Thursday, 17 February 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। চৈতন্য মহাপ্রভু। ১৮.০২.২০২২. Vol -650 The blogger in literature e-magazine


চৈতন্য মহাপ্রভু (Chaitanya Mahaprabhu)
 

জন্মগ্রহণ করেন ১৪৮৬ খ্রিঃ ১৮ শে ফেব্রুয়ারী । ফাল্গুনী পূর্ণিমার পুণ্য তিথি । নবদ্বীপের আকাশে আর গঙ্গার বুকে জোছনার জোয়ার উথূলে উঠেছে । সেদিন আবার চন্দ্রগ্রহণের যোগ । ভিড়ের তাই অন্ত নেই । কোলাহল আর হরিধ্বনিতে আকাশ – বাতাস ভরপুর । এমন সময় মায়াপুর পল্লীতে শ্রীহট্টিয়া পাড়ায় নারীকণ্ঠের ঘন ঘন উলুধ্বনি শোনা গেল । শাঁখ বেজে উঠলো চারিদিকে । কি ব্যাপার ? – শোনা গেল এইমাত্র পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে তার স্ত্রী শচীদেবী একটি পুত্র সস্তানের জন্ম দিয়েছেন. 
নীলাম্বর চক্রবর্তী শচীদেবীর পিতা । মস্ত পণ্ডিত তো বটেই জ্যোতিষ শাস্ত্রেও তাঁর খ্যাতি কম নয় । দৌহিত্রের জন্ম – সংবাদ পেয়েই তিনি নবজাতকের ভাগ্য গণনায় বসে গেলেন । গণনা শেষে বললেন , এ জাতকের কোষ্ঠী অপূর্ব । এ শুধু অসামান্য মনীষী ও বিদ্যার অধিকারী হবে না , ধর্মজগতের এক মস্তবড় নেতা হবে । বহু লোক দেবতা জ্ঞানে তাঁকে পূজো করবে ।
দাদামহাশয়ের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছিল । নিমাই শুধু অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন নি , ধর্মজগতে এনেছিলেন এক বিরাট বিপ্লব । সমাজের ও ধর্মজীবনের কলুষ দূর করবার জন্যে দেশে ভক্তির বন্যা বইয়ে দেবার জন্যে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল । এই জন্যে তাকে বলা হয় যুগাবতার ।
জগন্নাথ মিশ্রের প্রথম ছেলের নাম বিশ্বরূপ । পরপর কয়েকটি ছেলে – মেয়ের মৃত্যুর পর এই ছেলের জন্ম । মা শচীদেবী তাই নবজাতকের নাম রাখলেন নিমাই । কোষ্ঠীর নাম ‘ বিশ্বম্ভর ।
ডুবনভোলানো রূপ নিমাইয়ের । একবার দেখলে চোখ ফেরানো কঠিন । বাপ – মায়ের তো বটেই , পাড়া – পড়শীদেরও সে নয়নের মণি । দিনে দিনে বাড়ে চাঁদের কলার মত । শচীমার বুকের ধন , চোখের মণি আঙিনায় খেলা করে । মা যশোদা যেমন তাঁর নয়নমণি শ্রীকৃষ্ণকে সাজাতেন তেমনি ক’রে শচীমাতাও সাজিয়ে দেন নিমাইকে । চঞ্চল অস্থির শিশু কারও কথা শোনে না । লেখাপড়ায় তার এতটুকুও মন নেই । সারাদিন , শুধু খেলা করে আর নেচে বেড়ায় । 
পাঁচ বছরে নিমাইয়ের হাতে খড়ি হলো । হাতে খড়ির দিন দেখা গেল , বালকের মেধা ও প্রতিভা দুই – ই বিস্ময়কর । বিদ্যালয়ের পাঠ অনায়াসেই সে আয়ত্ত করে । পুত্র গৌরবে মায়ের মন খুশিতে ভরে ওঠে ।
নিমাইয়ের বয়স যখন প্রায় সাত বছর , তখন তার বড় ভাই বিশ্বরূপ ষোল বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সংসার ছেড়ে চলে যান । জগন্নাথ মিশ্র ভেঙ্গে পড়েন । চোখের জলে বুক ভাসাতে থাকেন শচীমা । নিমাই বলেনঃ “ কেঁদো না মা । দাদা সন্ন্যাসী হয়েছেন কিন্তু আমি তো আছি । আমি তোমাদের দেখব । ” 


 পাছে বড় ছেলের মত নিমাইও লেখাপড়া শিখে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যায় এই ভয়ে জগন্নাথ মিশ্র নিমাইয়ের লেখাপড়া বন্ধ ক’রে দিলেন । কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়াতে বালক নিমাই এক দুরন্ত বালকে পরিণত হলেন । তাঁর অত্যাচারে ও দুরত্তপনায় নবদ্বীপের সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন ।
সাত বছরের ছেলে নিমাই কখনও কলাবাগান থেকে পাকা কলা চুরি করে খান , কখনও বা গঙ্গার জল তোলপার করে সাঁতার কাটেন । গঙ্গায় স্নানরত ব্রাহ্মণদের কাপড় – চাদর জলে ভিজিয়ে দেন , কখনও লুকিয়ে রাখেন । আবার কখনও বা কারও পূজার আসনে গিয়ে বসে নৈবেদ্যের ফলমূল খেয়ে পালিয়ে যান । গঙ্গাতীরে শিবলিঙ্গ সামনে রেখে কোন ব্রাহ্মণ হয়তো ধ্যানে বসেছেন । নিমাই নিঃসাড়ে সেখানে গিয়ে সেই শিবলিঙ্গ চুরি করে পালিয়ে যান । এমনি আরও অনেক অপকর্ম করে বেড়ান নিমাই ।

 নিমাইয়ের এমনিতর উৎপীড়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নবদ্বীপবাসীরা জগন্নাথ পণ্ডিতের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন । বলেন , দুরস্ত ছেলেটাকে একটু সামলান । ওর দুষ্টামির জ্বালায় আমরা যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম ।পাড়া – প্রতিবেশীদের কথায় বাপ মায়ের চৈতন্য হলো । তারা বুঝলেন — লেখাপড়া করতে না দেওয়াতে ছেলে এমন দুরস্ত হয়ে উঠেছে । জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবী তখন বাধ্য হয়ে ছেলেকে গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলে লেখাপড়া শিখতে পাঠিয়ে দিলেন ।গঙ্গাদাস , বিষ্ণুদাস ও সুদর্শন — এই তিন পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীর পড়া যখন নিমাই শেষ করলেন তখন তার বয়স আঠারো বছর । বেশ কয়েক বছর আগেই জগন্নাথ মিশ্র দেহত্যাগ করেছেন । অসাধারণ তাঁর প্রতিভা ও বিদ্যাবত্তা । নানা কূট প্রশ্ন তুলে লোককে বিব্রত করা , অপদস্ত করে রঙ্গ দেখা এখন তাঁর বিলাস । নবদ্বীপের নবীন ও প্রবীণ পণ্ডিতেরা এখন তাঁর ভয়ে ভীত , সবাই তাকে এড়িয়ে চলেন ।
নবদ্বীপ শহরে মুকুন্দসঞ্জয় নামে একজন বর্ধিষ্ণু লোক ছিলেন । তার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে নিমাই টোল খুলে অধ্যাপনা করতে বসলেন । নিমাইয়ের প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চারিদিকে প্রচারিত হতে লাগলো । দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসতে লাগলো নিমাই পণ্ডিতের টোলে । টোল জমে উঠতে দেরি হলো না । ধনী ও প্রতিপত্তিশালী নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অচিরে নিমাই বেশ গণ্যমান্য হয়ে উঠলেন ।নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে নিমাইয়ের বিয়ে হয়েছিল ।

 বিয়ের কিছুকাল পরে নিমাই গেলেন পূর্ববঙ্গে । সুপন্ডিত ও প্রতিভাবান পুরুষ বলে সে অঞ্চলে তিনি যথেষ্ট মর্যাদা পেলেন । কিছুকাল পরে নবদ্বীপে ফিরে এসে শুনলেন লক্ষ্মীদেবী সাপের কামড়ে মারা গেছেন । শোক ভুলে থাকবার জন্যে অধ্যাপনার ওপর জোর দিলেন । তিনি আর সেই পরিহাসপ্রিয় চঞ্চল যুবক নন । রাতারাতি হয়ে উঠেছেন গাম্ভীর্যের প্রতিমূর্তি ।কিছুকাল পরে শচীদেবী আবার ছেলের বিয়ে দিলেন । নবদ্বীপের সনাতন পণ্ডিতের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে । সংসারে আবার আনন্দের বন্যা বয়ে গেল । কিন্তু আনন্দময় এই জীবন কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন বিপর্যস্ত হয়ে গেল । আর সে বিপর্যয় এল নিমাইয়ের অলৌকিক ভাবমত্তার মধ্য দিয়ে দমকা হাওয়ার মত । বিবাহের অল্পকাল পরে নিমাই স্বর্গত পিতার পিণ্ডদান করতে গেলেন গয়াধামে । সেখানে শ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্ম দর্শনের পর তাঁর মধ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দিল । তাঁর মধ্যে জন্ম হল শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগী এক প্রেমিক সাধকের । অহঙ্কারী পন্ডিত নিমাই হলেন শ্ৰীকৃষ্ণসাধক।গয়ায় ওই সময় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক মাধবেন্দ্র পরীর শিষ্য ঈশ্বরপুরী নামে এক শ্রীবিষ্ণুভক্ত সাধু ছিলেন । নিমাই তাঁকে দেখে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেনঃ “ প্রভু আমাকে দীক্ষা দিন । ” ঈশ্বরপুরী জানতেন — নিমাই একজন পরম ভক্ত । তিনি নিমাইকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন ।
নিমাই এরপর ফিরে এলেন নবদ্বীপে । কিন্তু তখন তিনি আর আগের নিমাই নন , যেন অন্য মানুষ । সারা মন তার কৃষ্ণনামে ভরা । কৃষ্ণনাম করতে করতে তিনি কাঁদেন , কখনও বা মূর্ছিত হয়ে পড়েন ।নবদ্বীপের শাসনকর্তা তখন একজন মুসলমান কাজী । বৈষ্ণবদের কীর্তন নিয়ে এই মাতামাতি হৈ – হুল্লোড় তিনি ভাল চোখে দেখতেন না । তিনি আদেশ জারী করলেন , নবদ্বীপে সমবেতভাবে কীর্তন করা চলবে না।
 তাই শুনে নিমাই ক্রোধে রুদ্রমূর্তি ধারন করলেন । সেই দিনই তিনি হাজার হাজার ভক্ত নিয়ে শ্রীহরির নাম গান করতে করতে পথে বেরলেন । সারা শহর প্রদক্ষিণ করে অবশেষে কাজীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন । নিমাইয়ের ভগবদ্ভক্তি ও মধুর নাম গান শুনে কাজীর মনের পরিবর্তন হলো । তিনি তাঁর আদেশ তুলে নিলেন । সারা নবদ্বীপ কৃষ্ণনাম গানে ভরে গেল ।এরপর নিমাইয়ের অন্তরাত্মায় এলো আর এক নতুন আহ্বান । বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য তাঁকে এই প্রেমভক্তির প্রবাহকে সঞ্চালিত করতে হবে । গৃহত্যাগ না করলে সেই বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে ঝাপ দেওয়া যাবে না । তাই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের এক রাতে নিমাই গৃহত্যাগ করলেন । ছুটে গেলেন কাটোয়ায় । সেখানে পন্ডিত কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নিলেন । নিমাই তখন থেকে পরিচিত হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে । তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ বছর ।জাতিবর্ণ ধর্ম নির্বিশেষ সকল মানুষের মধ্যে প্রেমের বাণী প্রচার করেছিলেন শ্রীচৈতন্য । এর বাইরে তিনি অন্য কোন ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেননি । কোন ধর্মগ্রন্থও রচনা করেন নি । মানবীয় চেতনার পূর্ণবিকশিত , রূপবিগ্রহ ছিলেন তিনি । মানুষে মানুষে বিভেদ মুছে দেবার ব্রতই ছিল তাঁর জীবনসাধনা । সন্ন্যাসী হলেও তিনি আত্মমুক্তিকামী বা মানবতা বিমুখী ছিলেন না । সেই আকর্ষণেই হাজার হাজার মানুষ তার কাছে ছুটে আসত , লাভ করত জীবনের আলো । তিনি সকল মানুষের জন্য যে মহানাম প্রচার করে গেছেন তা হলো –

 ” হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।”
জীবনের শেষ আঠারোটি বছর শ্রীচৈতন্যদেব পুরীধামে কাটিয়েছিলেন । পুরীধামে ১৫৩৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ শে জুন ( আষাঢ় মাসে ) শ্রীচৈতন্যদেব চিরতরে অন্তর্হিত হয়ে যান । হিন্দুধর্মের এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাব হয়েছিলো । তিনি সেই সময় প্রচার করেন— “ ঈশ্বরের আরাধনায় সকলের সমান অধিকার । প্রাণে ভক্তি নিয়ে ঈশ্বরকে ডাকলে তাকে পাওয়া যায় । ভক্তিতেই মুক্তি । ” 


No comments: