Saturday, 30 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ৩০.১০.২১. Vol -541. The blogger in literature e-magazine

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 

১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতা শহরের হাতিবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মায়ের নাম ইন্দুমতি বসুমল্লিক। সুধীন দত্তের বাল্যকাল কেটেছে কাশীতে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাশীর থিয়সফিক্যাল হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পরে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯২২ সালে স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য ও আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত যথারীতি পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও কোনো বিষয়েই পরীক্ষা দেন নি।

১৯২৪ সালে ছবি বসুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু এক বছরের ভিতরেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালের ২৯ মে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রাজেশ্বরী বসুর সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬০ সালের ২৫ জুন কবি নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করেন।
সুধীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ ছয়টি :

তন্বী (১৯৩০)
অর্কেষ্ট্রা (১৯৩৫)
ক্রন্দসী (১৯৩৭)
উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০)
সংবর্ত (১৯৫৩)
দশমী (১৯৫৬)
এছাড়াও তার দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে :

স্বগত (১৯৩৮)
কুলায় ও কালপুরুষ (১৯৫৭)
অনুবাদগ্রন্থ : প্রতিধ্বনি (১৯৫৪)


বিশ শতকে বুদ্ধির দীপ্তি কিংবা প্রতিভার বিশেষ আবেশে বাংলা সাহিত্যকে যাঁরা অগ্রসরতার পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেছেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (৩০ অক্টোবর ১৯০১-- ২৫ জুন ১৯৬০) তাঁদের মধ্যে অবশ্য-বিবেচ্য ব্যক্তিত্ব।বাংলা কবিতায় “ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক” হিসেবে খ্যাত সুধীন্দ্রনাথ।, “ক্লাসিকাল” অর্থে “ধ্রুপদী” শব্দটি তাঁরই উদ্ভাবনা। নানান বিদ্যায় বিদ্বান এবং বহুভাষাবিদ এ কবি মনস্বী তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন।

এবং তথ্য ও তত্ত্বে আসক্ত মানুষ হিসেবে তিনি সমকালে ও উত্তরকালে প্রশংসিত হয়েছেন।
 
গার্হস্থ্য ধর্মপালনে, সামাজিক আচারে কিংবা পঠন ও আলাপনে তাঁর আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতা ছিল একরকম ঈর্ষণীয়।

ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠার মোহ সুধীনকে কখনো আঁকড়ে ধরেনি; পিতার উত্তরসূরি এই দেশহিতৈষী সমাজ সেবায়ও একসময় আগ্রহ হারিয়েছেন সমাজ ও সমকালের অধোগতির ফলে। আর শেষত স্থিত হয়েছেন সর্বজনের প্রতি প্রসারিত কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত সাহিত্যচর্চার উদার জমিনে।

তাঁর সমকালের কবি ও বন্ধু বুদ্ধদেব বসু সুধীনকে বলেছেন-- “স্বভাবকবি নন, স্বাভাবিক কবি”।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কৈশোরে কিংবা যৌবনের প্রথমপাদে ছোটগল্প এবং উপন্যাসের খসড়া তৈরি করলেও শেষপর্যন্ত কবিই হলেন। ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, পুস্তক-সমালোচনা, অনুবাদ, প্রবন্ধ এবং বিবিধ গদ্যও লিখেছেন তিনি তাঁর প্রতিদিনকার কার্যলিপিতে। “পরিচয়” (১৯৩১--১৯৩৬) নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন।

তন্বী (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩০) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০-- এই দশ বছর সুধীনের অধিকাংশ রচনার জন্মকাল। পরে জীবনের ক্রান্তিকাল আর অভিজ্ঞতাও তাঁর লেখালেখির সরল উপাদান হয়েছে। আবেগ আর পরিশ্রমের দারুণ ফসল তাঁর কবিতা। সুধীনের সাহিত্যসাধনার মূল ভিত্তি ছিল আত্মোপলব্ধি। তাই কবিতার স্বপ্নবাড়িতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন প্রবল প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় মাল-সামানা ও রশদ সাথে নিয়ে। নিজেকে ক্রমাগত অতিক্রমের এক অনিমেষ প্রেরণাকে চেতনায় ধারণ করে তিনি সামাজিক দুঃশাসন এবং সামাজিকের অবোধ্যতা-নির্বোধতাকে সরলপাঠে ও সাহসের সমাচারে তুলে ধরেছেন।

নিজের কবিতাযাত্রা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন-- “আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি”। অনুভবজ্ঞানের এই আত্মপ্রচার আমাদেরকে বিস্মিত ও শ্রদ্ধানত করে।

সুধীন্দ্রনাথের লেখা ১৯০টি কবিতার পরিসরকে বিবেচনায় রেখে এবং আমার কবিতা-বিশ্লেষণের অযোগ্যতাকে স্বীকার করে, বর্তমান পাঠ ও পর্যালোচনাটি দুটি কবিতাÑ “উটপাখি” এবং “দুঃসময়” কে ঘিরে আবর্তিত হবে এবং শেষত তা আপাত সমাপ্তির পথে, সুধীনের চিন্তা ও নির্দেশনাকে মনে রেখে, সতর্ক পা বাড়াবে।

“উটপাখি” (১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ক্রন্দসী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত) কবিতাটি আত্মবিবরণ, আত্মপ্রতিফলন আর সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে মানব জীবনে বাস্তবতা-কল্পনায় অবগাহনের ভাবনামিশ্রিত এবং বিচিত্র চিন্তা-জাগানিয়া বিবরণের বর্ণে মাখা। অভিভাবকীয় সুরে কবি এখানে নির্মাণ করেছেন কবিতার কথামালা; প্রাজ্ঞ এক সমাজ-বিশ্লেষক যেন বলছেন তাঁর দেখে-আসা সকল অনুভব, অভিজ্ঞতা আর পরামর্শের ব্যাপারাদি।

কবিতাটির আরম্ভ হচ্ছে এভাবে:

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছ তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরুভূমি;
ক্ষ’য়ে ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ।

ফেলে-আসা সময়ের ও চিন্তার গতি-প্রকৃতির স্মৃতি-রোমন্থনে কবি মাঝে মাঝে নিবিড় হয়ে ওঠেন। মধ্যে মধ্যে হয়তো কোনো প্রিয়মুখের অনুপস্থিতিও তাঁকে বিষণ্ন করে তোলে। তাঁর অনুভব: “নিষাদের মন মায়ামৃগে মজে নেই;/ তুমি বিনা তার সমূহ সর্বনাশ। / কোথায় পালাবে? ছুটবে বা আর কত?/ উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা। / প্রাক্পুরাণিক বাল্যবন্ধু যত/ বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা। /”

নিঃসঙ্গতা, অপারগতা আর সময়ের অপার শূন্যতায় মানুষের নির্মম পরিণতির কথা ভাবতে গিয়ে তিনি যেন অন্তসারশূন্য সমাজের ছবি দেখেছেন নিজের চোখে ও অনুভবে।

মরুভূমিতে পানি ঢেলে সবজি চাষের চেষ্টা বৃথা, যেমন ক্ষুধার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলার বোকামি সত্য। ইচ্ছা নামক ঘুড়িকে উড়তে দেওয়ার মধ্যে আছে স্বাধীনতা; সে স্বাধীনতা চিন্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার। বিপদ মোকাবিলা করার জন্য যে জাগতিক জ্ঞান দরকার তা বোধকরি সকলে আয়ত্ব করতে পারে না-- বিশেষত প্রতিভার প্রশস্ত বারান্দায় যারা ঠায় দাঁড়িয়ে মেধাবৃত্তির অমোঘ বাতাসে চুল ওড়াতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তারা তো ওই নিরেট সত্যের পাটাতন থেকে নিশ্চিত দূরত্বে আপন অবস্থান নির্মাণ করেন হয়তো বা নিজেরই অজান্তে; কোনো অলৌকিক আবেশের অপরিহার্য প্রবল টানে। কবি কি সংসার-বিবাগি মরুচারি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন? কে জানে সে কথা! তবে তিনি জাগতিক কৃত্রিম জীবন-ব্যবস্থার চেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক ও প্রতিযোগিতাহীন জীবনকেই হয়তো আরাধ্য জেনেছেন। নতুনের পথে; এবং তা অবশ্যই কৃত্রিমতাবিহীন-- তাঁর মানসিক পরিভ্রমণ এই কবিতায় একটা নিটোল ছবি হয়ে ধরা পড়ে পাঠকের সোজা চোখে।

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনও বিপদ্প্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনও নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অন্তত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে॥

আমরা যদি নিবিড়চোখে তাকাই দেখবো--- সমকালের যাপিত জীবন ও পৃথিবীর চালচিত্রের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে লিপ্ত হয়ে আছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতার শরীর--  রক্ত ও মাংসসমেত সমূহ প্রবণতা ও প্রস্রবন। মানবিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সম্প্রীতির ব্যাপারে তাঁর ভাবনার অতলতাকে আমরা স্পর্শ করি তাঁরই নির্মিত কবিতা-কথনের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময়। আর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দায় ও দায়িত্বের বিষয়েও যে তিনি প্রবল সচেতন, তাও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রসঙ্গত “উটপাখি” কবিতার শেষাংশের পাঠ নেওয়া যেতে পারে:

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার;
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি ॥

ঈশ্বরে বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস থাক-বা-না-থাক আমরা কিন্তু বিপদে পড়লে কিংবা প্রবল হতাশা ও ক্লান্তির মধ্যে অবগাহনের কালে একজন বা একাধিক বিধাতার কাছে অবনত মস্তকে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় মগ্ন হই। বিধাতাকে অস্বীকার হয়তো করেননি কবি সুধীন; তবে তাঁর নানান কবিতায় বিধাতার উপস্থিতি বিষয়ে সংশয়ের কথা আমরা জানি। আবার আরাধ্য মানুষের জন্য আকুতি প্রকাশের সময় এই কবিকে বিধাতার কাছে দ্বারস্থ হতে দেখি। কবি ও দার্শনিক সুধীন জানতেন--- পৃথিবীতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি মিথ্যা হয়, তাহলেও মানুষ তার অমর বাসনার উচ্চারণ করেই ভুবনকে তাৎপর্য দান করতে পারে; আর এভাবেই অনুভবের পীড়িত-অবস্থা থেকে মুক্তির পথে প্রবেশ করে সচেতন ও প্রজ্ঞাবান মানুষ।

কবিতাটির পাঠ-বিবরণের মধ্যপর্যায়ে জীবন-মৃত্যুর আস্বাদ, বর্তমান-ভবিষ্যতের ফারাক আর ইচ্ছা ও সাধ্যের ব্যাপারাদি কবির কাছে, পাঠকের কাছেও নিশ্চয়, খুব মূল্যবান বস্তু হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি বর্তমানের সত্য ও অসহায়তাকে মেনে নিয়ে কেবল ভবিষ্যতের অনাগত অন্ধকার বা আলোর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেও যেন প্রস্তুত!

