Monday, 31 January 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কৃষ্ণ ধর। ০১.০২.২০২২. Vol -632. The blogger in literature e-magazine


কৃষ্ণ ধর

 জন্ম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১ লা ফেব্রুয়ারি  বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের কমলপুর গ্রামে। পিতা উপেন্দ্রচন্দ্র ধর ও  চিন্ময়ী ধর - মাতা। তিনি কিশোরগঞ্জেরই বাজিতপুর এইচ ই হাই স্কুল থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফেনী কলেজ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আই. এ পাশ করে কলকাতায় আসেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থশাস্ত্রে স্নাতক হন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে [কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়] থেকে এম.এ পাশ করেন।


কলকাতার দেশবন্ধু গার্লস কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হতে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক "যুগান্তর" পত্রিকার সহ-সম্পাদক হন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যাপনা ও করেছেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ভারতীয় বিদ্যাভবনে। 

দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন কল্পনা ধর। সন্তান- নীলাঞ্জনা চৌধুরী (কন্যা)- সুরঞ্জনা চৌধুরী (কন্যা)


বাংলা সাহিত্য নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনার সময়ই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। এম.এ পাশের আগেই ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "অঙ্গীকার" প্রকাশিত হয়। তারপর অধ্যাপনা ও সাংবাদিকতার সাথে সাথে সাহিত্যচর্চা করেছেন সমানভাবে। কবিতার পাশাপাশি কাব্যনাটক, ভ্রমণকাহিনী, সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নিজের ধারণা রচনাসম্ভারে ঠাঁই হয়েছে। কৃষ্ণ ধরের রচনা সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক শিশির কুমার দাশ মন্তব্য করেছেন -"  সুমিত শব্দচয়ন, রূপময় চিত্রকল্প রচনা এবং সূক্ষ্ম ভাবাবেশ কবিতাগুলির প্রধান আকর্ষণ। কাব্যনাট্যে তার বিশিষ্টতা বিদগ্ধ মহলে স্বীকৃত।"

রচনা কর্ম ;

কবি কৃষ্ণ ধর গত শতাব্দীর পাঁচের ও ছয়ের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। ওই সময়কালের মধ্যে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘প্রথম ধরেছে কলি’ (১৯৫৫), ‘এ জন্মের নায়ক’ (১৯৬২), ‘এক রাত্রির জন্য’ (১৯৬০), ‘আমার হাতে রক্ত’ (১৯৬৭), ‘কালের নিসর্গ দৃশ্য’ (১৯৬৮) ‘দুঃসময় কবিতার লেখকের কাছে’ (১৯৭০) প্রভৃতি। পরবর্তী কালে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আছে ‘কালের রাখাল তুমি ভিয়েতনাম’ (১৯৭২), ‘যে যেখানে আছো’ (১৯৭৬), ‘শব্দহীন শোভাযাত্রা’ (১৯৮১), ‘হে সময় হে সন্ধিক্ষণ’ (১৯৯১), ‘নির্বাচিত কবিতা’ (১৯৯৬), ‘প্রিয় বাক্ কথা রাখো’ (২০০১), ‘গাঙচিলের স্বপ্ন ও সাতরঙা রামধনু’ (২০০৫), ‘হাঁটব থামব না’ (২০০৮), ‘জোনাকপরি হোমাপাখি’ (২০০৮), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (সংকলনগ্রন্থ) (২০১৬), ‘কবিতা সংগ্রহ’ (২০১৯) প্রভৃতি। কবিতার পাশাপাশি তিনি অনেক কাব্যনাটক রচনা করেছেন। তাঁর কাব্যনাটকগুলি হল ‘নির্বাচিত কাব্যনাটক’ (১৯৮৪), ‘বিরুদ্ধ বাতাস’ (১৯৮৯), ‘কাব্যনাটক সংগ্রহ’ (২০০৯) (‘ভোরের মানুষেরা’, ‘সিন্ধুপারের পাখি’, ‘আমি নচিকেতা’, ‘ডানা’, ‘অভিমন্যু’, ‘জেগে আছো বর্ণমালা’, ‘খড়কুটো’, ‘বিরুদ্ধ বাতাস’, ‘বিকেলের বারান্দা পেরিয়ে’, ‘পায়ের শব্দ শোনা যায়’, ‘প্রচ্ছদে লেগেছে ধুলো’, ‘কেয়া ফুলের গন্ধ’, ‘পদধ্বনি কার’, ‘যাই উৎসের দিকে’, ‘একটাই জীবন’, ‘নদীতেই প্রতীক’, ‘গোলাপের যুদ্ধ’, ‘ঘরে ফেরার দিন’, ‘যদিও সন্ধ্যা, ‘পাহাড় ডেকেছিল’, ‘হে সময় হে সন্ধিক্ষণ’, ‘নিহত গোধূলি’, ‘বধ্যভূমিতে বাসর’, ‘করুণ রঙীন পথ’, ‘অন্ধকারে জুঁই ফুলের গন্ধ’, ‘বনজ্যোৎস্না’, ‘সমবেত করতালি’, ‘বাতিঘর’, ‘পদধ্বনি পলাতক’)। অপ্রকাশিত কাব্যনাটক ‘ফুলওয়ালি’ ১৯৬৮/৬৯ সালে গন্ধর্ব নাট্যগোষ্ঠীর দ্বারা মঞ্চস্থ হয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।তাঁর লেখা দুটো অত্যন্ত সুখপাঠ্য ভ্রমণকাহিনী হল ‘মস্কো থেকে ফেরা’ (১৯৭৪), এবং ‘অন্য দেশ অন্য নগর’ (১৯৮১)।আজ থেকে চার বছর আগে বেরিয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বই ‘আট দশক সাত কাহন'(২০১৬)। গত বছর ‘ঝাঁকিদর্শন’ (২০১৯) শিরোনামে তাঁর আর একটা স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দুটোই বেশ সুখপাঠ্য।সাহিত্য নিয়ে লেখা তাঁর বইয়ের মধ্যে আছে ‘আধুনিক কবিতার উৎস'(১৯৬৯) ও ‘সাহিত্যের সাজঘর'(২০১৫)।

তার ইতিহাসমূলক লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ (১৯৭১), ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রামে বাংলা’ (১৯৯৭) ও ‘কলকাতা তিন শতক’ (প্রথম সংস্করণ ১৯৮৯, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৪)।


তাঁর লেখা জীবনীগুলি হল ‘দেশনায়ক সুভাষ’ (প্রথম সংস্করণ ১৯৯৭, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৭), এবং ‘সংগ্রামী সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়’ (২০০৭)।


সাংবাদিকতা নিয়ে লিখেছেন ‘সাংবাদিকতার দর্শন : আদর্শ ও বিচ্যুতি’ (প্রথম সংস্করণ ২০০৩, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৫)।

এ ছাড়াও অন্যান্য ধরনের তাঁর দুটো উল্লেখযোগ্য বই আছে। সেগুলো হল ‘বই পড়ুয়ার দেখা মানুষ’ (২০১৪) ও ‘পুরানো আখরগুলি’ (২০১৩)।

স্বনামে লেখার পাশাপাশি তিনি মল্লিনাথ, বিদুর ও অন্যদর্শী ছদ্মনামেও লিখেছেন।


সারাজীবনে তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুধা বসু পুরস্কার, পোয়েট্রি ইন্ডিয়া পুরস্কার, শিশির কুমার পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির নজরুল পুরস্কার, মুজফফর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, অমৃত পুরস্কার, ত্রিবৃত্ত পুরস্কার, গৌরী ঘোষাল স্মৃতি পুরস্কার, সারঙ্গ সাহিত্য পত্রিকার সারঙ্গ অর্ঘ্য নিবেদন ও গ্রেট বেঙ্গল পুরস্কার।


তাঁর কবিতার ভাষা বড়ো মোলায়েম। ব্যক্তি জীবনের মতো কবিতাতেও তিনি মৃুদুভাষী। অনুচ্চ কণ্ঠে মৃদু পদক্ষেপে তাঁর কবিতা আমাদের অজান্তেই আমাদের নিয়ে চলে যায় তাঁর কবিতার নিজস্ব ভুবনে। কঠোর বাস্তবের লড়াই সংগ্রামের কথা বলার সময়েও কৃষ্ণদা বরাবর অনুত্তেজিত থেকেছেন। তাই তাঁর কবিতা পড়ে পাঠকেরাও অনুত্তেজিত চিত্তে সমকালে তাঁদের কৃত্যাকৃত্য নির্ধারণের দিশা খুঁজে পান। ‘হে সময় হে সন্ধিক্ষণ’ কাব্যগ্রন্থের নীচের কবিতাটি পড়লেই এটা বুঝতে পারা যাবে।

অশ্বমেধের ঘোড়া

মারহাট্টা ডিচের ওপারে থমকে দাঁড়িয়ে যায় 

যত অশ্বমেধের ঘোড়া 

এমনি শহর ওরা বানিয়ে রেখেছে।


মহারাজ, তবে আজ তুমিও যজ্ঞের আশা ছাড়ো 

ওই দ্যাখো কালিগুলার দামাল ঘোড়াটা

ইতিহাসে পাথর সেজেছে।


এ শহরকে তুমি চেনো না মহারাজ 

হাততালি দিলে পিল পিল করে 

বেরিয়ে পড়ে অক্ষৌহিণী সেনা 

এরা সব সংসপ্তক।

হাজার বছর ধরে মার খেতে খেতে 

এ মাটি এখন পাথর 

এ বড় কঠিন শহর মহারাজ, 

দ্যাখো কী বেইজ্জত, অশ্বমেধের ঘোড়া 

ময়দানে গিয়ে মুখ দেয় অর্বাচীন ঘাসে।

কিংবা তাঁর ‘কবিতা সংগ্রহ’-এর নীচের কবিতাটি।


সব দিতে পারি

দিতে পারি আমাদের সব গোপন অহংকার 

ভাষার মালা গেঁথে অনিঃশেষে 

দিতে পারি আমাদের দিন ফুরোবার আশা ও নিরাশা 

বিনাশর্তে হলুদ খামেতে পুরে ডাকবাক্সে 

দিতে পারি বাহান্ন বিঘার ছায়াবীথির কুসুমবাস 

চৈত্র দিনের খ্যাপা হাওয়া বিজন দুপুরে 

দিতে পারি ঘাট বাঁধানো পুকুরের শান্ত শীতলতা 

তৃষ্ণার্তের প্রহরে অযাচিতে।


দিতে পারি অভিমানী হৃদয়ের মৌনভাষ।

অনিদ্রাকাতর রাত্রির নিঃসঙ্গ মুহূর্তে 

দিতে পারি আমাদের নিকানো দাওয়ার আলপনা 

মাঘমণ্ডলের ব্রতকথা, আশ্বিনের ঘ্রাণ

দিতে পারি এই জেনে, তোমার শিয়রে ওরা জেগে থেকে 

আমাদের শিকড়ে দেবে জল আর রৌদ্রের খবর।

 বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ কৃষ্ণ ধরের কবিতা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘সুমিত শব্দচয়ন, রূপময় চিত্রকল্প রচনা, এবং সূক্ষ্ম ভাবাবেশ তাঁর কবিতাগুলির প্রধান আকর্ষণ।’


কবির বয়স এখন বিরানব্বই বছর। এখনো তাঁর চিন্তা ও মনন আগের মতোই সক্রিয়। এখনো তিনি আগের মতোই প্রেরণাদায়ী কবিতা লিখে যাচ্ছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির এপ্রিল, ২০২০ সংখ্যার বুলেটিনে প্রকাশিত তাঁর কবিতাটি পড়লেই পাঠক সে কথা বুঝতে পারবেন।

নির্ভয়

ব্যাঙ্গমা বলছে ব্যাঙ্গমিকে 

শোনো শোনো কান পেতে শোনো 

ব্যাঙ্গমি বলে কী আর শুনবো

সবই তো পুরনো পুথির বাক্য একই ছাঁদে ঢালা

সবারই এক কথা-- পালা পালা পালা 

কোথায় পালাবে তারা? কার কাছে যাবে?

কে আছে ডেকে নিতে ছাদহীন ঘুঘুচরা ভিটেতে তাদের

একদিন শিখেছিল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে থাকো

এখন ত্রস্ত তারা দিশেহারা পরিযায়ী পাখিদের মতো।

ব্যাঙ্গমা বলছে, এত ঘৃণা, এত বিষ, জমা ছিল 

তবে কেন একদিন জেনেছিল মানুষ মানুষের জন্য 

মানুষের মাপেই সব কিছুর বাছ ও বিচার 

মৃত্যুনীল বিষের অক্ষরে ধ্বংস ও বিনাশের ভয়

আকাশে বাতাসে ছড়ায় 

ব্যর্থ করো ব্যর্থ করো তারে 

মানুষই ফেরাবে তাকে শুভ চেতনায়

১৪২৭-এর শারদীয় ‘কালান্তর’ পত্রিকায় কবি আলোর পথযাত্রীদের ফিরে আসার ডাক দিচ্ছেন। ফিরে এসো নামের এই কবিতায় তিনি স্বভাবসুলভ মৃদু স্বরে আর একবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করলেন তাঁর বুকের মধ্যে আজীবন সযত্নে লালিত গভীর প্রত্যয়। কবি বলছেন, ‘ওদের ফিরিয়ে আন/ আমরা আবার ওদের সঙ্গে অনেক দূর হাঁটব’

যাবার আগে বলেছিল, আসি 

যেমন মেঘ ফিরে আসে নদীজলে 

উৎসে ফিরে যাবার এই আকুলতা 

কোনো বাধা মানে না

মাঝখানে অনেক বদলে যাওয়া -- ভুলে যাওয়া

সময় ঢুকে যায় সময়ের নিবিড় বুকে 

কেউ কি জানতে চায় কোথায় হারিয়ে গেল 

সেনেট হলের ডোরিক কলামগুলো 

ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে শুয়ে যে স্বপ্ন দেখ 

সে আজ কোথায় 

গোলদিঘির বুকে বিচ্ছুরিত হত কত রৌদ নীলিমা 

হাওয়ায় উড়ে আসত কতশত পাণ্ডুলিপির পাতা

ওদের ফিরিয়ে আন 

আমরা আবার ওদের সঙ্গে অনেক দূর হাঁটব . 

বিভিন্ন সময়ে তিনি সাম্মানিক পদে থেকে বহুবিধ দায়িত্ব পালন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাস মিডিয়া সেন্টারের সভাপতি। ছিলেন কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের রিনেমিং কমিটির সদস্য। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্র সদনের উপাদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন।


কবিতা ১.


এক অলীক শহরের গপ্পো।


এ যেন এক অলীক শহরের গপ্পো

তার ঘর বাড়িগুলো দেখতে ঝকঝকে

যেন বা ডানা মেলে এখুনি উড়ে এসেছে

অন্য গ্রহ থেকে।

তাদের এক ঝুল-বারান্দায় লম্বা জোব্বা আর মেঘের টুপি পরে

দাঁড়িয়ে শিস দিচ্ছেন শহরের মেয়র।

রাস্তায় রাস্তায় উজ্জ্বল রূপোলি আলােগুলাে

কামরাঙা ফলের মতাে

হেলমেটপরা ট্রাফিক পুলিশের মাথায় চুমু খাচ্ছে।

শহরের টুরিস্ট নারীদের দিকে না তাকানােই এখন ভব্যতা

কেননা ওরা জন্মদিনের পােশাকে

স্নান করতে নেমেছেন নদীতে।

আশ্বিনের মেঘ দেখলেই

ওদের বাড়ির কথা মনে পড়ে যাবে।

তখন ভিনাস ডি মিলোর ভঙ্গিতে জল থেকে উঠে এসে

নিজস্ব স্বর্গে ফিরে যাবেন লক্ষ্মী মেয়ের মতাে

সবার হাঁ-করা মুখের ওপর দিয়ে।

অলীক শহরটা সেদিন খুব বেজার হবে তাদের ব্যবহারে

তার বুকটা টনটন করে উঠবে ব্যথায়।

ওরা ভাবতে থাকবে

কবে আবার পাখিরা আসবে তার সাজানো বাগানে

কবে তার গাছপালাগুলো আবার সবুজের কনসার্ট বাজাবে ভােরবেলা।

শুধু ফুটপাতের ভিখিরি শিশুটা

খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠবে তিনবার।

শহরের মেয়র তিন সত্যি করেছিলেন

ওকে এবার শীতে একটা কম্বল দেওয়া হবে।

সেদিন থেকে সে স্বপ্ন দেখে

সবার গায়ে রঙ-বেরঙের পশমের পােশাক

সেই শুধু ঠকঠক করে কাঁপছে বােকার মতাে

মেয়রের ম্যাজিকে যদি তার সেই কাপুনিটা থেমে যায়

তাই সে হাততালি দিয়ে উঠল খুশিতে।


কবিতা ২.

আরে ধ্যুৎ! আরে ধ্যুৎ!


লােডশেডিং-এ ঘটনাটা ঘটলাে অদ্ভুত

 গােবিনমামার চোখের সামনে।

                              আস্ত একটা ভূত!

                     (আরে ধ্যুত! আরে ধ্যুৎ !)

  শােনাই না গল্পটা তার

  ঘটলাে যা তা চমৎকার

                 বারান্দায় ঘােরে ফেরে কেটা?

 নিশ্চয় হবে কোনাে পেত্নির বেটা।

 আসে যায় হাত নাড়ে, হঠাৎ সটকে পড়ে

                                           সুরুৎ সুরুৎ ?

                            (আরে ধ্যুৎ! আরে ধ্যুৎ!)

 কী যে বলো আজগুবি

 হাসি পায় শুনে খুবই

 তবু বলা চাই তার গল্পটা ভূতের

 যেন বা নামতা পড়ে ছয়ের সাতের।

 এইসব কালাে ছায়া বিতিকিচ্ছিরি

 ভূতেরা নৃত্য করে কী বা তার ছিরি

 ভূতের শরীর কেমন ? নরম, লােমশ ?

 মুখটা দেখেছে তার কিংবা মুখােশ?

 ক’টা হাত? ক’টা পা?

 আছে নাকি রণপা ?

 নাকিসুরে কাঁদে, নাকি

                        বাজে জগঝম্পা?

 বলাে বলাে সাফ কথা

 ভূত নিয়ে মাথাব্যথা

 হাসালে গােবিনমামার কাহিনী কিম্ভুত

 ভূতেরাও শুনে হাসে।

 ছিল যারা আশেপাশে

 হঠাৎ চমকে উঠে,

                         জ্বলেছে বিদ্যুৎ!

             কোথা ভূত? কোথা ভূত?

               (আরে ধ্যুৎ! আরে ধ্যুৎ!)


কবিতা ৩

তোমার বসন্ত

বসন্তে ফোটাই ফুল, কথা দিচ্ছি এই ফুল

তুলে তোমাকে একগুচ্ছ দেবো চুলে।

দিয়ো। কিন্তু বিহ্বলতা এনো না কখনো চোখে

তার চেয়ে স্বপ্ন দেখো, কে জাগাল চৈত্রদিনে

কে জাগাল আকস্মিকতায়?

আমি কি বসন্ত হ’বো তোমার বসন্ত

স্পর্ধা নিয়ে দোলাবো কি তোমার যৌবন

নতুন বৃষ্টির মতো ধানচারা তোমার শরীর

আমাকে জড়াতে চায়, আমি কিন্তু

বিপন্নের মত তখন লুকোবো মুখ

দুঃখিত হয়োনা অরুন্ধতী।

তোমার বক্ষের স্বর্গ করতলে দিয়েছে

উত্তাপ, চাই না চাই না আমি, ওই দুটি

বিস্মিত আপেল কোনো চিত্রশিল্পীকে দিয়ে।

অনাবৃত উপহার সে আঁকবে আশ্চর্য তুলিতে

আমি হ’বো বিমুগ্ধ দর্শক।



==========={{{{{{{{{{================







Sunday, 30 January 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। শিবনাথ শাস্ত্রী। ৩১.০১.২০২২. Vol -632 .. The blogger in literature e-magazine.

সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ-সংস্কারক ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক 



আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী 


সময়টাও ছিল একটু অন্যরকম। উনবিংশ শতক। ব্রিটিশরা গোটা দেশ অধিকার করে নিয়েছে। আর তার মধ্যেই শুরু হয়েছে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার। এই ধর্মের মতবাদ, আদর্শ, একেশ্বরবাদ অনেককেই আকৃষ্ট করল তখন। বিশেষ করে, অল্পবয়সী যুবারা দলে দলে যোগ দিতে শুরু করলেন এখানে। সনাতন ধর্মের কুসংস্কার, গোঁড়ামিকে আক্রমণ করতে লাগলেন। সংস্কৃত কলেজের ওই যুক্তিবাদী তরুণ, শিবনাথ শাস্ত্রীও এই দলে ভিড়লেন। আর ছেলে ব্রাহ্মসমাজে যাচ্ছে, এমন কথা শুনে তেড়েফুঁড়ে উঠলেন বাবা। তাঁরা রক্ষণশীল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ; এভাবে ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারেন! 

কিন্তু শিবনাথ যাকে বলে, নাছোড়বান্দা। ছোটো থেকে বাবার বদমেজাজ সহ্য করে এসেছেন তিনি। এবার তাঁর স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ করতে চান তিনি! শুরু হল বাবা-ছেলের যুদ্ধ। এমন যুদ্ধ তো সেই সময় কলকাতায় হরদম দেখা যেত। কিন্তু এখানে যে তরুণটির নাম শিবনাথ শাস্ত্রী! পরবর্তীকালে বাংলার ইতিহাসের খাতায় তাঁর নাম উঠে যাবে চিরকালের জন্য। যাই হোক, ছেলের যে কোনভাবে ‘মতি ফিরবে না’, সে কথা বুঝে গিয়েছিলেন বাবা হরানন্দ ভট্টাচার্য। যার অবশ্যম্ভাবী ফল, শিবনাথের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করা। রবং তারপরই বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া… 



জন্ম ১৮৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশপরগনা জেলার চাংড়িপোতা গ্রামে (বর্তমানে সুভাষগ্রাম)  মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে। তাঁর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ ভট্টাচার্য (১৮২৭-১৯১২) ছিলেন জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার প্রথম পৌরপ্রধান। তাঁর মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (১৮১৯-১৮৮৬) ছিলেন তৎকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সোমপ্রকাশ'এর সম্পাদক।


শিবনাথ কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৬৬) এবং কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৬৮), বি.এ (১৮৭১) ও এম.এ (১৮৭২) পাস করেন। পরে ঐ কলেজ থেকেই তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন।

১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট শিবনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেন। শিবনাথ, ছেদ করেন পরিবারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক। পিতা হরানন্দ শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেন, স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথও চিরকালের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ক্রমে শিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হনছাত্রাবস্থায়ই (১৮৬৯) শিবনাথ কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। Indian Reforms Association-এ যোগ দিয়ে তিনি মদ্যপান নিবারণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে এবং শিল্প-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যার প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। মদ্যপানের বিরোধিতা কল্পে তিনি ১৮৭০ সালে প্রকাশ করেন মদ না গরল শীর্ষক একটি মাসিক পত্রিকা। পরে তিনি সোমপ্রকাশ (১৮৭৩-৭৪) ও ধর্মবিষয়ক সমদর্শী পত্রিকা (১৮৭৪) এবং আরও পরে তত্ত্বকৌমুদী, ইন্ডিয়ান মেসেজ ও মুকুল (১৮৯৫) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

শিবনাথ কেশব সেনের ভারত আশ্রমের বয়স্কা মহিলা বিদ্যালয় (১৮৭২), ভবানীপুর সাউথ সুবারবন স্কুল (১৮৭৪) এবং হেয়ার স্কুলে (১৮৭৬) শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৭৮)। নারীমুক্তি আন্দোলনে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে তিনি কেশবচন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। তাঁদের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ১৮৭২ সালে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সসীমা ১৪ বছর নির্ধারিত হয়।


১৮৭৭ সালে শিবনাথ ব্রাহ্ম যুবকদের ‘ঘননিবিষ্ট’ নামে একটি বৈপ্লবিক সমিতিতে সংগঠিত করে পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষার পক্ষে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি সিটি স্কুল ও স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি (১৮৭৯) এবং নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে মেয়েদের নীতিবিদ্যালয় (১৮৮৪) স্থাপন করেন। ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা সখা (১৮৮৩) তার উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়। ১৮৯২ সালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সাধনাশ্রম

  শিবনাথ মামার আদর্শে মানুষ। নরানাম্ মাতুলক্রমঃ। মামার মতোই জেদী। নিজে যা ভালো বোঝেন,তাই করেন। ব্রাহ্মধর্মের সংস্রব তাঁর পক্ষে ত্যাগ করা সম্ভব না। এই নিয়ে বাপছেলেতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট শিবনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেন শিবনাথ, ছেদ করেন পরিবারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক। পিতা হরানন্দ শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেন, স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথও চিরকালের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ক্রমেশিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ইতোমধ্যে ১৮৬৮ সালেব্রাহ্ম-আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪) প্রতিষ্ঠা করেন IndianReforms Association। এসংস্থার উদ্দেশ্য ছিল মদ্যপান নিবারণ, শিক্ষা প্রসার, সুলভ সাহিত্য ও কারিগরিজ্ঞানের প্রচার, নারীশিক্ষা তথা নারীমুক্তি। এসব আদর্শের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেশিবনাথ যোগ দেন IndianReforms Association-এ।শিবনাথ কেশবচন্দ্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে এসময় সমাজ সংস্কারমূলক অনেক কাজের সঙ্গেজড়িয়ে পড়েন। নারীশিক্ষার পক্ষে তিনি গ্রহণ করেন দৃঢ় অবস্থান, বিধবাদের বিয়ের পক্ষেতিনি উচ্চারণ করেন জোরালো বক্তব্য। কেশবচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় এসময় শিবনাথ মদ্যপাননিবারণ এবং শিক্ষা-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যা প্রচারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।সমাজে মদ্যপানের ভয়াবহতা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তরুণ সমাজকে মদ্যপানের ছোবল থেকে রক্ষাকরার মানসে তিনি প্রকাশ করেন মদ না গরলশীর্ষক পত্রিকা।শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখেরউদ্যোগে ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় Indian Association’। এই সংস্থাই হলো ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সংঘবদ্ধপ্রয়াস। এই সংস্থার অনুপ্রেরণাতেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী গঠন করেন ‘গুপ্ত বৈপ্লবিকসমিতি’। এই সংস্থার প্রধান কর্মসূচি ছিল – জাতিভেদ অস্বীকার, সরকারি চাকরিপ্রত্যাখ্যান, সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, অশ্বারোহণ ও বন্দুকচালনা শিক্ষা, জাতীয়তামূলক ও সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয়স্বাধীনতা। এসব উদ্দেশ্য থেকেই শিবনাথ শাস্ত্রীর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।


দ্বারকানাথই ছিলেন শিবনাথের সাংবাদিক জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণা। ১৮৮৩ সালে শিবনাথ

শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে সখা নামে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক প্রকাশিত হয়। অভিন্ন সময়ে তত্ত্বকৌমুদী (১৮৮২) এবং ইন্ডিয়ান মেসেজ (১৮৮৩) নামে দুটিক্ষণস্থায়ী পত্রিকা সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৯৫ সালে তাঁর সম্পাদনায়প্রকাশিত হয় বিখ্যাত কিশোর মাসিক মুকুল।

বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য বিকাশে এই পত্রিকা পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। উল্লিখিত

পত্রিকাসমূহ সম্পাদনায় শিবনাথ শাস্ত্রী বিশেষ দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন।


রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের দুই প্রধান কান্ডারি –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) এবং কেশবচন্দ্র সেন। প্রথম দিকে দেবেন্দ্রনাথ ও

কেশবচন্দ্রের মধ্যে ছির দারুণ সখ্য। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা সভায় তাঁরা বসতেন

পাশাপাশি। কিন্তু ১৮৭০-এর দশকে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরে। ব্রাহ্ম হলেও

দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটা প্রাচীনপন্থী। হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠান অনেকটাই পালন

করেন তিনি, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেন হিন্দুমতে, ব্রাহ্মণদের উপবীত ধারণে অনুমতি দেন।

পক্ষান্তরে কেশবচন্দ্র অনেক বেশি আধুনিক ও বিপ্লবী। ব্রাহ্মধর্মকে তিনি হিন্দুধর্ম

থেকে একেবারে আলাদা করতে চান। তাঁর মতে, ব্রাহ্মরা অ-হিন্দু। হিন্দুধর্মের সকল

প্রচার কুসংস্কারমূলক আচার-অনুষ্ঠান বর্জনের তিনি পক্ষপাতী। ক্রমে এই দুই

ব্রাহ্ম-নেতার বিরোধ ধারণ করে চরম রূপ। এসময় ব্রাহ্ম ধর্মসভায় নারীদের প্রকাশ্য

স্থানে উপাসনা করার পক্ষে ও বিপক্ষে মত প্রকাশে দেখা দেয় নতুন বিতর্ক। এ বিতর্কের

সূত্র ধরেই ১৮৭৮ সালে ভেঙে যায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। এ সময় শিবনাথ শাস্ত্রীর

নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। অন্যদিকে কেশবচন্দ্র

প্রতিষ্ঠা করেন ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ছিল ‘আদি

ব্রাহ্মসমাজ’। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রী এসময় পালন

করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাঁর নেতৃত্বগুণে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দ্রুত কলকাতার

সমাজজীবনে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। ধর্ম প্রচার ছাড়াও সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক

সংস্কার ছিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান কর্মসূচি। সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে

শিবনাথ শাস্ত্রী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করেন।


ইতোপূর্বেই শিক্ষাব্রতী হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর খানিকটা পরিচয় আমরা

জেনেছি। এ প্রসঙ্গে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সিটি স্কুলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ

করতে হয়। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল উত্তরকালে সিটি

কলেজে রূপান্তরিত হয়। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে উনিশ-বিশ

শতকের বহু আলোকিত মানুষ বিদ্যা লাভ করেন। সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় শিবনাথ শাস্ত্রী

তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু আনন্দমোহন বসু এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সহযোগ লাভ করেন।

অভিন্ন উদ্দেশ্যে এঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টুডেন্ট সোসাইটি’ (১৮৭৯)। বস্ত্তত এটিই

হলো ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্রসংগঠন।


১৮৮৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী ইংল্যান্ড গমন করেন। ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের

সমাজকে তুলনামূলক দৃষ্টিতে বিচার করার মানসেই তাঁর বিলেত গমন। ছয় মাস তিনি বিলেতে

প্রবাসজীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের নানা স্থানে ভারতবর্ষের সমাজ ও

সংস্কৃতি, বিশেষত ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে বহু বক্তৃতা দেন এবং অর্জন করেন প্রচুর প্রশংসা।

ইংল্যান্ড ভ্রমণ শিবনাথ শাস্ত্রীর মনে গভীর রেখাপাত করে। ইংরেজদের মধ্যে তিনি লক্ষ

করলেন বহু সদ্গুণ। দেশে প্রত্যাবর্তন করে ওই সদ্গুণের চর্চা করার মানসে তিনি

প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাধনাশ্রম’ (১৮৮৯)। জনগণের মধ্যে উচ্চ আদর্শ ও সদ্গুণ প্রচারে

সাধনাশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান

বিশেষভাবে স্মরণীয়। সমাজ সংস্কারমূলক বিচিত্র কাজে ব্যস্ত থাকলেও তিনি

সাহিত্যসৃজনেও ছিলেন সমান উৎসাহী ও আন্তরিক। তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ,

ইতিহাস, আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শিবনাথ শাস্ত্রী যেসব কাব্য

প্রকাশ করেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), পুষ্পমালা

(১৮৭৫), হিমাদ্রি কুসুম (১৮৮৭), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), ছায়াময়ী

পরিণয় (১৮৮৯) ইত্যাদি। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শিবনাথ শাস্ত্রীর

কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। সহজ-সরল হৃদয়বাণী গুণে শিবনাথের কবিতা সমকালে বিশেষ খ্যাতি

অর্জন করেছিল। তাঁর লেখা ‘আজি শচীমাতা কেন চমকিলে/ ঘুমাতে ঘুমাতে উঠিয়া বসিলে।’ –

পঙ্ক্তিদ্বয় তখনকার প্রতিটি ছাত্রের মুখে-মুখে উচ্চারিত হতো।


বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

একটি বিশিষ্ট আদর্শ তাঁর ঔপন্যাসিক চেতনায় সর্বদা থেকেছে ক্রিয়াশীল। নারীজীবনকে

তিনি সমাজে-সংসারে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন স্বমহিমায়। প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না

দেখে সামাজিক লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণে নারীকে বিবেচনার প্রাথমিক আভাস শিবনাথ শাস্ত্রীর

উপন্যাসে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে আছে মেজবৌ

(১৮৭৯), নয়নতারা (১৮৮৯), যুগান্তর (১৯১৫), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি। প্রসঙ্গত

উল্লেখ্য যে, তাঁর যুগান্তর

উপন্যাস থেকেই উত্তরকালীন বিখ্যাত সংবাদপত্র যুগান্তরের নামকরণ করা হয়েছিল। উপন্যাসে ভাষা-ব্যবহারে শিবনাথ

শাস্ত্রী ছিলেন অতিসতর্ক। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহার তাঁর

উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের বিকাশের ধারায় শিবনাথ

শাস্ত্রীর অবদান যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এখনো মূল্যায়িত হয়নি।


শিবনাথ কাব্য , উপন্যাস , প্রবন্ধ, জীবনী ইত্যাদি ধারায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর কয়েকটি অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থও আছে। 

১) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৯০৪),

 ২) আত্মচরিত (১৯১৮) 

৩),History of Brahma Samaj ইত্যাদি 

তাঁর গবেষণামূলক আকরগ্রন্থ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা হলো:

 নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), 

পুষ্পমালা (১৮৭৫),

 মেজ বৌ (১৮৮০),

 হিমাদ্রি-কুসুম (১৮৮৭), 

পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), 

যুগান্তর (১৮৯৫), 

নয়নতারা (১৮৯৯), 

রামমোহন রায়, ধর্মজীবন (৩ খণ্ড, ১৯১৪-১৬), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি। 

ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথা এলে শিবনাথ শাস্ত্রীও আসবেন অবধারিতভাবে। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেই তিনি উঠে আসেন সারিতে। প্রথমে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেও, পরে সেই আকর্ষণ চলে যায় কেশবচন্দ্র সেনের দিকে। যুক্তি, চিন্তা আর প্রশ্নের মাধ্যমেই আসল ব্যাপারগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন তিনি। একটা সময় মদ্যপানের বিরোধিতা করে বের করেছিলেন আস্ত একটি মাসিক পত্রিকা ‘মদ না গরল’। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নানা সময় নানা আন্দোলন করেছেন। কেন একটি মেয়েকে নাবালিকা অবস্থাতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি। সেই বিবাহের বয়স যাতে ন্যুনতম ১৪ বছর হয়, তারই চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু যখন দেখলেন কেশবচন্দ্র সেন নিজেই তাঁর নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে দিলেন, তখনই সরে এলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৭৮ সালে তৈরি করলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। 

এ তো ছিল সমাজসংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী। পাঠক, এবার আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করাব অন্য একটি দিকে। তিনি কবি শিবনাথ। তখন স্কুলের ছাত্র তিনি। ক্লাসেরই একটি ছাত্রের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না বাকিদের। ধনী পরিবারের সন্তান; কাজেই তার দেমাকও তেমন। পড়াশোনাতেও মন ছিল না একেবারে। সেই ছেলেই একবার প্রথম হয়ে গেল! ব্যস, আর পায় কে! অহংকার যাকে বলে আকাশে পৌঁছে গিয়েছিল। আর সেই ছাত্রটিকে জব্দ করার জন্যই কিশোর শিবনাথ একটা ফন্দি আঁটলেন। নিজের মনেই লিখে ফেললেন একটি কবিতা; অবশ্যই ব্যঙ্গাত্মক। আর যায় কোথায়! শিবনাথের সেই একটা কবিতাতেই বোমা ফাটল ক্লাসঘরে। জীবনের প্রথম কবিতা ওইখানেই।

তারপর থেকে মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’-এই প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর কবিতা। অবশ্য স্বনামে নয়; ছদ্মনামে। ‘শ্রীশ’ নামে ভরে উঠতে লাগল পত্রিকার পাতা। প্রায় সবই ব্যঙ্গাত্মক রচনা। কবিতার ছন্দের আড়ালে বসেই মেঘনাদের মতো সমাজকে দেখতে লাগলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ওই লেখাগুলো থেকেই তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ এবং সমাজ-সংস্কারের বিষয় চলে আসার ফলে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি। কবি শিবনাথ শাস্ত্রীকে আর সেভাবে দেখতেই পেল না বাংলা।


মৃত্যু - ১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।


========================{========

Saturday, 29 January 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। নরেন্দ্র মিত্র। ৩০.০১.২০২২. Vol -630 . The blogger in literature e-magazine


নরেন্দ্রনাথ মিত্র


"এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ঘটনার স্রোত বয়ে চলেছে। যুদ্ধ, হত্যা, কত দ্রুত রাজনৈতিক পরিবর্তন। সব খবরের কাগজে পড়ে যাই বড় বড় ছাপার অক্ষরে, কিন্তু মনে কোন ছাপ পড়ে না। সে সব দূরবর্তী দেশের কথা, চোখের আড়ালে যেখানে, ঘটনা তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে তার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আমার চোখের সামনে, আমার চারপাশেও তো কত ছোট ছোট ঘটনার ঢেউ উঠেছে। সে সম্বন্ধেও তো কোন সচেতনতা নেই” (নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বিশেষ সংস্করণ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৬৩০) 

১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারী, ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত সদরদি ভাঙা গ্রামে নরেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। পিতা, মহেন্দ্রনাথ, মা বিরাজবালা। নরেন্দ্রনাথ শৈশবেই হন মাতৃহারা।

