শঙ্খ চৌধুরী
দেশে-বিদেশের বহু স্থানে শঙ্খ চৌধুরীর ভাস্কর্যকলা প্রদর্শিত হয়েছে।
১৯৪৬: বোম্বাইয়ে প্রথম একক প্রদর্শনী।
১৯৫৪: সমসাময়িক ভাস্কর্যের প্রদর্শনী, আধুনিক শিল্পকলার জাতীয় গ্যালারি।
১৯৫৭: নয়াদিল্লিতে একক প্রদর্শনী।
১৯৬৯: বোম্বাইয়ে একক প্রদর্শনী।
১৯৭১: রেট্রোস্পেক্টিভ শো: ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট।
১৯৭৯: বোম্বাইয়ে ইরা চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনী।
১৯৮৭: নয়াদিল্লি একক প্রদর্শনী।
১৯৮৭: স্কেচ এবং অঙ্কন ইত্যাদির একক প্রদর্শনী, কলকাতা।
১৯৯১: কলকাতায় একক প্রদর্শনী।
১৯৯২: এলটিজি গ্যালারি, নয়া দিল্লিতে একক প্রদর্শনী।
১৯৯৫: বোম্বাইয়ের সাইমরোজা আর্ট গ্যালারিতে - একক প্রদর্শনী
২০০৪: সরোজান আর্ট গ্যালারি দ্বারা আয়োজিত বরোদায় একক প্রদর্শনী।
১৯৪০-এর দশকের অন্যান্য ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত, চিন্তামণি কর বা শঙ্খ চৌধুরী পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে আত্তীকৃত করতে চেষ্টা করেছেন দেশীয় রূপচেতনার ভিত্তির উপর। ছবিতে যেমন নব্য-ভারতীয় ঘরানার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য আত্তীকরণের একটি প্রকৃষ্ট ধারা গড়ে উঠেছিল, ভাস্কর্যে সে রকম কিছু ছিল না। তাই ভাস্কর্যে আত্মপরিচয় সন্ধান পাশ্চাত্য আধুনিকতার সঙ্গে এক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্কে বাঁধা ছিল এবং এখনও রয়েছে ।
মাণিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনিও শিল্পী ও শিক্ষক দুই পরিচয়েই সমান ভাস্বর। শঙ্খ চৌধুরীর পোশাকি নাম ছিল নরনারায়ণ।
জন্ম ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি বিহার রাজ্যের বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে। পিতা সংস্কৃতজ্ঞ নরেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন ঢাকার অ্যাডভোকেট। মাতা কিরণময়ী। তিনি ছিলেন পিতামাতার কনিষ্ঠ সন্তান। শঙ্খ ঢাকায় বাল্যশিক্ষা সমাপ্তির পর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে ভরতি হন এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দেস্নাতক হন। এরপর রামকিঙ্কর বেইজের তত্ত্বাবধানে ভাস্কর্যকলার অনুশীলনে ব্রতী হন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলাভবনের ফাইন আর্টস তথা চারুকলার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্নাতকোত্তর পর্বে তিনি রামকিঙ্করের সাথে নেপালে যান এবং সেখানে তিনি ষুদ্ধ-স্মারক গড়তে রামকিঙ্কর বেইজকে সহায়তা করেন। নেপালের ব্রোঞ্জ ঢালাইয়ের কাজ প্রত্যক্ষ করেন এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করেন।
প্রায় দুবৎসর পর তিনি ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের অনুদান পেয়ে নির্বিঘ্নে সৃজনশীল কর্মে মনসংযোগ করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কুড়িটি শিল্পকর্ম নিয়ে বোম্বাইয়ে প্রথম একক প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এখানে সফলতা পাওয়ার পর তিনি প্রাচীন ও সমকালীন রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ ও অনুশীলনের জন্য ওই বছরেই ইউরোপ গমন করেন। সেই সময়কার আভঁ-গার্দ শিল্প আন্দোলনের কিউবিজম প্রথায় কিছু কাজ তিনি শুরু করার পর প্যারিসে ইভস্থান বেথির দ্বারা প্রভাবিত হন। শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে ঘুরে দেখেন ইটালি, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও হল্যান্ডের শিল্পকেন্দ্রগুলি। এ সকল স্থানের প্রখ্যাত চিত্র ও সংগ্রহশালা পরিদর্শনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং দেশে ফিরে আসেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বরোদার মহারাজা সয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ফাইন আর্টস এর বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। প্রায় কুড়ি বৎসর অধ্যাপনা পর স্বেচ্ছা-অবসর নেন।
