আরণ্যক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
চতুর্থ উপন্যাস। ১৯৩৯ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারে তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাসটি রচনা করেন। আরণ্যক উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৩৭-৩৯ খ্রিষ্টাব্দ। "কাত্যায়ণী বুক স্টল" থেকে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বই হিসাবে প্রকাশের আগে প্রবাসী মাসিক পত্রিকায় কার্তিক ১৯৩৮ থেকে ফাল্গুন ১৯৩৯ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ এই উপন্যাসটি অকালে-লোকান্তরিতা তার প্রথমা স্ত্রী গৌরী দেবীকে উৎসর্গ করেন।
১৯২৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি 'স্মৃতির রেখা'তে তিনি লিখছেন,
“ | এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো - একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি।এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার - এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা।মাঝে মাঝে, যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে শুড়ি পথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েচে দেখা গেল, ঐ রকম শুড়ি পথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্চে - পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র, সরলতা, এই virile, active life, এই সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি এই সব. আরণ্যক'এ উল্লিখিত গোষ্ঠবাবু মুহুরী, রামচন্দ্র আমীন, আসরফি টিন্ডেল, জয়পাল কুমার, পণ্ডিত মটুকণাথ এবং রাখাল ডাক্তারের স্ত্রীর কথা ঐ দিনলিপিতেও পাওয়া যায়। চরিত্র : সত্যচরণউপন্যাসের নায়ক হলেন সত্যচরণ — একজন তরুণ যুবক, যাকে কাজের সন্ধানে কলকাতার বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। একসময় সে জঙ্গলে একটি চাকরি পেয়ে যায়। সে তথাকথিত সভ্যজগতের সাথে বনের সেতুবন্ধন। এই চরিত্রটির উপস্থিতি ছাড়া গল্পে না বলা দুই জগতের তুলনা, যা প্রায় উপন্যাসটির প্রতি জায়গায় লুকানো ছিল তা সম্ভব হত না। সত্যচরণ এই উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র। যদিও তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে করাটা অনেক বড় ভুল হবে। সে একজন বহিরাগত, যার সাথে জঙ্গল অথবা জঙ্গলের লোকদের কোন সম্পর্ক নেই। জঙ্গলের রহস্যভরা মঞ্চে প্রতিদিন মঞ্চায়িত হওয়া নাটকের সে শুধুমাত্র একজন দর্শক। সে শুধুমাত্র বাইরে থেকে এই নাট্যাভিনয় দেখতে পারে, কিন্তু এতে যোগ দেওয়ার সক্ষমতা তার নেই। মূলত আরণ্যক উপন্যাসে কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। জঙ্গলই হলো এর কেন্দ্রীয় চরিত্র, যা প্রতিক্ষেত্রেই নিজের সৌন্দর্য এবং এর মধ্যে লোকজনের জীবনাচার দ্বারা নিজের পরিচয় দেয়। সত্যচরণ এই সবকিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার প্রখর মেধা ও অনুভূতি দ্বারা সে যাকিছু দেখে তা বুঝতে ও উপভোগ করতে পারে, কিন্তু সে এসব কিছুর সাথে মিশে যেতে পারেনা। কারণ সে একজন আগন্তুক, জঙ্গলে তার কোন স্থান নেই। রাজু পাঁড়েজঙ্গলে বহু বিচিত্র চরিত্র রয়েছে। কিন্তু কেউই রাজু পাড়েঁর মত নয়। অতি দরিদ্র,ভীষণ নিরীহ, লাজুক ব্যক্তি — যে সারাদিন পূজা অর্চনা ও গীতা পাঠ করে কাটায়। সত্যচরণ তাকে চাষের জন্য দুই বিঘা জমি দিলেও দুই বছরেও তা সে বন কেটে পরিষ্কার করতে পারেনি। সে শুধুমাত্র চীনা ঘাসের দানা খেয়ে জীবন ধারণ করত। সত্যচরণ তাকে আরও কিছু জমি দিলেও তার অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেনা। আসলে রাজু একজন অর্থ উপার্জনকারী থেকে অনেক বেশি দার্শনিক ও কবি প্রকৃতির মানুষ। ধাতুরিয়াযখন