রাধারমন মিত্র
কলকাতার ইতিহাস নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ ছিল। একসময় সে কারণে কলকাতা শহরের পথে পথে একা ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ ও লেখালিখির কাজ করেছেন রাধারমণ।তার কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তন্মধ্যে কলিকাতা দর্পণ ১৯৮১ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিল।তার অন্যান্য বইগুলি হল:
- বাংলার তিন মনীষী
- কলিকাতায় বিদ্যাসাগর
- ডেভিড হেয়ার: হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্কস
- রাধারমণ মিত্রের প্রবন্ধ.
তিনি কলকাতার শ্যামবাজারে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭। পৈতৃক নিবাস ছিল বর্ধমান। ১৯১৩ সালে হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯১৫ সালে স্বর্ণপদক সহ আই.এ পাশ করেন। সেন্ট পলস কলেজ থেকে বি এ পাশ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।
এম.এ পড়াকালীন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে উত্তরপ্রদেশ চলে যান সহযোগী বিপ্লবী বঙ্কিম মুখার্জীর সাথে। গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উত্তর প্রদেশের এটাওয়া তে সংগঠকের কাজ করেন। এই সময় গ্রেপ্তার হয়ে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের নৈনি জেলে বন্দী হন। এক বছর কারাবাস করার পর তিনি সবরমতী আশ্রমে যান ও মহাত্মা গাঁধীর সাথে টানা তিন বছর কাজ করেন। গান্ধীবাদী আদর্শের অনুগামী হলেও তার সাথে মতপার্থক্যের কারণে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায় ও কর্পোরেশন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ নেন। শিক্ষকতা ছাড়াও শ্রমিক আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বহুবার নেতার ভূমিকায় ছিলেন রাধারমণ মিত্র। মার্কসবাদী দর্শনে আকৃষ্ট হলেও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেননা। ১৯২৯ সালে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশ সরকার আবার তাকে গ্রেপ্তার করে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান। ১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। পরে মতপার্থক্যের কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গেলেও তার পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা এবং বামপন্থী রাজনীতি ও মতাদর্শের প্রতি জ্ঞান তাকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। তিনি ভারত সোভিয়েত সুহৃদ সমিতিরও সদস্য ছিলেন।
Portrait of 25 of the Meerut Prisoners taken outside the jail. Back row (left to right): K. N. Sehgal, S. S. Josh, H. L. Hutchinson, Shaukat Usmani, B. F. Bradley, A. Prasad, P. Spratt, G. Adhikari. Middle Row: রাধারমণ মিত্র, Gopen Chakravarti, Kishori Lal Ghosh, L. R. Kadam, D. R. Thengdi, Goura Shanker, S. Bannerjee, K. N. Joglekar, P. C. Joshi, মুজফ্ফর আহ্মেদ. Front Row: M. G. Desai, D. Goswami, R.S. Nimbkar, S.S. Mirajkar, S.A. Dange, S. V. Ghate, Gopal Basak.
মৃত্যু - ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ ।
একজন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী বিপ্লবী ও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক। তিনি ১৯২৯ সালের মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হন। শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে অন্যতম পুরোধা, দেশের মানুষের মধ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রচারে একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি একসময় মহাত্মা গান্ধীর 'ডানহাত'-স্বরূপ ছিলেন।
এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসবকে কেন্দ্র করে পায়ে হেঁটে কলকাতার একটি অঞ্চলকে জানার আর চেনার জন্য অসাধারণ এক পদযাত্রা সম্প্রতি হয়ে গেল পুরনো কলকাতার গ্রুপের উদ্যোগে গত ২২শে অক্টোবর, রবিবার, ইংরাজিতে যাকে বলা যায় Heritage Walk। পদযাত্রাটির নাম দেওয়া হয়েছিল প্রখ্যাত কলকাতা বিশেষজ্ঞ রাধারমণ মিত্রের স্মরণে “ কলকাতার দর্পণ– রাধারমণ, Walk Through His Eyes“। পায়ে হেঁটে একটি শহরের কিছু অংশকে চেনার এই উদ্যোগ এখন বেশ পরিচিত তবু বলব, তার মধ্যেও এই ভ্রমণটি কিন্তু বেশ আলাদা। এর কারণ অনেকগুলি। প্রথমত, এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে একটি শিক্ষামূলক ভ্রমণ অর্থাৎ সেই অর্থে Commercial Tour নয়। কিন্তু তা না হলেও অন্যদিকে এটি আবার কিছুটা Professional Tour-ও। যেখানে পরিকল্পনা থেকে তার রূপায়ণ সবেতেই একটা Professionalism বা পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট। যেমন, বাংলা সাহিত্য উৎসবকে কেন্দ্র করে এই ভ্রমণ তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল এমন কিছু জায়গা, যার সঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ আর সারস্বত সাধনার বেশ কিছু ইতিহাস সম্পৃক্ত হয়ে আছে। বাংলা শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর সে ইতিহাস অনেকেরই জানা। তাই এঁরা বেছে নিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিট নয়, বরং ঠিক তার চৌহদ্দির বাইরেই ঝামাপুকুর আর বিধান সরণীর এমন কিছু অঞ্চল। যেখানেও লুকিয়ে আছে অনেক ইতিহাস, কিন্তু তা আছে অনেকেরই জানার সীমানার বাইরে। এঁদের প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সেই ইতিহাসকে সবার সামনে তুলে আনা। কলকাতাকে ভালোবেসে গঠনমূলক চিন্তার এ এক অনন্য উদাহরণ। আবার এঁদের সেই কাজে একদিকে যেমন তাঁরা পেয়েছিলেন এমন কিছু মানুষকে, কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছুই যাঁদের নখদর্পণে, তেমনই অন্যদিকে নিয়ে এসেছিলেন এই ভ্রমণের পরিচালক হিসেবে শ্রী গৌতম বসু মল্লিককে। যিনি কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে এক চলন্ত অভিধানই বলা চলে। নিজেকে তিনিই অভিহিত করেছেন রাধারমণ মিত্র, নিখিল সরকার, তারাপদ সাঁতরার উত্তরসূরি হিসেবে। পায়ে হেঁটে কলকাতা শহরকে যাঁরা চিনেছেন, জেনেছেন, নতুন করে আবিষ্কার করেছেন, আর পরে সেই সব জ্ঞান উজাড় করে দিয়েছেন অন্যদের কাছে, উত্তরসূরিদের হাতে। “পুরনো কলকাতার গল্প” গ্রুপের পেশাদারিত্ব এখানেই যে, তাঁরা এই ভ্রমণের ভার তুলে দিয়েছিলেন সেই কলকাতাপ্রেমী বিশেষজ্ঞ গবেষক ও সাংবাদিক গবেষক গৌতম বাবুর হাতে
যিনি তাঁর জ্ঞানের বিচ্ছুরণে সেদিনে সবাইকে সমৃদ্ধ করেছেন, শিহরিত করেছেন। সে কথায় আমরা পরে আসব। কিন্তু এই যে এইভাবে কলকাতাকে দেখা আর চেনা এটি করতে গিয়ে তাঁরা কিন্তু ভোলেননি। এ ব্যাপারে অন্যতম পথিকৃৎ শ্রী রাধারমণ মিত্রকে। কোন দায় ছিল না এঁদের। এই ভ্রমণটি রাধারমণ মিত্রের নামে উৎসর্গ করা। তবু তাঁরা তা করেছেন। কারণ ইতিহাস মানেই পিছনে ফিরে তাকিয়ে নিজেদেরই নতুন করে আবিষ্কার করা। সেই আবিষ্কারে যাঁরা আমাদের অগ্রজ, সেই পূর্বসূরিদের সম্মান দেওয়াও কিন্তু সেই ইতিহাস সাধনার অঙ্গ, আমাদের নৈতিক কর্তব্য। ইতিহাসের পথে সেই যাত্রাকে একজন পূর্বসূরি ঐতিহাসিকের নামেই উৎসর্গ করা। সেটিও এই ভ্রমণের আর একটি বৈশিষ্ট্য। আবার সবার পরে এই ভ্রমণকে নিয়েই একটি আলোচনা সভার আয়োজন এক সপ্তাহ পরে অক্সফোর্ড বুক স্টোরে। রাজপথে ভ্রমণ তো একটা বড় দলকে নিয়ে সম্ভব হয় না, অথচ জানার থাকে অনেক কিছুই। তাই সেই জানাকে ছড়িয়ে দেওয়া আরও অনেক বেশী মানুষের কাছে । যাঁরা সেদিন সেই ভ্রমণে না গিয়েও জানতে পেরে যাবেন সেদিনের অনেক কিছু ইতিহাসের খুঁটিনাটি। জানবেন সেই গৌতম বসু মল্লিক মহাশয়ের মুখ থেকেই। সেই সঙ্গে থাকবেন জনাব শাহেনশা মির্জা এবং আরও কেউ কেউ। মানে সেদিনের ভ্রমণ সেদিনেই শেষ নয়, তার রেশ টেনে নিয়ে যাওয়া পরবর্তী আর একদিনে আলোচনা, বক্তৃতা, স্লাইড শো আর সেদিনের যাত্রার চলমান ছবি বা ভিডিওর মধ্যে দিয়ে। একটি heritage tour কে এইভাবে ব্যপ্ত করে ছড়িয়ে দেওয়া আরও অনেকের মাঝে পেশাদারী চিন্তা ভাবনার এ এক অনন্য নিদর্শন। সেইজন্যেই বলেছি, সেদিনের সেই ভ্রমণ ছিল এক অসাধারণ ভ্রমণ, যা এ ধরণের অন্য অনেক ভ্রমণের চাইতে অনেক দিক দিয়েই আলাদা।
এতটা পড়ার পরে অনেকেই হয়তো আগ্রহী হবেন সেদিন আমরা কি দেখেছি, কি জেনেছি তা জানতে। পরে হয়ত এই নিয়ে আরও বড় করে কিছু লেখা হবে এই গ্রুপে, তবে আজ সংক্ষেপে কিছু ধারণা দেওয়াই যেতে পারে আমাদের সেদিনের দ্রষ্টব্য স্থানগুলির সম্পর্কে। শুরু হয়েছিল আমহার্স্ট স্ট্রীটের সিটি কলেজের সামনে থেকে যে রাস্তাটির নাম এখন রাজা রামমোহন রায় সরণী, আর যে এলাকাটি একসময় রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের মত যুগ পুরুষদের কর্মকাণ্ডের সাক্ষী। সেখান থেকে শুরু করে প্রথমেই ঝামাপুকুর লেনের দেব সাহিত্য কুটির বাংলা প্রকাশনার প্রথম যুগ থেকে শুরু করে আমাদের ছোটবেলার শুকতারা আর বড়বেলার নবকল্লোলের পথ ধরে যাঁদের বাংলা ও ইংরাজি অভিধান আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ঠিকানা ধরে দেব সাহিত্য কুটিরের শতাব্দী প্রাচীন এই “চমৎকারবাড়ি”তে যে কেউই পৌঁছে যেতে পারেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে কজন জানবেন বাড়ীর সামনের ওই রকটির গুরুত্ব যেখানে একসময় বিদ্যাসাগর মশাই এসে বসতেন, আলোচনা করতেন সমাজ ও সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে? এখানেই এই ধরনের ভ্রমণের সার্থকতা জানার মধ্যে থেকেও অনেক অজানা মনিমানিক্যের খোঁজ পাওয়া। সেখান থেকে ঝামাপুকুরের রাজা দিগম্বর মিত্রের বাড়ী আর রামকৃষ্ণ দেবের এক সময়ের লীলাস্থল, আজকের শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ ছুয়ে, ঠিক এইভাবেই খোঁজ পাওয়া গেল নবজাগরণ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, বাগ্মী সমাজসংস্কারক রামগোপাল ঘোষের প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ীর। ওই এলাকার বিখ্যাত কালীপূজোর বিশাল আলোকোজ্জ্বল মঞ্চের ঠিক পিছনেই সেই জরাজীর্ণ বাড়ীর খোঁজ কে আমাদের দিতেন গৌতম বসু মল্লিক ছাড়া? কে বলতেন একটু পরেই, বর্তমানের প্রায় অপরিচিত জহর সিনেমা হল একসময়ে ছিল বীণা থিয়েটার বলে একটি নাটকের মঞ্চ কাছেই বীণা সিনেমা থেকে যা আলাদা? কে জানাতেন কলেজ স্ট্রিট আর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের সংযোগস্থলের জায়গাটিকে একসময় বলা হত ইহুদি বাজার বা ওই কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের ওপরে, ঠনঠনিয়া কালী বাড়ির কাছে, লাহাদের বিশাল লাল রাজবাড়ীর উল্টোদিকের একটি বাড়ীতে থাকতেন কবি ও সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব? কালীপূজোর সময় ওই এলাকা ভিড়ে উপচে পড়ে। একদিকে ঠনঠনিয়া কালী বাড়ী আর অন্যদিকে বিখ্যাত সার্বজনীন কালী পুজোর দৌলতে, কিন্তু ইতিহাস থেকে যায় সেই অন্ধকারেই। সে অপেক্ষায় থাকে এই রকম কলকাতাপ্রেমী মানুষদের জন্যে। যার সামনে সে নিজেকে আবার নতুন করে উন্মোচিত করতে পারে, নতুন করে পুরনো দিনের কথা শোনাতে পারে।
No comments:
Post a Comment