Tuesday, 5 October 2021

শুভ জন্মদিন। মণীন্দ্র রায়। ০৪.১০.২১. Vol -515 The blogger in literature e-magazine

 

মণীন্দ্র রায়

 ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর  পাবনা জেলার শীতলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা শহরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তিনি ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেন। পাবনাতে থাকাকালীন ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও চিত্রশিল্পী রথীন মৈত্র র প্রেরণায় সাম্যবাদী ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। 



১৯৩৬ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত 'পরিচয়' পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। ১৯৩৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ত্রিশঙ্কু প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে একচক্ষু, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ছায়া সহচর, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সেতুবন্ধন কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়। তেভাগা আন্দোলন এর প্রেক্ষাপটে তিনি ইয়াসিন মিঞা নামে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। তিনি সীমান্ত ও নিষ্পন্ন নামক দুটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি অমৃত ও সত্যযুগ নামে দুটি সাময়িক পত্রিকারও সম্পাদনা করেন। তার লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি ---

 কৃষ্ণচূড়া

অন্যপথ

অতিদূর আলোর রেখা

সুখের মেলাই

অমিল থেকে মিলে,

 ভিয়েতনাম,

 লেনিন,

 নদী ঢেউ ঝিলমিল।  প্রভৃতি। 

নাটক -

জামায় রক্তের দাগ,

 নাটকের নাম ভীষ্ম

মাথায় জড়ানো জলপাই

পল্লব আমাকে বাঁচতে দাওআমাকে জাগতে দাও। প্রভৃতি । 


পুরস্কার

 ১৯৬৯ সালে তাঁর দীর্ঘ কবিতা মোহিনী আড়াল সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯৩ সালে তিনি 'সনেট সমগ্র' গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন।

দেশ ভাগের কান্না কবি কান পেতে শুনেছেন। লিখেছেন’ চিঠি’ কবিতা।  কবি  ফুটিয়ে তুলেছেন এক উদ্বাস্তু বৃদ্ধার ছেড়ে আসা গ্রাম এবং সেখানকার মানুষ-জনের জন্য বৃদ্ধার দুশ্চিন্তা ও মনখারাপের অনুভূতি-"

সুশান্ত, তোমার মনে পড়ে

সরলার মাকে, যে এখানে
কাজ করত? হঠাৎ সেদিন
শুনলো যেই বন্যা পাকিস্তানে,
বুড়ি গিয়ে বসল বারান্দায়,
দেখি তার চোখে জল ঝরে।…"

আলোচনা

ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চায় স্বাধীনতা একটি মহান ও পবিত্র বিজয়ফলক হিসাবে স্বীকৃত। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতি লাভ করে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। আরও সুস্পষ্ট রূপে বললে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গ দেশভাগের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেও পিছপা হননি। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের প্রকল্পে দেশভাগ ও তদ্‌জ্জনিত দুর্ভোগ ছিল নেহাৎই একটি মহান লক্ষ্য পূরণের জন্য কিছু মানুষের সামান্য আত্মত্যাগ। স্বাভাবিকভাবেই দেশভাগ বহু বছর ভারতের ইতিহাস চর্চায় উপেক্ষিত থেকে যায়। স্বাধীনতা উদ্‌যাপনের আনন্দোৎসবে ঢাকা পড়ে যায় দেশভাগের ফলে উৎখাত হওয়া মানুষের স্বজন ও স্বদেশ হারানোর হাহাকার। বিগত সহস্রাব্দের শেষ দশক থেকে দেশভাগের অভিজ্ঞতা নিয়ে এক নতুন ধরনের ইতিহাসচর্চা শুরু হয় মূলতঃ উত্তরভারতে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে। এর রেশ এসে পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও। সম্প্রতিকালে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও আলোচনা হচ্ছে। এর অনেকটাই স্মৃতিনির্ভর। এই ধরণের ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে স্মৃতি, সাহিত্য ও ইতিহাসের লক্ষ্মণরেখা ক্রমশঃ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যা বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। ইতিহাসের এই পদ্ধতিগত অভিযোজন নিয়ে যে বিতর্ক আছে তার মধ্যে না গিয়ে এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করব স্বাধীনতা ও দেশভাগের সমসায়িক বাংলার সৃষ্টিশীল মানুষরা কি ভাবে দেশভাগকে দেখেছিলেন। বাংলা কবিতা ও গানে তার প্রতিফলন কেমন হয়েছিল।


দেশভাগের অন্য ইতিহাস


পেশাদার ঐতিহাসিকরা কিছুকাল আগে পর্যন্ত দেশভাগ নিয়ে সচরাচর যে ধরনের ইতিহাস চর্চা করেছেন তার মূল লক্ষ্য ছিল দেশভাগের কারণ অনুসন্ধান, তার প্রভাব অনুধাবন নয়। ঐতিহাসিক জ্ঞান পাণ্ডে লিখেছেনঃ ‘On the question of Partition, Indian histriography occupies a paradoxical position. On the one hand, Partition has dominated the consciousness of nationalist and professional historians in a remarkable way…On the other hand, the history of Partition is effectively suppressed by the focus on India’s freedom struggle— the unity of India and the nationalist enterprise continued almost unaffected by Partition and all that accompanied it. The history of Partition (sometimes called the history of ‘communalism’) is presented separately, or at best as a subordinate and apparently (in the long run) inconsequential motif in the larger drama on India’s struggle for independence.’ তিনি এই ইতিহাস চর্চার ধারাকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন এবং দেশভাগের এক নতুন ধারার ইতিহাস চর্চার সুত্রপাত করেন।


প্রায় একই সময় ঊর্বশি বুটালিয়া Seminar পত্রিকায় লেখেনঃ ‘Partition was not only a division of properties, of assets and liabilities. It was also, to use a phrase that Partition victims use repeatedly, “a division of hearts”. It brought untold suffering, tragedy, trauma, pain, violence to communities who had hitherto lived together in some kind of social contract. It separated families across an arbitrarily drawn border, sometime overnight, and made it practically impossible for people to know if their parents, sisters, brothers, children were alive or dead, and these aspects of the Partition — how people coped with the trauma, how they rebuilt their lives, what resources, both physical and mental, they drew upon, how their experience of dislocation and trauma shaped their lives, and indeed the cities and towns they settled in—find little reflection in written history.’ একই সঙ্গে তিনি দেশভাগের ইতিহাস চর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাঁকের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা হল বাংলায় এবং পূর্ব পাকিস্তানে দেশভাগের অভিজ্ঞতা, যা তাঁর মতে নিজ অধিকারে বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে।


দেশভাগের অভিজ্ঞতাঃ স্মৃতি ও সাহিত্যে


বাংলায় দেশভাগের অভিজ্ঞতা নিয়ে চর্চা শুরু হয় ৯০-র দশকের শেষ দিক থেকে। এই চর্চার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত হওয়া হিন্দু বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের অভিজ্ঞতার বিবরণ। যদিও দেশভাগের অভিজ্ঞতা শুধু হিন্দু বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের অভিজ্ঞতা নয় দেশভাগের দুর্দশার শরিক ছিল উদ্বাস্তু নয় এমন হিন্দু বাঙ্গালীরাও। বাঙ্গালী মুসলমানরাও দেশভাগের ফলে কম দুর্দশার শিকার হয়নি। এই ইতিহাস চর্চা প্রথাগত সরকারি আর্কাইভ নির্ভর ইতিহাস চর্চার খাতে প্রবাহিত হয়নি। কারন সরকারি নথিপত্রে সেই ইতিহাসকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেই কারণে দেশভাগের অভিজ্ঞতাকে খুঁড়ে বার করতে আমাদের অনেকটাই নির্ভর করতে হয় সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যারা তাদের জীবন অতিবাহিত করেছে তাদের স্মৃতিচারণার উপর। মানবস্মৃতিও একটি আর্কাইভ যা ঠাসা থাকে বিভিন্ন বাছাই করা নথিতে। এর কিছুটা প্রকাশিত হয় এবং অধিকাংশই অপ্রকাশিত থেকে যায়। আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে তার কিছুটা স্মৃতিতে থাকে, অধিকাংশই চলে যায় বিস্মৃতির গহ্বরে। স্মরণ ও বিস্মরণ এই দুই প্রক্রিয়াই একই সঙ্গে চলতে থাকে। দেশভাগের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি সিংহভাগই অব্যক্ত থেকে গেছে। এই নিয়ে সস্প্রতিকালে মৌখিক ইতিহাসের চর্চা হচ্ছে। দেশভাগের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি কিছুটা হলেও প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও গানে। এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় বাংলা কবিতা ও গানে তার প্রতিফলিত দেশভাগের অভিজ্ঞতা।


