Wednesday, 29 December 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। ২৯.১২.২০২১. Vol - 600. The blogger in literature e-magazine


ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী

"আমার রবি কাকা সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সব সময় মনে হয় তিনি যৌবনের চেয়ে বৃদ্ধ বয়সে বেশি সুন্দর মানুষে পরিণত হন।

     সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, রবিকাকার আদরের বিবি। ঠাকুরবাড়ির নব জাগরণের আরেক নাম। ঐবাড়ির মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম বি.এ পাশ করেন।

                                     বিশ্বকবির মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জ্ঞানদানন্দিনীর মেয়ে, জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৮৭৩।পাঁচ বৎসর বয়সে ইন্দিরা তাঁর মা ও ভাই সুরেন্দ্রর সাথে বিলেতে যান। বছরখানেক পর রবীন্দ্রনাথও ইংল্যান্ডে গেলে কবিগুরুর নিবিড় সান্নিধ্যে বেড়ে ঊঠেন তারা দুই ভাইবোন। ইন্দিরা দেবীকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন কবিগুরু, নতুন কিছু লিখলেই প্রিয়তম ভাইঝিটিকে না দেখিয়ে থাকতে পারতেন না। ছোটবেলা থেকেই ইন্দিরা পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উপর তালিম নেন। কবিগুরুর অসংখ্য গানের নোটেশন লিখেছেন তিনি। এছাড়া কয়েকটি ব্রাহ্ম সঙ্গীতও রচনা করেছিলেন।


দেশে ফেরার পর ১৮৮১ সালে প্রথমে সিমলার অকল্যান্ড হাউজে এবং পরে কলকাতার লোরেটা হাউজে পড়াশোনা করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি এন্ট্রান্স ও পরে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।

ইংরাজীর পাশাপাশি তিনি লামার্টিনিয়ার স্কুলের একজন শিক্ষয়িত্রীর কাছে ফরাসি ভাষা শিখে নেন। এক্ই সাথে বিদেশী সঙ্গীত শিক্ষকদের কাছে পিয়ানো ও বেহালা বাজানো শেখেন। এরপর ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিকের ইন্টারমিডিয়েট থিয়েরি পরীক্ষায় পাস করে ডিপ্লোমা লাভ করেন এবং বদ্রিদাস মুকুলের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালিম নেন ।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ের দিন ঠাকুর বাড়ির জামাই সারদা প্রসাদ মারা যান। এরপর ঠাকুর পরিবারের কেউই আর জমিদারী দেখার দায়িত্ব নিতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ তখন ২৭ বছরের যুবক। বাবার আদেশে এরপর তাঁকে শিলাইদহে আসতে হয়। এখান থেকে ইন্দিরা দেবীকে অসংখ্য চিঠি লেখেন কবি। এই চিঠিগুলোর কথা ইন্দিরা দেবীর বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে জানা যায়। রবিকাকার সঙ্গে মুসৌরি ভ্রমণ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘ভ্রমণের সময় একদিন কীভাবে একজন সত্যিকার গৃহিণীর মতো বাথরুমের বেসিন পরিস্কার করেছিলাম। গোলাপ জলের দেশ গাজিপুরেও আমরা বেশ কিছুদিন ছিলাম। সিমলাতে কাকার সাথে দীর্ঘ সময় কাটানো নিয়ে এমন সব মনোরম ঘটনা রয়েছে যেগুলো লিখতে গেলে এক একটা অক্ষর ছবি হয়ে উঠতে চায়। রবিকার ঘনিষ্ঠ সাহচর্যের মধ্যে আরো একটি ভ্রমণ স্থলের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। জায়গাটির নাম কারওয়া। সেখানে কিছুদিন বাংলোর বাইরে সমুদ্র দেখে আনন্দমুখর দিন কাটিয়েছিলাম।’


ইন্দিরা দেবীর বয়স যখন ছাব্বিশ বছর তখন আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। অনুবাদক হিসেবে ইন্দিরা দেবী অল্পবয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। কৈশোরে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত ও মাতা জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত বালক পত্রিকায় রাস্কিনের রচনার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরে ফরাসি শিখে তিনি রেনে গ্রুসের L’Inde, পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাশ্রম এবং মাদাম লেভির ভারতভ্রমণ কাহিনী অনুবাদ করেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় এগুলো প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতার ও রচনার তিনি ছিলেন দক্ষ অনুবাদক। রবীন্দ্রনাথও তার অনুবাদ পড়ে সবসময় সন্তোষ প্রকাশ করতেন। ইন্দিরাই প্রথম তার ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। সঙ্গীত বিষয়েও তার জ্ঞান ছিল অগাধ। তিনি বেশ কিছু সংগীত বিষয়ক বই লিখেছেন। তার মধ্যে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে একযোগে লেখা ‘হিন্দু সংগীত’ গ্রন্থের ‘সংগীত পরিচয়’ নামক প্রাথমিক অংশ উল্লেখযোগ্য। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের তথ্য এবং তত্ব দুটিকেই সমান ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধসহ জাপানযাত্রীর ডায়রী-র ইংরেজি অনুবাদও তিনি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত ও সাহিত্যবিষয়ে তাঁর অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। বঙ্গনারীর শুভাশুভ বিষয়ে তাঁর মতামত ‘নারীর উক্তি’ নামক প্রবন্ধে বিধৃত হয়েছে। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতে এবং পিয়ানো, বেহালা ও সেতারবাদনে পারদর্শিনী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা তাঁর এক অমর কীর্তি। ‘মায়ার খেলা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘কালমৃগয়া’ প্রভৃতিসহ আরও দুশো রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু স্বরলিপি গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেন।


সঙ্গীত বিশারদ,অনুবাদক হবার পাশাপাশি তিনি নিজেকে সামাজিক উন্নয়নেরও অংশীদার করেছেন। বাবার পথ ধরেই মহিলা শিক্ষা, সর্ব ভারতীয় মহিলা সম্মেলন, সঙ্গীত সম্মেলন সহ আরো নানান কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন।


১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ভুবনমোহিনী’ স্বর্ণপদক, ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ এবং ডি-লিট ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৫৯ সালে রবীন্দ্রভারতী সমিতি তাঁকে ‘রবীন্দ্রপুরস্কার’-এ ভূষিত করে।


১৯৪১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন এবং বিশ্ব ভারতীর ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৬০ সালের ১২ই আগস্ট ঠাকুর পরিবারের নবজাগরণের অংশীদার এই মহীয়সী সাহিত্যিক এবং সঙ্গীত বিশারদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শান্তিনিকেতনে ইন্দিরা দেবী ‘আলাপনী মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা ও তার মুখপত্র ঘরোয়া প্রকাশ করেন। মহিলা কল্যাণে গঠিত ‘বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশন লীগ’, ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’, ‘হিরণ্ময়ী বিধবা আশ্রম’ ইত্যাদি সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন।


ইন্দিরা দেবীর কয়েকটি মৌলিক রচনা হলো: শ্রুতি স্মৃতি, রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম (১৯৫৪) ও রবীন্দ্রস্মৃতি (৫ খন্ড, ১৯৫৯)। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: নারীর উক্তি (১৯২০), বাংলার স্ত্রী-আচার (১৯৫৬), স্মৃতিকথা, পুরাতনী (১৯৫৭) ও গীতপঞ্চশতী।


===============∆∆∆∆===={==={==={{

No comments: