জন্ম ৩রা ডিসেম্বর, ১৮৫৭ . একজন ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। তার জন্ম বর্তমান ইউক্রেনে (তদানীন্তন রুশ সম্রাজ্য) এবং বেড়ে ওঠা রুশ সম্রাজ্য কর্তৃক অধিকৃত পোল্যান্ডে. তবে ইংল্যান্ডে বসবাস শুরু করার পর থেকে তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখতেন। জন্মের সময় তার নাম ছিল Józef Teodor Konrad Korzeniowski কিন্তু ইংরেজি ভাষাভাষীদের উচ্চারণের সুবিধার্থে এবং নিজের প্রকৃত শেষ নামের বিকৃত উচ্চারণের হাত থেকে রেহাই পেতে শেষ নাম হিসেবে কনরাড ব্যবহার শুরু করেন।১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করলেও তিনি আজীবন নিজেকে পোলীয় মনে করতেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস লর্ড জিম (১৯০০), নস্ট্রোমো (১৯০৪), ও দ্য সিক্রেট এজেন্ট (১৯০৭) এবং বড় গল্প হার্ট অফ ডার্কনেস (১৯০২)। রচনাশৈলীর গভীরতা এবং সমুদ্র ও বিভিন্ন দুর্গম স্থানের জীবন সম্পর্কে লেখার কারণে জীবদ্দশায়ই তিনি অনেক প্রশংসিত হন। তবে সমুদ্রের রোমাঞ্চকর গল্পের আড়ালে তার রচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে, সেটা হচ্ছে মানব মনের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে ভাল-খারাপের দ্বন্দ্ব। ভয়ানক একাকীত্বের কারণে সমুদ্র কনরাডের কাছে একটা ট্র্যাজেডির জায়গা ছিল। যত দিন যাচ্ছে ততোই তাকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন মনে করা হচ্ছে.
কনরাডের বাবা Apollo Nalęcz Korzeniowski ছিলেন একজন কবি এবং একনিষ্ঠ পোলীয় দেশপ্রেমিক। রুশ সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কারণে ১৮৬১ সালে তাকে আটক করে সাইবেরিয়ার নির্বাসনে পাঠানো হয়। অগত্যা তার স্ত্রী এবং চার বছর বয়সী সন্তানও সাইবেরিয়ায় পাড়ি জমায়। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে না পেরে ১৮৬৫ সালে যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী মারা যান। আনুমানিক এই সময়েই কনরাড প্রথম ইংরেজি সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন, কারণ তখন তার বাবা অর্থ উপার্জনের জন্য উইলিয়াম শেকসপিয়র ও ভিক্টর হুগোর (ফরাসি) রচনা অনুবাদ করতেন।[৪] সাইবেরিয়ার নিঃসঙ্গ জীবনে বাবার সাথে তিনি পোলীয় ও ফরাসি ভাষায় ওয়াল্টার স্কট, জেম্স ফেনিমোর কুপার, চার্লস ডিকেন্স এবং উইলিয়াম মেইকপিস থ্যাকারির বই পড়েছেন। ১৮৬৯ সালে তার বাবা যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে বর্তমান পোল্যান্ডের ক্রাকো শহরে মারা যান।
এরপর কনরাডের দায়িত্ব নেন তার মামা। ক্রাকো এবং সুইৎজারল্যান্ডের স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনায় তার খুব একটা মন বসেনি। সাগরের টানে ১৮৭৪ সালে ফ্রান্সের মার্সেইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মামা তাকে বছরে দুই হাজার ফ্রাংক ভাতা দিতেন এবং তাকে একজন ফরাসি বণিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এই বণিকের সহায়তায় কনরাড প্রথমে "Mont-Blanc" জাহাজের সাধারণ যাত্রী হিসেবে মার্টিনিকের (ক্যারিবীয় সাগরের ফরাসি দ্বীপ) উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পরবর্তীতে একই জাহাজে শিক্ষানবিসের চাকরি পান। ১৮৭৬ সালে "Saint-Antoine" জাহাজের স্টুয়ার্ড হিসেবে আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভেনিজুয়েলার উপকূল পর্যন্ত যান। এসময় কিছু আইনবিরুদ্ধ কাজ করেছিলেন। এই জাহাজের ফার্স্ট মেইট ছিল Dominic Cervoni নামের এক কর্সিকান যার আদলে তিনি নস্ট্রোমো উপন্যাসের নায়কের চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন। সাঁ-আঁতোয়ান জাহাজের অনেক অভিজ্ঞতাই নস্ট্রোমোতে কাজে লেগেছে।
