১৯৪৪ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার আনাড়ার জন্ম। তাঁর বাবা রেলে চাকরি করতেন। ১২ বছরে হাওড়ার স্কুলজীবন শুরু করেন। তারপর অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবেই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তারইমধ্যে চার্লি চ্যাপলিন, আকিরা কুরোয়াওয়া, রবার্তো রোসেল্লিনির মতো চলচ্চিত্র জগতের মহীরূহদের কাজের প্রতি ভালোবাসা গড়ে ওঠে বুদ্ধদেববাবুর। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘দূরত্ব’।
বুদ্ধদেব অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যামসুন্দর কলেজে এবং কলকাতার সিটি কলেজের পাশে। ১৯৭৬ সালে যখন তিনি এই ফাঁক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন তখন তিনি অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, যা তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য গ্রহণ করেছিলেন। এদিকে, কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে তার সদস্যপদ, যেখানে তিনি প্রথম তার কাকার সাথে সিনিয়র হাই স্কুলে থাকা অবস্থায় যাচ্ছিলেন,তা তাকে চার্লি চ্যাপলিন, ইঙ্গমার বার্গম্যান, আকিরা কুরোসাওয়া, ভিত্তরিও দে সিকা, রবার্টো রোসেলিনি এবং মাইকেল এনজেলো আন্তোনিওনির মত পরিচালকের কাজের সাথে পরিচয় করিয়েছিল। । যা পরবর্তীতে, তাকে অভিব্যক্তির একটি পদ্ধতি হিসাবে ফিল্ম তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি ১৯৬৮ সালে ১০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দ্য় কন্তিনেন্ত অব লাভ দিয়ে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন,অবশেষে তিনি ১৯৭৮ সালে তার প্রথম সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম, দোরাতওয়া (দূরত্ব) তৈরি করেছিলেন।
তার গীতসংহিতাও চলচ্চিত্রের সাথে বর্ধিত হয়। তার চলচ্চিত্রের কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে, দাশগুপ্ত সত্যজিৎ রায়ের বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্রগুলির দ্বারা অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্রগুলি তৈরি করেছিলেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য রূপে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা, চারচার ও উত্তরা হল তার বেশিরভাগ প্রশংসিত চলচ্চিত্র।
দাম্পত্য সঙ্গী সোহিনী দাশগুপ্ত । বড় কন্যা, অলকানন্দ দাশগুপ্ত, একজন প্রশিক্ষিত শাস্ত্রীয় পিয়ানোবাদী, তার ২০১৩ সালের চলচ্চিত্র, আনোয়ার কা আজিব কিসসার জন্য পটভূমি স্কোর রচনা করেছিলেন।
সেই শুরু। তারপর থেকে ছক ভেঙে একাধিক সিনেমা করে গিয়েছেন বুদ্ধদেববাবু। ‘তাহাদের কথা’, ‘উত্তরা’, ‘চরাচর’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘বাঘ বাহাদুর', ‘গৃহযুদ্ধ’-এর মতো অসামান্য সিনেমার জনক ছিলেন। ‘উত্তরা’, ‘তাহাদের কথা’-র জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটক উত্তর যুগে বাংলা সিনেমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বের সামনে। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে, ছবির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। নির্দিষ্ট, ধরাবাধা ছকে এগিয়ে যাননি। বরং ছক ভেঙে এগিয়ে যাওয়াই হয়ে উঠেছিল বুদ্ধদেববাবুর স্বকীয়তা।
ফিচার ফিল্ম
সময়ের কাছে (১৯৬৮) (short)
দুরত্ব (১৯৭৮) (Distance)
নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯) (Bitter Morsel)
গৃহযুদ্ধ (১৯৮২) (The Civil War)
অন্ধ গলি (১৯৮৪) (Blind Alley)
ফেরা (১৯৮৮) (The Return)
বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯) (The Tiger Man)
তাহাদের কথা (১৯৯২) (Their Story)
চরাচর (১৯৯৩) (Shelter of the Wings)
লাল দরজা (১৯৯৭) (The Red Door)
উত্তরা (২০০০) (The Wrestlers)
মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২) (A Tale of a Naughty Girl)
স্বপ্নের দিন (২০০৪) (Chased by Dreams)
আমি, ইয়াসিন আর আমার মধুবালা (২০০৭) (The Voyeurs)
কালপুরুষ (২০০৮) (Memories in the Mist)
জানালা (২০০৯) (The Window)[৪]
মুক্তি(২০১২)
পত্রলেখা (২০১২)
আনোয়ার কা আজিব কিসসা (২০১৩) (Sniffer, Hindi)[৫]
টোপ (২০১৭)
তথ্যচিত্র ও টিভিকর্ম সম্পাদনা
দ্য় কন্তিনেন্ত অব লাভ (১৯৬৮)
ধোলার রাজা খিরোড নত্ত (১৯৭৩)
ফিশারম্যান অব সুন্দরবন (১৯৭৪)
সারাচন্দ্র (১৯৭৫)
রিদম অব ষ্টিল(১৯৮১)
ইন্ডিয়ান সায়েন্স মার্চে অ্যাহেড (১৯৮৪)
বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কার (১৯৮০)
গ্লাস স্টোরি (১৯৮৫)
ভারত অন দ্য মুভ (১৯৮৫)
সিরামিকস (১৯৮৬)
আরণ্যক (১৯৯৬)
কন টেম্পোরারি ইন্ডিয়ান স্ক্লাপচার (১৯৮৭)
হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান জুট(১৯৯০)
বছরের পর বছর ধরে তিনি গভীর আড়ালে, কফিন কিংবা সুটকেস, হিমজগ, ছাতা কাহিনি, রোবটের গান, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভোম্বোলের আশ্চর্য কাহিনি ও অন্যান্য কবিতা সহ কবিতার বিভিন্ন রচনা প্রকাশ করেছেন।
২০২১ সালের ১০ই জুন দক্ষিণ কলকাতার নিজের বাসভবনে মৃত্যু হয় তার । সকাল ৬টায় ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে। অনেকদিন ধরেই তিনি কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। চলছিল ডায়ালিসিস। কিডনির সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বার্ধক্যজনিত সমস্যা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
বুদ্ধদেববাবুর প্রয়াণে চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিচালক তরুণ মজুমদার বলেন, ‘খুবই বড় ক্ষতি। আমি হতবাক।’ পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘এই ভয়ংকর সময় এই খবরটা আরও মর্মান্তিক। শরীর খারাপ ছিল। তবে কবিতা লিখছিলেন। ফোনে কথা বলছিলেন। একসঙ্গে স্বপ্ন দেখছিলাম। তাঁর চলচ্চিত্র যাতে সংরক্ষিত হয়, সেই আর্জি জানাব।’
পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা
২০০৮ সালের ২৭ মে স্পেনের মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে জীবনকালের কৃতিত্বের সম্মাননা প্রদান করা হয়।[১]
২০০৭ সালে এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন এথেনা পুরস্কার
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
সেরা চলচ্চিত্র
১৯৮৯: বাঘ বাহাদুর
১৯৯৩: চরাচর
১৯৯৭: লাল দরজা
২০০২: মন্দ মেয়ের উপাখ্যান
২০০৮: কালপুরুষ
সেরা নির্দেশনা
২০০০: উত্তরা
২০০৫: স্বপ্নের দিন
সেরা চিত্রনাট্য
১৯৮৭: ফেরা
বাংলাতে সেরা ফিচার ফিল্ম
১৯৭৮: দোরাতওয়া
১৯৮৭: ফেরা
১৯৯৩: তাহাদের কথা
শ্রেষ্ঠ আর্টস / সাংস্কৃতিক ফিল্ম
১৯৯৮: এল পেইন্টার অফ ইলোকেন্ট সাইলেন্স: গণেশ পাইন
ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল
১৯৮২: এফআইপিআরএসসিআই পুরস্কার: গৃহযুদ্ধ
২০০০: শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য সিলভার লায়ন: উত্তরা
১৯৮২: গোল্ডেন লায়ন মনোনয়ন: গৃহযুদ্ধ
২০০০: গোল্ডেন লায়ন মনোনয়ন: উত্তরা
বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
১৯৮৮: গোল্ডেন বিয়ার মনোনয়ন: ফেরা[৬]
১৯৯৪: গোল্ডেন বিয়ার মনোনয়ন: চারাচার [৭]
লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভাল
সমালোচকদের পুরস্কার: দোরাতওয়া
বিশেষ জুরি পুরস্কার: নিম অন্নপূর্ণা
এশিয়া প্যাসিফিক চলচ্চিত্র উৎসব
সেরা চলচ্চিত্র: জানালা
কার্লোভি ভারি ফিল্ম ফেস্টিভাল
বিশেষ জুরি পুরস্কার: নিম অন্নপূর্ণা
দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
গোল্ডেন প্রাইজ: নিম অন্নপূর্ণা
ব্যাংকক আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল
সেরা এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড (২০০৩): মন্দ মেয়ের উপাখ্য়ান।
কবিতায় সিনেমার রুদ্ধ দরজা খুলে দিয়েছেন তিনি। পাঠকের মনে হবে ছবি দেখছেন। শব্দে শব্দে গতিশীল ছবি। যা প্রবাহিত হচ্ছে অনুভবে, উপলব্ধিতে। ছোট ছোট দৃশ্য দিয়ে বোনা হয়েছে কবিতার কোলাজ। যেমন-
শাড়ির ফলস পাড় উঠে পড়ছে অনেকদূর
চক্রাকারে বেড়ে উঠেছে ক্রমশ ঢের শান্ত এক তি
মাঝখানে আছে সময় যা পার হলে বোঝা যাবে স
মানুষের কোন কোন অঙ্গ হৃদয়ের মতো বিষন্ন হ
মাইল মাইল ঘুরে আসার বদলে আমার হলুদ হাত
শুয়েছিল তোমার হাতের নীচে
অন্যরকম এক কবিতা। এই কবিতার নীচে শুয়ে আছে যত্নলালিত ছবি। যেন ক্যামেরার উজ্জ্বল লেন্স থেকে এক একটি শব্দ বেরিয়ে এসে সাজিয়ে তুলছে কবিতার খাতা। যেন বিকেল শেষ হয়ে গেছে। ম্লান আলোর ভেতর উঠে আসছে কয়েকটি লাই
"… শেষ হয়ে আসছিল তখন, বিকেল শেষ হয়ে এ
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম,
দেখলাম আমার স্নানের জল
তুলে দিচ্ছে বুড়ি।
এক প্রসন্ন আশ্রয়ের ছবি ভেসে উঠছে সন্ধ্যের মর্মরিত আলোয়। কবিতা নয় এক সিনেমার দৃশ্যপট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পাঠক। বন্দুকের গল্প কবিতার দিকে যদি আমরা তাকাই কী দেখব, শব্দ দিয়ে বুনে ফেলা সিনেমা
হাড় হিম ছোট্ট ফোকরের ভেতর
সেই বন্দুক শুয়ে থাকে সারা রাত,
সারা রাত সমস্ত শহর জুড়ে ফ্যান ঘোরার শব্দ
শুনতে পায় সেই বন্দু
বন্দুকের ঘুম হয় না
ছোট্ট এই ছবির ভেতর উঠে আসছে অস্থির সময়। রক্তলাঞ্ছিত সময়ের রূপ। কয়েকটি লাইন দিয়ে সেই চলমান ছবিটি ধরা আছে কলমের আশ্চর্য লেন্সে
ডিম কবিতায় আমরা জীবনের চিরন্তন ছবি দেখতে পাই।
"কেন না বেঁচে থাকা মানে
ক্রমাগত ডিম পাড়ার স্বপ্ন দেখা ও ডিম পাড়ার জন্য অপেক্ষা করা
আর কিছু ন
যার ভেতর থেকে একদিন মাথা ঠুকতে ঠুকতে আমরাও বেরিয়ে এসেছি।
কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতায় বাড়ি, ঘর, চার দেওয়াল, গাছপালা, জল মাটি, পাখি, পাখির ডিম, ছাতা, পাহাড় এসব বারবার এসেছে। জীবন মানে তো শুধু মানুষ নয়। শুধু মানুষ তো নির্জীব। দৃশ্যই পারে মানুষের ভেতরে যে জীবন যে সজীবতা তাকে বাঙময় করে তুলতে।
========}}}}}}}}{{{{{{{{{{==============
No comments:
Post a Comment