১৯৭২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান জার্মান কথাসাহিত্যিক হাইনরিখ বোল। ১৯১৭ সালে ২১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া বোল জার্মানির বহুল পঠিত লেখকদের অন্যতম। ত্রিশটির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। বোল তাঁর বইয়ে পুঁজিবাদের অন্ধকার দিক তুলে ধরেন। সে কারণে তিনি পূর্ব ইউরোপে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নোবেল কমিটির পক্ষে বলা হয়, ‘তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নিজের সময়ের ওপর ব্যাপক পরিসরের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংবেদনশীল দক্ষতার মিশেলে চরিত্র চিত্রায়ণ ও জার্মান সাহিত্যের নবরূপায়ণে ভূমিকা রাখার জন্য’ তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো।"
লেখালেখির আগে বোল বইয়ের দোকানে কেরানির কাজ করেন। ৩০ বছর বয়সে লেখায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ট্রেইন ওয়াজ অন টাইম’ প্রকাশ করেন ১৯৪৯ সালে। জার্মান লেখকদের সংগঠন গ্রুপ ৪৭ তাদের ওই বছরের সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় এবং ১৯৫১ সালে তাঁর লেখাকে সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করে। তার পর থেকে তাঁর লেখার প্রবাহ পুরোদমে চলতে থাকে। হাইনরিখ বোলের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে—
উপন্যাস :
‘হয়ার অয়ার ইউ, অ্যাডাম’ (১৯৫১),
‘অ্যান্ড নেভার সেইড আ ওয়ার্ড’ (১৯৫৩),
‘দ্য ব্রেড অব দোজ আর্লি ইয়ার্স’ (১৯৫৫),
‘দ্য সেফটি নেট’ (১৯৭৯),
‘আ সোলজার্স লেগ্যাসি’ (১৯৮২);
ছোটগল্প : ‘
ক্রিস্টমাস নট জাস্ট ওয়ান্স আ ইয়ার’ (১৯৫১),
‘দ্য বালেক স্কেলস’ (১৯৫২), ‘
ইউ গো টু হাইদেলবার্গ টু অফেন’ (১৯৭৯);
প্রবন্ধ :
‘মিসিং পারসনস’ (১৯৫৭) ইত্যাদি।
বিষয়বস্তু ও উপাদান সম্পর্কিত বৈচিত্র্য থাকলেও তাঁর লেখার উপস্থাপনায় কয়েকটি প্যাটার্ন বারবার এসেছে। অনেক উপন্যাস ও গল্পে ব্যক্তিগত জীবনের নিবিড় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক বিভেদ এবং গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের বিপরীতে ব্যক্তির শক্ত অবস্থানের কথা বলা হয়েছে সেসব লেখায়।
হাইনরিখ বোলের নিজের শহর কোলনের প্রতি ছিল তাঁর শিকড়ের সম্পর্ক। সেখানকার মানুষদের রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসের প্রতি টান এবং রসবোধের প্রতিও সচেতন ছিলেন তিনি। তাঁর লেখার মধ্যে ক্যাথলিক বিশ্বাসের গুরুত্ব ছিল এবং এ প্রসঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হয়ে থাকে গ্রাহাম গ্রিনের সঙ্গে।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের মানুষদের ওপর যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছে ক্ষমতাধর মানুষদের আত্মতৃপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার।
লেখার জগৎ ছাড়াও বাস্তব জীবনে জন্মস্থান ছিল তাঁর কাছে প্রিয়তম জায়গা। যুদ্ধের সময় কোলন শহর নিবাসীদের দখলে যাওয়ায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন। মিত্রশক্তির বোমার আঘাতে কোলন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলে তিনি আজীবন সে দুঃখ ভুলতে পারেননি। এ ছাড়া আজীবন তিনি কোলনের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে তাঁর উদারনৈতিক মনোভাবের জন্য জার্মানির রক্ষণশীল সমাজ তাঁকে পছন্দ করতে পারেনি। দেশের সংবাদপত্র তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তাদের ব্যাখ্যা ছিল, নোবেল পুরস্কার শুধু উদারপন্থী ও বামদের মধ্যে যাঁরা চরমপন্থী তাঁদের দেওয়া হয় না।
হাইনরিখ বোল বেশ কয়েকবার রাশিয়া ভ্রমণ করেন। সেখানকার অনেক লেখকের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ভিন্নধর্মী সাহিত্য সৃষ্টিতে রাশিয়ার যেসব লেখক অগ্রণী ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে বোলের মতামতের ঐক্য তৈরি হয়। রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্ডার সোলঝেনেিসন তাঁর দেশের সরকারের কোপানলে পড়লে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। প্রথমত, তিনি আশ্রয় নেন বোলের আইফেল কটেজে।
হাইনরিখ বোলের নামে পুরস্কার ও স্কলারশিপ দেওয়া হয় জার্মানিতে। তাঁর নামে রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নামকরণ করা হয়েছে। তিনি কিছুদিন আয়ারল্যান্ডের একাইল দ্বীপে ছিলেন। সেখানে তাঁর ব্যবহূত কটেজ ১৯৯২ সাল থেকে লেখক শিল্পীদের গেস্টহাউস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment