মুকুন্দ দাস
স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বহু স্বদেশী বিপ্লবাত্মক গান ও নাটক রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন স্বদেশী যাত্রার প্রবর্তক। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন চারণকবি ছিলেন
১৮৮৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বাবা গুরুদয়াল দাস ও মা শ্যামাসুন্দরী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার দেওয়া নাম ছিল যোগেশ্বর দাস, ডাকনাম যজ্ঞা। তার জন্মের পরই বানরি গ্রামটি পদ্মা নদীর করাল গ্রাসে তলিয়ে যায়। নিরুপায় গুরুদয়াল তার কর্মস্থল বরিশালে যান সপরিবারে। সেখানে ব্রজমোহন স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয় যজ্ঞার। বরিশালের বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূতের নজরে আসেন যজ্ঞা হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসংগীত গেয়ে। মুগ্ধ রামানন্দ তার নাম বদলে রাখেন মুকুন্দ দাস।
সেই থেকেই তিনি মুকুন্দ দাস নামে খ্যাত হলেন। মুকুন্দ বাবার মুদি দোকান ছেড়ে নিজই কীর্তনের দল গঠন করে সারা দেশে ঘুরতে লাগলেন। তার গণসংগীত রচনাও শুরু হয় এ সময় থেকেই। ১৯০৩ সালে সাধন সঙ্গীত নামে একটি গানের বই বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয়। তাতে শতাধিক গান স্থান পায়। যার অধিকাংশই দেশাত্মবোধক।
তখন থেকেই মুকুন্দ দাস বদলে যান দেশপ্রেমিক হিসেবে। দেশের মানুষকে পরাধীনতার বিরুদ্ধে ও নানা সামাজিক দুর্দশার বিরুদ্ধে সচেতন করার জন্য গান ও যাত্রাপালা রচনায় মনোনিবেশ করেন।
সে সময়ে স্বদেশি বিপ্লবীদের উদ্দীপনার উৎস হয়ে উঠেছিল মুকুন্দ দাসের গান-পালা-বক্তৃতা। তিনি সারা দেশ ঘুরে ফিরতেন। তার গণসংগীত, স্বদেশি গান আর যাত্রাপালায় মানুষ উজ্জীবিত হতো দেশপ্রেম আর বিদ্রোহের আগুনে।
বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হলে মুকুন্দ দাস গান বাঁধলেন :হাসি হাসি পরব ফাঁসিদেখবে জগৎ বাসী একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
স্বদেশি রেনেসাঁর চারণকবি যখন গ্রামগঞ্জে মানুষকে জাগাতে কণ্ঠে সুর বেঁধেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ-কাজী নজরুলও আছেন বেঁচে। তারা মুকুন্দ দাসের খবর রাখতেন। তার দেশপ্রেমের প্রতি প্রীত হয়ে তাকে উপাধি দিলেন চারণকবি। ১৯৩০ সালে মুকুন্দ দাস আইন অমান্য করে সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিলেন। কীর্তন গাইতে গাইতে কণ্ঠে তুলে নিলেন আগুনঝরা গণসংগীত। ভারী তেজ আর ঝলসে দেওয়ার মতো বাণী সে গানে।
গাইলেন :ভয় কি মরণে থাকিতে সন্তানেমাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।তাথৈ তাথৈ দ্রিমি দ্রিমি দং দংভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী,আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমানথাকে থাকিবে প্রাণ, না হয় যাইবে প্রাণ।লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়াননিতে হয় মুকুন্দ রে, নিও রে সঙ্গে।তার মতো করে এযাবৎকাল লোকনাট্যকার হিসেবে আর কেউ একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারেননি। মুকুন্দ দাসের পালাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- তার সব রচনা বিংশ শতকের স্বদেশি আন্দোলন আর সামাজিক অনাচারের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস তার ভাবগুরু অশ্বিনী কুমার তাকে সঙ্গে নিয়ে দেশের নানা স্থানে স্বদেশির প্রচারে বের হন।
এ সময় মুকুন্দ দাস স্বদেশি যাত্রা পার্টি নামে দল গঠন করেন। সেই দল নিয়ে সারা দেশে ঘুরে তিনি লোকচিত্রকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। আমাদের জাতীয় নাট্য বলে যদি কিছু থাকে, সেটি হলো যাত্রা। আর মুকুন্দ দাস প্রথম জাতীয় নাট্যকে জাতির রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজে লাগালেন।
মুকুন্দদাসের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- মাতৃপূজা,
সমাজ,
আদর্শ,
পল্লীসেবা,
সাথী,
কর্মক্ষেত্র,
ব্রহ্মচারিণী,
পথ ইত্যাদি।
মুকুন্দ দাস ব্রিটিশ শাসকদের জানিয়ে দিলেন- ‘আর কি দেখাও ভয়! দেহ তোমার অধীন বটে মন তো স্বাধীন রয়। হাত বাঁধবে প বাঁধবে, ধরে না হয় জেলে দেবে, মন কি ফিরাতে পারবে এমন শক্তিময়?’ তার কাছে চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা জীবন বলে প্রতিভাত হতো। তিনি তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা ও গণসংগীত গেয়ে জনগণের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার মুকুন্দ দাসের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মাতৃপূজা নামের তার একটি পালা ব্রিটিশদের খেপিয়ে দেয়। মুকুন্দ দাসকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বরিশালে এসে তিনি যাত্রাপালার দল গঠন করেন। সমাজ নামে পালা লেখেন। ১৯১৬ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আমন্ত্রণে যাত্রার দল নিয়ে কলকাতায় যান। কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে যাত্রা মঞ্চস্থ করেন। মহাত্মা গান্ধী আহূত অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস- কর্মক্ষেত্র, পথ, পল্লী সমাজ প্রভৃতি যাত্রাপালা রচনা করেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় মুকুন্দদাস একের পর এক গান,কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। এরপর ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহের অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করেন ও বিচারে তাকে দিল্লী জেলে আড়াই বছর সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। মাতৃপূজা নাটকটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথাক্রমে বাংলা মায়ের দামাল ছেলে চারন-সম্রাট মুকুন্দ উপাধিতে ও সন্তান আখ্যায় ভূষিত করেন।
=================================
No comments:
Post a Comment