ্কট আর নেই।... তোমার কাছে কিছু গোপন করা অন্যায় মনে করেই আজ আমি বলচি আমার মনে কিছুদিন থেকে এই আশঙ্কা জেগেছে তোমার নতুন সংসার তোমাকে নীচের দিকে ভারগ্রস্ত করতে আরম্ভ করেছে। এক দিন এমন আশা ছিল যে উপরের পথে চলবার দিকেই তোমার দাম্পত্য জীবন তোমার পাথেয় জোগাবে। কিন্তু আমি হয়ত ভুল বুঝচি— তবু এই শঙ্কাই নানা ছোটবড় কথায় ও ঘটনায় আমার মনে জেগেছে যে ঠিক সে রকমটি হয়নি বরং তার উল্টো হয়েছে এবং তোমাকে এতে খানিকটা পরাভূতও করেছে।
আমার এই কথাটা সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক এই কথা মনে আনা ও প্রকাশ করার দরুণ তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো।’’
অজিতকুমার ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ-সম্পর্ক অজিতকুমারের শান্তিনিকেতন ত্যাগের পরও অটুট ছিল, কিন্তু অজিতকুমার তাঁর প্রতি কবির স্নেহশূন্যতা কিংবা শ্রদ্ধাশূন্যতার অভিমান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। সেই রকমই কোনও প্রসঙ্গ থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘তুমি লিখেছ আমি তোমাকে প্রত্যক্ষভাবে কিছু দিতে পারিনি। সে কথাটা ঠিক— আমি কাউকেই সেভাবে কিছু দিতে পারিনে।’’ নিজেকে গুরুর আসনে বসিয়ে অন্যের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থ চেষ্টা করা ছিল রবীন্দ্রস্বভাব-বিরোধী। বস্তুত অজিতকুমারকে স্বীকৃতিদানে রবীন্দ্রনাথের কার্পণ্য কোথাও দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে বলা যায় না।
‘আত্মপরিচয়’ থেকে ‘জীবনস্মৃতি’র বয়ানে যে বদল, তাতে কি অজিতকুমারের ‘রবীন্দ্রনাথ’ রচনার ভূমিকা আছে? শিশিরকুমার দাশ লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘কবিজীবনী’ থেকে জীবনের সমস্ত ‘বৃত্তান্ত’ বাদ দিতে চেয়েছিলেন। অজিতকুমার জীবনী-রচনায় ইতিহাসের আদর্শকে অস্বীকার করলেন না, বরং জীবনচরিত ও কাব্য উভয়কেই মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। কবির অন্তর্জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টা, কাব্য ও জীবনের সম্পর্ক সন্ধানের চেষ্টাও এই প্রথম।
বত্রিশ বছরের জীবনে মহর্ষি, রামমোহন ছাড়াও জিশুর জীবনী লিখেছেন। পত্রপত্রিকায় ছড়ানো রচনা, অনুবাদ ছাড়াও আছে বারোটি বই। ছিলেন ‘তত্ত্ববোধিনী’র সম্পাদক। তবুও যেন তিনি স্বীকৃতিহীন। বিলেতে ‘সোনার তরী’র কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন সত্ত্বেও তা প্রকাশ পায়নি। কবির অনেকগুলি রচনার অজিত-কৃত অনুবাদ হয় প্রকাশিত হয়নি, হলেও চেপে যাওয়া হয়েছে অনুবাদকের নাম।
অজিতকুমার চক্রবর্তী ১৮৮০ সালের ২০ আগস্ট ফরিদপুর জেলার মঠবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শ্রীচরণ চক্রবর্তী ও মাতা সুশীলা দেবী।
রচিত গ্রন্থ
- রবীন্দ্রনাথ (১৯১২)
- কাব্যপরিক্রমা (১৯১৪)
- মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১১)
- রামমোহন চরিত (১৯১৬)
১৩২৫ সনের ১৪ পৌষ তার মৃত্যু হয়..তেতলার খোলা ছাদ রোদে ভরে গেছে তখন। তিনি শুয়ে আছেন— যেন ঘুমিয়ে আছেন— মুখখানা হাসিতে যেন উদ্ভাসিত। মা পায়ের কাছে নীরবে চোখ বুজে হাতজোড় করে বসে— চোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরে পড়ছে।
স্মৃতি ছুঁয়ে এ বর্ণনা অমিতা ঠাকুরের। পিতা অজিতকুমার চক্রবর্তীর মৃত্যু-মুহূর্তের সেই বর্ণনায় যুক্ত হয়ে যাবেন সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় এবং তাঁর স্ত্রী। তাঁরা গান ধরলেন, যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে...। ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৮ চলে গেলেন রবীন্দ্র-স্নেহধন্য অজিতকুমার, কলকাতার ৯৪/১ বি, গড়পার রোডের বাড়িতে। অসমাপ্ত রইল রামমোহনের জীবনী রচনার কাজ, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের অনুরোধে যা শুরু করেছিলেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা, তখন যা ‘যুদ্ধজ্বর’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল, তাতেই মৃত্যু হল তাঁর।
অজিতকুমারের মৃত্যুর তিন দিন পর, ১৯১৯-এর ১ জানুয়ারি জগদীশচন্দ্র বসুকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অজিতের অকাল-মৃত্যুতে সাহিত্যের ক্ষতি হবে। তার গুণ ছিল— সে সম্পূর্ণ নির্ভীকভাবে সকল পক্ষের বিরুদ্ধে এবং প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ করতে পারত। ঠিক বর্তমানে সে রকম আর কোনো বাংলা লেখক ত মনে পড়ছে না।’’ আর একটি চিঠিতে অমল হোমকে লিখছেন, ‘তার (অজিত) যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি সে দিয়েছে আমাকে ঘিরে। ইদানীং সে একটু দূরে সরে গিয়েছিল, সেটা একদিক থেকে ভালই হয়েছিল তার স্বাতন্ত্র্যবিকাশে।’
তা-ই যদি হয়, তবে স্ত্রী লাবণ্যলেখাকে অজিত কেন লিখবেন, ‘গুরুদেবের কাছে আদপে যাই না। কারণ তাঁর সঙ্গে বেশি মিশলে লোকের হিংসার উদ্রেক হয় এবং তা ছাড়া আমি মনেই ভেবেছি যে আমি তাঁর সঙ্গে কাজের সম্বন্ধ ছাড়া কোনো সম্বন্ধ বাহিরে রক্ষা করব না। ভিতরে যা কিছু আছে তা ভিতরেই থাক।’ লিখেছেন, ‘আসল কথা হচ্ছে গুরুদেবেরই মোটে আমার উপর স্নেহ নেই— স্নেহ সামান্য থাকলে শ্রদ্ধা ও আশা কিছুই নেই। সেই জন্যে আমাকে আঘাত করা যার তার পক্ষে সহজ। এণ্ডরুজ যে গুরুদেবকে বলতে সাহস পেল যে আমি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে কোন কাজের নই— এটা গুরুদেব বরদাস্ত করলেন তো? তিনি যদি সামান্য প্রতিবাদটুকু করতেন তবেই এসব সমালোচনা কবে নিরস্ত হয়ে যেত।’ রবীন্দ্রনাথও কি ভুল বুঝেছিলেন?
যন্ত্রণা নিয়েই শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছিল অজিতকুমারকে। প্রশান্তকুমার পাল ‘রবিজীবনী’তে জানাচ্ছেন, আর্থিক ও অন্যান্য কারণে বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠছিল। বিদ্যালয় ছেড়ে মহর্ষির জীবনী রচনার জন্য বৃত্তি নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। তখন ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে অজিতকুমার। কিন্তু আশ্রমের প্রতি টান আর গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট ছিল তাঁর। আশ্রমে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিও দেন তিনি। ১৯১৮-র ২৮ অক্টোবর লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি তার প্রমাণ। ‘শান্তিনিকেতনে তোমার আসা সম্বন্ধে এখনো কিছুই স্থির করিনি।... এখানে স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্যে একটা কোনও উপায় বোধ হয় শীঘ্র করা যেতে পারবে।’
∆∆∆∆∆\\\\\\\\\ lllllllllllllll∆∆∆∆∆∆∆∆===
No comments:
Post a Comment