ধাতুরিয়া নামের একটি বালক কাছারিতে নাচ দেখানোর জন্য আসে, তখন তার বয়স বারো অথবা তেরোর বেশি ছিলনা। দক্ষিণে খরার কারণে দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে ঐ অঞ্চলের লোকেরা নাচ দেখিয়ে অর্থ উপার্জনের আশায় বের হয়। ধাতুরিয়া এমনই একটি দলের সাথে এসেছিল। তাকে নাচের জন্য দল থেকে কোন অর্থ দেওয়া হতনা তাকে শুধুমাত্র চীনা ঘাসের দানা অথবা জঙ্গলের কিছু শাকসবজি খেতে দেওয়া হত। আর সে এতেই সন্তুষ্ট ছিল। ধাওতাল সাহুধাওতাল সাহু নওগাছিয়া গ্রামে বাস করে। সে একজন মহাজন, লোকজনকে সুদের বিনিময়ে অর্থ ধার দেয়। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ধাওতাল সাহু একজন মহাজন হওয়ায় একজন খারাপ মানুষ হতে পারে ও জোর করে অর্থ আদায় করে। কিন্তু মোটেও এমনটি নয়। সে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের একজন দয়ালু ও নির্লোভ ব্যক্তি। জঙ্গলের প্রত্যকেই তাকে মহাজন ও লক্ষপতি মনে করে। সকলেই মনে করে তার সম্পদের কোন হিসাব নেই। কিন্তু সে একজন সরল ও নিরহংকারী ব্যক্তি, যার ময়লা জামা পরিধানে অথবা রাস্তা কিংবা গাছের নিচে বসে ছাতু খেতে কোন অসুবিধা নেই। মটুকনাথ পাঁড়েমটুকনাথ একজন ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিত, যে আগে তার গ্রামের টোলে পড়াতো। একসময় তার টোল বন্ধ হয়ে যায়, সে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে এবং একদিন সত্যচরণের অফিসে এসে উপস্থিত হয়। সে মনে করে ম্যানেজারবাবু যদি তাকে অনুগ্রহ করে, তাহলে তার উপার্জনের একটি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অফিসে তার কাজের কোন ব্যবস্থা করা যায়নি কারণ সে এসবের কিছুই বোঝেনা, কিন্তু সে সেখানে কিছুদিন থেকে যায়, যদিও সত্যচরণ এতে কোন আপত্তি করেনি। কারণ হয়তো সে এই সরল এবং সুখী লোকটিকে পছন্দ করে ফেলেছে। যূগলপ্রসাদউপন্যাসের অন্যতম রহস্যময় চরিত্র হলো যূগলপ্রসাদ৷ সে একজন নিঃস্বার্থ প্রকৃতিপ্রেমী। তার লক্ষ্য হলো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জঙ্গলকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য কাজ করা। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সে বিভিন্ন ফুলের বীজ রোপন করে। এতে তার সময় ও অনেক সময় অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু এতেই সে খুশি এবং সকল কাজের মধ্যে এতেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পায়। কুন্তালেখকের ভাষায় কুন্তা একজন সতী ও পবিত্র নারী। সে একজন বাইজীর মেয়ে ছিল। কিন্তু পরে সে একজন রাজপুতকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছু সময় পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়। বেশকিছুদিন পর রাসবিহারী সিং তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে সে তাকে নানা খারাপ প্রস্তাব দেয় এবং নানাভাবে তাকে নির্যাতন করে। এরপর কুন্তা সেখান থেকে পালিয়ে আসে এবং কয়েকদিন পর সত্যচরণ চাষাবাদের জন্য তাকে কিছু জমি দেয়। গল্পের শেষে সত্যচরণ চলে আসার সময় তাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। ভেঙ্কটেশ্বর প্রসাদভেঙ্কটেশ্বর একজন স্থানীয় কবি, যে জঙ্গলের ধারে তার স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করে। একবার সে সত্যচরণের অফিসে এসে তাকে তার লেখা কবিতা শোনায়। এরপর সত্যচরণ তার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করে। মঞ্চীরাজা দোবরু পান্নারাজা দোবরু পান্না সত্যিকারেই স্বল্প সংখ্যাক সাওতালদের রাজা। তিনি একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতার পর তার রাজকীয় ক্ষমতা হারিয়েছেন। তারপরও তার ব্যক্তিত্ব একজন রাজার মতই। সত্যচরণ তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি তাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। দেখা করার কয়েক মাস পর রাজা দোবরু পান্না মৃত্যুবরণ করেন। রাজকন্যা ভানুমতিLater on, Satya goes to Santal Pargana(residence of Doboru). Jagaru Panna is the son of Doboru who has no such influence on the plot. But Bhanumati, grand daughter of Doboru had a friendly relationship with Satya. At the fag end of the novel, when Satya is about to leave the forest for ever, he goes to visit Bhanumati for the last time. We find much to our exclaim that on his return Satya thinks If I could marry Bhanumati and build a happy nest for us.. Bhanu would speak out of some imaginative giant, and I would be her listener..but that is a dream and dream can never be true.... রাসবিহারী সিংরাসবিহারী সিং একজন নিষ্ঠুর ও অহংকারী মহাজন, যে তার লাঠিয়াল বাহিনীর সাহায্যে গরীব গাঙ্গোতাদের থেকে নানা অত্যাচারের মাধ্যমে ঋনের অর্থ আদায় করে। সত্যচরণের সাথে তার সরাসরি কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু সে নানাভাবে সত্যচরণকে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। হলি উৎসবের সময় একবার সে নিজের সম্পদ ও প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য সত্যচরণকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ করে। সে কুন্তার উপরও অত্যাচার চালায়। নন্দলাল ওঝাউপন্যাসের স্বল্পসংখ্যক খারাপ লোকের মধ্যে নন্দলাল ওঝাঁ একজন। সে জানে নিজের সুবিধার জন্য অন্য লোকদের থেকে কিভাবে কার্যসিদ্ধি করা যায়। যে তাকে খুশি করতে পারে না সে তার শত্রুতে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষেই সে একজন ভয়ানক ব্যক্তি। আলোচনা |
বেদনাবোধ, প্রকৃতিপ্রীতি, ইতিহাসবোধ ও রোমান্টিকতা
ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) অবস্থান স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। সমকালীন কথা সাহিত্যে তিনি সংযোজন করেন এক স্বতন্ত্র মানবচেতনা, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক মূল্যবোধ, আবেগ - সংবেদনাময় কর্মপ্রবাহ এবং জ্যোতির্ময় মনন ও প্রজ্ঞা। ব্যক্তির অবিরাম বিনষ্টকে নয় বরং অনিঃশেষ সম্ভবনাকেই তিনি শিল্পধারায় সিঞ্চন করেছেন। শহুরে জীবনে বহুমাত্রিক চালচিত্রের পাশাপাশি তিনি অঙ্কন করেছেন শহরবিচ্ছিন্ন অরণ্য লালিত অন্ত্যজ ও প্রান্তিক বিপুল মানুষের জীবনচিত্র।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রক্তসূত্রে ছিলেন একজন প্রকৃতিপ্রেমী শিল্পী। শৈশবের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কর্মজীবনেও তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কলকাতা, নাগপুর, ভাগলপুর নামক স্থানগুলোতে। ফলে তাঁর প্রকৃতিচেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে এসব পুরনো অভিজ্ঞতাগুলো। শুধু বাংলা দেশই নয় বর্হিবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিচিত্র প্রকৃতি ও নানা স্বভাবের মানুষ তাকে আকর্ষণ করেছিল। এই অভিজ্ঞতাগুলোই হচ্ছে তাঁর মনন ও শিল্প চেতনার মূল উপাদান। যথারীতি তাঁর উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে গ্রাম ও অরণ্যের দ্বৈত পটভূমি। আধুনিক যুগের জটিলতা, রোমান্টিকতা ও স্বপ্নের বিহ্বলতার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নগর ও অরণ্যের পটভূমিতে। এই ধরনের অরণ্য কেন্দ্রিক একটি বিশেষ উপন্যাস হচ্ছে "আরণ্যক(১৯৩৯)"। অপরাজিত উপন্যাসে অমরকণ্টক এর ভৌগোলিক পটভুমিতে অরণ্যের যে প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছিল তা ব্যাপক ও বিস্তৃত ভাবে উঠে এসেছে " আরণ্যক " উপন্যাসে। এ প্রসঙ্গে ডঃ ক্ষেত্রগুপ্ত বলেছেন,
"এও পথের পাঁচালী, আর এক পথের পাঁচালী, যে পথ জনহীন আদিম অরণ্যের মধ্য দিয়ে অরণ্য ধ্বংসকারী ঘন বসতির দিকে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে। "
বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কুশী নদীর অপর পারের অরণ্যময় বিস্তৃত অঞ্চলটি হচ্ছে " আরণ্যক" উপন্যাসের মূল পটভূমি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসপুত্র অপুর পরিবর্ধিত রূপ হচ্ছেন আরণ্যক উপন্যাসের কথক সত্যচরণ। তিনি নাগরিক সভ্যতার প্রতিনিধি হিসেবে বন কেটে বসতি স্থাপন করার লক্ষ্যে এখানে এসেছেন। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের চিন্তায় কাজ করেছে শিল্পায়নের যুগে অরণ্য ধ্বংসের দিকটি। আরণ্যক উপন্যাসের প্রকৃতি শুধু নগর কলকাতা থেকেই নয়, সমগ্র বাংলা দেশের প্রকৃতির প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা। লেখক এখানে শহরবাসী সত্যচরণ ও অরণ্যজীবনের মধ্যে জনতা ও নির্জনতার মধ্যকার বিরোধকে তুলে ধরেছেন। আর এ বিরোধের যথার্থ পটভূমি হিসেবে ঔপন্যাসিক বেছে নিয়েছেন উক্ত বঙ্গ বহির্ভূত অঞ্চলটি। যেখানে অরণ্য ধ্বংসকারী একজন মানুষ ধীরে ধীরে লবটুলিয়ার নির্জনতম প্রকৃতির প্রেমে পড়ে, সেখানকার মানুষের ঐহিত্যকে নিজের মধ্যে লালিত করতে চেয়েছিলেন।
'নিতান্ত নব আগন্তুক ' তার কাছে ওখানকার মানুষ বর্বর, ভয় অবিশ্বাসই সত্যচরণকে ঘিরে রেখেছিল। ব্যক্তি হিসেবে অভ্যন্তরীণ ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সত্যচরণ মানুষদের সঙ্গে মিশতে চায়। কিন্তু তার ঐতিহাসিক ভূমিকা বহিরাগত ঔপনিবেশদের মতোই থাকে, সে নিজেই ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। উপন্যাসের 'আমি ' সত্যচরণকে মধ্যশ্রেণীর লোক হিসেবে তুলে ধরেছেন লেখক। উপন্যাসের শুরুর দিকে সত্যচরণ্যের একাকীত্বের ছাপটি লেখক তুলে ধরেছেন গভীরভাবে। লবটুলিয়া আজমাবাদের মতো নির্জনতম অরণ্যমণ্ডিত এলাকায় তাঁর অসহায় অবস্থা যেন করুণ। এদেশের মূর্খ, বর্বর মানুষের সাথে সে কিভাবে দিনের পর দিন থাকবে তা সে যেন কল্পনাই করতে পারে না ; বহু মানুষের ভিড় যেন অপরিহার্য হয়ে ওঠে তার কাছে। বহু মানুষের ভিড়ের বিচ্ছিন্নতার বোধ এই নির্জনতম অঞ্চলে এসে যেন সত্যচরণের মনে ধরা দেয়।
" পূর্বে কি জানিতাম মানুষের মধ্যে থাকিতে এত ভালোবাসি। মানুষকে এত ভালোবাসি! "
সত্যচরণের এই উপলব্ধি ঔপন্যাসিকের অন্তর্মুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচালক। কিন্তু আরণ্যক উপন্যাসের বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে অন্য জায়গায়। এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের রোমান্টিক চেতনাকে ছাপিয়ে প্রকট হয়েছে তাঁর যুগ সচেতনতা। লবটুলিয়া, আজমাবাদ, ফুলকিয়া বইহার এর প্রকৃতির রূপ ও ঋতুর খেলা সত্যচরণকে যতটা ভাবুক বানিয়েছে ; তার থেকে বেশি প্রভাবিত করেছে বুনো মানুষের সহজ সরল জীবন প্রণালী। সত্যচরণকে দৃষ্টি ভঙ্গি ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে। পাশাপাশি অরণ্যচারী মানুষের সঙ্গে নায়কের কথোপকথনে আরণ্যক উপন্যাসের মূল সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নগরায়ন ও অরণ্য ধ্বংসের মাঝে যে সূক্ষ্ম বেদনার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে তার করুন আর্তি ধ্বনিত হচ্ছে।
পূর্নিমা নিশীথিনীর অবর্ণনীয় জ্যোৎস্নাই লেখককে মুগ্ধ করে বারবার। মধ্যবিত্ত মানসিকতার সত্যচরণের কাছে প্রকৃতি আসে রোমান্টিক ভাবনায়, নারীর চিত্রকল্পেঃ
" কত রূপে কত সাজেই যে বন্যপ্রকৃতি আমার মুগ্ধ অনভ্যস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া আমায় ভুলাইল!"
এখানে অরণ্য মন ভোলানোর চিত্রকল্পে আসে না। অরণ্য এখানে মানুষকে নির্মাণ করে, তার চরিত্রের বিকাশে, পরিবেশের সঙ্গে লড়াইয়ের উপাদানকে দৃঢ় করে তুলতে।
আরণ্যক উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্র্যের উপর বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি দেখান ওই দারিদ্র্য, ওই বৈষম্য সত্ত্বেও মানুষ বাঁচে, সতেজভাবে বাঁচে, প্রকৃতির সঙ্গে।
আরণ্যক উপন্যাসে লেখক যে প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা বলেছেন, ( মটুকনাথ, মঞ্চি, ভানুমতী, রাজু পাড়ে, ধাতুরিয়া) এরা গয়া জেলা জানে, ভারতবর্ষ জানে না। তাদের চৈতন্য মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শহরের শ্রেণীর জাতীয়বাদ থেকে ভিন্ন। এখানে বৈপ্লবিক মধ্যশ্রেণীর সূচনা ও বিকাশ ঘটে নি। সে কারণেই বিভূতিভূষণের কাছে সাধারণ মানুষ গুলো হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ, যাদের মধ্যে সত্যচরণ আবিষ্কার করেছিলেন যথার্থ পুরুষ মানুষকে।
বিভূতিভূষণের প্রকৃতি চেতনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর ইতিহাসবোধ। তাঁর প্রকৃতি শুধু মানবিক নয়, ঐতিহাসিকও বটে।সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্না ও তার পরিবারের সান্নিধ্যে এসে সত্যচরণের নতুন উপলব্ধি ঘটেছে। আর্য ও অনার্য এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে লড়াই চলছে তা দেখে সত্যচরণ বিস্মিত হয়েছেন৷ শুরু থেকেই নির্জনতা ও জনতার মধ্যে যে বিরোধ দানা বেঁধেছিলো তা আরো প্রবল হয়েছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর বিরোধের পটভূমি স্থানান্তরিত হয়েছে। এভাবে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে জাতিগত বিরোধের ট্রাজিক আখ্যান। অরণ্য তার অন্তরে লুকিয়ে রেখেছে বহুকালের বঞ্চনার ইতিহাস, যা সময়ের ধারায় আজও প্রবাহমান। রাজ্যহীন রাজা দোবরু পান্না ও রাজকন্যা ভানুমতী হচ্ছেন সেই ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী। বাংলার শান্ত পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে অরণ্যচারী অধিবাসীদের না দেখলে সত্যচরণের এই উপলব্ধি হতো কিনা তা বলা মুশকিল। সত্যচরণের মতে,
" ওকে দেখিলেই অলিখিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক অধ্যায় আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে। "
রাজকন্যা ভানুমতীর কাছে ভারতবর্ষ হচ্ছে এক অজানা জগৎ। তার সঙ্গে কথা বলে সত্যচরণ নিজের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছেন। পরাজিত আত্মার সমাধির উপর সভ্যতার যে তাজমহল তৈরি হচ্ছে এর স্থায়িত্ব নিয়ে সত্যচরণ প্রশ্ন তুলেছেন। আধুনিক সভ্য সমাজের কাছে তার এই প্রশ্ন উপন্যাসটিতে দলীয় সংঘর্ষের জীবন্ত দলিল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আরণ্যক উপন্যাসের বাস্তবতার প্রতিপাদনে বঙ্গ বহির্ভূত পটভূমি কত প্রবল সে সম্পর্কে শিশিরকুমার দাশ বলেন,
" বিহারের কুশী নদীর অপর প্রান্তের অরণ্যভূমির বাকি ইতিহাস অবশ্যই আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। কিন্তু জানি সে ইতিহাস অরণ্য হননের ইতিহাস। সেই সঙ্গে জানি আরণ্যক এ শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় দুই ভারতবর্ষের কাহিনী। "
এক পরিবারের ভিতরে যেমন থাকে চূড়ান্ত শ্রেণিগত পার্থক্য, তেমনি এক রাষ্ট্রের মধ্যেও আছে দুই ভারতবর্ষ। কোথাও সমৃদ্ধি, কোথাও দারিদ্র্য বঞ্চনা। আরণ্যক উপন্যাসে লেখক এ রকম চিত্রই তুলে ধরেছেন । এই উপন্যাসে মধ্যবিত্ত চেতনা, ইতিহাস বোধ সবই রয়েছে।
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷∆∆∆∆∆∆∆÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
No comments:
Post a Comment