ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
হুগলি জেলার চাতরায়। পিতার নাম ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম এলোকেশী দেবী। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ভাটপাড়ার কাছে নারায়ণপুর গ্রামে। পিতা বারাসতের আইনজীবী ছিলেন। তাই ধূর্জটিপ্রসাদের শৈশবের পড়াশোনা বারাসত গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। এখান থেকেই তিনি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পাশ করেন।১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ধূর্জটিপ্রসাদ রিপন কলেজ (বর্তমানের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাসে এম.এ এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অর্থনীতিতে এম.এ পাশের পর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। নতুন লক্ষৌ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অর্থনীতির ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন এবং তিন দশকের (১৯২২ - ৫৪) বেশি সময় অধ্যাপনা করেন। পরে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.জাকির হোসেনের আহ্বানে তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন।
ধূর্জটিপ্রসাদ তার সময়কালে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম ছিলেন। পূরণচাঁদ যোশী, ত্রিলোকী নাথ মদন, অশোক মিত্র অওধ কিশোর সরন, ভি বি সিং প্রমুখ তার ছাত্রদের জীবনে ও ভাবনায় আদর্শ হতে পেরেছিলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থনীতি বিষয়ক এক সাপ্তাহিকের প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তিনি "লাইট উইদাউট হিট" বা 'তাপ ব্যতীত আলো' শীর্ষক এক প্রবন্ধ লেখেন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বুদ্ধিপ্রধান ও মননশীল লেখক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম থেকেই যুক্তি তর্কের দিকে মন ধাবিত হয়। তাঁর এই মন গড়ে উঠেছিল বন্ধু সাহচর্য ও বিপুল গ্রন্থ পাঠের ফলে। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-“ কুঁড়েমি জিনিসটার উপর তোমার কিছুমাত্র দয়ামায়া নেই”। এই মননের জন্য পারিবারিক পরম্পরাকে তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতির অধ্যাপক হয়ে লখনউ, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন কাটালেও তাঁর প্রিয় বিষয় সাহিত্য ও সংগীত।
কী লিখি নয় কেমন করে লিখি এটাই ছিল তাঁর কাছে প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ইংরেজি বই, প্রবন্ধ তিনি লিখিছিলেন মূলত চাকরি বজায় রাখবার জন্য। এমনকি এও বলেন- পিতৃপুরুষের সঞ্চিত অর্থ তিন পার্সেন্টের বদলে পাঁচ-ছয় পার্সেন্ট হলে কোনদিন লিখতাম না। তবে বেশিরভাগ প্রবন্ধই লেখা হয়েছিল বন্ধু ও সহকর্মীদের ব্যঙ্গের কারণে। সহকর্মীদের ব্যঙ্গ তিনি নাকি শুধু সাহিত্য, সংগীত নিয়েই মত্ত, নিজের বিষয়ে দক্ষ নন। আবার কখনও ব্যঙ্গ এসেছে- ধূর্জটি শুধু পড়েই গেল কিছুই লিখল না- এই সমস্ত ব্যঙ্গের উত্তর দিতেই তাঁকে বারবার কলম ধরতে হয়েছে। লেখা যেন তাঁর কাছে-“ লিখি দম্ভের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য, রাগ প্রকাশের জন্য।“
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রিয়ালিস্ট’। গল্পগুলি হল –‘একদা তুমি প্রিয়ে’, ‘প্রেমপত্র’, ‘রিয়ালিস্ট’ ও ‘মনোবিজ্ঞান’। গল্পের ধারাকেই তিনি পাল্টে দেন। প্রচলিত প্রেম, বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝি তা তিনি ভেঙে দেন। গপ্পের প্রতি তাঁর কোন নজর নেই। পাঠকের অবসরের সাথি তিনি নন। গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পর মতামত জানার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠালেন। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের এমন নীরস গল্প ভালো লাগে নি। নালিশ জানিয়েছিলেন –পাতা কেটে পড়তে হয়েছে। আসলে তিনি সরস গল্প খুঁজে পাননি। তবে আখ্যান, স্টাইলের প্রশংসা করেছিলেন-“ তোমার বইয়ের যে নাম দিয়েছ রিয়ালিস্ট তার মধ্যে বিদ্রুপের অট্টআস্য রয়েছে। নিছক রিয়ালিজ্ম যে কত অদ্ভুত ও অসঙ্গত তা তোমার গল্পে ফুটিয়ে তুলেছ।“
১৩৪০ এর ‘পরিচয়’ এ তাঁর ‘এই জীবন’ গল্প প্রকাশিত হয়। এ গল্প পড়ে সুধীন্দ্রনাথ, গিরিজাপ্রসাদ এ কাহিনিকে উপন্যাসের রূপ দেবার কথা বলেন। তারই পরিণতি ‘অন্তঃশীলা’ উপন্যাস। তৎকালীন সমাজে ইনটেলেকচুয়াল এক ব্যক্তির মানসিক অভিব্যক্তির পরিণতি দেখানোই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। নিজের অজ্ঞাতে খগেনবাবুর রমলা দেবীর প্রতি আকর্ষণই এর বিষয়। তবে এ উপন্যাসে খগেনবাবুর ক্রমবিকাশ শেষ হয় নি, তা এগিয়ে গেছে ‘আবর্ত’ ও ‘মোহনা’য়। মাতাকে উৎসর্গ করা এ উপন্যাসে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন ‘ধুকু’ নামে- এটি মাতার দেওয়া স্নেহের নাম। অন্যদিকে বন্ধু মহলে পরিচিত ছিলেন ‘ডি.পি’ নামে।
বারবার নিজেকে বীরবলের শিষ্য বলে মনে করতেন। ফলে ভাষা, আঙ্গিক ও গদ্যের স্বচ্ছতায় সে প্রভাব বিদ্যমান। তবে ‘অন্তঃশীলা’য় সে ভাষাকে এড়িয়ে গেলেন। তিনি এ উপন্যাস ভাবের বশে লেখেন নি। আসলে উপন্যাস তো লেখকের মানসবীণার ফলশ্রুতি ফলে ধূর্জটিপ্রসাদের মতো খগেনবাবুও চিন্তাশীল। মনে পড়ে এ উপন্যাস পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা-“ দাড়িমের শক্ত খোলার মধ্যে শত শত দানা, এবং প্রত্যেক দানার মধ্যেই একটি করে বীজ। তোমার অন্তঃশীলা সেই দাড়িম জাতীয় বই। বীজ-বাণীতে ঠাসা। তুমি এত বেশি পড়েছ এবং এত চিন্তা করেছ যে তোমার ব্যাখ্যান তোমার আখ্যানকে শতধা বিদীর্ণ করে বিস্ফুরিত হতে থাকে।“ উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি বারবার concrete হতে চেয়েছেন, Romantic realism এ তার বিশ্বাস নেই। সেই বুদ্বিদীপ্ত মননপ্রধান ট্রিলজি ‘অন্তঃশীলা- আবর্ত-মোহনা’। ‘আবর্ত’র সূচনা হরিদ্বারে খগেনবাবুর অসুস্থতার মধ্য দিয়ে। আর ‘মোহনা’র সূচনা মাসিমার মৃত্যুতেও খগেনবাবু ও রমলা দেবীর বসবাসের অসুবিধা হয় নি এর মধ্য দিয়ে। উপন্যাসের শেষ খগেনবাবুর পলায়নের মধ্য দিয়ে। তবে যাওয়ার আগে রমলা দেবীকে চিঠি লিখলেও ছিঁড়ে ফেলেছেন। কেননা মেয়ালি বাক্যে চিঠি লেখা তাঁর ধাতে নেই।
