জনম দুখিনির ঘর
"দুব্বার কয়েকটি ছোপ
ধানের গুচ্ছের একটু ছটা
কয়েকটা দয়েল ফিঙে টুনটুনি
নরম হাসির আভা
দু-একজনের ঠোঁট আদর করার মতো খোলা
এই সব নিশানা ধরেই
এখানে ফিরেছি আমি।
দুরন্ত রোদের টিলা পেরিয়ে এলাম,
কুয়াশা প্রান্তর বনবাদাড়ের রাত
আমায় ঘোরায়নি আর,
অচেনা হাটূরে আনাগোনা ক্রমে ক্রমে মুছে গেছে,
নানান জিঞ্জাসাবাদ বিচিত্র ভাষার স্তূপ ঠেলে
এখন আমার কান শুদ্ধ এক ধ্বনিতে পেতেছি।
সেই পিদ্দিমের আলো দেখা যায়,
জন্মদুখিনির ঘর।
কবে আমি বড়ো হয়ে তাকে ছেড়ে চ'লে আসি
তবু তার আঁচলের হাওয়া আজও আমার নিভূতে,
ঘুমের সময় যত গল্প ছিল আমাদের
অন্ধকার ভরাত যা সবই সে তো রূপকথার,
তবু দুঃখ ঘোচানোর গোপনতা নিয়ে
গল্পের রাতের মধ্যে অভিভুত আমরা ঘুমোতাম।
তারপর একদিন বেরিয়েছি,
সন্ধ্যার সীমান্তজোড়া পাহাড় ডিঙিয়ে
কতদূর চ'লে গেছি,
বিভূঁই মনের মধ্যে পথ খুঁজে কতবার দিশেহারা,
রূপকথার কোনো দেশ দেখিনি তো।
আজ দুব্বা ধান পাখি দেখে
ভালোবাসার দু-একটা মুখ দেখে
এখানে ফিরেছি
পিদ্দিপ জ্বলার একলা ঘর,
ওই আলো অন্ধকার আমার নাড়িতে বাজে,
আমার শ্রবণ একক স্বরের স্থিতি পায়ঃ
ভাঙাচোরা বুড়ি গলা
বিশুদ্ধ অতলস্পর্শ,
ঘরে ফিরতে বলে ডাকে।
সলতেটা নেভার পরও এই ডাক ঘুরতে ঘুরতে থাকবে
যতক্ষণ না আমি
রাত্তিরের গল্পগুলো মনে চেপে
আবার দাঁড়াব গিয়ে দুঃখের দুয়োরে ।।"
মাত্র ষোলো বছর বয়সে 'বেণু' নামে একটি কিশোর পত্রিকায় প্রথম অরুণ মিত্রের কবিতা প্রকাশিত হয়। তার মৌলিক কাব্যগ্রন্থগুলি হল প্রান্তরেখা (১৯৪৩), উৎসের দিকে (১৯৫০), ঘনিষ্ঠ তাপ(১৯৬৩), মঞ্চের বাইরে মাটিতে (১৯৭০), শুধু রাতের শব্দ নয় (১৯৭৮), প্রথম পলি শেষ পাথর (১৯৮১) ও খুঁজতে খুঁজতে এতদূর (১৯৮৬)। শুধু রাতের শব্দ নয় কাব্যগ্রন্থটি ১৯৭৯ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারে এবং খুঁজতে খুঁজতে এতদূর কাব্যগ্রন্থখানি ১৯৮৭ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়। তাঁর কাব্য সংকলন পনেরো খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৩৬-এ স্পেনের গৃহযুদ্ধ, স্পেনের গণতন্ত্রী সরকারের পথে বিব-জনমত গড়ে ওঠা, লােরকা-র্যাল ফক-বাওওয়েলের মৃত্য, ১৯৩৭-এ জাপানের চীন আক্রমণ। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু (১৯৩৯), অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ (১৯৪১)—ফ্যাসিবাদ-বিরুদ্ধ উদ্দীপনার বিপুল তরঙ্গাভিঘাত। এদেশের মাটিতে ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়াে আন্দোলন’ সমর্থন করেননি সাম্যবাদীরা। কিন্তু বিরুদ্ধতারও একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় নিজেদেরই মধ্যে বাংলায় ফ্যাসিস্ট বিরােধী লেখক ও শিল্পী সঙেঘ’র প্রতিষ্ঠা (১৯৪২), তারপরে মন্বন্তর (১৯৪৩), ‘গণনাট্য সঙেঘ’র প্রতিষ্ঠা (১৯৪৪), পুনশ্চ সাম্প্রদায়িকতার কলুষিতরূপ (১৯৪৬), দেশ টুকরাে হওয়া স্বাধীনতা (১৯৪৭), পুনশ্চ সাম্প্রদায়িক হানাহানি (১৯৪৮) এবং স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধ হওয়া। এই অশান্ত আবর্তের মধ্যে কবি সমর সেন, দিনেশ দাশ, মনীন্দ্র রায়, সুভাষ মুখােপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, রাম বসু প্রমুখদের মতাে কবি অরুণ মিত্রও জেগে উঠেছেন।
১৯৩৫ সাল থেকেই. শ্রী মিত্রের কবিতায় ফ্যাসীবাদ বিরােধী ও সাম্যবাদী দর্শনের মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। তার বিভিন্ন কবিতায় যেমন- লাল ইস্তাহার, মাটির কবর, কসাকের ডাক ১৯৪২, বসন্তবাণী ইত্যাদিতে মার্কসীয় জীবনদৃষ্টির পরিচয় ফুটে ওঠে। অরুণ মিত্রের সাম্যবাদী কবিতার মধ্যে লাল ইস্তাহার কবিতাটি সবিশেষ উল্লেখযােগ্য, যেখানে সাম্যবাদী ইস্তাহারকে মুক্তি আর প্রতিরােধের প্রতীকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রাচীরপত্রে পড়ােনি ইস্তাহার?/ লাল অক্ষর আগুনের ঝলকায় / ঝলসাবে কাল জানাে।/ আকাশে ঘনায় বিরােধের উত্তাপ / ভোতা হয়ে গেছে পুরনাে কথায় ধার। আসলে লাল ইস্তাহার কবিতাটি সাম্যবাদী লেখকদের আত্মপ্রকাশের পত্রিকা ‘অগ্রণীতে প্রকাশ হয়ে বেশ বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল—
দেবতার ক্রোধ কুৎসিত রীতিমতাে
মানুষেরা হুশিয়ার!
লাল অক্ষরে লটকানাে আছে দেখ।
নতুন ইস্তাহার।”
আবার
,মাটির কবর’ কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের উত্থান ও জাগরণের কথা আছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরূদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান ধ্বনিত হয় ‘কসাকের ডাক ১৯৪২’ কবিতায়। ‘বসন্তবাণী’ কবিতায় আছে অস্ত্রে অস্ত্রে প্রতিরােধ করার স্মরণীয় উত্তি। তাঁর কবিতায় সাম্যবাদী দর্শনের যে প্রতিফলন তা তাঁর সমাজসচেতন জীবনবাদের ফলশ্রুতি। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে -
"শান্তির শিশির- মুক্ত-ঝলমলে এক পৃথিবী তিনি চেয়েছেন, যেখানে মানুষের উজ্জ্বল বেঁচে থাকার স্রোতে উচ্ছাসের সমস্ত আলাে জ্বলে ওঠে। পৃথিবী, ধুলাে, নদী, ফসল, ধানশিয, অর্থারােহী সেনা ইত্যাদির সমারােহে তার কবিতা এক অন্তর্লীন মগ্নতার জগৎ গড়ে তােলে। তিনি নিজের কাঙ্খিত পৃথিবীর অজস্র রূপ দেখতে দেখতে একসময় বিভাের হয়ে যান। সেই ভবিষ্যত পৃথিবীর সঙ্গে যােগস্থাপনে আগ্রহী অরুণ মিত্রের চারপাশে ক্রমে ঘনিয়ে ধুলাে মাটির গান।”
(জহর সেন মজুমদার বাংলা কবিতাঃ মেজাজ ও মনােবীজ’ গ্রন্থে ‘অরুণ মিত্র বাংলা কবিতার বৈদ্যুতির তরঙ্গ’)
১৯০৯ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশের যশোর শহরে কবি অরুণ মিত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম হীরালাল মিত্র ও মায়ের নাম যামিনীবালা দেবী। অল্পবয়সেই অরুণ মিত্র কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুলে তার শিক্ষাজীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৬ সালে এই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৮ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইসিএস পরীক্ষা ও ১৯৩০ সালে রিপন কলেজ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ডিস্টিংশন সহ বিএ পাস করেন। এই সময়ে সাহিত্যের চেয়ে সঙ্গীতের প্রতি তার অধিক আকর্ষণ পরিলক্ষিত হয়। আবার এই সময়েই ভিক্টর হুগোর উপন্যাস ইংরেজি অনুবাদে পড়ে ফরাসি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। বিএ পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পড়া শুরু করেন। কিন্তু পিতামাতার জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ায় সাংসারিক দায়দায়িত্বের চাপে এমএ পড়া অসমাপ্ত রেখেই ১৯৩১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
১৯৯০ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিক ডি. লিট. উপাধিতে ভূষিত করে। ফরাসি ভাষা ও ফরাসি সাহিত্য নিয়ে নিরন্তর গবেষণার জন্য ১৯৯২ সালে ফরাসি সরকার তাকে 'লিজিয়ন অফ অনার' সম্মানে ভূষিত করে। প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের অগ্রজা বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও সবুজ চুড়ি গল্পগ্রন্থের রচয়িত্রী শান্তি মিত্র (সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ভাগ্নি) তার স্ত্রী।
২০০০ সালের ২২ অগস্ট কলকাতায় অরুণ মিত্র প্রয়াত হন।
“আমি একজন উৎকৃষ্ট (সর্বোৎকৃষ্টও বলা যায় হয়তাে) অভিনেতা। যাঁরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাটক করে হৈ চৈ লাগিয়ে দেন, অনেক সময় বিজয় করেন, আমি তাদের দলে পড়িনা। আমি তৈরী করা মঞ্চটঞ্চের ধার ধারি না। জীবনটাই আমার মঞ্চ।”
পুরস্কার
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার(১৯৮৭),
রবীন্দ্র পুরস্কার(১৯৭৯)
===============∆∆∆∆∆∆∆=========
No comments:
Post a Comment