সুভাষ মুখোপাধ্যায়
"আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল".
“ প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীলমদ্য কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া ।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন শঙ্খ গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে
তিল তিল মরণেও অসংখ্য জীবনকে চাই ভালোবাসতে । ”
কোনো রোমান্টিক ভাবনায় ভেসে যাওয়া নয় , মানুষের দিকে তাকিয়েছিলেন কবি । সেজন্যই কবি ‘ মিছিলের মুখ ’ – এ মুষ্টিবদ্ধ একটি শানিত হাত দেখতে পান , গর্জে ওঠেন শোষণের বিরুদ্ধে । মানুষের কথা বলার জন্য তিনি যে একদিন গদ্যকেও হাতিয়ার করবেন সে ইচ্ছেটি তার কবিভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র এবং মা যামিনী দেবী । পিতা আবগারি বিভাগে চাকরি করতেন । পিতার বদলির চাকরি হওয়ার জন্য শৈশবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেও বিভিন্ন স্থানে কাটাতে হয়েছে প্রথমে নওগাঁর স্কুলে ভরতি হলেও ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা মেট্রোপলিটান স্কুলে ভরতি হন । এরপর সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে সপ্তম শ্রেণিতে এবং পরে ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভরতি হন । শিক্ষক হিসেবে কাছে পান কবি কালিদাস রায়কে । বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে । ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন । এই কলেজ থেকেই ১৯৪১ খ্রিস্টব্দে দর্শন বিষয়ে বিএ ( সাম্মানিক ) এবং পরবর্তী সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন.
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে রাজনীতির শুরু তাঁর ছাত্রজীবন থেকেই । ১৯৩২-১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে 'বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল ‘ – এর সক্রিয় সদস্য হন । সমর সেনের দেওয়া ‘ হ্যান্ডবুক অফ মার্কসিজম্ ’ পড়ে মার্কসীয় মতবাদের প্রতি তিনি অনুরক্ত হন । এরপর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন । ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পীসংঘের কমিটিতে বিষ্ণু দে এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় যুগ্ম – সম্পাদক নির্বাচিত হন । প্রসঙ্গত সাহিত্যিক সোমেন চন্দের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে গড়ে উঠেছিল— ‘ Anti Fascist Writers and Artists Association ‘ । এরপর তিনি মাসিক পনেরো টাকা ভাতায় পার্টিকর্মী হিসেবে ‘ জনযুদ্ধ ’ পত্রিকায় কাজকর্মের জন্য নিযুক্ত হন । পরে ‘ দৈনিক স্বাধীনতা ‘ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজে যোগ দেন । কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করা হলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কারাবরণও করেন । পরবর্তী সময়ে পার্টির কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ বর্জন করেন ।