শঙ্খ চৌধুরীর ভাস্কর্যকলার আদিপর্বের মাধ্যম ছিল প্রধানত দারু ভাস্কর্য। আবলুস,পাইন, ওক ইত্যাদি কাঠের গড়া ভাস্কর্যগুলিতে "ফর্ম" অর্থাৎ আকার-আকৃতির সংক্ষিপ্ত রূপারোপ ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। শ্বেতপাথর, ব্লাক মার্বেল, লাইমস্টোনে গড়া ভাস্কর্যে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি ব্লাক মার্বেলে খোদিত মসৃণ ভাস্কর্য শৃঙ্গারনেহেরু মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। ধাতুর পাতে গড়া ভাস্কর্যের মধ্যে তামা'য় গড়া কক, অ্যালুমিনিয়াম ও পিতলে গড়া মিউজিক এবং পিতলে গড়া কেমিস্ট তাঁর উদ্ভাবনী মানসিকতার নিদর্শন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রতিকৃতি ভাস্কর্য হল–
- আমার পিতা
- আবদুল গফুর খান
- একজন ইংরেজের প্রতিমৃর্তি
- মহাত্মা গান্ধী
- ইন্দিরা গান্ধী
দিল্লির প্রগতি ময়দানেগ্রামীণ ভারত প্রাঙ্গণ শঙ্খ চৌধুরীর নকশায় তৈরি করা হয়েছে এবং ললিত কলা একাডেমিতে গঠিত স্টুডিও তৈরি হয়েছিল তাঁরই প্রচেষ্টায়। স্মৃতিবিস্মৃতি হল শঙ্খ চৌধুরী রচিত একটি গ্রন্থ।
শঙ্খ চৌধুরী কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে যে যে পদে কর্মরত ছিলেন ও সাম্মানিক পদ অলংকৃত করেন সেগুলি হল–
১৯৪৯-৫৭: রীড়ার ও বিভাগীয় প্রধান, ভাস্কর্য বিভাগ, এমএস ইউনিভার্সিটি অফ বরোদা।
১৯৫২ : প্রথম সাম্মানিক যুগ্ম সম্পাদক - ইন্ডিয়ান সমিতি, বোম্বে।
১৯৫৬: সদস্য,ললিত কলা একাডেমি।
১৯৫৭-৭০: অধ্যাপক ও প্রধান, ভাস্কর্য বিভাগ, এমএস ইউনিভার্সিটি অফ বরোদা।
১৯৬৬-৬৮: ডিন, চারুকলা অনুষদ, এমএস ইউনিভার্সিটি অফ বরোদা।
১৯৭৪: অনারারি সেক্রেটারি,ললিত কলা একাডেমি।
১৯৭৬: ভিজিটিং প্রফেসর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় *১৯৭৭-৭৮: ভিজিটিং ফেলো, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন।
১৯৮০: চারুকলার অধ্যাপক, দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়, তানজানিয়া।
১৯৮৪-৮৯:
পূর্ণকালীন সদস্য, দিল্লি আরবান আর্ট কমিশন।
সদস্য, অল ইন্ডিয়া হস্তশিল্প বোর্ড,
সদস্য আন্তর্জাতিক জুরি,- 5 তম ত্রিণাল-ভারত,
সভাপতি,ললিত কলা একাডেমি।
পুরস্কার ও সম্মাননা
শঙ্খ চৌধুরী শিল্পকর্মের জন্য দেশ বিদেশ হতে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
১৯৫৬: ভারতের ললিত কলা একাডেমির রাষ্ট্রীয় শিল্পকলা পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭১:ভারত সরকার বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী প্রদান করে।
১৯৭৪: ফিলিপাইন্সের সেন্টার এস্কোলার ইউনিভার্সিটি সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করে।
১৯৭৯ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবন-গগন পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮২:ললিত কলা একাডেমি ফেলো নির্বাচিত হন।
১৯৯৭:রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করে।
১৯৯৮ : বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দেশিকোত্তম উপাধি লাভ করেন।
২০০০-০২: মধ্যপ্রদেশ রাজ্য সরকার প্লাস্টিক শিল্পশৈলির জন্য কালিদাস সম্মান প্রদান করে।
২০০২: আদিত্য বিড়লা কলা শিখর পুরস্কার।
২০০৪: "ললিত কলা রত্ন"ললিত কলা একাডেমি কর্তৃক সম্মানিত হন।
২০০৪: "লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড" লিজেন্ড অফ ইন্ডিয়া।
অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব
১৯৬১ : ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে যুগোস্লাভিয়ায় ভাস্করদের আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৬৩ : মকরানায় ললিত কলা একাডেমির ভাস্কর শিবিরের আয়োজন।
১৯৬৪ : পোল্যান্ডে বক্তৃতা সফর; শিল্পী ইউনিয়নের অতিথি হিসেবে রাশিয়া সফর করেছেন।
১৯৬৯ : ললিত কলা আকাদেমির জন্য "ভারতের লোক ও উপজাতীয় চিত্র" প্রদর্শিত।
১৯৭২ : অল ইন্ডিয়া হস্তশিল্প বোর্ডের পক্ষ থেকে সংগঠিত পল্লী ভারত কমপ্লেক্স।
১৯৭৪ : আরব শিল্পীদের প্রথম দ্বিবার্ষিকীতে অংশগ্রহণ।
১৯৭৬ : ইংল্যান্ডের ডার্লিংটন, টেগোর সেমিনারে অংশগ্রহণ।
১৯৭৬-৭৭: ললিত কলা আকাদেমির জন্য গাড়িতে সংগঠিত শিল্পীদের স্টুডিও।
১৯৮২ ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে অংশ নেওয়া, ভারতের উৎসবে বইয়ের প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
১৯৮৩ : আন্তর্জাতিক আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাগদাদে আমন্ত্রিত- জুরি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৫ : ইউনেস্কো, প্যারিস সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব - লোককাহিনী ditionতিহ্যের সংরক্ষণ।
১৯৮৫ : পরিদর্শন বুখারেস্ট - গ্রাম জাদুঘর।
১৯৮২ : ইউনেস্কো, ভেনিসের পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৮৬ : ওসলো, লিলহ্যামার এথনোগ্রাফিক মিউজিয়াম পরিদর্শন এবং খোলা - ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে এয়ার মিউজিয়াম।
১৯৮৮ : জাপান পরিদর্শন করেন, ফেলো হিসাবে এবং ইন্দোনেশিয়া সফর করেন।
১৯৮৯ : চীনা জনগণের আমন্ত্রণে চীনে একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন - বিদেশী দেশের সাথে বন্ধুত্বের জন্য সোসাইটি॥
ভাস্কর হিসেবে শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন মুক্তমনের এবং আধুনিক চিন্তার মানুষ। বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, মাধ্যম সবকিছু নিয়েই নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে থাকতেন তিনি। নির্দিষ্ট কোনো ঘরানায় বিশ্বাস ছিল না তাঁর। প্রতিটি কাজেই নিজের করা আগের কাজটিকে অতিক্রম করতে চাইতেন। শিক্ষক রূপেও ছিলেন অতুলনীয়। শিক্ষার্থীদের মনের ওপর কোনো ধারণা বা মতামত জোর করে চাপিয়ে দিতেন না তিনি। শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন এমনই এক ভাস্কর যিনি বিশ্বশিল্পের গতিপ্রকৃতিকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে, তাকে নিজের মননে ও চিন্তায় ধারণ করেছিলেন। তাই তাঁর কাজকে কোনো তত্ত্বের মধ্যে ফেলে বিচার করলে ভুল করা হবে। শঙ্খের ভাস্কর্যে একদিকে যেমন গুরু রামকিঙ্করের চেতনা লুকিয়ে আছে, তেমনিই অন্যদিকে নিহিত আছে ব্রাঁকুসির ভাস্কর্যের মসৃণ বিমূর্ততা। বস্তুর আকৃতিকে তিনি সরলতা দান করে তার অন্তরের রূপটিকে প্রকাশিত করতে চাইতেন। আবার কোনো ব্যক্তির মুখাবয়ব নির্মাণ করার বেলায় শঙ্খ বেছে নিতেন অমসৃণতা। মার্বেল, পোড়ামাটি, ধাতু, কাঠ, সিমেন্ট সব মাধ্যমেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। এমন আন্তর্জাতিক মানের একজন ভাস্কর জন্মদিন শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি।
======{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}=======
No comments:
Post a Comment