মার্সেই ফিরে আসার পর ঋণের ভারে জর্জরিত কনরাড একবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন। তখন ফরাসি বণিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সবার জন্য সামরিক দায়িত্ব পালন বাধ্যতামূলক ছিল। তাই ১৮৭৮ সালে কনরাড ফরাসি নৌবাহিনীতে নাম লেখান। তাকে একটি ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজে ডেকহ্যান্ডের কাজ দেয়া হয়। জাহাজটি কয়লা নিয়ে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) যাচ্ছিল। ফিরতি যাত্রার সময় তাকে ইংল্যান্ডের Lowestoft-এ নামিয়ে দেয়া হয়। তখন কনরাড খুব একটা ইংরেজি জানতেন না কিন্তু ইংল্যান্ডে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৭৮-এর শেষ দিকে সাধারণ নাবিক হিসেবে লন্ডন-সিডনি ভ্রমণ করেছিলেন। ১৬ বছর তিনি ব্রিটিশ নৌ-বণিক বাহিনীতে কাজ করেছেন; ১৮৮০ সালে সেকেন্ড মেইটের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৮১ সালে প্যালেস্টাইন নামক একটি জাহাজে চেপে বসেন দূর-প্রাচ্যের উদ্দেশ্যে।
প্যালেস্টাইন জাহাজের অভিজ্ঞতা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি।[৩] জাহাজটি পথিমধ্যে প্রচুর বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয় এবং অবশেষে দূরপ্রাচ্যে পৌঁছানোর পর কয়লা থেকে সৃষ্ট আগুনে একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। অন্য সব ক্রূর সাথে কনরাড লাইফবোটে আশ্রয় নেন এবং আনুমানিক তের ঘণ্টার মধ্যেই একটি দ্বীপের সন্ধান পান, দ্বীপটি ছিল সুমাত্রার (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ায়) নিকটবর্তী। রোমাঞ্চকর যাত্রার কাহিনী পরবর্তীতে একটি গল্প (Youth) হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন।
১৮৮৩ সালে লন্ডনে ফিরে এসে আবার ভারতের মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মুম্বাইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে প্রসূত উপন্যাস The Nigger of the 'Narcissus'-কে অনেকে কনরাডের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে অভিহিত করেন।[৫] আনুমানিক একই সময়ে তিনি প্রথম ইংরেজিতে চিঠি লেখা শুরু করেন। ১৮৮৬ সালে তার জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, আগস্টে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ এবং তার কয়েক মাস পর মাস্টার মেরিনারের সার্টিফিকেট অর্জন। ১৮৮৭ সালে Highland Forest জাহাজের ফার্স্ট মেইট হিসেবে জাভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, এই জাহাজের ক্যাপ্টেনের অনুকরণেই Nan Shan in Typhoon গল্পের স্টিমার ক্যাপ্টেনের চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন। সাড়ে চার মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দ্বীপপুঞ্জে ৫-৬ টি ভ্রমণের সময় অর্জিত প্রচুর অভিজ্ঞতা তার পরবর্তী বেশ কয়েকটি উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে, যথা- Almayer’s Folly, An Outcast of the Islands, এবং লর্ড জিম।
মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ফিরে আসার পর আবার সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে Otago জাহাজে উঠেন। পথিমধ্যে জাহাজের ক্যাপ্টেন মারা গেলে কনরাড প্রথম বারের মত একটি জাহাজের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। সিঙ্গাপুর পৌঁছানোর আগে তিন সপ্তাহের যাত্রায় (১,৩০০ কিলোমিটার) একমাত্র কনরাড ও রাঁধুনী ছাড়া জাহাজের সবাই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ১৮৮৯ সালে লন্ডনে ফিরে এসে Almayer’s Folly উপন্যাসের কাজ মাত্র শুরু করেছেন এমন সময় একটি অভূতপূর্ব সুযোগ তার সামনে এসে হাজির হয়। তিনি ছোটবেলায় শপথ করেছিলেন আফ্রিকায় যাবেন। ১৮৮৫ সালে বার্লিনের একটি সম্মেলনে আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকার প্রায় পুরো অঞ্চলটি নিয়ে কঙ্গো মুক্ত রাজ্য (বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর সাথে তুলনীয়) নামে একটি স্বাধীন দেশ ঘোষণা করা হয় এবং বেলজিয়ামের রাজা লেওপোল্ড ২ রাষ্ট্রটির অধিকর্তা বনে যান।[৬] অনেকটা ইউরোপীয়দের ব্যক্তি মালিকানায় থাকা এই রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য তখন বিভিন্ন সম্রাজ্যের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। এই সুযোগে কনরাড ব্রাসেলসে গিয়ে কঙ্গো নদীর একটি স্টিম চালিত নৌকার কমান্ডারের দায়িত্ব আদায় করে নিয়ে আসেন।
কঙ্গোতে তিনি যা দেখেছেন এবং অনুভব করেছেন তা থেকেই জন্ম নিয়েছে তার সেরা গল্প, হার্ট অফ ডার্কনেস। এই গল্পের শিরোনাম কেবল তদানীন্তন আফ্রিকার হৃদয়কে নির্দেশ করে না, সাথে সকল অশুভের মূল, সকল দুর্নীতি ও নৈরাশ্যের উৎস এবং সর্বোপরী মানুষের হৃদয়কে নির্দেশ করে। এই বই কনরাডের জীবনে এতো বিশাল একটা স্থান দখল করে ছিল যে অনেকে ভাবতে বাধ্য হন, নিশ্চয়ই তার কঙ্গো ভ্রমণ খুব বেদনাদায়ক ছিল। তবে এটা তার মধ্যে অনেক পরিবর্তনও এনেছে, তিনি একবার বলেছিলেন, "কঙ্গোর আগে আমি কেবল একটি পশু ছিলাম"। কঙ্গোতে তাকে মনস্তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক এবং এমনকি অধিবিদ্যাগত আঘাতও হজম করতে হয়েছে। তার স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ৪ মাস থেকে ১৮৯১ সালে কঙ্গো থেকে ফিরে আসার পর তার ঘন ঘন জ্বর ও বাতের ব্যথা হতো। এরপর ফার্স্ট মেইট হিসেবে আরও কয়েকটি অভিযানে অংশ নেয়ার পর ১৮৯৪ সালে মামা মারা যাওয়ায় তার সমুদ্র জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
১৮৯৫ সালে Almayer’s Folly প্রকাশিত হয় যে বইয়ে তিনি প্রথমবারের মত কেবল "জোসেফ কনরাড" নামটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে দ্বিতীয় উপন্যাস An Outcast of the Islands প্রকাশ করেন। এই বই দুটি তার এমন একটি পরিচিতি প্রতিষ্ঠিতি করে ফেলেছিল যা তাকে খুব ব্যথিত করে। তাকে অনেক জায়গায় "ভিনদেশী অদ্ভুত" (exotic) বিষয়ের গল্পকার বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল। পরবর্তী আরও কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প এই খ্যাতির পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু কনরাড কখনো এবাবে চিত্রায়িত হতে চাননি। তিনি চটকদার গল্পের খাতিরে এমন প্রেক্ষাপট নির্বাচন করতেন না, বরং তার কাছে মনে হয়েছিল- জাহাজে বা কোন প্রত্যন্ত গ্রামে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে পুরো জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থেকে একেবারে নিজের মতো করেই সেটার সুরাহা হয়। এ কারণে অন্য সবকিছুর তুলনায় এই পরিস্থিতিগুলোকে আলাদা ও প্রকটভাবে উপলব্ধি করা যায়। তখনকার অধিকাংশ লেখকেরা বিশ্বের তাবৎ আপাত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে লেখার মাধ্যমে সমাজের প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ হতে চেয়েছিলেন[টীকা ২] যা কনরাডের ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি বিচ্ছিন্ন জগতে ট্র্যাজেডির ঘনীভবন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
১৮৯৫ সালে কনরাড ২২ বছর বয়সী জেসি জর্জকে বিয়ে করেন। তাদের দুটি সন্তান হয়েছিল। এরপর তিনি মূলত ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে থাকতেন। তার লেখক জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক সব ধরনের সমস্যায়ই তিনি জর্জরিত ছিলেন। "লর্ড জিম", "নস্ট্রোমো", "দ্য সিক্রেট এজেন্ট" এবং "আন্ডার ওয়েস্টার্ন আইস" (১৯১১) উপন্যাস চারটি প্রকাশের পর তার আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। পরবর্তীতে তার জন্য ১০০ পাউন্ড সরকারি ভাতা বরাদ্দ করা হয় এবং মার্কিন সংগ্রাহক জন কুইন তার পাণ্ডুলিপি কেনা শুরু করেন, যদিও খুব কম দামে। "চান্স" উপন্যাসটি নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডে ১৯১২ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বাতের ব্যথা থাকলেও তিনি আজীবন লিখে গেছেন।
উপন্যাস
Almayer's Folly (১৮৯৫)
An Outcast of the Islands (১৮৯৬)
The Nigger of the 'Narcissus' (১৮৯৭)
Heart of Darkness (১৮৯৯)
Lord Jim (১৯০০)
The Inheritors (with Ford Madox Ford) (১৯০১)
Typhoon (১৯০২)
The End of the Tether (১৯০২)
Romance (১৯০৩)
Nostromo (১৯০৪)
The Secret Agent (১৯০৭)
Under Western Eyes (১৯১১)
Chance (১৯১৩)
Victory (১৯১৫)
The Shadow Line (১৯১৭)
The Arrow of Gold (১৯১৯)
The Rescue (১৯২০)
The Nature of a Crime (১৯২৩)
The Rover (১৯২৩)
Suspense: A Napoleonic Novel (১৯২৫, মরণোত্তর)
৩রা আগস্ট,১৯২৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ড়্যামজি ম্যাকডোনাল্ড কর্তৃক প্রদত্ত নাইট উপাধি ফিরিয়ে দেন। একই বছর তার মৃত্যু ঘটে।
=================================
No comments:
Post a Comment