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ পরিচয় ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন । কয়েক বছরের জন্য সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ‘ সন্দেশ ’ পত্রিকার যুগ্ম – সম্পাদকও হন ।১৯৫১ খ্রিস্টাব্দেই গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন । সুভাষ মুখোপাধ্যায় একজন সৃষ্টিশীল মানুষ । শুধুমাত্র কাব্য নয় , রিপোর্টাজ , ভ্রমণকাহিনি , উপন্যাস , শিশুসাহিত্য , অনুবাদসাহিত্য – সাহিত্যের সব শাখাতেই সমান বিচরণ ছিল।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর উল্লেখযোগ্য কাব্য : ‘ পদাতিক ‘ ( ১৯৪০ ) , ‘ অগ্নিকোণ ’ ( ১৯৪৮ ) , ‘ চিরকুট ’ ( ১৯৫০ ) , ‘ ফুল ফুটুক ’ ( ১৯৫৭ ) ‘ যত দূরেই যাই ’ ( ১৯৬২ ) , ‘ কাল মধুমাস ‘ ( ১৯৬৬ ) , ‘ এই ভাই ‘ ( ১৯৭১ ) , ‘ ছেলে গেছে বনে ’ ( ১৯৭২ ) , ‘ একটু পা চালিয়ে ভাই ‘ ( ১৯৭৯ ) , ‘ জল সইতে ’ ( ১৯৮১ ) , ‘ চইচই চইচই ’ ( ১৯৮৩ ) , ‘ বাঘ ডেকেছিল ’ ( ১৯৮৫ ) , ‘ যা রে কাগজের নৌকো ‘ ( ১৯৮৯ ) , ‘ ধর্মের কল ’ ( ১৯৯১ )।
অনুবাদ সাহিত্য :
অনুবাদ সাহিত্য : ‘ নাজিম হিকমতের কবিতা ’ ( ১৯৫২ ) , ‘ দিন আসবে ’ ( ১৯৬১ ) , ‘ পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ ’ ( ১৯৭৩ ) , ‘ রোগা ঈগল ’ ( ১৯৭৪ ) , ‘ হাফিজের কবিতা ‘ ( ১৯৮৪ ) , ‘ চর্যাপদ ‘ ( ১৯৮৬ ) , ‘ অমরু শতক ’ ( ১৯৮৮ ) , ‘ গাথা সপ্তসতী ‘ ( ১৯৯৮ ) ।
উপন্যাস :
‘ হাংরাস ‘ ( ১৯৭৩ ) , ‘ কে কোথায় যায় ’ ( ১৯৭৬ ) , ‘ অন্তরীপ বা হ্যানসেনের অসুখ ’ ( ১৯৯০ ) , ‘ কাঁচা – পাকা ’ ( ১৯৮৯ ) ‘ কমরেড ’ , ‘ কথা কও ‘ ।
কথা সাহিত্য :
অনূদিত কথাসাহিত্য : ‘ কত ক্ষুধা ‘ ( ১৯৫৩ ) , ‘ রুশ গল্প সঞ্চয়ন ’ ( ১৯৬৩ ) , ‘ ইভান দেনিসেভিচের জীবনের একদিন ’ , ‘ তমস ’ ( ১৯৮৮ ) ।
ভ্রমন
রিপোর্টাজ , ভ্রমণকাহিনি , প্রবন্ধ ও আত্মজৈবনিক : ‘ আমার বাংলা ‘ ( ১৯৫১ ) , ‘ ভূতের বেগার ‘ ( ১৯৫৪ ) , ‘ যখন যেখানে ’ ( ১৯৬৭ ) , ‘ ডাকবাংলার ডায়েরি ’ ( ১৯৭২ ) , ‘ ভিয়েতনামে কিছুদিন ‘ ( ১৯৭৪ ) , ‘ যেতে যেতে দেখা ’ , ‘ ক্ষমা নেই ’ ( ১৯৮১ ) , ‘ নারদের ডায়েরি ’ ( ১৯৭৬ ) , ‘ আবার ডাকবাংলার ডাকে ‘ ( ১৯৮১ ) , ‘ অগ্নিকোণ থেকে ফিরে ’ ( ১৯৮৪ ) , ‘ এখন এখানে ’ ( ১৯৮৬ ) , ‘ খোলা হাতে খোলা মনে ’ ( ১৯৮৭ ) , ‘ ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন ‘ ( ১৯৮৭ ) , ‘ কুড়িয়ে ছিটিয়ে ’ ( ১৯৯০ ) , ‘ কবিতার বোঝাপড়া ’ ( ১৯৯৩ ) , ‘ টানাপোড়েনের মাঝখানে ’ ( ১৯৯৪ ) , ‘ ঢোলগোবিন্দের মনে ছিল এই ’ ( ১৯৯৪ ) ।
ছোটদের লেখাগ্রন্থ :
‘ অক্ষরে অক্ষরে ‘ ( ১৯৫৪ ) , ‘ জগদীশচন্দ্র বসু ( ১৯৫৫ ) , বাঙালির ইতিহাস ( ১৯৫৯ ) , ‘ কথার কথা ’ ( ১৯৫৫ ) , ‘ ইয়াসিনের কলকাতা ‘ ( ১৯৭৮ ) , ‘ মিউ – এর জন্য ছড়ানো ছিটানো ‘ ( ১৯৮০ ) , ‘ টো টো কোম্পানী ‘ ( ১৯৮৪ ) , ‘ রূপকথার ঝুড়ি ’ ( ১৯৮৮ ) , ‘ জানো আর দ্যাখো জানোয়ার ’ ( ১৯৯১ ) ইত্যাদি ।
পুরস্কার ও সম্মাননা
যত দূরেই যাই ‘ কাব্যগ্রন্থের জন্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে পুরষ্কৃত হন । এ ছাড়াও ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানপীঠ এবং ওই বছরই আনন্দ পুরস্কারেও ভূষিত হন পদাতিক কবি সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গদ্যলেখায় মানবতাবাদের জয়গান ঘোষিত হয়েছে , আলোচিত হয়েছে সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট এবং গুরুত্ব পেয়েছে তাদের ওপর সংঘটিত শোষণ অত্যাচারের কাহিনি । সুভাষ মুখোপাধ্যায় (Subhas Mukhopadhyay) রিপোর্টাজধর্মী লেখায় উঠে এসেছে গ্রামগঞ্জের নিখুঁত জীবনযাপনচিত্র , আঞ্চলিক সংস্কৃতি । সুগভীর পর্যবেক্ষণ এবং সাধারণ মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অমৃতলোকে যাত্রা করেন ।
শুধুমাত্র কবি ও গদ্যকার হিসেবেই নয় , একজন মানবতাবাদী মানুষ হিসেবেও পাঠকমহলের হৃদয় মন্দিরে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন ।
পদাতিক
এ গ্রন্থের বধূ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধ রোম্যান্টিকতার বিপরীত ধ্বনি শোনা যায়; কতকটা কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো গানের অনুষঙ্গে –
“ ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম
উধাও; লোক লোচন উঁকি মারে
সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
-লেকের জলে মরণ যেন ভালো।
”চিরকুট
চিরকুট কাব্যটি বাংলা ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। শুধু ফ্যাসিবিরোধিতাই নয়, এই কাব্যে উঠে এসেছে ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের স্মৃতি। স্ফুলিঙ্গ, জবাব চাই, প্রতিরোধ প্রতিজ্ঞা আমার, ফের আসবো, এই আশ্বিনে, চিরকুট প্রভৃতি কবিতায় আছে বিশ্বাস, বলিষ্ঠতা, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আবার আবেগের বিধুরতাও। ঘোষণা কবিতায় দেখা যায় –
“ গঙ্গার জোয়ার এসে লাগে
ভল্গার তীরের স্পর্শ,
চোখে নব সূর্যোদয় জাগে;
মুক্তি আজ বীরবাহু
শৃঙ্খল মেনেছে পরাভব;
দিগন্তে দিগন্তে দেখি
বিস্ফোরিত আসন্ন বিপ্লব।
”অগ্নিকোণ
১৯৪৮ সালে পার্টির দৈনিকের টাকা তোলার জন্য কবি লেখেন মাত্র পাঁচটি কবিতার সংকলন অগ্নিকোণ। কবির ভাষায়, “রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির জন্যেই অগ্নিকোণের প্রকাশ”।[৫] এই কাব্যে কবি উদ্বেল হয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তিসংগ্রামের সংবাদে –
“ লক্ষ লক্ষ হাতে
অন্ধকারকে দু’টুকরো ক’রে
অগ্নিকোণের মানুষ
সূর্যকে ছিঁড়ে আনে।
”অগ্নিকোণ ও ফুল ফুটুক কাব্য রচনার মধ্যবর্তী সময়ে কবি উপলব্ধি করেন এক চরম নান্দনিক সত্য:
“ সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত সংগ্রাম আর প্রেরণা, জয়, পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা, খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না। কবিতার গদ্যের আর কথা বলবার ভাষার বিভিন্নতা নতুন কবি স্বীকার করেন না। এমন এক ভাষায় তিনি লেখেন – যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র গভীর, একান্ত জটিল – অর্থাৎ অনাড়ম্বর সেই ভাষা।[৬] ”
এই সত্য প্রতিফলিত হয় তার পরবর্তীকালের কাব্যগুলিতে। কমিউনিজমের বাঁধা বুলি ছেড়ে তিনি চিত্রকল্প নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় রত হন এই কাব্যগুলিতে। ফুল ফুটুক কাব্যের আরও একটা দিন কবিতায় অন্ধকারের এক আশ্চর্য ছবি আঁকেন কবি,
“ জলায় এবার ভাল ধান হবে –
বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে
এ বাড়ির বউ এল আলো হাতে
সারাটা উঠোন জুড়ে
অন্ধকার নাচাতে নাচাতে।
No comments:
Post a Comment