প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘আমরা ও তাঁহারা’, ‘চিন্তয়সি’, ‘সাহিত্যিকা’ ও ‘বক্তব্য’। নিজের মতকে তিনি নিজেই ভেঙেছেন। নিজের ভাবনাকে ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের কাছে। লেখার জন্য চেয়েছেন মনের অবসর। তাই লেখেন-“ চিরকাল আবাদ করলে প্রাচুর্যের অভাব হয় না, অভাব হয় লক্ষ্মীশ্রীর। জমি পতিত রাখা প্রয়োজন স্বীকার করি।“ ‘বক্তব্য’ গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড সমাজ ও দ্বিতীয় খণ্ড সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ। দ্বিতীয় খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সমাজচেতনা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে। ‘রবীন্দ্র সমালোচনার পদ্ধতি’ তে তিনি দেখিয়ে দেন ভারতীয় পরিবেশে রবীন্দ্রমানসকে কীভাবে বিচার করা প্রয়োজন।
‘সুর ও সঙ্গতি’ উৎসর্গ করেন অতুলপ্রসাদ সেনকে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংগীত নিয়ে তিনিই একমাত্র দীর্ঘ পত্র বিনিময় করেছিলেন। ১৯৩৪ এর বড়দিনে All Bengal music competition conference এ তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ সংগীত নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ধূর্জটি লখনউে গিয়ে কবিকে চিঠিতে বেশ কিছু প্রশ্ন পাঠান এবং এই সমস্ত নিয়ে কবিকে একটি গ্রন্থ লিখতে অনুরোধ করেন। কিন্তু অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তখন গ্রন্থ সম্ভব নয় ফলে প্রশ্নের উত্তর তিনি চিঠিতেই দিয়ে পাঠান। এরপর মার্চ মাসেই রবীন্দ্রনাথ লখনউে যান ফলে ধূর্জটি সংগীত নিয়ে আলোচনার আরও সুযোগ পান। রবীন্দ্রনাথ ও ধূর্জটির সংগীত বিষয়ক চিঠিগুলি স্থান পেয়েছে ‘সুর ও সঙ্গতি’ গ্রন্থে। তবে তিনি চিঠিগুলিকে ক্রম অনুসারে সাজান নি, সাজিয়েছেন যুক্তি অনুসারে। সমস্ত চিঠির নিচেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘তোমাদের রবীন্দ্রনাথ’। পত্রালাপে রবীন্দ্রনাথ যখন আর তর্কে ইচ্ছুক নন তখন আপসেই বলেন – তোমার মতই মেনে নিলাম। আবার কখনও ধৈর্যচ্যুতি হলে আপাত রসিকতার ঢঙে লেখেন-“ তুমি আমাকে সংগীতের তর্কে টেনে বিপদে ফেলতে চাও কেন ? তোমার কী অনিষ্ট করেছি।“
‘কথা ও সুর’ উৎসর্গ করেন বন্ধু মন্টুকে। গান নিয়ে তাঁর সঙ্গে লেখকের বহু বিতর্ক হলেও মতেরও মিল ছিল। তাই গান নিয়ে লেখা এ গ্রন্থ তাঁকেই উৎসর্গ করেন। সংগীতেরও যে ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস বাঙালি ভুলতে বসেছিল তা স্মরণ করতেই এ গ্রন্থের অবতারণা। যাত্রাগান, পাঁচালি, কীর্তন, বাউল থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ ও রজনীকান্ত পর্যন্ত যাত্রা করেছেন। সংগীতকে তিনি দুইভাবে দেখতে চান- পুনরুদ্ধার ও নতুনসৃষ্টি। আর তিনি সমস্ত গান ও রাগ –রাগিনীকে বিচার করতে চেয়েছেন ভারতীয় পরিবেশে।
বন্ধুরা তাঁকে ancdotes লিখতে বসেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ইংরেজিতেই লিখবেন, নামও ঠিক করেছিলেন ‘Anecdotage’। কিন্তু তিনি লিখলেন ‘মনে এলো’। যা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। এ ঠিক ডায়েরি নয় নিজের সঙ্গে নিজেরই কথোপকথন। অন্যদিকে আছে ‘ঝিলিমিলি’ গ্রন্থ। ঝিলিমিলি অর্থাৎ স্ফটিকের ওপর ফেলা আলো। বহু আগে পড়া গ্রন্থ, জীবন অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিন পরে মনে যে অনুরণন তুলেছে তারই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এ গ্রন্থ। পাঠ প্রতিক্রিয়ার যে বিবর্তন তা এ গ্রন্থ- যা অসুস্থ অবস্থায় লেখা। আবার কখনও লেখেন- “ কখনও বা পড়ার চেয়ে বেশি বুঝেছি, এই সময় লিখি। কিন্তু গড়পড়তা বেশি বোঝার চেয়ে বেশি পড়েছি।“ ‘বক্তব্য’ গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধ সংকলনে। কিন্তু আরও বহু প্রবন্ধ ছড়িয়ে ছিল। যা সংগ্রহ করে পাঠককে উপহার দিয়েছিলেন বিমলপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যেমন-‘প্রমথ চৌধুরীর গল্প’,’ সমাজ ও সন্ন্যাসগ্রহণ’, ‘বাংলা কাব্য ও সুধীন্দ্রনাথ’ ও ‘বৈঠকখানা ও সমাজ’।
‘অন্তঃশীলা’ ও ‘আমরা ও তাঁহারা’ পাঠ্যতালিকাভুক্ত হওয়ায় গ্রন্থ দুটি সম্পর্কে পাঠক অধিক পরিচিত। তাঁর বিপুল সৃষ্টিই রয়েছে পাঠকের অগোচরে। তিনি সস্তা বা আবেগের লেখক নন। বুদ্ধি ও চিন্তা নিয়েই তাঁর লেখকসত্তা। কখনও বলেন-“চিন্তার গতি নিয়েই আমার কারবার। চিন্তা নেই, আমিও নেই।“ – তাই তিনি আবেগসর্বস্ব হুজুগপ্রিয় বাঙালির কাছে উপেক্ষিত। এ শতাব্দীর চিন্তাবিশ্ব ও আখ্যানচর্চায় আবার সময় এসেছে ধূর্জটিপ্রসাদকে নতুন করে পাঠ করার
১৯৩৭-৪০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে গোবিন্দ বল্লভ পন্থ নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের ডিরেক্টর অফ ইনফরমেশন পদে কাজ করেন এবং ব্যুরো অফ ইকোনমিক্স এন্ড স্ট্যাটিস্টিক্স গঠন করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক বছরের জন্য যুক্তপ্রদেশ সরকারের লেবার এনকোয়ারি কমিটির সদস্য হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইকনমিক ডেলিগেট হয়ে সোভিয়েত রাশিয়া যান। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেদারল্যান্ডসের ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সে সমাজতত্ত্ব বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসরপদে কাজ করার জন্য আমন্ত্রিত হন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে অক্টোবর হতে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই মে তিনি সেখানে "সোসিওলজি অফ কালচার" (সংস্কৃতির সমাজবিজ্ঞান) বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বান্দুং সম্মেলনে যোগ দেন এবং তিনদিন এশিয়ার দেশগুলির ইকনমিক কো-অপারেশন সেমিনারে বক্তৃতা করেন।
ধূর্জটিপ্রসাদ সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ধূর্জটিপ্রসাদের সাহিত্য, সঙ্গীত ও কলা বিষয়ে গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচকও ছিলেন।
তিনি রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অল ইন্ডিয়া সোশিওলজিক্যাল কনফারেন্স গঠন করেন এবং এর প্রথম সম্মেলন হয় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে।
গলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড যান। উপশম হলেও তার কণ্ঠস্বরের বিশেষ ক্ষতি হয়। তা সত্বেও, তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে থাকেন এবং অবসরের পর দেরাদুনে চলে যান। শেষে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ৫ ই ডিসেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বুদ্ধিপ্রধান ও মননশীল লেখক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আজ থেকে ১২৫ বছর আগে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর হুগলির শ্রীরামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। রামেন্দ্রসুন্দরের ছাত্র হওয়ায় প্রথম থেকেই যুক্তি তর্কের দিকে মন ধাবিত হয়। তাঁর এই মন গড়ে উঠেছিল বন্ধু সাহচর্য ও বিপুল গ্রন্থ পাঠের ফলে। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-“ কুঁড়েমি জিনিসটার উপর তোমার কিছুমাত্র দয়ামায়া নেই”। এই মননের জন্য পারিবারিক পরম্পরাকে তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতির অধ্যাপক হয়ে লখনউ, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন কাটালেও তাঁর প্রিয় বিষয় সাহিত্য ও সংগীত।
কী লিখি নয় কেমন করে লিখি এটাই ছিল তাঁর কাছে প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ইংরেজি বই, প্রবন্ধ তিনি লিখিছিলেন মূলত চাকরি বজায় রাখবার জন্য। এমনকি এও বলেন- পিতৃপুরুষের সঞ্চিত অর্থ তিন পার্সেন্টের বদলে পাঁচ-ছয় পার্সেন্ট হলে কোনদিন লিখতাম না। তবে বেশিরভাগ প্রবন্ধই লেখা হয়েছিল বন্ধু ও সহকর্মীদের ব্যঙ্গের কারণে। সহকর্মীদের ব্যঙ্গ তিনি নাকি শুধু সাহিত্য, সংগীত নিয়েই মত্ত, নিজের বিষয়ে দক্ষ নন। আবার কখনও ব্যঙ্গ এসেছে- ধূর্জটি শুধু পড়েই গেল কিছুই লিখল না- এই সমস্ত ব্যঙ্গের উত্তর দিতেই তাঁকে বারবার কলম ধরতে হয়েছে। লেখা যেন তাঁর কাছে-“ লিখি দম্ভের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য, রাগ প্রকাশের জন্য।“
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রিয়ালিস্ট’। গল্পগুলি হল –‘একদা তুমি প্রিয়ে’, ‘প্রেমপত্র’, ‘রিয়ালিস্ট’ ও ‘মনোবিজ্ঞান’। গল্পের ধারাকেই তিনি পাল্টে দেন। প্রচলিত প্রেম, বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝি তা তিনি ভেঙে দেন। গপ্পের প্রতি তাঁর কোন নজর নেই। পাঠকের অবসরের সাথি তিনি নন। গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পর মতামত জানার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠালেন। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের এমন নীরস গল্প ভালো লাগে নি। নালিশ জানিয়েছিলেন –পাতা কেটে পড়তে হয়েছে। আসলে তিনি সরস গল্প খুঁজে পাননি। তবে আখ্যান, স্টাইলের প্রশংসা করেছিলেন-“ তোমার বইয়ের যে নাম দিয়েছ রিয়ালিস্ট তার মধ্যে বিদ্রুপের অট্টআস্য রয়েছে। নিছক রিয়ালিজ্ম যে কত অদ্ভুত ও অসঙ্গত তা তোমার গল্পে ফুটিয়ে তুলেছ।“
১৩৪০ এর ‘পরিচয়’ এ তাঁর ‘এই জীবন’ গল্প প্রকাশিত হয়। এ গল্প পড়ে সুধীন্দ্রনাথ, গিরিজাপ্রসাদ এ কাহিনিকে উপন্যাসের রূপ দেবার কথা বলেন। তারই পরিণতি ‘অন্তঃশীলা’ উপন্যাস। তৎকালীন সমাজে ইনটেলেকচুয়াল এক ব্যক্তির মানসিক অভিব্যক্তির পরিণতি দেখানোই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। নিজের অজ্ঞাতে খগেনবাবুর রমলা দেবীর প্রতি আকর্ষণই এর বিষয়। তবে এ উপন্যাসে খগেনবাবুর ক্রমবিকাশ শেষ হয় নি, তা এগিয়ে গেছে ‘আবর্ত’ ও ‘মোহনা’য়। মাতাকে উৎসর্গ করা এ উপন্যাসে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন ‘ধুকু’ নামে- এটি মাতার দেওয়া স্নেহের নাম। অন্যদিকে বন্ধু মহলে পরিচিত ছিলেন ‘ডি.পি’ নামে।
বারবার নিজেকে বীরবলের শিষ্য বলে মনে করতেন। ফলে ভাষা, আঙ্গিক ও গদ্যের স্বচ্ছতায় সে প্রভাব বিদ্যমান। তবে ‘অন্তঃশীলা’য় সে ভাষাকে এড়িয়ে গেলেন। তিনি এ উপন্যাস ভাবের বশে লেখেন নি। আসলে উপন্যাস তো লেখকের মানসবীণার ফলশ্রুতি ফলে ধূর্জটিপ্রসাদের মতো খগেনবাবুও চিন্তাশীল। মনে পড়ে এ উপন্যাস পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা-“ দাড়িমের শক্ত খোলার মধ্যে শত শত দানা, এবং প্রত্যেক দানার মধ্যেই একটি করে বীজ। তোমার অন্তঃশীলা সেই দাড়িম জাতীয় বই। বীজ-বাণীতে ঠাসা। তুমি এত বেশি পড়েছ এবং এত চিন্তা করেছ যে তোমার ব্যাখ্যান তোমার আখ্যানকে শতধা বিদীর্ণ করে বিস্ফুরিত হতে থাকে।“ উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি বারবার concrete হতে চেয়েছেন, Romantic realism এ তার বিশ্বাস নেই। সেই বুদ্বিদীপ্ত মননপ্রধান ট্রিলজি ‘অন্তঃশীলা- আবর্ত-মোহনা’। ‘আবর্ত’র সূচনা হরিদ্বারে খগেনবাবুর অসুস্থতার মধ্য দিয়ে। আর ‘মোহনা’র সূচনা মাসিমার মৃত্যুতেও খগেনবাবু ও রমলা দেবীর বসবাসের অসুবিধা হয় নি এর মধ্য দিয়ে। উপন্যাসের শেষ খগেনবাবুর পলায়নের মধ্য দিয়ে। তবে যাওয়ার আগে রমলা দেবীকে চিঠি লিখলেও ছিঁড়ে ফেলেছেন। কেননা মেয়ালি বাক্যে চিঠি লেখা তাঁর ধাতে নেই।
প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘আমরা ও তাঁহারা’, ‘চিন্তয়সি’, ‘সাহিত্যিকা’ ও ‘বক্তব্য’। নিজের মতকে তিনি নিজেই ভেঙেছেন। নিজের ভাবনাকে ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের কাছে। লেখার জন্য চেয়েছেন মনের অবসর। তাই লেখেন-“ চিরকাল আবাদ করলে প্রাচুর্যের অভাব হয় না, অভাব হয় লক্ষ্মীশ্রীর। জমি পতিত রাখা প্রয়োজন স্বীকার করি।“ ‘বক্তব্য’ গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড সমাজ ও দ্বিতীয় খণ্ড সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ। দ্বিতীয় খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সমাজচেতনা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে। ‘রবীন্দ্র সমালোচনার পদ্ধতি’ তে তিনি দেখিয়ে দেন ভারতীয় পরিবেশে রবীন্দ্রমানসকে কীভাবে বিচার করা প্রয়োজন।
‘সুর ও সঙ্গতি’ উৎসর্গ করেন অতুলপ্রসাদ সেনকে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংগীত নিয়ে তিনিই একমাত্র দীর্ঘ পত্র বিনিময় করেছিলেন। ১৯৩৪ এর বড়দিনে All Bengal music competition conference এ তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ সংগীত নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ধূর্জটি লখনউে গিয়ে কবিকে চিঠিতে বেশ কিছু প্রশ্ন পাঠান এবং এই সমস্ত নিয়ে কবিকে একটি গ্রন্থ লিখতে অনুরোধ করেন। কিন্তু অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তখন গ্রন্থ সম্ভব নয় ফলে প্রশ্নের উত্তর তিনি চিঠিতেই দিয়ে পাঠান। এরপর মার্চ মাসেই রবীন্দ্রনাথ লখনউে যান ফলে ধূর্জটি সংগীত নিয়ে আলোচনার আরও সুযোগ পান। রবীন্দ্রনাথ ও ধূর্জটির সংগীত বিষয়ক চিঠিগুলি স্থান পেয়েছে ‘সুর ও সঙ্গতি’ গ্রন্থে। তবে তিনি চিঠিগুলিকে ক্রম অনুসারে সাজান নি, সাজিয়েছেন যুক্তি অনুসারে। সমস্ত চিঠির নিচেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘তোমাদের রবীন্দ্রনাথ’। পত্রালাপে রবীন্দ্রনাথ যখন আর তর্কে ইচ্ছুক নন তখন আপসেই বলেন – তোমার মতই মেনে নিলাম। আবার কখনও ধৈর্যচ্যুতি হলে আপাত রসিকতার ঢঙে লেখেন-“ তুমি আমাকে সংগীতের তর্কে টেনে বিপদে ফেলতে চাও কেন ? তোমার কী অনিষ্ট করেছি।“
‘কথা ও সুর’ উৎসর্গ করেন বন্ধু মন্টুকে। গান নিয়ে তাঁর সঙ্গে লেখকের বহু বিতর্ক হলেও মতেরও মিল ছিল। তাই গান নিয়ে লেখা এ গ্রন্থ তাঁকেই উৎসর্গ করেন। সংগীতেরও যে ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস বাঙালি ভুলতে বসেছিল তা স্মরণ করতেই এ গ্রন্থের অবতারণা। যাত্রাগান, পাঁচালি, কীর্তন, বাউল থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ ও রজনীকান্ত পর্যন্ত যাত্রা করেছেন। সংগীতকে তিনি দুইভাবে দেখতে চান- পুনরুদ্ধার ও নতুনসৃষ্টি। আর তিনি সমস্ত গান ও রাগ –রাগিনীকে বিচার করতে চেয়েছেন ভারতীয় পরিবেশে।
বন্ধুরা তাঁকে ancdotes লিখতে বসেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ইংরেজিতেই লিখবেন, নামও ঠিক করেছিলেন ‘Anecdotage’। কিন্তু তিনি লিখলেন ‘মনে এলো’। যা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। এ ঠিক ডায়েরি নয় নিজের সঙ্গে নিজেরই কথোপকথন। অন্যদিকে আছে ‘ঝিলিমিলি’ গ্রন্থ। ঝিলিমিলি অর্থাৎ স্ফটিকের ওপর ফেলা আলো। বহু আগে পড়া গ্রন্থ, জীবন অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিন পরে মনে যে অনুরণন তুলেছে তারই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এ গ্রন্থ। পাঠ প্রতিক্রিয়ার যে বিবর্তন তা এ গ্রন্থ- যা অসুস্থ অবস্থায় লেখা। আবার কখনও লেখেন- “ কখনও বা পড়ার চেয়ে বেশি বুঝেছি, এই সময় লিখি। কিন্তু গড়পড়তা বেশি বোঝার চেয়ে বেশি পড়েছি।“ ‘বক্তব্য’ গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধ সংকলনে। কিন্তু আরও বহু প্রবন্ধ ছড়িয়ে ছিল। যা সংগ্রহ করে পাঠককে উপহার দিয়েছিলেন বিমলপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যেমন-‘প্রমথ চৌধুরীর গল্প’,’ সমাজ ও সন্ন্যাসগ্রহণ’, ‘বাংলা কাব্য ও সুধীন্দ্রনাথ’ ও ‘বৈঠকখানা ও সমাজ’।
‘অন্তঃশীলা’ ও ‘আমরা ও তাঁহারা’ পাঠ্যতালিকাভুক্ত হওয়ায় গ্রন্থ দুটি সম্পর্কে পাঠক অধিক পরিচিত। তাঁর বিপুল সৃষ্টিই রয়েছে পাঠকের অগোচরে। তিনি সস্তা বা আবেগের লেখক নন। বুদ্ধি ও চিন্তা নিয়েই তাঁর লেখকসত্তা। কখনও বলেন-“চিন্তার গতি নিয়েই আমার কারবার। চিন্তা নেই, আমিও নেই।“ – তাই তিনি আবেগসর্বস্ব হুজুগপ্রিয় বাঙালির কাছে উপেক্ষিত। এ শতাব্দীর চিন্তাবিশ্ব ও আখ্যানচর্চায় আবার সময় এসেছে ধূর্জটিপ্রসাদকে নতুন করে পাঠ করার।
আলোচনা -
No comments:
Post a Comment