সৈয়দ মুজতবা আলী
বাংলা ভাষার একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। প্রধানত রম্যলেখক হিসেবে সুপরিচিত হলেও এই একটিমাত্র শব্দে পরিচয় দিতে গেলে সেটি তার অগাধ পান্ডিত্যকে খর্ব করবে। যার দখলে আঠারোটি ভাষা, রাশিয়ান ভাষার উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ হয়েছে যার হাতে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট, বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক, মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, গীতা থেকে গীতবিতান যার সম্পূর্ণ মুখস্ত- শুধুমাত্র পন্ডিত শব্দ দিয়েও তার গুণগান সম্পূর্ণ করা যায়না
প্রবন্ধের মতো গুরুগম্ভীর সাহিত্যকে তিনি রম্যের আঙ্গিকে লিখে পাঠকদের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিলেন। আর এই বিরল আঙ্গিকের লেখনী দিয়ে কোন বিষয়টিকে পাঠকের উপযোগী করে একইসাথে আনন্দদানেরও গুরুদায়িত্ব পালন করেননি? হিটলারের প্রেম থেকে শুরু করে ওমর খৈয়ামের কবিতা কোনোটাই বাদ যায়নি।
'দেশে বিদেশে' মুজতবা আলীর প্রথম বই এবং অনেক সমালোচকের মতে সর্বশ্রেষ্ঠ। তার রসনা ভরা শব্দে বিন্যস্ত বর্ণিল অভিজ্ঞতার সাথে মানুষ প্রথমবারের মতো পরিচিত হয়। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই ভ্রমণকাহিনী। বইয়ের নাম 'দেশে বিদেশে' হলেও এটি মূলত তার আফগানিস্তানের জীবনযাপন এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক কোনো ভ্রমণকাহিনী।
বিষয়বস্তু ও লেখকের বর্ণনা
ভ্রমণকাহিনীটি শুরু হয় হাওড়া স্টেশন থেকে পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রা দিয়ে। দেশত্যাগের সময়ে স্বাভাবিকভাবেই সবার বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে উঠে। অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে ভীষণ একা মনে হয়। লেখকও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম যে ভাবনা আমার মনে উদয় হল সেটা অত্যন্ত কাপুরুষজনোচিত–মনে হল, আমি একা।
ট্রেন যখন তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছিল তিনি সতর্কদৃষ্টিতে জানালার বাইরে বাংলাদেশের পরিচিত কোনো ছবি খুঁজছিলেন। একটি সুপারি গাছ কিংবা একটি আম গাছ হয়তো তার অন্তরে তৃপ্তি দিতে পারত। কিন্তু দেশের সীমানা তিনি পার হয়ে এসেছিলেন বহু আগেই। শুধু বদ্ধ কামরার ভেতরেই একটা হাল্কা সোঁদা গন্ধ যেন মলিন স্মৃতিকাতরতায় তাকে বারে বারে ধাক্কা দিচ্ছিল।
ট্রেন এগোনোর সাথে সাথে মুজতবা আলীর দুলকি চালের বর্ণনাও এগোতে থাকে। কখনো তার বর্ণনায় চলে আসে ভৌগোলিক বর্ণনা, কখনো বা স্থানীয় মানুষের বর্ণনা আর এরকম কাঠখোট্টা বিষয়ক আলোচনাগুলোও তার কথার রসে এমনভাবে সিক্ত যে পাঠক সে রস আস্বাদন করতে বাধ্য। সাথে তার স্বাভাবিক রসিকতা যুক্ত তো হয়েছেই।
লেখকের বর্ণনায় পাঠানদের আন্তরিকতা ও আড্ডার মনোভাবের বেশ ভালো ছবি ফুটে উঠেছে। যখন আপনদেশ ছেড়ে আসার ফলে তার মন বেশ বিপর্যস্ত, এক পাঠান বৃদ্ধ তা খেয়াল করে তখন নিজ থেকেই আলাপ শুরু করে দিলেন। সে আলাপ যে ব্রিটিশদের মতো সংক্ষিপ্ত, সাবধানী নয় তা-ও লেখক উল্লেখ করতে ভোলেননি।
সামনের বুড়ো সর্দারজীই প্রথম আলাপ আরম্ভ করলেন। ‘গোয়িঙ ফার?’ নয়, সোজাসুজি ‘কহাঁ জাইয়েগা?’ আমি ডবল তসলীম করে সবিনয় উত্তর দিলুম ভদ্রলোক ঠাকুরদার বয়সী আর জবরজঙ্গ দাড়ি-গোঁফের ভিতর অতিমিষ্ট মোলায়েম হাসি। বিচক্ষণ লোকও বটেন, বুঝে নিলেন নিরীহ বাঙালী কৃপাণবন্দুকের মাঝখানে খুব আরাম বোধ করছে না।
বাইরে থেকে পাঠানদের শুষ্ক, রসকষহীন মনে হলেও একবার আলাপ হলেই তারা যে কাউকে আপন করে নেয়। গল্পের বেশিরভাগ যদিও নিজেদের গোষ্ঠী আর জাতির কথা কিন্তু তাতে করে তাদের চিন্তাভাবনা আত্মকেন্দ্রিক ভাবলে ভুল হবে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের মেহমানদারিতে। গরীব জাতি হলেও মেহমানদারিতে তাদের কোনো কমতি নেই। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেহমানদারী করার ইচ্ছা টাকা থাকা না থাকার উপর নির্ভর করেনা।
তারা গল্পগুজব না করে সময় কাটাতে পারে না। এই আড্ডার অজুহাতে তারা বেশ মজাদার কাজকর্ম করে থাকে।
গল্পগুজব না করে সে এক মাইল পথও চলতে পারে না। কাউকে না পেলে সে বসে যাবে রাস্তার পাশে। মুচীকে বলবে, দাও তো ভায়া, আমার পয়জারে গোটা কয়েক পেরেক ঠুকে। মুচী তখন ঢিলে লোহাগুলো পিটিয়ে দেয়, গোটা দশেক নূতনও লাগিয়ে দেয়। এই রকম শখানেক লোহা লাগালে জুতোর চামড়া আর মাটিতে লাগে না, লোহার উপর দিয়েই রাস্তার পাথরের চোট যায়। হাফসোল লাগানোর খরচাকে পাঠান বড় ভয় করে কিনা। সেই পেরেক আবার হরেক রকম সাইজের হয়। পাঠানের জুতো তাই লোহার মোজায়িক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, লোহা ঠোকানো না-ঠোকানো অবান্তর–মুচীর সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য ঐ তার অজুহাত।
পাঠানরা অলস এবং আড্ডাবাজ জাতি হলেও তারা আরামপ্রয়াসী নয়। গালগল্প আর আড্ডায় মশগুল থাকা স্বভাবের ভেতরে তাদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম আবিষ্কার করে মুজতবা আলী অবাক হয়েছেন। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ অপরিপক্ক হওয়ায় তাদের রাজ্য কখনো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ওভাবে চোখে দেখেনি। অভাবের তাড়নায় তাই তারা লুটতরাজ করে বেড়ায়। তাদের কতগুলো গোষ্ঠী রয়েছে যেমন আফ্রিদী, শিনওয়ারী, খুগিয়ানী যাদের মধ্যে সারাবছরই মারামারি লেগে থাকে।
আফগান আইনে খুন খুব বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ‘খুনের বদলা খুন’ এই নীতিতেই আফগানরা বিশ্বাসী। অন্যান্য সভ্য দেশকে অনুসরণ করে যদিও তাদের পথেঘাটে কিছু সংখ্যক পুলিশ রাখা হয় কিন্তু এই পুলিশেরা এসব খুনখারাবির ব্যাপারগুলোতে বেশ উদাসীনই থাকে। লেখক তার হাস্যরসাত্মক ভাষায় এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
তবু আফগানিস্তান স্বাধীন সভ্য দেশ; আর পাঁচটা দেশ যখন খুনখারাবির প্রতি এত বেমালুম উদাসীন নয় তখন তাদেরও তো কিছু একটা করবার আছে এই ভেবে দুচারটে পুলিশ দু-একদিন অকুস্থলে ঘোরাঘুরি করে যায়। যদি দেখে আপনার আত্মীয়স্বজন কা তব কান্তা দর্শনে বুদ হয়ে আছেন অথবা শোনে যে খুনী কিম্বা তার সুচতুর আত্মীয়স্বজন আপনার আত্মীয়স্বজনকে চাকচিক্যময় বিশেষ বিরল ধাতুদ্বারা নাক কান চোখ মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, আপনারা জীবনের এই তিনদিনের মুসাফিরীতে কে দু ঘন্টা আগে গেল, কে দু ঘণ্টা পরে গেল, কে বিছানায় আল্লা রসুলের নাম শুনে শুনে গেল, কে রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে খাবি খেয়ে খেয়ে পাড়ি দিল এসব তাবৎ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, তবে বিবেচনা করুন, মহাশয়, পুলিশ কেন মিছে আপনাদের তথা খুনী এবং তস্য আত্মীয়স্বজনদের মামেলায় আরো ঝামেলা বাড়িয়ে সবাইকে খামকা, বেফায়দা তত্ব করবে?
গন্তব্যস্থল কাবুলের দিকে লেখকের যাত্রা এগিয়ে যেতে থাকে। পথিমধ্যে নুড়িযুক্ত পথ, মরুভূমির মতো প্রান্তর, আফগান সীমান্তের শুরুতে এক দুর্গ, এক প্রাচীন সরাই, চমৎকার নিমলার বাগান পড়ল। লেখকের চোখে কিছুই এড়াচ্ছিল না। বাসের মধ্যে যাত্রীরা কে কী রকম জামা পড়েছিল। কত অদ্ভুত এবং বাংলার লোকদের থেকে তা কত পৃথক, কত পুরনো সংস্কৃতি ধারণ করে আছে সে জামা সবই তার লেখায় ধরা পড়ছিল। সাথে সে অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা তো রয়েছেই। এত চমৎকার করে ইতিহাস, ভূগোল এবং বাস্তব গল্পের মিশেল সম্ভবত মুজতবা আলীর মতো পান্ডিত্য ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। আরবি-ফারসি যুক্ত সাবলীল হাস্যরসাত্মক ঢং সে লেখাতে আরো নতুন মাত্রা যোগ করেছে
পেশওয়ার থেকে তার কাবুল যাত্রার এই বর্ণনা শুধু সাহিত্য নয়, তথ্যগুণেও অমূল্য। অচেনা এই দেশকে পাঠকের চোখের সামনে ছবির মতো করে তুলে ধরেছেন তিনি। পশ্চিম ভারত আর আফগানিস্তানের শহর গ্রাম সবকিছুই তার লেখনীর জোরে বইয়ের কাগজ ছেড়ে পাঠকের চোখে মোহনীয় দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
অবশেষে রেডিওর ধ্বনি শুনে লেখক বুঝতে পারলেন তিনি কাবুল এসে পৌঁছেছেন। কাবুল ইউরোপের কোনো কিছু অনুসরণ করতে গেলে ফ্রান্সকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেয়। সেখানে বেতারবাণী শুরু হয় ‘ইসি পারি’ বা ‘এখানে প্যারিস’ দিয়ে। লেখকের গাড়িতে ঠিক সেরকমই বেতারবাণী হল ‘ইন্ জা কাবুল’ বা ‘এখানে কাবুল’ বলে।
মুজতবা আলী আফগানিস্তানের ইতিহাসকে ‘অরক্ষণীয়া মেয়ে’র সাথে তুলনা করেছেন তার ইতিহাস লেখা হয়নি বলে। গরীব দেশ বলে প্রত্নতত্ত্ব খোঁজার উদ্দেশ্যে তাদের মাটির নিচে খোঁড়াখুঁড়ি হয়নি। আর সাম্প্রতিক ইতিহাস বিভিন্ন পান্ডুলিপিতে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। লেখক দাবি করছেন, আফগানিস্তানের ইতিহাস না জেনে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পূর্ণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এই ইতিহাস না লেখারও কিছু কারণ রয়েছে। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক সীমান্ত এমনই জটিল যে নিজেদের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হলে তাদেরকে আরো কয়েকটি দেশের ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে।
আফগানিস্তানের উত্তর ভাগ অর্থাৎ বল্খ্-বদখশানের ইতিহাস তার সীমান্ত নদী আমুদরিয়ার (গ্রীক অক্ষুস, সংস্কৃত বন্ধু) ওপারের তুর্কিস্তানের সঙ্গে, পশ্চিমভাগ অর্থাৎ হিরাত অঞ্চল ইরানের সঙ্গে, পূর্বভাগ অর্থাৎ কাবুল জলালাবাদ খাস ভারতবর্ষ ও কাশ্মীরের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা যুগে নানা রঙ ধরেছে। আফগানিস্তানের তুলনায় সুইটজারল্যাণ্ডের ইতিহাস লেখা ঢের সোজ। যদিও সেখানে তিনটে ভিন্ন জাত আর চারটে ভাষা নিয়ে কারবার।
ভারতবর্ষ আর আফগানিস্তানের ইতিহাস এমনভাবে মিলেমিশে রয়েছে যে এই দুই দেশকে আলাদা করে দেখাকে লেখক কুসংস্কার হিসেবে মন্তব্য করেছেন। কুষাণ বংশের দ্বিতীয় রাজা বিম শক এবং ইরানী পার্থিয়ানদের হারিয়ে আফগানিস্তান দখল করেছিলেন। সে সময়ে পশ্চিম ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সংস্কৃতিগত কোনো পার্থক্য ছিল না। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কনিষ্ক তার শেষ বৌদ্ধ অধিবেশনের প্রতিবেদন যে তাম্রফলকে খোদাই করে রেখেছিলেন তা আফগানিস্তানে পাওয়া গেলেও অবাক হওয়ার মত নয়। কারণ কনিষ্ক যতখানি ভারতীয় রাজা ছিলেন ঠিক ততটুকুই আফগান রাজাও ছিলেন। ভারতবর্ষে কুষাণদের পতনের পরেও আফগানিস্তানে তারা দুশ বছর শাসন করেছিল।
ভারতবর্ষের গুপ্তযুগের শিল্পপ্রচেষ্টা আফগান গান্ধার শিল্পের কাছে অনেকখানিই ঋণী বলে লেখক অভিমত প্রকাশ করেছেন। লেখকের ভাষায়:
গুপ্তযুগের শিল্পপ্রচেষ্টা গান্ধারের কাছে কতটা ঋণী তার ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। ভারতবর্ষের সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ কখনো কখনো গান্ধার শিল্পের নিন্দা করেছে–যেদিন বৃহত্তর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শিখব সেদিন জানব যে, ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানকে পৃথক করে দেখা পরবর্তী যুগের কুসংস্কার। বৌদ্ধধর্মের অনুপ্রেরণায় ভারত অনুভূতির ক্ষেত্রে যে সার্বভৌমিকত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল পরবর্তী যুগে তা আর কখনো সম্ভবপর হয়নি। আফগানিস্তানের ভূগর্ভ থেকে যেমন যেমন গান্ধার শিল্পের নিদর্শন বেরোবে সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের চারুকলার ইতিহাস লেখা হয়ে ভারতবর্ষকে তার ঋণ স্বীকার করাতে বাধ্য করবে।
আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষ প্রথম আর্য অভিযান বা তারও আগে থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহের ভেতর দিয়ে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে নিজেদের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এরপরে আফগানরা মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতীয় ঐতিহাসিকরা এই দুটি দেশকে আলাদা করে দিয়েছেন। তাতে মুজতবা আলী মতভেদ প্রকাশ করেছেন। তার ভাষায়:
যদি বলা হয় আফগানরা মুসলমান হয়ে গেল বলে তাদের অন্য ইতিহাস তাহলে বলি, তারা একদিন অগ্নিউপাসনা করেছিল, গ্রীক দেবদেবীর পূজা করেছিল, বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। তবুও যখন দুই দেশের ইতিহাস পৃথক করা যায় না, তখন তাদের মুসলমান হওয়াতেই হঠাৎ কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? বুদ্ধের শরণ নিয়ে কাবুলী যখন মগধবাসী হয়নি তখন ইসলাম গ্রহণ করে সে আরবও হয়ে যায়নি। ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে মুসলিম আফগানিস্তান বিশেষ করে কান্দাহার, গজনী, কাবুল, জলালাবাদ— বাদ দিলে ফ্রন্টিয়ার, বানু, কোহাট এমন কি পাঞ্জাবও বাদ দিতে হয়।
একাদশ শতাব্দীতে আফগান সুলতান মাহমুদের সভাপণ্ডিত আল-বিরুনি ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ লিখেছিলেন। এর পূর্বে ভারতের কোনো লিখিত ইতিহাস ছিল না।
সম্রাট বাবরের আত্মজীবনী থেকে আফগানিস্তানের এক চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তার সময়কার কান্দাহার, গজনী বা কাবুলের সাথে লেখকের সময়কালের তেমন কোনো তফাৎ নেই বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। বাবরের আত্মজীবনী থেকে তার ভেতরকার সাধারণ মানুষের সত্তাটিকে আলাদা করে দেখা যায়। তিনি হিন্দুস্থানের নববর্ষের প্রথম দিনে আনন্দে অধীর, জালালাবাদের আখ খেয়ে তা নিজের দেশে টবে করে চালান করেছেন। আফগানিস্তান ভ্রমণে তার এই আত্মজীবনী বইটি সঙ্গে নিয়ে গেলেই যথেষ্ট। লেখকের মতে:
শ্বেতাঙ্গ পণ্ডিতের নির্লজ্জ জাত্যভিমানের চূড়ান্ত প্রকাশ হয় যখন সে বাবরের আত্মজীবনী অপেক্ষা জুলিয়াস সীজারের আত্মজীবনীর বেশী প্রশংসা করে।
মুজতবা আলীর বাসাটি কাবুল থেকে আড়াই মাইল দূরের খাজামোল্লা গ্রামে ছিল। তার কলেজের অধ্যক্ষ সাথে একজন চাকরও দিয়েছিল। কাবুল নিয়ে লেখকের সোজাসাপটা অভিমত, এখানে দেখার মতো কিছু নেই। পুরনো কোনো মসজিদ নেই, কোনো পুরাতাত্ত্বিক প্রদর্শনী নেই। যে আস্তাবলে সিকন্দর শাহের ঘোড়া বাঁধা ছিল, সেখানে হয়তো এখন বেগুন ঝুলছে। যা রয়েছে তা হচ্ছে অনেকগুলো বাগান। লেখকের বন্ধুবান্ধব কেউ না কেউ সে বাগানগুলোতে সারাদিন কাটাবার বন্দোবস্ত করে তাকে নিয়ে যেত। কাবুলের বাজারগুলোও সরু রাস্তা দিয়ে নির্মিত। দোকানগুলো পান দোকানের দ্বিগুণ বা তিনগুণ বড় হবে। তবে সে বাজারে বেচাকেনার জন্যে কেউ ব্যস্ত নয়। বরং আড্ডা দিতেই সবাই বাজারে আসে, দোকানে বসে।
আফগানিস্তানের মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে তাদের উপজাতিদের নিয়ে অথচ কোথাও তাদের নিয়ে কোনো কথা বলা হয় না, কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনা। আফগান পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করলে তারা ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে না।
ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে কাবুলীরা প্রায়ই বলেন, তারপর শিনওয়ারীরা বিদ্রোহ করল, কিন্তু যদি তখন প্রশ্ন করেন, বিদ্রোহ করল কেন, তবে উত্তর পাবেন, মোল্লারা তাদের খ্যাপালো বলে, কিন্তু তারপরও যদি প্রশ্ন শুধান যে, উপজাতিদের ভিতরে এমন কোন্ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উষ্ণ বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছিল যে, মোল্লাদের ফুলকি দেশময় আগুন ধরাতে পারল তাহলে আর কোনো উত্তর পাবেন না।
তাদের গ্রামগুলোও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দুরবস্থায় ভোগে। সরকার তাদের উন্নতির ব্যাপারে বেশ উদাসীন। তাই সরকারকে তারা বেশ অনিচ্ছায় খাজনা দিবে তা অনুমান করাই যায়। দেশে কোনো সমস্যা হলে এই গ্রামগুলো থেকে লোকজন বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় লুটতরাজ চালায়।
কাবুলের লোকদের ভাষা ফারসি হওয়াতে ভারতের দিল্লি, লাহোরে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা প্রবেশ করে। গরীব দেশ হওয়ায় নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। গ্রামের অর্ধশিক্ষিত মোল্লারা এসব প্রতিষ্ঠানফেরত মৌলবীদের কথা মেনে চলে। আর গ্রামগুলোতে এই মোল্লাদের প্রভাব অনেক বেশি।
আফগানিস্তানের সম্পূর্ণ চাষবাসের সময় হচ্ছে শুকনো ঋতুতে। শীতে তাদের ক্ষেতের উপর বরফ জমে আর আর গলে এই পানি চুইয়ে মাটির অনেক নিচে ঢোকে আর ক্ষেতটাকে নরম করে তোলে। গ্রীষ্মকালে চারপাশের পাহাড়গুলোর উপরে জমা বরফ গলে কাবুল উপত্যকায় নেমে আসে। চাষীরা তখন এই পানি বাঁধ দিয়ে নিজেদের ক্ষেতগুলো নাইয়ে নেয়। মুজতবা আলীর বাড়ির সামনে এরকমই একটি নালা বয়ে গিয়েছিল। তাই তার আফগান কৃষকের এসব চাষবাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
মুজতবা আলী ছুটিতে একবার দেশ থেকে ঘুরে এসেছিলেন। এসেই দেখলেন কাবুলে বরফ পড়তে শুরু করেছে। বাঙালির জন্যে এরকম বরফ পড়া শীত বাড়াবাড়িই বলা চলে। এই শীতে সবাই নিজেদের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে লম্বা সময়ের জন্যে ঘরের ভেতর বন্দি হয়ে পড়ে। এরপর যখন বসন্ত ঋতু আসে সবাই একসাথে বের হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ঘরের ভেতর জমে থাকা খাবারের সংগ্রহ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাজারগুলোতে বেশ ব্যস্ততা দেখা দেয়। কিন্তু এরকমই এক বসন্তে দেখা দিল বিপর্যয়।
আফগান মোল্লারা সবগুলো উপজাতিগুলোকে খেপিয়ে তুলল এই বলে যে তাদের শাসক আমান উল্লাহ একজন কাফির। আমান উল্লাহ একজন ইউরোপ ঘেঁষা শাসক ছিলেন। ইউরোপের কোনোকিছু তার ভালো লাগলেই তা নিজের দেশে প্রয়োগ করতেন। এরকম কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ফলে মোল্লারা তার উপর রেগে গিয়েছিল। আর তারা লেলিয়ে দিল উপজাতিদেরকে। উপজাতিগুলোর মধ্যে সারাবছরই মারামারি লেগে থাকে কিন্তু মোল্লাদের যুক্তি তাদেরকে একত্রিত করে তুলল। এরকমই অস্থিতিশীল অবস্থায় এক কুখ্যাত ডাকাত সর্দার বাচ্চায়ে সকাও কাবুল শহর দখল করতে এলো। প্রচন্ড গোলাগুলির পর সবাই নিজ নিজ ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা হয়ে যায়। শহরের নিরাপত্তা বাহিনীর সবাই পালিয়েছিল। ফলে আমান উল্লাও নিজের ঘরে আশ্রয় না নেওয়া ছাড়া উপায় খুঁজে পেলেন না।
এসময়ে ব্রিটিশ রাজদূত আমান উল্লার সাথে কথা বলে বিদেশিদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করলেন। সব দেশের লোকেরা ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে গেলেও ভারতীয়দের শহরত্যাগের কোনো উপায় পাওয়া গেল না। অথচ যে বিমান এসেছিল তা ভারতীয় অর্থে কেনা, পাইলটরা ভারতীয় অর্থের বেতনভোগ করে। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন দ্বারা ভারতীয়দের শোষণ ও বঞ্চনার একটা ছোট ধারণা যায়। মুজতবা আলী বেশ কড়াভাষায়ই তা বর্ণনা করেছেন:
ইংরেজের জাতিভেদ বড় ভয়ঙ্কর জিনিস। তার দেশে যেরকম কাগজে কলমে লেখা, আইনে বাঁধা কন্সটিটুশন নেই ঠিক তেমনি তার জাতিভেদপ্রথা কোনো বাইবেল-প্রেয়ারবুকে আপ্তবাক্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। অথচ সে জাতিভেদ রবীন্দ্রনাথের ভূতের কানমলার মত সে কানমলা না যায় ছাড়ান, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার। দর্শন, অঙ্কশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হোন, মার্কসিজমের দ্বিগ্বিজয়ী কৌটিল্যই হোন, অথবা কয়লার খনির মজুরই হোন, এই কানমলা স্বীকার করে করে হৌস অব লর্ডসে না পৌঁছানো পর্যন্ত দর্শন মিথ্যা, মার্কসিজম ভুল, শ্রমিকসঙ্ঘের দেওয়া সম্মান ভণ্ডুল। যে এই কানমলা স্বীকার করে না ইংরেজের কাছে সে আধপাগল। তার নাম বার্নাড শ।
আফগানিস্তানের চরম সংকটপূর্ণ সময়ে এসে শাসক আমান উল্লা সিংহাসন ত্যাগ করে পালালেন। শাসনভার দিয়ে গেলেন বড় ভাই ইনায়েত উল্লার হাতে। কিছুদিন পর ডাকাত সর্দারের আক্রমণে ইনায়েত উল্লাও আফগানমুলুক ছেড়ে পালালেন। সিংহাসনের দখল এলো ডাকাতদের হাতে। পুরো দেশে একরকম জরুরী অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ডাকাতরা যেখানে যা পাচ্ছিল তা-ই ডাকাতি করে নিচ্ছিল। যেখানে সেখানে মানুষ মারছিল, বাজারের দোকান সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে লেখককে একরকম অনাহারে থাকতে হয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে শেষে ব্রিটিশ লিগেশন থেকে মুজতবা আলীর ভারতে ফেরার ব্যবস্থা করা হলো।
দীর্ঘদিন আফগানিস্তান থেকে লেখকের এই দেশের জন্যে মমতা তৈরি হয়েছিল। নিজের দেশের মতই এই দেশ ছেড়ে চলে আসার সময় আবার তার বুক আর্দ্র হয়ে উঠেছিল। বিদায়বেলায় তার চাকর আবদুর রহমানের আকুলতা দেখে পাঠকের হৃদয়ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে।
চরিত্র বর্ণনা
এই ভ্রমণকাহিনীতে অনেক মানুষের সাথে মুজতবা আলীর দেখা হয়। অনেকের সাথে তিনি দীর্ঘদিন সময় কাটিয়ে ছিলেন, অনেকের সাথে কিছু মূহুর্ত। কিন্তু লেখকের বর্ণিল ভাষায় সবগুলো চরিত্রের ছাপই বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। এদের মধ্যে কয়েকজনের কথা না বললেই নয়।
পেশওয়ারের ট্রেনে ওঠার পর তার দেখা হয় এক পাঠান বৃদ্ধের সাথে যার নির্জলা আন্তরিকতা ও সাবলীল মিশুক প্রকৃতি দেখে লেখকের পাঠানদের সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা হয়ে যায়। এরপরে অন্য পাঠানরাও অবশ্য ট্রেনে তাকে ঘিরে ধরে, রৌদ্রতপ্ত খটখটে গরমের দিনে জমে যায় আড্ডা। আর প্রতি স্টেশনেই পাঠানরা তাকে কিছু না কিছু খাওয়াচ্ছিল।
পেশওয়ারে নামার পর লেখক আহমদ আলীর বাসায় মেহমান হয়ে আশ্রয় নেন। মেহমানদারির মত অন্য কোনো কিছুতে পাঠানরা এত আনন্দ পায় না তা আহমদ আলীকে দেখলে বোঝা যায়। আহমদ আলীর সাথে কাটানো সময়গুলোর মাধ্যমে পাঠক পাঠান জাতিকে একটু একটু করে বুঝে উঠতে শুরু করবে। তার সাথে লেখকের খোশগল্পের বর্ণনাগুলো বেশ উপভোগ্য।
কাবুলে পৌঁছে প্রথমেই যার সাথে লেখকের দেখা হয়েছিল তিনি পূর্বপরিচিত। তিনি অধ্যাপক বগদানফ, জাতে রুশ। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের সময়ে রাশিয়া থেকে ইরানে এসে পৌঁছান, সেখান থেকে তৎকালীন বোম্বেতে। রবীন্দ্রনাথ তার পান্ডিত্য দেখে ফারসির অধ্যাপক হিসেবে তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। এই অধ্যাপক বহু ইউরোপীয় ভাষা জানতেন। তাছাড়া তুর্কী বহু আঞ্চলিক ভাষা উপভাষায়ও সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারতেন। এত পান্ডিত্যের বিপরীতে দেখা গেল যে তিনি কুসংস্কারে তীব্র বিশ্বাসী যা বেশ বেমানান।
রাশিয়ান এম্বাসিতে গিয়ে লেখকের আরো একজনের সাথে পরিচয় হলো। তার নাম তারিশ দেমিদফ। প্রথম দর্শনেই তাকে বেশ আন্তরিক মনে হয়েছিল লেখকের, ব্রিটিশদের মতো নাক উঁচু নয়।
প্রথম দর্শনেই তারিশ দেমিদকে আমার বড় ভালো লাগলো। রোগা চেহারা, সাধারণ বাঙালীর মতন উঁচু, সোনালী চুল, চোখের লোম পর্যন্ত সোনালী, শীর্ণ মুখ আর দুটি উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ নীল চোখ। বেনওয়া যখন আলাপ করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন তিনি মুখ খোলর আগেই যেন চোখ দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিচ্ছিলেন। সাধারণ কন্টিনেন্টালের চেয়ে একটু বেশী ঝুঁকে তিনি হ্যাণ্ডশেক করলেন, আর হাতের চাপ দেওয়ার মাঝ দিয়ে অতি সহজ অভ্যর্থনার সহৃদয়তা প্রকাশ করলেন।
তার সাথে লেখকের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত। রাশিয়ান সাহিত্যের পাঠক বলে দেমিদফ তাকে বেশ খাতির করেছিলেন। এমনকি পশ্চিম ইউরোপীয়ানদের এটিকেটের সাথে পার্থক্য দেখিয়ে তার স্ত্রী দুপুরে খেয়েও যেতে বলেছিলেন। লেখকের বেশ মনে ধরেছিল এই দুজনকে।
একজন বেশ মজাদার চরিত্র ছিলেন, নাম দোস্ত মুহম্মদ খান। জাতে পাঠান। স্বভাবে কিছুটা পাগলাটে ধরনের হলেও খাস পাঠানদের মতই তার ভেতরে নির্জলা আন্তরিকতা অস্পষ্ট নয়। কাবুলের সামাজিক জীবন তিনভাগে বিভক্ত ছিল। একদল হচ্ছে খাঁটি কাবুলের লোক, দ্বিতীয় দল হচ্ছে ভারতীয়রা আর সর্বশেষ দল হচ্ছে ইউরোপিয়ানরা। দোস্ত মুহম্মদ ছিলেন সেরকম বিরল একজন মানুষ যার এই তিনদলের লোকের সাথেই খাতির ছিল।
প্রথম দেখায় তিনি লেখকের সাথে ইংরেজ ভদ্রতা দেখিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা বললেন। দ্বিতীয় দেখায় তা আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। তৃতীয় দেখায় একেবারে বন্ধুর মতো করে আচরণ শুরু করলেন। দোস্ত মুহম্মদ এমনই অদ্ভুত মানুষ ছিলেন যিনি নিজের ঘরের আসবাবপত্র বিলিয়ে দিয়ে আবার তা নিয়ে আফসোস করেন।
আর সর্বশেষ যার কথা না বললেই নয় সে হচ্ছে মুজতবা আলীর চাকর আবদুর রহমান। পুরো আফগানিস্তানের মধ্যে লেখকের সবচেয়ে কাছের লোক ছিল এই আবদুর রহমান। তার চরিত্রটিও বেশ মজাদার। মুজতবা আলীর জন্যে সে সব করতে পারবে কিন্তু তিনি কষ্ট পাবেন এমন হালকা কোনো কাজও সে করতে রাজি নয়। প্রথমদিনেই চারজনের খাবার রেঁধে তা লেখককে দেওয়ার পর তিনি তা না খেতে পারায় সে মন খারাপ করেছিল এই ভেবে যে তার রান্না সম্ভবত ভালো হয়নি। প্রচন্ড শীতে যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এই আবদুর রহমানই তার পরিচর্যা করেছিল। দাঙ্গার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বের হয়েছিল। আফগানিস্তানের সংকটময় রাজনৈতিক অবস্থায় না খেতে পেয়েও সে লেখককে ছেড়ে যায়নি। যখন লেখক ভারতবর্ষে চলে আসছিল আবদুর রহমান কান্নাকাটি করে লেখকের সাথে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। তার সাথে মুজতবা আলীর বিদায় এই বইয়ের শেষ অংশ। আবদুর রহমানই তো আফগানিস্তানের সাথে মুজতবা আলীর সবচেয়ে বড় যোগাযোগটি, সবচেয়ে বড় মমতার স্থানটি স্থাপন করেছিল।
শেষকথা
আফগানিস্তান ভৌগোলিকভাবে একটি দেশ হলেও তার বিভিন্ন উপজাতি, ভাষা-উপভাষা এবং বৈচিত্র্যে তা কয়েকটি দেশকে হার মানাতে পারে। তাই বইটির নাম বহুবচনে রাখা না হলে যেন দেশটির প্রতি অবিচার করা হয।
পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হতেই পারে যে আফগানিস্তান দেশটি মরুময়, প্রাণহীন, রসহীন, যেখানে আছে কেবল যুদ্ধবিগ্রহ আর হানাহানি। কিন্তু একজন লেখক যেখানে ভ্রমণ করেন সেখানের বালি, পাথর, কাদা সবকিছুতেই তার অতিসূক্ষ্ম নজর থাকে। সে অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক নিদর্শনগুলো থেকে যদি কোনো রস বা সৌন্দর্য আহরণ করতে না পারেন তবে তা তার হৃদয়ের দীনতা এবং একজন লেখকের অন্তরে এই ধরনের দীনতা থাকলে তিনি কোনো লেখকই নন। আমাদের সৌভাগ্য, সৈয়দ মুজতবা আলীর মত উঁচুমানের সাহিত্যিক আফগানিস্তান ভ্রমণ করেছিলেন। তাই এই রুক্ষ দেশটির মাঝের যে চাঞ্চল্য, যে জীবনযাত্রা তার যথাযথ মর্যাদা এই রসময় লেখায় ফুটে উঠেছে, এই মরুর দেশটিও তার ভাষার মাধুর্যে মধুর মতো হয়ে উঠেছে।
No comments:
Post a Comment