আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয় – সত্য জননী।”
“মানুষ তো ভগবানকে ভুলেই আছে। তাই যখন যখন দরকার, তিনি নিজে এক একবার এসে সাধন করে পথ দেখিয়ে দেন। এবার দেখালেন ত্যাগ।”
“যেমন ফুল নাড়তে-চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবত্তত্ত্বের আলোচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়।
ভালবাসায় সবকিছু হয়, জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না।”
“সৎসঙ্গে মেশো, ভাল হতে চেষ্টা কর, ক্রমে সব হবে।”
“কাজ করা চাই বইকি, কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।”
“মনটাকে বসিয়ে আলগা না দিয়ে কাজ করা ঢের ভাল। মন আলগা হলেই যত গোল বাধায়।”
“আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।”
“ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে কজনে?”
“যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানকে জানিয়ে দিও, মা, আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।”
“শোন মা, যত বড় মহাপুরুষই হোক, দেহধারণ ক'রে এলে দেহের ভোগটি সবই নিতে হয়। তবে তফাৎ এই, সাধারণ লোক যায় কাঁদতে কাঁদতে, আর ওঁরা যান হেসে হেসে--মৃত্যুটা যেন খেলা।”
“কত সৌভাগ্য, মা এই জন্ম, খুব ক'রে ভগবান্কে ডেকে যাও। খাটতে হয়, না খাটলে কি কিছু হয়? সংসারে কাজকর্মের মধ্যেও একটি সময় ক'রে নিতে হয়।”
“মা--মানুষের আর কতটুকু বুদ্ধি? কি চাইবে কি চাইবে। শেষে কি শিব গড়তে বানর হ'য়ে যাবে। তাঁর শরণাগত হ'য়ে থাকা ভাল। তিনি যখন যেমন দরকার, তেমন দিবেন। তবে ভক্তি ও নির্বাসনা কামনা করতে হয়--এ কামনা কামনার মধ্যে নয়। আমি--ঠাকুর বলেছেন, `এখানে যাঁরা আসবে তাদের শেষ জন্ম।' আবার স্বামীজী বলেছেন, `সন্ন্যাস না হ'লে কারও মুক্তি নেই।' গৃহীদের তবে উপায়? মা--হ্যাঁ, ঠাকুর যা বলেছেন তাও ঠিক, আবার স্বামীজী যা বলেছেন তাও ঠিক। গৃহীদের বহিঃ-সন্ন্যাসের দরকার নেই। তাদের অন্তর-সন্ন্যাস আপনা হতে হবে। তবে বহিঃ-সন্ন্যাস আবার কারো কারো দরকার।”
একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, ``মা, ভগবানের নাম করলেও কি প্রারব্ধ ক্ষয় হয় না?" মা বলিলেন, ``প্রারব্ধের ভোগ ভুগতেই হয়। তবে ভগবানের নাম করলে এই হয়--যেমন একজনের পা কেটে যাবার কথা ছিল, সেখানে একটা কাঁটা ফুটে ভোগ হ'ল।
পরের একটি ছেলে নিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিলুম। তার উত্তরে রাধুর জন্য নিজের অবস্থা দেখিয়ে মা বলেছিলেন, ``অমন কাজও করো না। যার উপর যেমন কর্তব্য ক'রে যাবে, কিন্তু ভাল এক ভগবান্ ছাড়া আর কাউকে বেসো না। ভালবাসলে অনেক দুঃখ পেতে হয়।"
“দয়া যার শরীরে নাই, সে কি মানুষ? সে তো পশু। আমি কখনও কখনও দয়ায় আত্মহারা হয়ে যাই, ভুলে যাই যে আমি কে।”
গ্রন্থালোচনা:
শ্রীমা সারদা দেবী । স্বামী গম্ভীরানন্দ
গ্রন্থকারের নিবেদন
মায়ের জীবনী-রচনার কথা আমরা মনে মনে যতই আলােচনা করিয়াছি, ততই এই কার্য কত গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃসাধ্য ইহা ভাবিয়া দ্বিধাগ্রস্ত হইয়াছি। এইরূপ অদৃষ্টপূর্ব দেবচরিত্রের মর্মোদঘাটনের জন্য যে প্রকার অন্তদৃষ্টি ও বাঙনৈপুণ্য আবশ্যক, তাহার কিছুই আমাদের নাই। তথাপি আমরা এই বিশ্বাসে এই অসীম সাহসিক কার্যে অগ্রসর হইয়াছি যে, ইহাতে আমাদের ব্যক্তিগত লাভ আছে। চরিত্রাণ-প্রসঙ্গে আমরা বস্তুতঃ এক সুদীর্ঘ আধ্যাত্মিক সাধনায়ই রত হইয়াছি। আবার আমরা ইহাও জানি যে, কোনও বুদ্ধিমত্তার আশ্রয় না লইয়া সরল ভাবে এই অলৌকিক জীবনের ঘটনাবলী শুধু পরপর সাজাইয়া গেলেই শুদ্ধচিত্ত পাঠক ইহার তাৎপর্য অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন। কারণ মা কোন নিগুঢ় দর্শন বা জটিল মতবাদ লইয়া আসেন নাই; তিনি আসিয়াছিলেন জীবমাত্রের কল্যাণবিধায়িনী জননীরূপে। জননীর স্নেহ সন্তানের নিকট ব্যাখ্যা করার প্রয়ােজন হয় না।
অধিকন্তু তিন বৎসর পূর্বে মায়ের শতবর্ষীয় জয়ন্তী-উৎসবের জন্য যে অস্থায়ী সমিতি সংগঠিত হয়, তাঁহারা বঙ্গভাষায় একখানি প্রামাণিক ও বিস্তারিত জীবনীয় প্রয়ােজন বােধ করিয়া বর্তমান লেখকের উপর ঐ গুরুভার অর্পণ করেন। তখনই এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বেলুড় মঠের সাধারণ সম্পাদক স্বামী মাধবানন্দজী ইহা সম্পাদন করিবেন। ইহাতে আমরা সাহস ও উৎসাহ পাইয়া এই সাধ্যাতীত কর্তব্যপালনে উদ্যত হই। বলা বাহুল্য যে, স্বামী মাধবানন্দজী গ্রন্থখানি আদ্যোপান্ত সংশােধন করিয়া দিয়াছেন।
গ্রন্থের উপাদান প্রায়শঃ প্রকাশিত পুস্তকাবলী হইতে সংগৃহীত হইলেও অনেক প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা বহু নূতন তথ্য লিখিত বা মৌখিক ভাবে দিয়াছেন। গ্রন্থগুলির ও বিবরণদাতাদের নাম পরিশিষ্টে প্রদত্ত হইল। এতদ্ব্যতীত পুরাতন পত্র ও দলিল প্রভৃতি হইতেও আমরা যথেষ্ট সাহায্য পাইয়াছি। আমরা গ্রন্থকার ও উপাদানদাতৃগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।
ইহা এক আশ্চর্য ব্যাপার যে, শ্ৰীমা যদিও মাত্র সার্ধএয়স্ত্রিংশ বর্ষ পূর্বে লীলাসংবরণ করিয়াছেন, তথাপি এই জীবনের চমৎকারিত্বে আকৃষ্ট বহু লেখক ইতিমধ্যেই অনেক তথ্য ভক্তসমাজে পরিবেশন করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই গ্রন্থগুলিতে প্রকাশিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে মৌলিক সামঞ্জস্য থাকিলেও সর্বাঙ্গীণ মিল নাই। এইরূপ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের বিচারশক্তির আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছি এবং অধিকাংশ স্থলে, পাদটীকায় আমাদের অবলম্বিত সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করিয়াছি। কিন্তু অযথা বাদপ্রতিবাদের ভয়ে স্থলবিশেষে যুক্তিযুক্ত বিবরণ-প্রদানন্তে কারণ-বিষয়ে মৌন অবলম্বন করিয়াছি। তবে পাঠক লক্ষ্য করিবেন যে, এই সকল স্থলে মায়ের নিজের কথাকেই আমরা সর্বাধিক সম্মান দিয়াছি।
২.
জন্মজন্মান্তরের মা- শ্রীমা সারদা দেবীর জীবনকথা বাংলা বই পিডিএফ সংগ্রহ।
রামকৃষ্ণ যদি অবতার হন, তবে শ্রীমা নিশ্চয় তার শক্তি। পূর্ব পূর্ব অবতারগণের শক্তির তেমন বিকাশ ছিল না। এযুগে সবই নূতন, অদ্ভুত। শক্তির বিশেষ ভূমিকা। শ্রীমার মধ্যে আমরা দেখতে পাই সীতার অপার সহিষ্ণুতা—বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে যিনি মহাদুঃখের জীবন যাপন করে গেছেন, নিত্য সাধ্বী, নিত্য শুদ্ধস্বভাবা। দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার দেহবোধরহিত অপার ভালোবাসা—'তৎসুখে সুখিত্বম্', যশোধরার মতো তিনি একান্তভাবে স্বামীর আদর্শের অনুবর্তিনী, বিষ্ণুপ্রিয়ার মতোই নীরব মহাসাধিকা। আবার অবতারতত্ত্বে যাঁরা উৎসাহ বোধ করেন না, তারাও উপলব্ধি করেন তাঁর দিব্য জীবনের মহিমা। তার মাতৃত্বের স্নেহলাভে ধন্য ভক্তহৃদয় জননীরূপে তাকে চিন্তা করে- যিনি পরম আশ্বাস দেন, সন্তানের সকল তাপ হরণ করে পরিচালিত করেন শান্তির পথে। সর্বদাই সর্বভূতহিতে রতা।...
যা (যিনি) দেবী ভগবতী, সা (তিনি) সারদা সরস্বতী। চণ্ডীতে দেবী বিভিন্ন নামে বর্ণিত হয়েছেন : যেমন দুর্গা, কালী, কৌশাম্বী, চামুণ্ডা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শিবদূতী, শাকম্ভরী, অম্বিকা, কাত্যায়নী, গৌরী, জগদ্ধাত্রী, ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মহামায়া, মঙ্গলা, জয়ন্তী ইত্যাদি। দৈত্যরাজ শুম্ভ দেবী দুর্গাকে বলল : তুমি গর্ব কোরো না। তুমি অন্যান্য দেবীর শক্তি আশ্রয় করে যুদ্ধ করছ। তখন দেবী বললেন, ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’—এ-জগতে একমাত্র আমিই বিরাজিতা। আমা ছাড়া দ্বিতীয় আর কে আছে? এ-সকল দেবী আমারই অভিন্না শক্তি। এই দেখো, এরা আমাতেই বিলীন হয়ে গেল।
মা সারদার জীবনীগ্রন্থ সমূহ পড়লে আমরা দেখতে পাই তিনিও বিভিন্ন নামে বর্ণিত হয়েছেন : যেমন সরস্বতী, কালী, বগলা, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী, ত্রিপুরসুন্দরী, দুর্গা, ভগবতী, পর্বতবাসিনী, সীতা, রাধা, বিষ্ণুপ্রিয়া, উমা, মহামায়া, জগদম্বা, শিবানী, সতী ইত্যাদি। একদিন কথাপ্রসঙ্গে স্বামী কেশবানন্দ বললেন, “মা, আপনাদের পরে ষষ্ঠী, শীতলা প্রভৃতি দেবতাকে আর কেউ মানবে না।” শ্রীমা বললেন : “মানবে না কেন? তারা ত আমারই অংশ।”
সারদা নামের রহস্য। সা-সামীপ্যে। স অর্থাৎ সাধনা, সহিষ্ণুতা, সেবা, সমদৃষ্টি, সদাচার, সরলতা; স অর্থে সবুজ বা তারুণ্য, সাদা বা শুচিতা। এসব দৈবী গুণাবলীর প্রতীক যিনি এবং যাঁর ধ্যানে সালোক্য, সামীপ্য, সারূপ্য ও সাযুজ্য মুক্তি হয়। র—রক্ষণে। কামক্রোধাদি ষড়রিপু, বিপদ আপদ, আধি-ব্যাধি, রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু থেকে যিনি রক্ষা করেন। দা-দানে। জ্ঞানভক্তিবিবেকবৈরাগ্য, ধর্ম-অর্থকামমোক্ষ, সুখসম্পদ, আনন্দ যিনি দান করেন। যিনি জীবের ভরণ, পোষণ ও রক্ষণ করেন তিনি মা সারদা।
নম: যথাগ্নের্দাহিকা শক্তি, রামকৃষ্ণে স্থিতা হি যা।
সর্ববিদ্যাস্বরূপাং তাং সারদাং প্রণমাম্যহম্।।
No comments:
Post a Comment