অসুন জেনে নিই তাঁর সেই প্রস্তুতির সারকথা: “তবুও ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে,/ কায়-মনে তোমারেই চাই। / জানি স্বর্গ মিথ্যা কথা, তথাপি অলীক বিধাতারে/ রাত্রি-দিন মিনতি জানাই। / উন্মথি হৃদয়সিন্ধু সৃজনের প্রথম প্রভাতে/ অভুঞ্জিত সুধাভা- অর্পিলাম মোহিনীর হাতে;/ মৃত্যুর মাধুরী কিন্তু বাকি আছে, এসো আজ তাতে/ আমাদের অমরা সাজাই। / অসাধ্যসিদ্ধির যুগ ফিরিবে না, জানি, এ-সংসারে;/ তবু রুদ্র ভবিষ্যতে চাই ॥”

ভগবানের অভাব সুধীন কবিতা দিয়ে মেটাতে চাননি; জনগণ কিংবা ইতিহাসের খেরোপাতা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েও নয়-- তাঁর তৃষ্ণা ছিল সনাতনতার ভেতর থেকে অমৃতকে উদ্ধার করার বাসনায়। মিথ্যা দেবতাকে তিনি চিন্তা ও চেতনায় ধারণ করেননি; তবে কল্পনায় স্বর্গের অনুভবও নিতে চেয়েছেন। মর্তভূমির পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেবের দিকে সুধীনের প্রবল আকুতি মাঝে মধ্যে আমাদেরকে তাঁর ঈশ্বরভাবনা বিষয়ে ভাবিয়ে তোলে। নিয়তিকে কি নির্মাণ অথবা পুনর্নিমাণ কিংবা বিনির্মাণ করা যায়? অনেকে তো বলেন শুনি-- নিজের হাতে নাকি ভাগ্যের চাকা ঘুরানো সম্ভব। কী জানি, কী সত্য এই পৃথিবীতে! তবু ভাগ্য মেনে কেউ করেন কাজ; আবার ভাগ্যকে নিজের কব্ন্ত্তা

মরুভূমিতে পানি ঢেলে সবজি চাষের চেষ্টা বৃথা, যেমন ক্ষুধার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলার বোকামি সত্য। ইচ্ছা নামক ঘুড়িকে উড়তে দেওয়ার মধ্যে আছে স্বাধীনতা; সে স্বাধীনতা চিন্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার। বিপদ মোকাবিলা করার জন্য যে জাগতিক জ্ঞান দরকার তা বোধকরি সকলে আয়ত্ব করতে পারে না-- বিশেষত প্রতিভার প্রশস্ত বারান্দায় যারা ঠায় দাঁড়িয়ে মেধাবৃত্তির অমোঘ বাতাসে চুল ওড়াতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তারা তো ওই নিরেট সত্যের পাটাতন থেকে নিশ্চিত দূরত্বে আপন অবস্থান নির্মাণ করেন হয়তো বা নিজেরই অজান্তে; কোনো অলৌকিক আবেশের অপরিহার্য প্রবল টানে। কবি কি সংসার-বিবাগি মরুচারি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন? কে জানে সে কথা! তবে তিনি জাগতিক কৃত্রিম জীবন-ব্যবস্থার চেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক ও প্রতিযোগিতাহীন জীবনকেই হয়তো আরাধ্য জেনেছেন। নতুনের পথে; এবং তা অবশ্যই কৃত্রিমতাবিহীন-- তাঁর মানসিক পরিভ্রমণ এই কবিতায় একটা নিটোল ছবি হয়ে ধরা পড়ে পাঠকের সোজা চোখে।

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনও বিপদ্প্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনও নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অন্তত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে॥



আমরা যদি নিবিড়চোখে তাকাই দেখবো--- সমকালের যাপিত জীবন ও পৃথিবীর চালচিত্রের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে লিপ্ত হয়ে আছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতার শরীর-- রক্ত ও মাংসসমেত সমূহ প্রবণতা ও প্রস্রবন। মানবিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সম্প্রীতির ব্যাপারে তাঁর ভাবনার অতলতাকে আমরা স্পর্শ করি তাঁরই নির্মিত কবিতা-কথনের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময়। আর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দায় ও দায়িত্বের বিষয়েও যে তিনি প্রবল সচেতন, তাও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রসঙ্গত “উটপাখি” কবিতার শেষাংশের পাঠ নেওয়া যেতে পারে:

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার;
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি ॥



ঈশ্বরে বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস থাক-বা-না-থাক আমরা কিন্তু বিপদে পড়লে কিংবা প্রবল হতাশা ও ক্লান্তির মধ্যে অবগাহনের কালে একজন বা একাধিক বিধাতার কাছে অবনত মস্তকে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় মগ্ন হই। বিধাতাকে অস্বীকার হয়তো করেননি কবি সুধীন; তবে তাঁর নানান কবিতায় বিধাতার উপস্থিতি বিষয়ে সংশয়ের কথা আমরা জানি। আবার আরাধ্য মানুষের জন্য আকুতি প্রকাশের সময় এই কবিকে বিধাতার কাছে দ্বারস্থ হতে দেখি। কবি ও দার্শনিক সুধীন জানতেন--- পৃথিবীতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি মিথ্যা হয়, তাহলেও মানুষ তার অমর বাসনার উচ্চারণ করেই ভুবনকে তাৎপর্য দান করতে পারে; আর এভাবেই অনুভবের পীড়িত-অবস্থা থেকে মুক্তির পথে প্রবেশ করে সচেতন ও প্রজ্ঞাবান মানুষ।

কবিতাটির পাঠ-বিবরণের মধ্যপর্যায়ে জীবন-মৃত্যুর আস্বাদ, বর্তমান-ভবিষ্যতের ফারাক আর ইচ্ছা ও সাধ্যের ব্যাপারাদি কবির কাছে, পাঠকের কাছেও নিশ্চয়, খুব মূল্যবান বস্তু হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি বর্তমানের সত্য ও অসহায়তাকে মেনে নিয়ে কেবল ভবিষ্যতের অনাগত অন্ধকার বা আলোর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেও যেন প্রস্তুত!

অসুন জেনে নিই তাঁর সেই প্রস্তুতির সারকথা: “তবুও ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে,/ কায়-মনে তোমারেই চাই। / জানি স্বর্গ মিথ্যা কথা, তথাপি অলীক বিধাতারে/ রাত্রি-দিন মিনতি জানাই। / উন্মথি হৃদয়সিন্ধু সৃজনের প্রথম প্রভাতে/ অভুঞ্জিত সুধাভা- অর্পিলাম মোহিনীর হাতে;/ মৃত্যুর মাধুরী কিন্তু বাকি আছে, এসো আজ তাতে/ আমাদের অমরা সাজাই। / অসাধ্যসিদ্ধির যুগ ফিরিবে না, জানি, এ-সংসারে;/ তবু রুদ্র ভবিষ্যতে চাই ॥”

ভগবানের অভাব সুধীন কবিতা দিয়ে মেটাতে চাননি; জনগণ কিংবা ইতিহাসের খেরোপাতা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েও নয়-- তাঁর তৃষ্ণা ছিল সনাতনতার ভেতর থেকে অমৃতকে উদ্ধার করার বাসনায়। মিথ্যা দেবতাকে তিনি চিন্তা ও চেতনায় ধারণ করেননি; তবে কল্পনায় স্বর্গের অনুভবও নিতে চেয়েছেন। মর্তভূমির পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেবের দিকে সুধীনের প্রবল আকুতি মাঝে মধ্যে আমাদেরকে তাঁর ঈশ্বরভাবনা বিষয়ে ভাবিয়ে তোলে। নিয়তিকে কি নির্মাণ অথবা পুনর্নিমাণ কিংবা বিনির্মাণ করা যায়? অনেকে তো বলেন শুনি-- নিজের হাতে নাকি ভাগ্যের চাকা ঘুরানো সম্ভব। কী জানি, কী সত্য এই পৃথিবীতে! তবু ভাগ্য মেনে কেউ করেন কাজ; আবার ভাগ্যকে নিজের কব্জায় নেবার জন্য কতজনকে যে কত কসরত করতে হয় তারও কোনো ইয়ত্তা পাওয়া যায় না।

সুধীন্দ্রনাথ কি ভাগ্যের নবায়ন বা নতুন রূপায়নের পক্ষে? এই প্রশ্নের চূড়ান্ত ফয়সালা মেলা ভার। তবে কি তাঁর কবিতায় আশাবাদের সুতো ধরে পানির স্বচ্ছ ধারার মতো নিচে নেমে এসেছে কপালের লিখনের জন্য দোয়াতে সাজিয়ে রাখা লাল বা সোনালি রঙের কালি! নাকি এসব সবই স্বপ্ন ও কল্পনার মিথ্যামিথ্যা খেলার জাল মাত্র! কী পাঠ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়? অনুসন্ধান করে দেখা যাক :

আঁধার ঘনায় চোখে, তুমি ছাড়া কেউ নেই পাশে,

অন্তরীক্ষে জমে বিভীষিকা।
লুব্ধ ভবিতব্য তারে রুদ্ধ করো দৃপ্ত পরিহাসে,
হাতে হাত রাখো, সাহসিকা।
তোমার মাভৈ শুনে হয়তো বা লজ্জিত নিয়তি
ফিরাবে, অভ্যাস ভুলে, ঐকান্তিক সময়ের গতি,
মৃত্যুর বিক্ষিপ্ত জাল দিবে বুঝি মোরে অব্যাহতি,
শাপমুক্ত হবে অহমিকা;
নবজাত ভগবান বিরচিবে কৃতজ্ঞ উল্লাসে
আমাদের নব নীহারিকা ॥

কবিতার মায়াবিনী মমতার পরশ ও সাহচর্য থেকে সুধীন যেন কিছুতেই মুক্তি পাননি। অবশ্য তার চেয়ে বড়ো কথা সে অবস্থা থেকে তিনি মুক্তি চাননি। কারণ তিনি প্রতিনিয়ত কবিতার পাশাপাশি নতুন করে রচনা করেছেন, আবিষ্কার করেছেন নিজেকে। এই পথ ছিল তাঁর আত্ম-অনুসন্ধানের পথ। কবি সুধীনের কাজ বহুমুখি হলেও সাধনা ও ধ্যান ছিল বিশুদ্ধ বাণীমাধুরী। বানান-ব্যাকরণ ও উচ্চারণের ভিন্নতায় তিনি অত্যন্ত সতর্ক শিল্পী। অস্পষ্ট ও অনিচ্ছুক ভাবনা-বেদনাকে ছন্দ ও ভাষার নিগড়ে বাঁধতে এবং চিরাচরিত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে শিল্পের উদার জমিনের গীতল আহ্বানে সাড়া দেবার প্রত্যক্ষ প্রত্যয়ের বিচারে বাংলা কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শূন্যস্থানপূরণ করা, বোধকরি, খুব সহজ নয়। সৃজনকর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পর্বে ও বাঁকে এই মানুষটি “কবি” শব্দের সকল সামর্থ্য ও শক্তিকে সফলভাবে ধারণ করতে পেরেছিলেন।

তাঁর কবিতায় দুরূহতা (বিশেষত নতুন ও অপ্রচলিত শব্দের প্রয়োগে) পাঠকের চোখে পড়ে; তবে সে কঠিনতা অল্পআয়াসে অতিক্রম করাও অসম্ভব নয়। আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি বাংলা কবিতাকে সুধীন দান করেছেন শ্রবণসুভগ সংহতি ও আভিজাত্য। সমাজের সত্য পাঠ অনুসন্ধান ও পরিবেশন, কল্পনা ও প্রেমানুভূতির উপস্থাপনাসমেত তিনি পাঠকের কাছে যথাসম্ভব হাজির থেকেছেন অভিজাত শিল্পী ও সামাজিকের দায় কাঁধে নিয়ে!
==============πππππππππππππππππ

No comments: