বাংলা ভাষা ও সাহিত্য : সুকুমার সেন
দেশে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব পঠনপাঠন শুরু হওয়ার পর যে দুই জ্ঞানঋদ্ধ ব্যক্তিত্ব বাংলা ভাষার কুলজি খুঁজে বার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁরা হলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর উত্তরসূরি অধ্যাপক সুকুমার সেন। দু’জনেই প্রচলিত প্রথার বাইরে এসে এই বিশেষ বিদ্যাটির প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার অতীতকে কাটাছেঁড়া করে তার গৌরবের ভিতটি কী ভাবে গড়ে উঠেছিল সেই রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অতীত সব কিছুই ভাষিক উপকরণের বিষয় ধরে খুঁজে দেখার প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের দ্রুত সম্প্রসারণ।
"ইতিহাসের পথে এগুতে হলে তথ্যের পাথেয় চাই। যুক্তির যষ্টির অবলম্বন চাই। …ইতিহাসের প্রতিষ্ঠা তথ্যের ওপর যুক্তির ওপর। ধর্মের প্রতিষ্ঠা বিশ্বাসের ও আচরণ নিষ্ঠার ওপর । "
তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, লোকসাহিত্য, আঞ্চলিক ইতিহাস, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, প্রাচীন বাংলা, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালি, নট-নাট্য-নাটক, বিদ্যাপতি ও ব্রজবুলি সাহিত্য, পুরাণ–রামকথা–ভারতকথার গ্রন্থিমোচন, সমকালের সাহিত্যের গুণিজন ও সর্বোপরি ভাষাতত্ত্ব ও শব্দবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়কে আশ্রয় করে প্রায় শ-তিনেক প্রবন্ধ ও চারটি স্বল্প-আয়তনের গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
রচনা কর্ম।
ভাষার ইতিবৃত্ত (বাংলা ভাষাতত্ত্বের একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা)
Women's Dialect in Bengali (বাংলা মেয়েলি ভাষা নিয়ে গবেষণামূলক রচনা)
বাংলা স্থাননাম (বাংলা স্থাননাম নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ)
রামকথার প্রাক-ইতিহাস (রামায়ণ-সংক্রান্ত তুলনামূলক পুরাণতাত্ত্বিক আলোচনা)
ভারত-কথার গ্রন্থিমোচন (মহাভারত-সংক্রান্ত তুলনামূলক পুরাণতাত্ত্বিক আলোচনা)
A History of Brajabuli Literature (ব্রজবুলি সাহিত্যের ইতিহাস)
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (৫টি খণ্ডে, সুকুমার সেনের সবচেয়ে বিখ্যাত বই, বাংলা সাহিত্যের একটি পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক ইতিহাস)
বঙ্গভূমিকা (বাংলার আদি-ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থ)
ইসলামি বাংলা সাহিত্য
কলিকাতার কাহিনী
ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি
বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা [৩]
বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য [৪]
দিনের পরে দিন যে গেল ( আত্মজীবনীমূলক রচনা )
১৯৬৪ সালে ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে 'যদুনাথ সরকার পদক' প্রদান করে। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র থেকে পান 'রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য' উপাধি। তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।
ব্যক্তি পরিচয় :
১৯০১ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার গোয়াবাগানের মাতুলালয়ে সুকুমার সেনের জন্ম হয়। পিতা হরেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বর্ধমান কোর্টের আইনজীবী এবং মা নলিনী দেবী। বর্ধমান জেলার গোতান গ্রামে ছিল তাদের পৈতৃক নিবাস। এখানেই সুকুমার সেনের পড়াশোনার শুরু। ১৯১৭ সালে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং ১৯১৯ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে বাংলা, সংস্কৃত, লজিক ও অঙ্কে লেটার সহ প্রথম বিভাগে আই.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২১ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে সংস্কৃতে সাম্মানিক সহ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৫ সালে "সিনট্যাক্স অফ বৈদিক প্রোজ" নামে একটি থিসিস লিখে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ "নোটস অফ দি ইউজ অফ কেসেস ইন দ্য কথক সংহিতা" প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালে। এরপর মধ্য ও আধুনিক (বাংলা) আর্যভাষার ঐতিহাসিক পদবিচারের উপর গবেষণা করে তিনি পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯২ সালের ৩ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
No comments:
Post a Comment