যার করো নিন্দে, সেই রয় পিন্দে’
জন্ম ০৩ রা নভেম্বর ১৯১৯ বাংলাদেশের শ্রীহট্টে। পিতার নাম রাধাগোবিন্দ পোদ্দার। তাঁর স্কুলজীবনের পড়াশোনা ময়মনসিংহে। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। এ শহরেই তার বিদ্যাচর্চার সাথে রাজনৈতিক ধ্যানধারণা গড়ে ওঠে। ছাত্রাবস্থায় বিপ্লবী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং স্বভাবতই আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গেই চলছিল লেখালেখির কাজও। ‘গণবার্তা’ পত্রিকাটি তখন দৈনিক ছিল। সেই পত্রিকার সর্বক্ষণের কর্মী হিশেবে কাজ করে অপর দুটি পত্রিকাতেও গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করবার পর বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের জোড়াজুড়িতেই প্রথাগত গবেষণা শুরু করেন অরবিন্দ। গবেষণাতে নাম নথিভুক্তের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিলেন স্বয়ং নীহাররঞ্জন। তিনি তখন থাকতেন পূর্ণদাস রোডে। নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিকে অরবিন্দের ব্যবহারের সম্পূর্ণ সুযোগই কেবলমাত্র তিনি করেননি, অরবিন্দের খাওয়া-দাওয়ারও সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন নীহাররঞ্জনের পত্নী।১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে অন্তরীণ হন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রেফতার হয়ে বন্দিজীবন কাটান তিন বৎসর বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্তকুমার বসু প্রমুখের সাথে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পাওয়ার পর এম.এ পাশ করেন এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ডি.ফিল ডিগ্রি লাভ করেন।এই সময়েই কলকাতার আশুতোষ কলেজ বিজ্ঞাপন দেয় একজন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকের জন্যে। নীহাররঞ্জন অনতিবিলম্বে আশুতোষ কলেজে দরখাস্ত করতে বলেন অরবিন্দকে। দেখা গেল ইন্টারভিউ বোর্ডে রয়েছেন প্রখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তিনি অরবিন্দের নিয়োগের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও ইন্টারভিউ বোর্ডের এক সভ্য অরবিন্দ বাবুর নামটি দেখে জানতে চান- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কসীয় আঙ্গিকে যে বঙ্কিম গবেষণা সন্দর্ভটি অনুমোদিত হয়েছে, সেটি এই অরবিন্দ পোদ্দারেরই করা কিনা। অরবিন্দ বাবু সম্মতি জানালে আবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কি কমিউনিস্ট? অরবিন্দ পোদ্দার দ্বিধাহীনভাবে সম্মতি জানান। বোর্ডের সভাপতি রমারঞ্জনবাবু অরবিন্দবাবুকে নিয়োগ করতে চাইলেও বোর্ডের অপর দুই সভ্য একজন কমিউনিস্টকে কলেজ শিক্ষক হিশেবে চাকরি দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। চাকরি হয় না অরবিন্দের। পরবর্তীতে সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড্ স্টাডিতে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন অরবিন্দ পোদ্দার। তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন।কর্মজীবন সম্পাদনা রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ও কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজের ফেলো ছিলেন। বামপন্থী ভাবধারায় তিনি সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার গবেষণাগ্রন্থগুলি থেকে উপকৃত হয়েছেন বাংলার বিশিষ্ট বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গ ও অগণিত ছাত্রছাত্রী।
গ্রন্থগুলি -
বঙ্কিম মানস (১৯৫১)
শিল্প দৃষ্টি (১৯৫১)
ঊনবিংশ শতাব্দীর পথিক (১৯৫৫)
মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্য যুগ (১৯৫৮)
রবীন্দ্রনাথের কিশোর সাহিত্য (১৯৫৯)
রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরে (১৯৬১)
ইংরাজী সাহিত্য পরিচয় (১৯৮১)
রবীন্দ্রনাথ:রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (১৯৮২)
'রামমোহন উত্তরপক্ষ' (১৯৮২)'
শিল্পীর আয়ুধ সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা' (১৯৮২)'
রেনেসাঁস ও সমাজ মানস'(১৯৮৩)'
মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্য বিচার' (১৯৮৫)'
বাংলার অগ্নিযুগ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দিনগুলি' (১৯৯৭)
'বঙ্কিম ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যের শত্রুরা' (১৯৯৯)'
আত্মানুসন্ধান জাতীয় সংহতি ও ইসলাম' (২০০১)'
কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ভারতবর্ষ এবং আমরা' (২০০৫)
'বন্দেমাতরম ইতিহাসে বিতর্কে' (২০০৬)
'একালের বুদ্ধিজীবী দর্পণে বৃহন্নলা' (২০০৬)'
স্বাধীনতার বিভ্রান্ত সেনাপতি এম কে গান্ধী' (২০০৭)'
পশুখামার ফিরে দেখা' (২০০৯)
'মধ্য এশিয়ার লুটেরা এবং আমরা ভারতীয়রা' (২০১০)
"কালান্তরের প্রবেশের মুখে ইতিহাস কোন্ কোন্ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হইতেছে, ইহার গতিপথের স্বরূপ কী, তাহা নিরুপণ করিতে পারিলে নূতন কালের বিকাশ ধারা এবং ইহার যুগ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যায়। আবার কাল প্রবাহের অমোঘ অনুশাসনে যখন এই কালের ও অন্তর্ধানের সময় আসিবে, তখন তিরোধানের লগ্নে যে কোন্ নূতন কালকে সৃষ্টি করিয়া যাইবে, কালের বর্তমান স্বরূপের মধ্যে তাহার সাক্ষাৎ পাওয়াও সম্ভব।” (বঙ্কিমমানস, বঙ্কিম ঐতিহ্য ও বন্দেমাতরম- অরবিন্দ পোদ্দার। পৃষ্ঠা-১৩.
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁকে বিদ্যাসাগরের উপর বক্তৃতা দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে নবোতিপর অরবিন্দবাবু টানা দেড় ঘণ্টা ইংরেজিতে বক্তৃতা করলেন। কর্তৃপক্ষ যখন ওঁকে সম্মানী চেকটা দিলেন, উনি সেটা নিয়ে আবার কর্তৃপক্ষের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন; চেকটা রাজ্যপালের ত্রাণ তহবিলে জমা করে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে নয়!
রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিতে গেলে স্বামী তেজসানন্দের লেখা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী পড়তে হয়। তেজসানন্দজী যখন বেলুড় বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ ছিলেন, অরবিন্দ পোদ্দার সেখানে অধ্যাপনা করতেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার জন্যে তেজসানন্দজী মিশন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সমস্যা মিটে যায়। উনি আবার মিশনে ফিরে আসেন।
অবসরের বহু পরে এরিয়ারের কিছু টাকা পান অরবিন্দবাবু। পুরো সেই টাকাটা তিনি রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়ে দেন তেজসানন্দীর স্মৃতিতে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়ার জন্যে।
বহু বছর আগে সমাজতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের ভবিষ্যত দৃষ্টি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অরবিন্দ পোদ্দার ১৩৬৬ সালে লিখেছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক, “আমরা আজ যারা ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছি তাদের কাম্য বোধ হয় এমন এক সমাজ, যেখানে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মতো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে চাই না, অথবা ব্যক্তিক উদ্যোগহীন মৌমাছির সমাজতন্ত্রও আমাদের কাম্য নয়, আমরা নিজ নিজ সত্তার বিকাশে, আপন মহিমায় পরস্পরের সঙ্গে সাধারণ মানব-অভিজ্ঞতার সাগরসঙ্গমে মিলিত হতে চাই। মুনাফার অংশীদার রূপে নয়, মানব ইতিহাসের অভিজ্ঞতার অংশীদার রূপে। একমাত্র এই শর্তেই ব্যক্তি তার আপন ঐশ্বর্য ও সত্যতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র যদি তাকে মৌমাছির মতো সহজ করে দিতে চায় তো পারে- তাতে রাষ্ট্র হয়ত বাঁচবে, কিন্তু মানবতার মৃত্যু হবে। মানুষের মৃত্যু হবে। তাই আমরা যেন না ভুলি, ব্যক্তি নিষ্প্রাণ জড় বস্তু নয়, একান্ত সজীব ক্রিয়াশীল স্বাধীন সত্তা। সেই সত্তার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল বলেই মূল্যবোধের ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করছি।” (স্বাধীনতা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ। এই প্রবন্ধটি অরবিন্দবাবু পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে লিখেছিলেন)।
ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বেপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষে রবীন্দ্রনাথের নীরব, নিভৃত ভূমিকাটির উন্মোচনে অরবিন্দ পোদ্দারের বিশেষ ভূমিকা আছে। চিন্মোহন সেহানবীশ, নেপাল মজুমদারদের সঙ্গেই বাংলায় রবীন্দ্রনাথের লেখা রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলি কীভাবে সশস্ত্র উপায়ে ব্রিটিশ বিতাড়নের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল তা দেখিয়েছেন অরবিন্দ পোদ্দার। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিনে রবীন্দ্রনাথের লেখা,
“শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী ভয়ঙ্করী।”
-এই কবিতাটিকে রবীন্দ্রমানসলোক উন্মোচনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন অরবিন্দবাবু।
শতবর্ষ উত্তীর্ণ হয়েও বয়সের অনুপাতে সুস্থ ই ছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার। স্ত্রী বিয়োগের পর উত্তর কলকাতার সিঁথি ছেড়ে চলে এসেছিলেন পুত্রের কাছেই এম বাইপাসের ধারে। বাড়ির ল্যাব্রাডর পোষ্যের সঙ্গে শতবর্ষীয় অরবিন্দ পোদ্দারের সখ্য দেখার মতো ছিল। কেবলমাত্র শ্রবণশক্তির কিছুটা সমস্যা ছিল। হেয়ারিং এইড দিয়ে সেই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাচ্ছিল। অল্প কদিন আগে কোভিড কেড়ে নেয় আদরের নাতিকে। সেই চরম দুঃসংবাদ অনেক চেষ্টা করেও বাড়ির মানুষেরা তাঁর কাছ থেকে গোপন করতে পারেন নি। নাতির অকাল মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারলেন শতবর্ষজীবী অরবিন্দ পোদ্দার। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হলেন। বেসরকারী হাসপাতালে যমে-মানুষে কটা দিনের লড়াই। অবশেষে ২০ জুন ২০২১ দুপুর ১টা নাগাদ চিরশান্ত হলেন।
========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆===========
No comments:
Post a Comment