দেশভাগের অভিজ্ঞতার বহুমাত্রিকতা ও সার্বজনীনতা


দেশভাগের অভিজ্ঞতা বহুমাত্রিক ও সার্বজনীন। শারীরিক ও মানসিক দুর্ভোগ, জীবনধারণের সংকট, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে বিচ্যুতি ও পরিচিতির সংকট তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও দেশভাগের অভিজ্ঞতার মধ্যে একধরনের সার্বজনীনতা লক্ষ্য করা যায়। বিগত বিংশ শতকে বিশ্বের বহু দেশের অসংখ্য মানুষ দেশভাগের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। জাতিগত কিম্বা সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিরসনের উপায় হিসাবে দেশভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে যথেচ্ছভাবে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দেশভাগকে ব্যবহার করেছে একটি প্রস্থান কৌশল হিসাবে। ঠাণ্ডা লড়াই-এর আমলে এর ব্যবহার আরও ব্যাপক আকার নেয়। ঠাণ্ডা লড়াই-এর অবসানের পর জাতিগত সংঘাত বিশ্বে আরও তীব্রতর হয়েছে এবং আর ও বহু দেশ নতুন করে বিভাজিত হছে।


বিংশ শতকের প্রথমার্ধের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশভাগঃ
দেশের নাম; দেশভাগের সময়; দেশভাগের পর যুদ্ধ ও সংঘাত
আয়ারল্যান্ড; ১৯২২ ১৯২২-২৭; উত্তর আয়ারল্যান্ড সমস্যা (১৯৭০-র দশকে)
ভারত; ১৯৪৭; ভারত-পাক সংঘাত ১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯
প্যালেস্তাইন; ১৯৪৮ ১৯৪৮-৯, ১৯৬৭, ১৯৭৮; ইসরায়েলের ওয়েস্ট ব্যাংক ও গাজা দখল, ১৯৬৭


বাংলা কবিতা ও গানে তার দেশভাগের অভিজ্ঞতা আলোচনার আগে ইংরাজী ভাষায় লেখা কয়েকটি কবিতার উল্লেখ করা যায়, যেখান থেকে দেশভাগের অভিজ্ঞতার সার্বজনীন আবেদনটি বোঝা যায়। এ’প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে যে কবিতাটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল ভারত বিভাগ প্রসঙ্গে W.H. Auden-র “Partition” নামে নীচে উদ্ধৃত দীর্ঘ কবিতাটি যেখানে রডক্লিফ ও তাঁর নেতৃত্ত্বাধীন সীমানা কমিশনের কর্মপদ্ধতি নিয়ে তীক্ষ্ণ শ্লেষ করা হয়েছেঃ

Unbiased at least he was when he arrived on his mission,
Having never set eyes on the land he was called to partition
Between two peoples fanatically at odds,
With their different diets and incompatible gods.
Time,’ they had briefed him in London, is short. It’s too late
For mutual reconciliation or rational debate:
The only solution now lies in separation.
The Viceroy thinks, as you will see from his letter,
That the less you are seen in his company the better,
So we’ve arranged to provide you with other accommodation.
We can give you four judges, two Moslem and two Hindu,
To consult with, but the final decision must rest with you.’

Shut up in a lonely mansion, with police night and day
patrolling the gardens to keep the assassins away,
He got down to work, to the task of settling the fate
Of millions. The maps at his disposal were out of date
And the Census Returns almost certainly incorrect,
But there was no time to check them, no time to inspect
Contested areas. The weather was frightfully hot,
And a bout of dysentery kept him constantly on the trot,
But in seven weeks it was done, the frontiers decided,
A continent for better or worse divided.

The next day he sailed for England, where he could quickly forget
The case, as a good lawyer must. Return he would not,
Afraid, as he told his Club, that he might get shot.


মার্কিন সাংবাদিক Marya Manne ১৯৫৯ সালে লেখা তাঁর “Gaza Strip” কবিতায় দেশভাগের নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন সুন্দর ভাবেঃ


Borders are scratched across the
hearts of men
By strangers with a calm, judicial
pen,
And when the borders bleed we
watch with dread
The lines of ink across the map
turn red.


আইরিশ কবি Paul Muldoon তাঁর “Boundary Commission” কবিতায় দেশভাগ জনিত বিচ্ছিন্নতার কাহিনী পাওয়া যায়ঃ


You remember that village where the border ran
Down the middle of the street,
With the butcher and baker in different states?
Today he remarked how a shower of rain
Had stopped so cleanly across Golightly’s lane
It might have been a wall of glass
That had toppled over. He stood there, for ages,
To wonder which side, if any, he should be on.


বাংলা কবিতায় দেশভাগ


তৎকালীন বাংলা কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে দেশভাগজনিত স্মৃতিমেদুরতা, বাস্তুচ্যুতির দুর্ভোগ, বাস্তুচ্যুত মানুষের শিকড়হীনতার হাহাকার। কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত’র “পূর্ব-পশ্চিম” এবং “উদ্বাস্তু” কবিতায় দেশভাগের যন্ত্রণা প্রতিফলিত হয়েছে। “পূর্ব-পশ্চিম” কবিতায় পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের নিবিড় ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং পারস্পরিক আদান-প্রদানের উপর কবি জোর দিয়েছেন। “উদ্বাস্তু” কবিতায় তিনি একটি পরিবারের সমস্ত শিকড় ছিন্ন করে উদ্বাস্তু হবার জীবন্ত ছবি এঁকেছেন। কবিতার শেষে কবি আমাদের এক নির্মম সত্যের সামনে এনে দাঁড় করান যখন তিনি লেখেনঃ


আমরা সবাই উদ্বাস্তু —
কেউ উৎখাত ভিটে-মাটি থেকে,
কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে।


বিষ্ণু দে তাঁর “জল দাও” কবিতায় লিখেছেনঃ

…গরমে বিবর্ণ হল গোলমোরের সাবেক জৌলুস-
কৃষ্ণচূড়া চোখে আনে জ্বালা
রৌদ্রের কুয়াশা জ্বলে ঝরা মরা পোড়া লেবার্নমে
এখানে ওখানে দেখ দেশছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায়
পার্কের ধারে শানে পথে পথে গাড়িবারান্দায়
ভাবে ওরা কী যে ভাবে ! ছেড়ে খোঁজে দেশ
এইখানে কেউ বরিশালে কেউ কেউ বা ঢাকায়…


আর এক সমসাময়িক কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর “এস দেখে যাও” কবিতায় আক্ষেপ করে লিখেছেনঃ


এস দেখে যাও কুটি কুটি সংসার
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছাড়ানো বে-আব্রু সংসারে
স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে
ভেসে এসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও-যে
ছেঁড়া কানিটুকু কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ-
আমার বাঙলা।


মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর আর একটি কবিতা “শুকনো মুখ উস্কোখুস্কো চুল”–এ লিখেছেনঃ


শুকনো মুখ, উস্কোখুস্কো চুল
বিষাদপ্রতিমা
রোজই রাস্তায় দেখি ফুটপাথের হাঁড়িকুড়ি-ছড়ানো সংসারে
শুকনো মুখ উস্কোখুস্কো চুল
শিয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আছড়ে-পড়া উদ্বাস্তু সংসারে
বিষাদপ্রতিমা…
শুকনো মুখ, উস্কোখুস্কো চুল
বিষাদপ্রতিমা
হারানো মা, আমারে কি হারানিধি বলে মনে ধরে!


কবি মণীন্দ্র রায় তাঁর একাধিক কবিতায় উদ্বাস্তু জীবনের দুর্ভোগ এবং অসহায়তার কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর এরকম একটি কবিতা হল “চিঠি”, যেখানে তিনি এক উদ্বাস্তু বৃদ্ধার ছেড়ে আসা গ্রাম এবং সেখানকার মানুষ-জনের জন্য দুশ্চিন্তা ও মনখারাপের অনুভূতি তুলে ধরেছেনঃ


সুশান্ত, তোমার মনে পড়ে
সরলার মাকে, যে এখানে
কাজ করত? হঠাৎ সেদিন
শুনলো যেই বন্যা পাকিস্তানে,
বুড়ি গিয়ে বসল বারান্দায়,
দেখি তার চোখে জল ঝরে।…


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উদ্বাস্তু জীবনের দুর্ভোগ এবং দুর্দশার কথা তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস এবং কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। “ধাত্রী” কবিতায় তিনি উদ্বাস্তু সমস্যা জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গকে তাঁর ধাইমার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং তাঁর অসহায়তার কথা লিখেছেনঃ


শিয়ালদার ফুটপাতে বসে আছেন আমার ধাইমা
দুটো হাত সামনে পেতে রাখা,
ঠোট নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে।
যে কেউ ভাববে দিনকানা এক হেঁজিপেঁজি বাহাত্তুরে রিফিউজি বুড়ি।
আঁতুর ঘরে আমার মুমূর্ষু মায়ের কোল থেকে উনি
একদিন আমাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন…
ধাইমা, এ কোন্ পৃথিবী আমাকে দেখালে?
বুড়ি, সর্বনাশিনী, আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছিলি
এই অকল্পনীয় পৃথিবীতে
আমি আর কত কিছু হারাবো?


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আর ও অসংখ্য কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে দেশভাগ, ছেড়ে আসা গ্রাম, নদী, প্রকৃতি ও মানুষজন। এমনই একটি কবিতা “যদি নির্বাসন দাও” যেখানে স্মৃতিকাতরতা কবিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাঁর লেখা এরকম আর কয়েকটি কবিতা হল “জনমদুখিনী”, “দুঃখের গল্প”, “ফিরে যাবো” ইত্যাদি।


সমকালীন আর এক প্রথিতযশা কবি শঙ্খ ঘোষ দেশভাগ, জন্মভূমি, ছেড়ে আসা গ্রাম, উদ্বাস্তুজীবনের দুর্ভোগ, শিকড়হীনতার বেদনার কথা বারবার তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। “স্বদেশ স্বদেশ করিস কারে” কবিতায় তিনি কৃত্রিম মানচিত্রসর্বস্ব জাতিরাষ্ট্রকে প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন। লিখেছেনঃ


তুমি মাটি? কিংবা তুমি আমারই স্মৃতির ঘূপে ধূপে
কেবল ছড়াও মৃদু গন্ধ আর, আর – কিছু নও?
রেখায় রেখায় লুপ্ত মানচিত্র-খণ্ডে চুপিচুপি—
বাল্যসহচর! তুমি মাটি নও দেশ নও তুমি…


তুমি দেশ? তুমিই অপাপবিদ্ধ স্বর্গাদপি বড়ো?
জন্মদিন মৃতুদিন জীবনের প্রতিদিন বুকে
বরাভয় হাত তোলে দীর্ঘকায় শ্যাম ছায়াতরু
সেই তুমি? সেই তুমি? বিষাদের স্মৃতি নিয়ে সুখী
মানচিত্ররেখা, তুমি দেশ নও মাটি নও তুমি!


“পুনর্বাসন” কবিতায় লিখেছেনঃ


যা কিছু আমার চারপাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চারপাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চারপাশে ছিল
ধ্বস্ত
তীরবল্লম
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিমমুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙ্গা বাক্স পড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাৎ সব বাস্তুহীন।…


“মন্ত্রীমশাই” কবিতায় কবি দেশভাগের কুটিল রাজনীতির সমালোচনা করেছেন এবং সেই রাজনীতির বলি উদ্বাস্তুদের অসহায়তার কথা তুলে ধরেছেনঃ


সবাইকে পথ দেবার জন্য কয়েকজনকে সরতে হবে।
তেমন-তেমন সময় এলে হয়তো আমায় মরতে হবে
বুঝতে পারি।
এ-যুক্তিতেই ভিটেমাটির ঊর্ণা ছেড়ে বেরিয়েছিলাম…


কিন্তু সবাই বললো সেদিন, হা কাপুরুষ, হদ্দ বাঙাল
চোরের মতো ছাড়লি নিজের জন্মভুমি।
জন্মভুমি? কোথায় আমার জন্মভুমি? খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল।
দিন কেটেছে চোরের মতো দিনভিখারি ঘোরের মতো
পথেবিপথে…


উদ্বাস্তুদের দেশহীনতার কথা লিখেছেন “দেশহীন” কবিতায়ঃ


আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত
আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি…


পূর্ববঙ্গ থেকে সংখ্যালঘু প্রতিবেশী হিন্দুদের দেশত্যাগের ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার প্রতিফলন ঘটেছে কবি জসীমউদ্দিনের “বাস্তুত্যাগী” কবিতার ছত্রে ছত্রেঃ


দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীর খোঁজ করি…
ফিরে এসো যারা গাঁ ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে,
তোমাদের কতো অতীত দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।
সুপারির বন শূন্যে ছিঁড়িছে দীঘল মাথার কেশ,
নারকেলতরু ঊর্দ্ধে খুঁজিছে তোমাদের উদ্দেশ।…
অতীতে হয়তো কিছু ব্যথা দেছি, পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা,
আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সেসব অতীত কথা!


বাংলা গানে দেশভাগ


কবিতার মতো বাংলা গানে দেশভাগের প্রতিফলন তত জোরালো নয়। স্বাধীনোত্তর বাংলা গানের মূল স্রোতটি প্রবাহিত হয় সিনেমাকেন্দ্রিক রোমান্টিক গানের দিকে। মতাদর্শগত বিরোধ গণনাট্য সংঘকে গ্রাস করে, যা ৪০-এর দশকে সমাজবাস্তবতাকে তাদের গানে তুলে এনেছিল। সেই ধারাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও সলিল চৌধুরী একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তা’সত্ত্বেও দেশভাগ এবং উদ্বাস্তুদের নিয়ে বেশ কিছু গান রচিত হয়। সেই সমস্ত গানের অধিকাংশই রেকর্ড হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলির বেশীরভাগই আজ হারিয়ে গেছে আমাদের স্মৃতি থেকে। কিছু গান বেঁচে আছে বিস্মৃতির ছোবল এড়িয়ে। যেমন দেশভাগের আঘাতে জর্জরিত উদ্বাস্তুদের মনোবল ফেরাতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গান বাঁধলেনঃ


বাঁচবো রে বাঁচবো
ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়ব…


দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে বহু কবিয়াল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এসে আশ্রয় নেন এবং বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে গান বাঁধেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম একজন কবিয়াল ছিলেন বরিশাল থেকে আগত নকুলেশ্বর সরকার। তাঁর রচিত অসংখ্য গানের মধ্যে একটি ছিলঃ


আছি বাস্তুহারা হিন্দু যারা, হবে মোদের বাস্তু গড়তে,
আবার হবে দাঁড়াতে — পথের কাঁটা সরাতে।


ফরিদপুর থেকে আগত সুরেন্দ্র নাথ সরকার উদ্বাস্তুদের নিদারুণ দুর্ভোগ নিয়ে গান বাঁধলেনঃ


আমরা যারা বাস্তুহারা, একেবারেই সর্বহারা
তাদের অন্নচিন্তা চমৎকার।
তারা কেউ ঝোপে-জঙ্গলে, কেউ বা তাঁবুর তলে
কেহ প’ড়ে তালবেতালে, আছে আজ নৈনিতালে।
কেহ বা দুটো অন্নের জন্য রয়েছে দণ্ডকারণ্যে,
কেহ বা বিনা খুনে গিয়েছে আন্দামানে…।


তাঁর রচিত গানের আরও কয়েকটি পংক্তি যেখানে পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুদের ক্যাম্প-কলোনী মাঠে-ঘাটে বাসের মর্মন্তুদ দুঃখ এবং তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযোগ ফুটে উঠেছেঃ


এমন সোনার বাংলা দেশে,
মানুষ বেড়ায় ভেসে ভেসে,
হলাম বাস্তুহারা সর্বহারা—
কার কলমের এক খোঁচায়।
আমরা ক্যাম্পে শুয়ে আজো মাঠে,
আর কত দিন জীবন কাটে,
দেখে মোদের দুঃখ কষ্ট—
শেয়াল কুকুর লজ্জা পায়।


শেষের কিছু কথা


দেশভাগ আমাদের দেশের ইতিহাস চর্চার সামনে একটি বিরাট বাধার প্রাচীর খাড়া করে। স্বাধীনতা ও দেশভাগ আধুনিক ভারতের ইতিহাসের জন্য এক অলঙ্ঘ্যনীয় লক্ষ্মণরেখা টানে যা অতিক্রম করা ঐতিহাসিকদের পক্ষে অনেকদিন সম্ভব হয়নি। ঐতিহাসিকদের সেই না করা কাজটি অনেকটাই করেছেন কবি, গীতিকার এবং সাহিত্যিকরা। দেশভাগের দুঃখ, বেদনা মূর্ত্ত হয়ে উঠেছে তাঁদের সৃষ্টিকর্মে। আজকের দিনে ঐতিহাসিকরা তাই অনেকটাই ঋণী সেযুগের কবি সাহিত্যিকদের কাছে। দেশভাগের মানবিক সত্ত্বাকে খুঁজে পাওয়া যায় সমকালীন সাহিত্যেই, সরকারী অভিলেখ্যাগারে নয়। সম্প্রতিকালে দেশভাগ নিয়ে যে নতুন ধারার ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে তাতে সমকালীন সাহিত্যে প্রতিফলিত দেশভাগের অভিজ্ঞতা দারুণ ভাবে আদৃত হচ্ছে এবং তার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের গণ্ডীও প্রসারিত হচ্ছে।

=============∆∆∆¶¶¶¶∆∆¶¶¶¶=======



No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...