তিনি বিমাতা জগমোহিনীর আশ্রয়েই মানুষ হন। শিশু নরেন্দ্রনাথের (ডাক নাম পন্টু) কাছে তিনিই আজন্ম মা-রূপে স্বীকৃত। পিতা বৈষয়িক কাজে দক্ষ ব্যক্তি, উকিলের সেরেস্তায় মুহুরী, কিন্তু গানে-অভিনয়ে-কাব্য উপন্যাস পাঠে এবং চিঠিপত্র লেখায় পারদর্শী ছিলেন। প্রথমে দারিদ্র্য তারপরে একান্নবর্তী পরিবারের দায়িত্বের বোঝা ইত্যাদির ফলে লেখাপড়া গান-বাজনার ইচ্ছা সত্ত্বেও সুযোগে বঞ্চিত হন। এই বাবা বাদে তার আর এক মামা চাকলাদার ঠাকুর্দা লেখকের শিশুমনে কিছুটা ছায়া ফেলেন। তবে খুড়তুতো ছোট ভাই কান্দুর তুলনায় নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে তিনি প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন : “শুধু বাবা নয়, আত্মীয়-স্বজন সবারই আচরণে আমি অনুভব করতাম আমি যেন কেমন কেমন। সবদিক থেকে আমি নিম্ন সাধারণ। সেই বোধ আমাকে পাঁচজনের সঙ্গ এড়াতে শেখাল। বুঝিয়ে দিল ঘরের কোণ আর নিজের মন ছাড়া তোমার কেউ নেই” (“স্মৃতি চিন্তা,” ‘বাবা’, নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০১)।


প্রথম লেখাপড়া গ্রামে অক্ষয় মাস্টারের কাছে, তারপর এম. ই. স্কুলে। পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষার অগ্রগতি থাকলেও ফলাফল সাধারণ মানের ১৩৫৩ সাল বা তার কিছুকাল আগে থেকে নরেন্দ্রনাথের পরিবারের নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবনের অবসান হয়। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারা বাংলা তখন বিধ্বস্ত, রাজনীতির চক্রান্তে দ্বিখণ্ডিত। পূর্ববঙ্গবাসীরা বিশেষভাবে হিন্দুদের জীবন তখন বিশেষভাবে বিপন্ন তারা সকলেই প্রায় ছিন্নমূল। পিতার মৃত্যুর ফলে সংসার আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হয়।

নরেন্দ্রনাথের ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আগমন হয়। কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্কের জব্বলপুর শাখায় বদলি হন, পরে পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায়, হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় কলকাতা তখন বিধ্বস্ত। অনুজ ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে নরেন্দ্রনাথের ৭/১, ব্রজদুলাল স্ট্রীটে এক সঙ্কীর্ণ গৃহে আশ্রয়গ্রহণ। এই পরিবেশেই শুরু হল সাহিত্যসাধনা। প্রকাশিত হল প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ’ (নামান্তরে ‘দ্বীপপুঞ্জ’)। ব্যাঙ্কে চাকরি করার সময় নরেন্দ্রনাথ বিপদে পড়েন। এক অসাধু ডিপজিটরের জাল সইয়ের কারসাজি বুঝতে না পেরে সাত হাজার টাকা তছরুপের দায়ে ফৌজদারী মামলার আসামী হয়ে যান। চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হন। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারক মি. ব্ল্যাক জুরিদের সঙ্গে একমত হয়ে তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, ডাক্তার পশুপতি ভট্টাচার্য প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ তাঁকে এইসময় নানাভাবে সাহায্য করেন। পরে নরেন্দ্রনাথ ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দিয়েই ইস্তাফা দেন। অস্থায়ী পদে চাকরী করেন ‘কৃষক’, ‘স্বরাজ’, ‘সত্যযুগ’, ‘মন্দিরা’ পত্রিকায়। শেষে ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকায় স্থায়ী পদে যোগদান করেন কর্মসূত্রে বন্ধু হন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাহিত্যিক বিমল কর, সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ এবং শাস্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিভিন্ন স্থানে চাকরির মত একাধিকবার বাড়ি বদলের দুর্ভোগও নরেন্দ্রনাথকে ভোগ করতে হয়। যেমন দ্বিতীয়বার সপরিবারে আশ্রয় নেন ১১৯বি, নারকেলডাঙ্গা মেন রোডের ব্রজদুলাল স্ট্রীটে একটি দেড়খানা ঘরে আটজন একত্রে, তারপর ৯৮, লিন্টন স্ট্রীটের এক বস্তি বাড়িতে, শেষে ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ২০/১/এ, রাজা মণীন্দ্র রোডের এক বড় বাড়িতে। তাঁর শেষ জীবন এখানেই অতিবাহিত হয়।


নরেন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন অন্যান্য সাহিত্যিকদের তুলনায় ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র। তিনি কোন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কলম ধরেন নি। উল্টোরথ’ পত্রিকার লেখক শ্রীকিরণকুমার রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এবং চিঠিতে জানান তাঁর লেখক হওয়ার ইতিহাসঃ “কি করে লেখক হলাম, কেন লেখক হলাম তা এক কথা তো ভালো, একশ কথাতেও বলা যায় কিনা সন্দেহ। আমরা সাধারণ লোক সাধারণ লেখক সবসময় সচেতনভাবে বিশেষ একটা পরিকল্পনা নিয়ে কিছু হয়ে উঠিনে, কি কিছু করে বসিনে। কিছু হওয়ার পরে সেই হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে বসি। সব লেখকই আদিতে পাঠক, আমিও তাই ছিলাম। ছেলেবেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসতাম। বই যে লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করতে হয় অল্প বয়সে আমার সে ধারণা ছিল না, বইয়ের জন্য পাড়ার সদ্য বিবাহিতা বউদিদের কাছে হাত পাততাম। পাঠক হিসেবে মেয়েদের সঙ্গে সেই যে আমার গোপন আত্মীয়তা হয়েছিল আজ লেখক হিসেবেও প্রায় তাই আছে। গভর্নমেন্ট অফ্ দি পিপল্, বাই দি পিপল, এ্যান্ড ফর দি পিপল-এর মত আমি মেয়েদের নিয়ে লিখি, মেয়েদের হয়ে লিখি, মেয়েদের জন্য লিখি। একথা বলতে আমার লজ্জা নেই। পুরুষ পাঠক যদি দু’ একজন মেলে তাকে ভাগ্য বলে মানি” (দ্রষ্টব্যঃ উদ্ধৃত, ‘তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থ পরিচয়', নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, ২, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৬)। 

এই পড়ার আগে শোনার শিক্ষা বাবার কাছে “আমার লেখক জীবন গঠনের মূলে একজন শক্তিবান ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ছিলেন। তিনি আমার বাবা। তিনি আমাকে হাত ধরে লেখাননি কিন্তু মুখে মুখে পড়িয়েছেন। সেই যে ছন্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে আরম্ভ সুর দিয়ে দিনের শুরু, জীবনের শুরু, তা কি ভুলতে পারি” (তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থপরিচয়', পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৬ ৬৩৭)। এই বাবা বাদে তাঁর ছোট ভাই ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর লেখার প্রধান উৎসাহদাতা। লেখকের মতে, “তার সমালোচনা ও পরামর্শের প্রভাবে আমার বহু রচনাকে মার্জিত এবং নিয়ন্ত্রিত করেছে” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৭)। 

এছাড়া “বহু বন্ধুর উৎসাহ আনুকূল্য লেখক হিসেবে” তার জীবনে উৎসাহ ও প্রেরণাদাতা রূপে স্মরণীয়। মেসজীবন, একাধিক বাসাবদল, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি ঘটনাসমূহের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয় নরেন্দ্রনাথের লেখকজীবন। স্বভাবতই সংখ্যাধিক্যে এবং বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয় তার সাহিত্যজগৎ।

নরেন্দ্রনাথের প্রথম আত্মপ্রকাশ কবি রূপে। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ‘দেশ' পত্রিকায় ছাপা হয় ‘মূক’ নামে প্রথম কবিতা। তারপর ১৯৩৬-১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ‘দেশ’-এ চারটি গল্প, ‘প্রবাসী-বিচিত্রা-বঙ্গশ্রী-পরিচয়’-এ চারটি গল্প প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ' (১৯৪২) ‘দেশ’-এ মুদ্রিত, পরে 'দ্বীপপুঞ্জ' (১৯৪৬) নামে পরিবর্তিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘রূপমঞ্জরী' (১৮৬০)। 

নরেন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসগুলি খ্যাত-স্বল্পখ্যাত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেমন দেশ প্রবাসী বিচিত্রা বঙ্গশ্রী-পরিচয়-জনসেবক-গণবার্তা ইদানীং চতুষ্কোণ চতুরঙ্গ মানসী ভারতবর্ষ, বসুধারা, বসুমতী, সত্যযুগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, বেতার জগৎ প্রভৃতি। সিনেমা, রেডিও এবং টি.ভি.-তে গৃহীত হয় তাঁর একাধিক গল্প উপন্যাস; যেমন ‘রস’ চলচিত্রে ‘সওদাগর’ নামে এবং ‘বিকল্প’, ‘অবতরণিকা’ ‘মহানগর’ নামে অভিনীত হয়। 

সমালোচক ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর আলোচনায় ('কালের প্রতিমা’, পৃষ্ঠা, ১৪০-১৪১) নরেন্দ্রনাথের উপন্যাস সমূহকে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করেছেন : প্রথম পর্ব (১৯৪৬ ১৯৫১ খ্রীঃ), দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫২-১৯৫৬ খ্রীঃ), তৃতীয় পর্ব (১৯৫৭-১৯৭১ খ্ৰীঃ)।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের উপন্যাস : দ্বীপপুঞ্জ' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘অক্ষরে অক্ষরে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘দেহমন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), ‘দূরভাষিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), 'সঙ্গিনী' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘চেনামহল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘গোধূলী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), 'অনুরাগিণী' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘সহৃদয়া’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘শুক্লপক্ষ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), 'কন্যাকুমারী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), 'অনামিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), 'সুখ দুঃখের ঢেউ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), 'কথা কও চোরাবালি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬, ১৩৬৭), 'হেডমাস্টার' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), 'জলপ্রপাত’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), 'উত্তরপুরুষ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), 'একটি নায়িকার উপাখ্যান নায়িকা' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), তিন দিন তিন রাত্রি' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘রূপমঞ্জুরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), 'হারানো মণি হারানো মন’ কিশোর উপন্যাস (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), 'উপনগর' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), 'পরম্পরা' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), 'মহানগর' (বঙ্গাব্দ ১৩৭০), দ্বৈত সঙ্গীত' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'মুগ্ধ প্রহর' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'পতনে উত্থানে' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'তমস্বিনী' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'সেতুবন্ধন' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'সূর্যসাক্ষী' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'দয়িতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), 'প্রতিধ্বনি' (বঙ্গাব্দ ১৩৭৭), 'উপছায়া’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), 'সুরের বাঁধনে' (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), ‘জল মাটির গন্ধ' (বঙ্গাব্দ ১৩৮০)।

(খ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প সংকলন : 'অসমতল' (বঙ্গাব্দ ১৩৫২), 'হলদে বাড়ি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘উল্টোরথ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘পতাকা' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৪), 'চড়াই উত্রাই' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘পাটরানী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), 'কাঠ গোলাপ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘অসবর্ণস্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬১), ‘ধূপকাঠি' (বঙ্গাব্দ ১৩৬১), ‘মলাটের রঙ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬২), 'রূপালী রেখা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), 'দীপান্বিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘ওপাশের দরজা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘একূল ওকূল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), 'বসন্ত পঞ্চম' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), 'মিশ্ররাগ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), 'উত্তরণ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘পূর্বতনী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘অঙ্গীকার’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘দেবযানী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), 'রূপসজ্জা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘সভাপর্ব' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘স্বরসন্ধি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘ময়ূরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), 'বিদ্যুৎলতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘পত্রবিলাস’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘মিসেস গ্রীণ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘বিন্দু বিন্দু’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), একটি ফুলকে নিয়ে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), 'বিনি সুতার মালা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘যাত্রাপথ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘সুধা হালদার ও সম্প্রদায়’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘অনধিকারিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘রূপলাগি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭০), 'চিলে কোঠা' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘প্রজাপতির রঙ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), 'অন্য নয়ন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘বিবাহবাসর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩), ‘চন্দ্রমল্লিকা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৪), ‘সন্ধ্যারাগ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৫), 'সেই পথটুকু' (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘অনাগত' (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), 'পালঙ্ক’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), 'উদ্যোগ পর্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), ‘বর্ণবহ্নি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৪), বিকালের আলো’ (১৯৮৩), ‘নাগরিক প্রেমের উপাখ্যান' (বঙ্গাব্দ ১৩৯০), ‘গল্পমালা-১' (১৯৮৬), ‘কিশোর গল্পসমগ্র' (বঙ্গাব্দ (১৩৯৫), 'গল্পমালা-২' (১৯৮৬), 'স্রোতস্বতী' (১৯৮৯), 'সাধ সুখ স্বপ্ন' (১৯৯০), ‘এইটুকু বাসা’ (১৯৯০), ‘গল্পমালা-৩’ (১৯৯২)।

(গ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্মৃতিমূলক রচনা : ‘আত্মকথা' (১৯৭২), ‘গল্প লেখার গল্প' (১৯৬৪), ‘আত্মচরিত’।

(ঘ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাব্য : 'জোনাকি', শ্রী বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সহ (বঙ্গাব্দ ১৩৪৫), 'নিবিবিলি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩)।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যকর্মের মধ্যে যেগুলি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার কয়েকটি - সত্যজিৎ রায়ের মহানগর, অগ্রগামীর 'হেডমাস্টার', 'বিলম্বিতলয়'; রাজেন তরফদারের 'পালঙ্ক'। 'রস' গল্পটির অমিতাভ বচ্চন অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের নাম 'সৌদাগর'. 


পুরস্কার ও সম্মাননা 

আনন্দ পুরস্কার (১৯৬২)


মৃত্যু- ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫.


দ্বিতীয় মহাসমরকালে নরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখতে শুরু করেন। কবিতায় তাঁর অভিষেক হলেও কথাশিল্পেই তাঁর শিল্পীমানসের বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠা। চল্লিশের দশকের আগে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন এবং চল্লিশের দশকে সাহিত্যের নির্মাতা হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁদেরও অনেকেই চল্লিশের দুঃসময়াক্রান্ত হয়ে যুদ্ধ-মন্বন্তর-দেশভাগজনিত কষ্টের ছায়ায় ছোটগল্প লিখেছেন। সে বিষয়ানুগ গল্প নরেন্দ্রনাথ মিত্রও লিখেছেন। তাঁর গল্পে দেশবিভাগ-দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি—সবকিছুই উঠে এসেছে। তবে তিনি যে রূপায়ণে এ প্রসঙ্গকে ছোটগল্পে চিত্রিত করেছেন তা সদর্থক। জীবন কখনো একক দুঃখের কিংবা একক সুখের সমষ্টি নয়, নিরবচ্ছিন্ন দুঃখময় জীবনেও সুখের আভাস বিদ্যমান। তাঁর গল্পের ভূমিতে থোকা থোকা কষ্ট ফুটে থাকে, দুঃখের বিদীর্ণ প্রান্তর তাঁর গল্পভূমি, দুঃসহ জীবনের রেখাপাত তাঁর একেকটি সৃষ্টি, সেই দুঃখসমুদ্র থেকে তিনি তুলে আনেন বিন্দু বিন্দু সুখের ছটা। সেই সুখের উদ্ভাস তিনি গল্পের পরিণতিতে এমনভাবে তুলির আঁচড়ে এঁকে দেন, যা পাঠকচিত্তকে জয় করতে কালবিলম্ব হয় না। গল্পগুলোকে তিনি পরিকল্পিতভাবে কদর্যপূর্ণ জীবনের বিপ্রতীপে উপস্থাপন করেন। তাঁর নিজের এ প্রবণতার পক্ষে ‘গল্প লেখার গল্প’ নিবন্ধে তিনি বলেছেন—’কিন্তু পিছন ফিরে তাকিয়ে বই না পড়ে নিজের গল্পগুলির কথা যতদূর মনে মনে পড়ে আমি দেখতে পাই ঘৃণা বিদ্বেষ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ বৈরিতা আমায় লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি প্রেম সৌহার্দ্য, স্নেহ শ্রদ্ধা ভালোবাসা, পারিবারিক গণ্ডির ভিতরে বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, একের সঙ্গে অন্যের মিলিত হবার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।’ নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে তাঁর গল্পগুলোতে আমরা তাঁর নিজের এই উক্তির ছায়া হিসেবে পাই।


‘পালঙ্ক’ গল্পে একটি পালঙ্ককে ঘিরে আবর্তিত গল্পের কাহিনি। গল্পে রাজমোহনের অশেষ মানসিক যন্ত্রণা লক্ষ করা যায়। সন্তানের প্রতি অভিমানে তিনি পালঙ্ক বিক্রি করেন। দেশবিভাগের সময়ে পরিবারের সকলেই দেশ ছেড়ে গেলেও তিনি কলকাতায় যানানি। বিক্রিত পালঙ্ক ফিরে পেতে তিনি একদিকে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকেন। অন্যদিকে ক্রেতা মকবুল না খেয়ে দিনাতিপাত করলেও পালঙ্ক ফেরত দিতে সম্মত নয়। একটি পালঙ্ককে কেন্দ্র করে গল্পের ঘটনা পরম্পরা দ্রুতই জটিল রূপ ধারণ করে। রাজমোহন যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখনো জ্বরে পুড়ে যাওয়া দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাতের অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে সেই পালঙ্ক ফেরত চাইতে গিয়েছিলেন। মকবু্ল যখন পালঙ্ক ফেরত দিতে সম্মত হয়। তখন সেই পালঙ্ক আর ফেরত নেয়না সে। পালঙ্কের ওপর মকবুলের সন্তানদের দেখে তার অনুভূতি বদলে যায়। সে তখন পরম তৃপ্ত। নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্প জুড়ে রাজমোহনের যে সীমাহীন আকুতি তুলে ধরেছেন তা মুহূর্তে প্রশমিত হয়। আর সেখানেই এ গল্পকারের স্বাতন্ত্র্য। ক্রমশ সিঁড়ি বেয়ে দুঃখের শীর্ষে পৌঁছাতেই যেন অকস্মাত্ সুখের সকাল ধরা দেয়।


‘হেডমাস্টার’ গল্পের হেডমাস্টার কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার চরিত্রটি একজন টিপিক্যাল শিক্ষকচরিত্র। অর্থনৈতিক সংকট তার জীবনের নিত্য সঙ্গী। তারপরও শেখানোর এক অদম্য চেষ্টায় রত। দেশবিভাগের পর শিক্ষকতার আয় দিয়ে


সংসার চলছিল না। সে জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে এসে এক শিক্ষার্থীর কাছে ব্যাংকের চাকুরি নেয়। অফিসে গিয়ে তার কর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে সকলের ভুল সংশোধন করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে তার চাকরি হারানোর অবস্থা তৈরি হলেও তিনি দীর্ঘকালের শিক্ষকতা স্বভাব ভুলতে পারেন না। হেডমাস্টারের নিজের পরিবারের এবং কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল বাস্তবতা সত্ত্বেও গল্পের শেষে পাহারাদারদের নিয়ে তার যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নে জীবনকে সুন্দর করে দেখার প্রবণতা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের জীবনে যে কষ্টঘন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা থেকে সম্পূর্ণরূপে উত্তরণ হয় না। কিন্তু মানুষকে নিয়ে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের স্বপ্ন গল্পটিকে শুভজীবনের মানদণ্ডে উন্নীত করে।

রস’ গল্পে মোতালেফ-মাজুখাতুন-ফুলবাণু তিনটি চরিত্রের যোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে গল্পটির পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে। রসাবহপূর্ণ জীবন পিয়াসী এরা সকলেই। মোতালেফ খুঁজেছে দেহগত সৌন্দর্য, গুড় তৈরিতে দক্ষ মাজুখাতুন খুঁজেছে জীবনের নিরাপত্তা, ফুলবাণু খুঁজেছে নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য। তিনটে চরিত্রের মধ্যেই সুখাবহ সৃষ্টির পরিবর্তে নেমে আসে দুঃখময় মুহূর্ত। মোতলেফ মাজুখাতুনকে গ্রহণ করেছিল ফুলবাণুকে পাওয়ার জন্য। যখন মাজুখাতুন মোতালেফের ঘরে তখন সে ভালোবেসেছে ফুলবাণুকে আর যখন ফুলবাণু ঘরে তখন সে ভালোবেসেছে মাজুখাতুনেকে। রূপের মোহে ফুলবাণু আর গুণের গুণে মাজুখাতুন মোতালেফের প্রিয় হয়েছিল। রূপের মোহ কেটে গেলেও গুণের প্রতি তার আসক্তি অটুট থাকে। মাজুখাতুনকে ত্যাগ করলে মাজুখাতুন পুনরায় বিয়ে করে। মোতালেফ একদিন কিছু রস নিয়ে গুড় বানানোর কৌশল শেখার জন্য মাজু খাতুনের কাছে গেলে সে লক্ষ করে মাজুখাতুন তখনো তাকে ভালোবাসে। মোতালেফের প্রতি মাজু খাতুনের অনিঃশেষ ভালোবাসা গল্পটির সকল কষ্ট ভুলে যেতে সাহায্য করে। গল্পটির সমাপ্তিও সেখানেই। ফলে গল্পের পরিণতিতে সুখানুভূতির পরিণত রূপ গল্পটিকে যে ব্যঞ্জনা দান করে তা ইতিবাচক জীবনের।


‘চাঁদমিঞা’ গল্পে কয়েক স্তরের কষ্ট রয়েছে। নশরত্ আলীর চার-পাঁচ স্ত্রী মারা গেছে, ঘরে আছে আর চারজন। তার শেষ স্ত্রী রাবেয়া নশরত্ আলীর ঘোড়ার সহিস চাঁদমিঞাকে ভালোবাসে। নশরত্ আলী বুঝতে পেরে একদিন চাঁদমিঞাকে নির্মমভাবে আঘাতে আঘাতে মৃতপ্রায় করে তোলে এবং রাবেয়াকে গলা টিপে হত্যা করে। গল্পের প্রত্যেকটি স্তর এখানে কষ্টের ভিতের ওপর দণ্ডায়মান। অথচ, গল্পপাঠ সমাপ্তিতে সকল দুঃখবোধ ম্লান হয়ে যায় শেষাংশের গুণে। গল্পের শেষ দৃশ্যে জানা যায়, শেষ জীবনে নশরত্ আলী এবং চাঁদমিঞার মধ্যে ভীষণ হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে এ নিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি হলেও পরস্পরের বন্ধুত্ব ছিল ঘনিষ্ঠ পর্যায়ের। এমনকি মালিক-ভৃত্য সম্পর্ক উঠে গিয়ে বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত হয় তাদের সম্পর্ক। নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্প বয়নে সাবধানতার সাথে সমাজের প্রকৃত অবস্থা উপস্থাপন করেন এবং গল্পের শেষে ক্লেদাক্ত সময়ে পরাজিত আশাবাদী ভাবনাকে যুক্ত করে দেন তাঁর গল্পে; যে অংশে নরেন্দ্রনাথ মিত্র স্বয়ং যুক্ত হন।


‘কাঠগোলাপ’ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশবিভাগজনিত কারণে স্বদেশত্যাগীদের করুণ জীবনের আখ্যান হলেও গল্পের শেষে সেই করুণ আর্তি আর থাকেনি। নীরদ আর অণিমার জীবনের করুণ চিত্র গল্পটিকে আলো দান করলেও শেষ পর্যন্ত সেই চিত্রকে ছাড়িয়ে যায় গল্পের শুভ সমাপ্তি। দেশভাগের পর কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালিদের জীবনবাস্তবতা ছিল খুবই করুণ। নরেন্দ্রনাথ মিত্র এ গল্পে সেই সত্যের প্রতিচ্ছবি অঙ্কনে কোনো দ্বিধা-সঙ্কোচ করেননি, কিংবা সেখানে আরোপিত কোনো রং লাগাননি। তিনি জীবনের শুভ দিকের পক্ষপাতি বলে গল্পে সুখী মানুষের আনয়নও করেননি। তিনি তাঁর স্বতন্ত্র রংয়ের আলতো আঁচড় গল্পের পরিসমাপ্তিতে দুঃখবোধ থেকে পাঠকের উত্তরণ ঘটান। বাস্তবতাবিমুখ অণিমার বাস্তব ভূমিতে নেমে আসা এবং প্রতীকী অর্থে তার এ প্রচেষ্টাকে একটি ফুলের সাথে তুলনা করার মধ্য দিয়ে কষ্টের নিগড়ে পড়ে থাকা জীবনের মধ্যে যেন আশার উপ্ত বীজের সন্ধান পাওয়া যায়।


‘চোর’ গল্পে নরেন্দ্রনাথ মিত্র অমূল্যের চৌর্যবৃত্তির অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। অমূল্যের স্ত্রী রেণু স্বামীর চৌর্যবৃত্তির প্রতি অশেষ ঘৃণা পোষণ করে। রেণুর ঘৃণার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে অমূল্য। শুধু তা-ই নয় ওপরতলা থেকে কাঁসার বাটি চুরি করার পরামর্শ দেয় স্ত্রীকে। একটি দোকানে কাজ করত অমূল্য। চুরির দায়ে চাকরি চলে যায়। তবু তার চুরি বন্ধ হয় না। চুরি না করলে উপোস করে থাকতে হতো বলেই চুরি করে অমূল্য। গল্পকার অমূল্যের চোরজীবনের যে আখ্যান গল্পে এনেছেন, এরচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ রেণুর চোর হয়ে ওঠার অংশটুকু। একদিকে অর্থসংকট অন্যদিকে চোর স্বামীসঙ্গ রেণুকে চোর হিসেবে গড়ে তোলে। গল্পের বুনন, সংলাপ, নিম্নবিত্তের স্বরূপ, নারীর অসহায়ত্ব সবকিছুর মধ্য দিয়ে গল্পটি পাঠক চিত্তে স্থান করে নেয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র যেহেতুে জীবনকে ইতিবাচক করে দেখেন তাই গল্প সমাপ্তিতে শেষ রেখা টেনেছেন সুস্থ জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে। নিজে চুরি করলেও চুরি পেশার প্রতি অমূল্যেরও যে ঘৃণা রয়েছে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সেখানে অমূল্য মহান হয়ে ওঠে। গল্পটি হয়ে ওঠে সদর্থক জীবনের গল্প।


‘সোহাগিনী’ গল্পে ত্রিকোণ প্রেমের পরিণতিতে তুফানীর মৃত্যু হয়। তুফানীর স্বামী বনমালী স্ত্রীকে মতি মিঞার বাড়ি থেকে আসতে দেখে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তুফানীকে বেদম প্রহার করলে তার মৃত্যু হয়। সেই রাতেই শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। গল্পটি এখানে শেষ হলে দুঃখাবহ পরিণতি হতে পারত। কিন্তু, গল্পের শেষে দেখা যায়, শেষকৃত্য শেষে বনমালী এবং মতি মিঞা দুজনেই বর্ষরাতে তুফানীর শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত। দুজনই অনুশোচনায় দগ্ধীভূত। নরেন্দ্রনাথ মিত্র এভাবেই গল্পের শেষ মোড়কে জীবনের আলো ছড়িয়ে দেন।


‘আবরণ’ গল্পের চাঁপা মন্বন্তরের জ্বলজ্বলে প্রতিনিধি। চাঁপার ন্যূনতম কাপড় নেই, যা দিয়ে নিজের শরীর আবৃত করতে পারে। চাঁপার করুণ অবস্থা নিবারণ করতে স্বামী বংশী গত্যন্তর না দেখে যৌনকর্মীর কাপড় আনার চেষ্টা করেছিল। বর্ণনাতীত এই দুঃসহ জীবনের মধ্যে স্ত্রীর জন্য বংশীর কাপড়ের চেষ্টায় এবং যৌনকর্মী সুখদার দগদগে ক্ষতবিশিষ্ট বুকের দিকে তাকিয়ে কাপড় ফেরত দেওয়ার মধ্যে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্বকীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ সেখানেই শুভ জীবনের উন্মোচন।


‘পালঙ্ক’ গল্পের রাজমোহন-মকবুল, ‘চাঁদমিঞা’ গল্পের চাঁদমিঞা-নশরত্ আলী, ‘চোর’ গল্পের অমূল্য-রেণু, ‘কাঠগোলাপ’ গল্পের নীরদ-অণিমা, ‘রস’ গল্পের মোতালেফ-মাজুখাতুন, ‘হেডমাস্টার’ গল্পের কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার, ‘সোহাগিনী’ গল্পে বনমালী-মতিমিঞা, ‘আবরণ’ গল্পের চাঁপা-বংশী, ‘ভুবন ডাক্তার’ গল্পের ভুবন ডাক্তার—এরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে দুঃখভারাক্রান্ত পর্বে বিন্যস্ত। তারা প্রত্যেকেই যন্ত্রণাবিদ্ধ। কখনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, কখনো সময়-সমাজের অনিবার্য দুর্লঙ্ঘনীয় বাস্তবতার নিষ্পেষণ তাদের জীবনকে বিষময় করে তুলেছিল। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পে সেই নিষ্পেষণে পীড়িত জীবনছবি চিত্রায়ণের সমাপ্তিতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যুক্ত করেন; যেখানে বেজে ওঠে মধুর সুরধ্বনি। জীবনের সীমাহীন কদর্থক অনুষঙ্গের আড়াল থেকে উঠে আসে তার প্রধান প্রবণতা—আশাবাদী জীবনের আলাপন।

তাঁর জন্ম ১৯১৬তে। অর্থাৎ তার বাল্যাবস্থাতেই কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি-যুগের সাহিত্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সেই নতুন ভাবধারার কথাসাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ প্রমুখেরা। বাস্তবের রূঢ়তা ও রুক্ষতা তাদের গল্পে-উপন্যাসে নির্মোহ ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। তার কিছু পরবর্তীকালে আরাে কয়েকজন কথা-সাহিত্যিকের আবির্ভাব, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলােড়নে আলােড়িত, নাগরিক সভ্যতার কঠিন সত্যকে দেখে এবং চিনে তারা সভ্যতার স্বরূপ সম্বন্ধে আরাে বেশি নির্মোহ। কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫) এই যুগের প্রতিনিধি. 


=================================





Friday, 28 January 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।আন্তন পাভলোভিচ চেখভ Anton Chekhov. ২৯.০১.২০২২. Vol -630. The blogger in literature e-magazine

 


আন্তন পাভলোভিচ চেখভ  Anton Chekhov 

"চেখভের গল্পগুলো এখনও তেমনই বিস্ময়কর (এবং অপরিহার্য), যেমনটা ছিল প্রথম প্রকাশের সময়ে। শুধুমাত্র তাঁর বিপুল সংখ্যক গল্পের সম্ভারই নয় - খুব কম লেখকই, যদি আদৌ তেমন কেউ থেকে থাকেন, তাঁর চেয়ে বেশি লিখেছেন - তিনি যে বিস্ময়জনক হারে সেরা গ্রন্থ ও গল্প রচনা করেছেন তা যেমন আমাদের আধ্যাত্মিক মুক্তির অনুভূতি দেয়, তেমনি আনন্দিত ও আলোড়িতও করে। তাঁর লেখা রচনা আমাদের আবেগ অনুভূতিকে যেভাবে তুলে ধরে তা শুধুমাত্র সত্যিকারের শিল্পকর্মের পক্ষেই সম্ভব।"

১৮৬০ সালের ২৯শে জানুয়ারি (পুরনো রীতিতে ১৭ই জানুয়ারি) দক্ষিণ রাশিয়ার আজভ সাগর সংলগ্ন বন্দরনগরী তাগানরোগে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল সন্ত মহান অ্যান্থনির মৃত্যুবার্ষিকী। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। চেখভের পিতা পাভেল জেগোরোভিচ চেখভ (১৮২৫-১৮৯৮) ছিলেন ভরনেজ প্রদেশের ওলহভাৎকা গ্রামের একজন প্রাক্তন ভূমিদাস কৃষক এবং তার মাতা ছিলেন ইউক্রেনীয়। পাভেল চেখভ তাগানরোগে একটি মুদি দোকান চালাতেন। তিনি ছিলেন গির্জার ধর্মসংগীতে নেতৃত্বদানকারী গায়কবৃন্দের পরিচালক এবং একজন ধর্মপ্রাণ গোঁড়াবাদী খ্রিস্টান। পিতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও রূঢ়। তার সন্তানদের তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও শাস্তি দিতেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন চেখভের রচিত কপটতাপূর্ণ চরিত্রগুলো তৈরী হয়েছে তার পিতার আদলে।চেকভের মা জেভগেনিয়া জাকোভলেভনা (১৮৩৫-১৯১৯), ছিলেন চমৎকার গল্পকথক। তিনি তার ছেলেমেয়েদের কাছে তার কাপড়-ব্যবসায়ী বাবার সাথে পুরো রাশিয়া ভ্রমণের গল্প বলতেন। চেখভ তার মায়ের কথা স্মরণ করেছেন এভাবে, “আমরা আমাদের মেধা বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, কিন্তু হৃদয় পেয়েছি মা’র কাছ থেকে”. ] পরিণত বয়সে চেখভ তার ভাই আলেকসান্দরের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি তার বিরুদ্ধ আচরণের সমালোচনা করতে গিয়ে তাকে তাদের পিতার নির্মম আচরণের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন:

ভুলে যেয়োনা মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতা তোমার মায়ের যৌবনকাল ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই একই মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতা আমাদের শৈশবও নষ্ট করে দিয়েছে, এতটাই যে সে অতীতের কথা স্মরণ করাটাও নিদারুণ বিরক্তির ও ভীতিপ্রদ। ভুলে যেয়োনা সেই বিতৃষ্ণা আর আতঙ্কের কথা, যা আমরা আমাদের বাবার প্রতি অনুভব করতাম যখন তিনি খাবার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং স্যুপে বেশি লবণের জন্য মা’কে কটু কথা বলতেন।


১৮৮০ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে তিনি সর্বমোট ৬০০টি সাহিত্যকর্ম রচনা ও প্রকাশ করেন। শুরুতে নাট্যকার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান থ্রি সিস্টার্সদ্য সিগাল এবং দ্য চেরি অরচার্ড এই তিনটি নাটকের মাধ্যমে। দ্য সিগাল নাটকটি ১৮৯৬ সালে মঞ্চস্থ হলে সেটি একেবারেই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এর মঞ্চায়ন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে চেখভ থিয়েটার বর্জন করেন। পরে ১৮৯৮ সালে এই নাটকটিই কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভ্‌স্কির আগ্রহে মস্কো আর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলে তা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। মস্কো আর্ট থিয়েটার চেখভের আঙ্কল ভানিয়া নাটকটি প্রযোজনাসহ তার শেষ দুটি নাটক, থ্রি সিস্টার্স এবং দ্য চেরি অরচার্ড এর প্রথম প্রদর্শনীও করে। চেখভের চারটি নাটক দর্শক ও সকল অভিনয়শিল্পীদের সমন্বিত অভিনয়, এই দুইয়েরই অনেক সময় ও মনোযোগ দাবী করে। কারণ এই নাটকগুলিতে কোনো সনাতন বাহ্যিক নাট্যক্রিয়া নেই, এর পরিবর্তে মামুলি অকিঞ্চিৎকর সব বিষয়ে করা সংলাপে রয়েছে আবেগঅনুভূতির অন্তঃস্রোতের প্রবাহ।
শুরুতে চেখভের লেখক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো না। প্রথমদিকের গল্পগুলো তিনি লিখেছিলেন জীবনযাপন ও পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরে তার মধ্যে শিল্পীসুলভ উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্ম নিলে ক্রমে তিনি সাহিত্যচর্চার ভিন্ন রীতি ও প্রবণতার উদ্ভাবন করেন যা আধুনিক ছোটগল্পের বিকাশে বিশেষ প্রভাব রাখে। চেখভের মৌলিকতা নিহিত আছে সাহিত্যচর্চায় তার স্ট্রিম অভ কনশাসনেস (কোনো ব্যক্তির বিরতিহীন চৈতন্যপ্রসূত অভিজ্ঞতা) আঙ্গিক ব্যবহারে, যা পরে গ্রহণ করেছিলেন জেমস জয়েস ও অন্যান্য আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকরা, এবং সনাতন গল্পকাঠামোর নীতিঘটিত পরম অবস্থানকে অস্বীকারের মাঝে।তার মতে, একজন শিল্পীর ভূমিকা হলো প্রশ্নকারীর, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দায়িত্ব নেই তার। চেখভ তার সাহিত্যিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যদিও এ থেকে তিনি সামান্যই উপার্জন করতেন। তিনি অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা করতেন বিনামূল্যে। তাই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আসতো তার লেখালেখি থেকে।
তাগানরোগের বাণিজ্যে গ্রিক ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই চেখভের পিতা চেখভকে ও তার এক ভাই নিকলাইকে গ্রিক চার্চ ও গ্রিক স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলটি অসফলভাবে চলছিল এবং দুই বছর পরেই এটি পরিণত হয় তাগানরোগ শরীরচর্চা কেন্দ্রে, যা বর্তমানে চেখভ জিমনেসিয়াম। স্কুলে চেখভের কৃতিত্ব ছিল গড়পড়তা মানের। পনের বছর বয়স পর্যন্ত চেখভকে একই ক্লাসের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছিল, কেননা তিনি একটি গ্রিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি।] এই ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে গ্রিক গোঁড়াবাদী গির্জার সমবেত ধর্মীয় সঙ্গীতে অংশগ্রহণ এবং তার পিতার দোকানের কাজে চেখভের নিয়মিত কার্যক্রম। এছাড়াও কারণ হিসেবে যোগ করা যেতে পারে সমকালীন রাশিয়ার কতৃত্বপূর্ণ শিক্ষা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি,কেননা চেখভ প্রভূত্বকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন, প্রবলভাবে অপছন্দ করতেন। ১৮৯২ সালে লেখা এক চিঠিতে চেখভ তার শৈশব বর্ণনা করতে গিয়ে “দুঃখক্লেশ” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তার শৈশবকে স্মরণ করেছেন এভাবে:

যখন আমার ভাইয়েরা ও আমি গির্জার মাঝে দাঁড়াতাম এবং ত্রয়ী গাইতাম, “আমার প্রার্থনা হোক মহিমান্বিত” বা “দেবদূতের কণ্ঠস্বর”, সবাই আমাদের দিকে আবেগভরে তাকিয়ে থাকতো আর আমাদের পিতামাতাকে ঈর্ষা করতো। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমরা নিজেরা যেন কিছুটা দণ্ডিত অপরাধীর মতো অনুভব করতাম।
১৮৭৬ সালে একটি নতুন বাড়ি তৈরিতে অনেক বেশি পুঁজি বিনিয়োগের পর চেখভের পিতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।[২৭] ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কারাবাস এড়াতে তিনি মস্কোতে পালিয়ে যান। সেখানে তার বড় দুই ছেলে আলেকসান্দর ও নিকলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। পরিবারটি মস্কোতে দারিদ্র্যের মাঝে বাস করছিলো। চেখভের মা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।[২৮] বিষয়সম্পত্তি বিক্রি ও স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার জন্য চেখভকে তাগানরোগেই রেখে আসা হয়েছিল।

চেখভ তাগানরোগে আরও তিন বছর ছিলেন। তিনি তাগানরোগে সেলিভানভ নামের এক ব্যক্তির সাথে থাকতেন যিনি চেখভের দ্য চেরি অরচার্ড-এর চরিত্র লোপাখিনের মতোই তাদের বাড়ি কিনে নিয়ে পরিবারটিকে ঋণমুক্ত করেছিলেন।[২৯] চেখভকে নিজের পড়াশোনার ব্যয় নিজেকেই বহন করতে হতো। এই খরচের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি বেশ কয়েকরকমের কাজ করতেন যার মধ্যে একটি ছিল গৃহশিক্ষকতা। এছাড়াও তিনি গোল্ডফিঞ্চ পাখি ধরে বিক্রি করতেন এবং খবরের কাগজে ছোট ছোট স্কেচ এঁকেও অর্থ উপার্জন করতেন।[৩০] তিনি তার দৈনন্দিন খরচ থেকে সঞ্চিত প্রতিটি রুবল মস্কোতে পাঠিয়ে দিতেন, সেই সাথে পরিবারের সদস্যদের উদ্দীপিত করার জন্যে পাঠাতেন হাস্যরসাত্মক চিঠি।[৩০] এই সময়টাতে তিনি প্রচুর পরিমাণে পড়েছেন। পড়েছেন বিশ্লেষণাত্মকভাবে। যে লেখকদের লেখা তিনি এই সময়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন থের্ভান্তেস, তুর্গেনেভ, গনচারভ এবং শোপনহাওয়ার।[৩১][৩২] একই সময়ে তিনি ফাদারলেস নামের একটি পুরো দৈর্ঘ্যের কমেডি নাটকও লিখেছেন, যেটাকে তার ভাই আলেকজান্ডার বাতিল করে দিয়েছেন "অমার্জনীয়, যদিও নির্দোষ কল্পকাহিনী" হিসেবে।[৩৩] চেখভ বেশ কিছু প্রণয়ঘটিত সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল শিক্ষকের স্ত্রীর সাথে।[৩০]

১৮৭৯ সালে চেখভ স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মস্কোতে তার পরিবারের সাথে যোগ দেন। তিনি আই.এম. সেচেনভ ফার্স্ট মস্কো স্টেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।[৩৪]

মস্কোতে চলে আসার অল্প কিছুদিন পরেই চেখভ মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এখানেই তার শিক্ষা গ্রহণ চলে ১৮৭৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৮৪ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত। ঐ গ্রীষ্মে চেখভ ফাইনাল পরীক্ষা দেন। এই সময়ের মধ্যে সাত সদস্যের চেখভ পরিবার কয়েকবার তাদের আবাস বদল করেছে। এবং স্থায়ী আবাসে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার আগের কয়েক মাস তাদেরকে যে অপ্রশস্ত বাসস্থান ও দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে বসবাস করতে হয়েছে তা চেখভের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

চেখভ তার প্রথম দিকের লেখা গল্প বা অন্যান্য রচনায় যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে বিস্ময়কর সব সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এই বিস্ময়কর সম্পর্কগুলোর সম্যক উপলব্ধি সম্ভব যদি তার শুরুর দিকে লেখা চিঠিগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৮৩ সালের আগস্টে একটি সাময়িকীর সম্পাদককে কিছু গল্পের সাথে পাঠানো এই চিঠির উল্লেখ করা যেতে পারেঃ

আমাদের সর্বোচ্চ কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে যতটা শোচনীয় পরিস্থিতির কথা আমরা ভাবতে পারি, ঠিক ততটাই শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমি লেখালেখি করে থাকি । আমাকে নিষ্করুণ বিরক্ত করছে আমার সামনে পড়ে থাকা সাহিত্যের সাথে সম্পর্কহীন কিছু কাজ, লাগোয়া ঘরটিতে এক শিশু বেড়াতে আসা আমার এক আত্মীয়কে দেখে তীব্র চিৎকার করছে, অন্য একটি ঘরে আমার বাবা লেসকভের দ্য সীলড এঞ্জেল থেকে আমার মা’কে উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনাচ্ছেন [...] আমার বিছানা দখল করে নিয়েছে বেড়াতে আসা আত্মীয়রা, তাদের কেউ কেউ আমার সাথে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে আসছেন [...] এক তুলনাহীন পরিস্থিতি। - ১৮৮৩ সালে লেখা আন্তন চেখভের একটি চিঠি থেকে 

এই অর্ধ-পরিহাসমূলক, অর্ধ-অপ্রসন্নতাবোধক ভাব বিদ্যমান ছিল চেখভের শিক্ষাজীবনে লেখা চিঠিগুলোয় এবং এর পরবর্তী সময়ের চিঠিতেও। শুধুমাত্র ঘিঞ্জি পরিবেশ ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনই তার লেখালেখির কাজকে বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং অনেক সম্পাদকের উপযুক্ত সম্মানী না দেয়ার মতো অসাধু মনোবৃত্তি, লেখার দৈর্ঘ্যের উপর সীমা আরোপও এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে। ১৮৮১ সালে একটি সন্ত্রাসবাদী দল জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে গুপ্তহত্যা করলে সরকারের সেন্সর পর্ষদ অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেয় যা চেখভের লেখার কাজ আরও কঠিন করে দেয়। ১৮৮২ সালে চেখভের প্রথম ছোটগল্প সংকলন আ প্র্যাঙ্ক স্থগিত হয় এবং ধরে নেয়া হয় যে এটি হারিয়ে গিয়েছে।

Works :
Plays 
Four-Act Plays
Untitled Play (Пьеса без названия, discovered 19 years after the author's death in manuscript form with title page missing; most commonly known as Platonov in English; 1878)—adapted in English by Michael Frayn as Wild Honey (1984)
Ivanov (Иванов, 1887)—a play in four acts
The Wood Demon (Леший, 1889)—a comedy in four acts; eight years after the play was published Chekhov returned to the work and extensively revised it into Uncle Vanya (see below)
The Seagull (Чайка, 1896)—a comedy in four acts
Uncle Vanya (Дядя Ваня, 1899-1900)—scenes from country life in four acts; based on The Wood Demon
Three Sisters (Три сестры, 1901)—a drama in four acts
The Cherry Orchard (Вишнёвый сад, 1904)—a comedy in four acts

One-Act Plays 

On the High Road (На большой дороге, 1884)—a dramatic study in one act
On the Harmful Effects of Tobacco (О вреде табака; 1886, 1902)—a monologue in one act
Swansong (Лебединая песня, 1887)—a dramatic study in one act
The Bear or The Boor (Медведь: Шутка в одном действии, 1888)—a farce in one act
A Marriage Proposal (Предложение, c. 1889)—a farce in one act
A Tragedian in Spite of Himself or A Reluctant Tragic Hero (Трагик поневоле, 1889)—a farce in one act
The Wedding (Свадьба, 1889)—a play in one act
Tatiana Repina (Татьяна Репина, 1889)—a drama in one act
The Night before the Trial (Ночь перед судом, the 1890s)—a play in one act; sometimes considered unfinished
The Festivities or The Anniversary (Юбилей, 1891)—a farce in one act

Short stories 

Chekhov wrote over 500 short stories. The following is a partial list.

Title [alternative title(s)] Russian publication Original title
A Letter to a Learned Neighbor 9 March 1880 Письмо к ученому соседу
Elements Most Often Found in Novels, Short Stories, etc. 9 March 1880 Что чаще всего встречается в романах, повестях и т. п.
Chase Two Rabbits, Catch None 11 May 1880
Papa 29 June 1880
Before the Wedding 12 October 1880
Artists' Wives 7 December 1880 Жены артистов
The Temperaments 17 September 1881
St. Peter's Day 29 June 1881
On the Train 29 September 1881 В вагоне
In the Train Car October 1881
The Trial 23 October 1881 Суд
This and That: Four Vignettes October 1881 И то и сё – Поэзия и проза
A Sinner from Toledo 23 December 1881
Sarah Bernhardt Comes to Town December 1881 И то и сё – Письма и телеграммы
Questions Posed by a Mad Mathematician February 1882 Задачи сумасшедшего математика
Supplementary Questions for the Statistical Census, Submitted by Antosha Chekhonte February 1882 Дополнительные вопросы к личным картам статистической переписи, предлагаемые Антошей Чехонте

A Confession, or Olya, Zhenya, Zoya 20 Mar 1882
Green Scythe April 1882 Зелёная Коса
Village Doctors 18 June 1882 Сельские эскулапы
A Living Chattel August 1882 Живой товар
Life as a Series of Questions and Exclamations September 1882 Жизнь в вопросах и восклицаниях
Late-blooming Flowers October–November 1882 Цветы запоздалые
An Unsuccessful Visit 22 November 1882 Неудачный визит
Confession, or Olya, Zhenya, Zoya December 1882 Исповедь, или Оля, Женя, Зоя
Bibliography 16 January 1883 Библиография
A Hypnotic Seance [A Seance] 24 January 1883 На магнетическом сеансе
Rapture Joy January 1883 Радость
A Lawyer's Romance: A Protocol 5 February 1883 Роман адвоката
At the Barber's 7 February 1883 В цирульне
Advice 12 February 1883 Совет
The Cross 12 February 1883 Крест
Questions and Answers 12 February 1883 Вопросы и ответы
The Collection 18 February 1883 Коллекция
An Incident at Law 17 March 1883 Случай из судебной практики
An Enigmatic Nature 19 March 1883 Загадочная натура
America in Rostov on the Don 21 March 1883 Америка в Ростове-на-Дону
Heights 9 April 1883 Обер-верхи
A Classical Student 7 May 1883 Случай с классиком
The Cat 14 May 1883 Кот
How I Came to Be Lawfully Wed 11 June 1883 О том, как я в законный брак вступил
Mr. Gulevich, Writer, and the Drowned Man [one half of Something [Кое-что]] June 1883 Г-н Гулевич (автор) и утопленник
The Potato and the Tenor [one half of Something [Кое-что]] June 1883 Картофель и тенор
The Death of a Government Clerk The Death of a Civil Servant 2 July 1883 Смерть чиновника
Goat or Scoundrel? 23 July 1883 Козел или негодяй
The Daughter of Albion A Daughter of Albion 13 August 1883 Дочь Альбиона
The Trousseau August? 1883 Приданое
An Inquiry 3 September 1883 Справка
The Fool, or The Retired Sea Captain 17 September 1883 Дура, или Капитан в отставке
Mayonnaise 17 September 1883 Майонез
In Autumn September? 1883 Осенью
Fat and Thin [Lean and Fat] 1 October 1883 Толстый и тонкий
The Grateful German 1 October 1883 Признательный немец
A Tragic Actor [A Tragic Role] 8 October 1883 Трагик
A Sign of the Times 22 October 1883 Знамение времени
At Sea 29 October 1883 В море
From the Diary of a Young Girl 29 October 1883 Из дневника одной девицы
The Stationmaster 5 November 1883 Начальник станции
Etc.
Novel Edit
The Shooting Party (1884)
Novellas Edit
The Steppe (Степь, 1888)
The Duel (Дуэль, 1891)
An Anonymous Story (aka The Story of an Unknown Man & The Story of a Nobody. Рассказ неизвестного человека, 1893)
Three Years (Три года, 1895)
My Life (Моя жизнь, 1896)
Short-story collections Edit
Collections of his stories that Chekhov prepared and published, or, in the case of The Prank, attempted to publish.

The Prank (Шалость, intended for publication in 1882 but was subsequently abandoned). First published by New York Review Books in 2015 in an English translation
The Tales of Melpomene (Сказки Мельпомены, 1884)
Motley Stories (Пёстрые рассказы, 1886)
At Dusk (aka In the Twilight; В сумерках, 1887)
Innocent Remarks (Невинные речи, 1887)
Stories (Рассказы, 1888)
Children (Детвора, 1889)
Gloomy People (aka Moody People; Хмурые люди, 1890)
Ward No. 6 (and Other Stories) (Палата № 6 (и др. рассказы), 1893)
Stories and Tales (Повести и рассказы, 1894)
Peasants and My Life (Мужики и Моя жизнь, 1897)

Notable awards
Pushkin Prize
Spouse
Olga Knipper ​(m. 1901)​
Relatives
Alexander Chekhov (brother)
Maria Chekhova (sister)
Nikolai Chekhov (brother)
Michael Chekhov (nephew)
Lev Knipper (nephew)
Olga Chekhova (niece)
Ada Tschechowa (great-niece)
Marina Ried (great-niece)
Vera Tschechowa (great-great niece)

Died
15 July 1904 (aged 44)[2]
Badenweiler, Grand Duchy of Baden, German Empire.
=================================













জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ইসমাইল কাদের । ২৮.০১.২০২২. Vol -629. The blogger in literature e-magazine


Ismail Kadare

 is an Albanian novelist, poet, essayist, screenwriter, and playwright. He is a leading international literary figure and intellectual. He focused on poetry until the publication of his first novel, The General of the Dead Army, which made him famous internationally. 


কবি, ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী ইসমাইল কাদারে ১৯৩৬ সালের ২৮ জানুয়ারি গ্রিসের সীমান্তবর্তী আলবেনিয়ার জেরোকাস্তায় জন্মগ্রহণ করেন। সোভিয়েত কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির একনিষ্ঠ ভাবশিষ্য হিসেবে পরিচিত কাদারে আলবেনিয়ায় সর্বাধিক বই বিক্রির রেকর্ডধারী লেখক। লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা একবার তাকে গোগল, কাফকা ও অরওয়েলের সঙ্গে তুলনা করেছিল।

পাঁচ বছর বয়সে জেরোকাস্তার একটি মিশন স্কুলে তার লেখাপড়ার শুরু। স্কুল শেষে রাশিয়ার তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও দর্শন অনুষদে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়েন। সেখানকার পড়া শেষে ভর্তি হন মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড লিটারেচারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা। ১৯৯০ সাল পর্য়ন্ত তার জীবনকালকে দুইভাগে ভাগ করা হয়- আলবেনিয়া ও ফ্রান্স। কম্যুনিস্ট শাসনামলে ১৯৭০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্য়ন্ত আলবেনীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে কিছু সময় দেশের বাইরে তার বই প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমনকি বিদেশ ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল। বলা হয়ে থাকে, তিনি নিজের স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট মূল্য পরিশোধ করা লেখক।

দীর্ঘ সময় রাশিয়ায় কাটিয়ে ১৯৬০ সালে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। কম্যুনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন এবং শোষণপীড়িত মানুষের যন্ত্রণা নিয়ে লেখা প্রথম কবিতার বই ‘ড্রিমস’ মস্কোয় ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। আলবেনিয়ায় ফিরে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। প্রায় ৩ বছর সময় নিয়ে লেখা তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জেনারেল অব দি ডেড আর্মি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই উপন্যাসটি আলবেনিয়াসহ সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন তোলে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল- দ্য ওয়েডিং (১৯৬৪), দ্য ক্যাসেল (১৯৭০), ক্রোনিকল ইন স্টোন (১৯৭১), ব্রোকেন এপ্রিল (১৯৮০) ও দ্য পিরামিড (১৯৯২) ইত্যাদি। তার কয়েকটি বই বাংলায় অনুদিত হয়েছে। এর মধ্যে বুলবুল সরওয়ারের অনুবাদে ‘স্বপ্নমহল’ ও অমর মুদির অনুবাদে ‘উত্তরাধিকার’ উল্লেখযোগ্য। তার বই চল্লিশটি দেশে কমপক্ষে ত্রিশটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

বেশ কয়েকবছর ধরে নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম শীর্ষে উচ্চারিত হয়ে আসছে। ১৯৯৬ সালে তিনি ফ্রান্সের একাডেমি অব মর‌্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সেসের আজীবন সদস্য হন। দার্শনিক কার্ল পপারের স্থলাভিষিক্ত করা হয় তাকে। ১৯৯২ সালে পিক্স মন্ডিয়াল কিনো ডেল ডুকা পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে প্রথম ‘দ্য ম্যান বুকার’ পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে পান প্রিন্সেস অব অ্যাস্টুরিয়াস অ্যাওয়ার্ড। এছাড়া আরও অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন।

তার স্ত্রীর নাম হেলেনা কাদারে। তাদের দুই সন্তান।Besiana Kadare। বাবা ও মা: হালিত কাদারে, হটিক্সহে ডোবি। 

Work :

By 2020 most of his approximately 80 novels, plays, screenplays, poetry, essays, and story collections had been translated into different languages.His works have been published in 45 languages.


Among his best-known books are The General of the Dead Army (1963), The Siege (1970), The Ghost Rider (1980), Broken April (1980; blood feuds in the highlands of north Albania),The Palace of Dreams (1981), The Pyramid (1992), and The Successor (2003; regarding the mysterious death of Hoxha's handpicked successor, Mehmet Shehu).


Some of his works have been translated into English by David Bellos, though not from the Albanian original, but rather from French translations.


English translations :

The following Kadare novels have been translated into English:


The General of the Dead Army (Albanian: Gjenerali i ushtrisë së vdekur)

The Siege (Albanian: Kështjella)

Chronicle in Stone (Albanian: Kronikë në gur)

Broken April (Albanian: Prilli i thyer)[38]

The Three-Arched Bridge (Albanian: Ura me tri harqe)

The Palace of Dreams (Albanian: Pallati i ëndrrave)

The Concert (Albanian: Koncert në fund të dimrit)

The File on H (Albanian: Dosja H: roman)

The Pyramid[150] (Albanian: Piramida)

Elegy for Kosovo (Albanian: Tri këngë zie për Kosovën)

Spring Flowers, Spring Frost (Albanian: Lulet e ftohta të marsit)

The Successor (Albanian: Pasardhësi)

Agamemnon's Daughter (Albanian: Vajza e Agamemnonit)

The Blinding Order (Albanian: Qorrfermani)

The Fall of the Stone City (Albanian: Darka e Gabuar)

The Accident (Albanian: Aksidenti)

The Ghost Rider (Albanian: Kush e solli Doruntinën?)

Twilight of the Eastern Gods (Albanian: Muzgu i perëndive të stepës)

A Girl in Exile (Albanian: E penguara)

The Traitor's Niche (Albanian: Kamarja e turpit)

Essays on World Literature: Aeschylus • Dante • Shakespeare (Albanian: Tri sprova mbi letërsinë botërore)

Stormy Weather on Mount Olympus (Albanian: Stinë e mërzitshme në Olimp)

The Doll: A Portrait of My Mother (Albanian: Kukulla)

Works published in Albanian Edit

The complete works (other than the essays, poetry, and short stories) of Ismail Kadare were published by Fayard, simultaneously in French and Albanian, between 1993 and 2004.[90] Kadare's original Albanian language works have been published exclusively by Onufri Publishing House since 1996,[151] as single works or entire sets. Published in 2009, the set of complete works constituted 20 volumes.[152]


The dates of publication given here are those of the first publication in Albanian, unless stated otherwise.


Novels and novellas 

Gjenerali i ushtrisë së vdekur (The General of the Dead Army) (1963)

Përbindëshi (The Monster) (1965)

Lëkura e daulles (The Wedding) (1967)

Kështjella (The Siege) (1970)

Kronikë në gur (Chronicle in Stone) (1971)

Dimri i vetmisë së madhe (The Winter of Great Solitude) (1973)

Nëntori i një kryeqyteti (November of a Capital) (1975)

Muzgu i perëndive të stepës (Twilight of the Eastern Gods) (1978)

Komisioni i festës (The Feast Commission) (1978)

Ura me tri harqe (The Three-Arched Bridge) (1978)

Kamarja e turpit (The Traitor's Niche) (1978)

Prilli i thyer (Broken April) (1980)

Kush e solli Doruntinën? (The Ghost Rider) (1980)

Pallati i ëndrraveThe Palace of Dreams) (1981)

Nata me hënë (A Moonlit Night) (1985

Viti i mbrapshtë (The Dark Year) (1985

Krushqit janë të ngrirë (The Wedding Procession Turned to Ice) (1985

Koncert në fund të dimrit (The Concert) (1988

Dosja H. (The File on H.) (1989

Qorrfermani (The Blinding Order) (1991

Piramida (The Pyramid) (1992

Hija (The Shadow) (1994

Shkaba (The Eagle) (1995

Spiritus (1996

Qyteti pa reklama (The City with no Signs) (1998, written in 1959

Lulet e ftohta të marsit (Spring Flowers, Spring Frost) (2000

Breznitë e Hankonatëve (2000

Vajza e Agamemnonit (Agamemnon's Daughter) (2003

Pasardhësi (The Successor) (2003

Jeta, loja dhe vdekja Lul Mazrekut (Life, Game and Death of Lul Mazrek) (2003

Çështje të marrëzisë (A Question of Lunacy) (2005

Darka e Gabuar (The Fall of the Stone City) (2008

E penguara: Rekuiem për Linda B. (A Girl in Exile) (2009

Aksidenti (The Accident) (2010

Mjegullat e Tiranës (Tirana's Mists) (2014, originally written in 1957–58

Kukulla (The Doll) (2015)

Plays 

Stinë e mërzitshme në Olimp (Stormy Weather on Mount Olympus) (1998)

Screenplays Edit

Sorkadhet e trembura (Frightened Gazelles) (2009)

Poetry 

Frymëzime djaloshare (1954)

Ëndërrimet (1957)

Princesha Argjiro (1957)

Shekulli im (1961)

Përse mendohen këto male (1964)

Motive me diell (1968)

Koha (1976)

Ca pika shiu ranë mbi qelq (2004)

Pa formë është qielli (2005)

Vepra poetike në një vëllim (2018)

Essays 

Autobiografia e popullit në vargje (The People's Autobiography in Verse) (1971)

Eskili, ky humbës i madh (Aeschylus, The Lost) (1985)

Ftesë në studio (Invitation to the Writer's Studio) (1990)

Nga një dhjetor në tjetrin (Albanian Spring) (1991)

La légende des légendes (1994)

Kushëriri i engjëjve (The Angels' Cousin) (1997)

Kombi shqiptar në prag të mijëvjeçarit të tretë (The Albanian Nation on the Threshold of the Third Millennium) (1998)

Unaza në kthetra (The Ring on the Claw) (2001)

Poshtërimi në Ballkan (Abasement in the Balkans) (2004)

Identiteti evropian i shqiptarëve (The European Identity of Albanians) (2006)

Dantja i pashmangshëm (Dante, The Inevitable) (2006)

Hamlet, le prince impossible (Hamlet, The Impossible Prince) (2007)

Don Kishoti në Ballkan (Don Quixote in the Balkans) (2009)

Mosmarrëveshja, mbi raportet e Shqipërisë me vetveten (2010)

Mbi krimin në Ballkan; Letërkëmbim i zymtë (On Crime in the Balkans)(2011)

Çlirimi i Serbisë prej Kosovës (Serbia's Liberation from Kosovo) (2012)

Mëngjeset në Kafe Rostand (Mornings in Cafe Rostand) (2014)

Arti si mëkat (Art as a Sin) (2015)

Uragani i ndërprerë: Ardhja e Migjenit në letërsinë shqipe (The Interrupted Hurricane: The Advent of Migjeni in Albanian Literature) (2015)

Tri sprova mbi letërsinë botërore (Essays on World Literature) (2017)

Kur sunduesit grinden (When Rulers Quarrel) (2018)

Story collections 

Emblema e dikurshme (1977)

Ëndërr mashtruese (1991)

Tri këngë zie për Kosovën (1998)

Vjedhja e gjumit mbretëror (1999)

Përballë pasqyrës së një gruaje (2001)

Bisedë për brilantet në pasditen e dhjetorit (2013)

Koha e dashurisë (Rrëfim Trikohësh) (2015)

Proza e shkurtër, në një 


Notable works

The General of the Dead Army

The Siege

Chronicle in Stone

The Palace of Dreams

The File on H.

The Pyramid

Spiritus

The Fall of the Stone City.


Notable awards

Prix mondial Cino Del Duca

1992

Man Booker International Prize

2005

Prince of Asturias Award

2009

Jerusalem Prize

2015

Order of Legion of Honour

2016

Park Kyong-ni Prize

2019

Neustadt International Prize for Literature

2020. 


==============={{{======{{{{={{{=====