সৈয়দ শামসুল হক
1.
পরানের গহীন ভিতর
উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,
শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,
পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,
তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,
আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,
গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,
গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,
দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।
একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?
2
এখন মধ্যরাত।
এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননকূল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার।
পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো।
জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫. একজন বিখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক। তিনি কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও হালিমা খাতুন দম্পতির আট সন্তানের প্রথম সন্তান। পিতা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। তিনি ডাক্তারি চর্চা করতেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের গর্বিত জনক জনাব হক ব্যক্তিজীবনে প্রথিতযশা লেখিকা ডাঃ আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্বামী। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর রচিত প্রথম পদ তিনি লিখেছিলেন এগারো-বারো বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তাঁর বাড়ীর রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দুলাইনের একটি পদ "আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে।" রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘’অগত্যা’’ পত্রিকায়। সেখানে “উদয়াস্ত” নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়।
সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সৈয়দ শামসুল হকের পিতার ইচ্ছা ছিলো তাঁকে তিনি ডাক্তারী পড়াবেন। পিতার এরকম দাবি এড়াতে তিনি ১৯৫১ সালে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশী এক সিনেমা প্রডাকশ হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘’দেয়ালের দেশ’’ প্রকাশিত হয় ।
রচনা কর্ম।
ছোট গল্প
তাস (১৯৫৪),
শীত বিকেল (১৯৫৯),
রক্তগোলাপ (১৯৬৪),
আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭),
প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২),
সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০),
জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০),
শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)
কবিতা
একদা এক রাজ্যে (১৯৬১),
বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯),
বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০),
প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩),
অপর পুরুষ (১৯৭৮),
পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০),
নিজস্ব বিষয় (১৯৮২),
রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮)
বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯)
এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯)
অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯)
কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০)
আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০)
তোরাপের ভাই (১৯৯০)
শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০)
রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১)
নাভিমূলে ভস্মাধার
কবিতা সংগ্রহ
প্রেমের কবিতা
ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯)
উপন্যাস
দেয়ালের দেশ
এক মহিলার ছবি (১৯৫৯)
অনুপম দিন (১৯৬২)
সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪)
নীল দংশন (১৯৮১)
স্মৃতিমেধ (১৯৮৬)
মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬)
স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭)
এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭)
স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯)
বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খণ্ড১৯৮৯, ২য় খণ্ড ১৯৯০)
বারো দিনের শিশু (১৯৮৯)
বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯)
ত্রাহি (১৯৮৯)
তুমি সেই তরবারী
কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯)
শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০)
নির্বাসিতা (১৯৯০)
নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০)
খেলারাম খেলে যা (১৯৯১)
মেঘ ও মেশিন (১৯৯১)
ইহা মানুষ (১৯৯১)
মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার
দ্বিতীয় দিনের কাহিনী
বালিকার চন্দ্রযান
আয়না বিবির পালা
কালঘর্ম
দূরত্ব
না যেয়ো না
অন্য এক আলিঙ্গন
এক মুঠো জন্মভূমি
বুকঝিম ভালোবাসা
অচেনা
আলোর জন্য
রাজার সুন্দরী
কাব্যনাট্য
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬)
গণনায়ক (১৯৭৬)
নুরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২)
এখানে এখন (১৯৮৮)
কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১)
ঈর্ষা
বাংলার মাটি বাংলার জল
নারীগণ
প্রবন্ধ
হৃৎ কলমের টানে (১ম খণ্ড ১৯৯১, ২য় খণ্ড ১৯৯৫)
মার্জিনে মন্তব্য
কথা কাব্য
অন্তর্গত
আত্মজীবনী
প্রণীত জীবন
অনুবাদ
ম্যাকবেথ
টেম্পেস্ট
এক নারীর জীবন
শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯)
শিশুসাহিত্য
সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮)
আনু বড় হয়
হড়সনের বন্দুক
অন্যান্য
শ্রেষ্ঠ গল্প
শ্রেষ্ঠ উপন্যাস
শ্রেষ্ঠ কবিতা
মুখ (১৯৯১)
পুরস্কার।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৬
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার , ১৯৬৯
অলক্ত স্বর্ণপদক ১৯৮২
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, ১৯৮২, ১৯৮৩
আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩
কবিতালাপ পুরস্কার ১৯৮৩
লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক,
একুশে পদক, ১৯৮৪
জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৮৫
পদাবলী কবিতা পুরস্কার,১৯৮৭
নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৯০
টেনাশিনাস পদক, ১৯৯০
মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার ২০১১
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, ২০১১
মারা গেছেন: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ঢাকা, বাংলাদেশ।
===={{[[[[[[[{{{{={{==={={={==={{={{===={={{