বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যেসব বাঙালি মুসলমান মননশীল গদ্য লেখক বিশিষ্টতা অর্জন করেন, কাজী ইমদাদুল হক তার মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর তৎকালীন মুসলমান সমাজে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভার অধিকারী হয়ে সাহিত্য অঙ্গন আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক।
১৮৮২ সালের ৪ নভেম্বর খুলনা জেলার গোদাইপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা কাজী আতাউল হক প্রথমে আসামে জরিপ বিভাগে চাকরি করতেন, পরে খুলনার ফৌজদারি আদালতে মোক্তার হন। ইমদাদুল হক ১৯০০ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর দীর্ঘকাল পরে ১৯১৪ সালে তিনি বিটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।
ইমদাদুল হক ১৯০৪ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালে তিনি আসামের শিলং-এ শিক্ষা বিভাগের উচ্চমান সহকারী হন। পরের বছর তিনি ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯১১ সালে ঢাকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে ভূগোলের অধ্যাপক, ১৯১৪ সালে ঢাকা বিভাগের মুসলিম শিক্ষার সহকারী স্কুল-পরিদর্শক এবং ১৯১৭ সালে কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২১ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম কর্মাধ্যক্ষ হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল ছিলেন।
১৯২০ সালের মে মাসে ইমদাদুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় শিক্ষাবিষয়ক মাসিক পত্রিকা শিক্ষক। পত্রিকাটি তিন বছর চালু ছিল। তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিক্ষা ও নীতিমূলক শিশুসাহিত্য রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ:
আঁখিজল (১৯০০)
মোসলেম জগতে বিজ্ঞান চর্চা (১৯০৪)
ভূগোল শিক্ষা প্রণালী (দু'খণ্ড, ১৯১৩, ১৯১৬)
নবীকাহিনী (১৯১৭)
প্রবন্ধমালা (১৯১৮)
কামারের কাণ্ড" (১৯১৯)
আবদুল্লাহ (১৯৩২)
আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাচীন পুস্তকাগার
আবদুর রহমানের কীর্তি
ফ্রান্সে মুসলিম অধিকার
আলহামরা
পাগল খলিফা
‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসটি লেখকের জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ বা প্রকাশ হয়নি। তিনি এ উপন্যাসটি জীবনের শেষান্তে শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তার খসড়ার ভিত্তিতে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ করা হয় এবং তা ১৯৩২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড (আজকের বাংলা একাডেমি) আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় প্রকাশ করে 'কাজী ইমদাদুল হকের রচনাবলি'।
অধুনা সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পাদনায় 'শুদ্ধস্বর' প্রকাশনী তার রচনাবলী প্রকাশ করেছে।
বাঙালি মুসলমান সমাজের কল্যাণসাধন ছিল ইমদাদুল হকের সাহিত্য সাধনার মূল লক্ষ্য। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (১৯১৮) প্রকাশনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। অত্যন্ত যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব পালন করায় সরকার তাঁকে ১৯১৯ সালে ‘খান সাহেব’ এবং ১৯২৬ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯২৬ সালের ২০ মার্চ কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। [
No comments:
Post a Comment