শৈলবালা ঘোষজায়া
"চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও যে দু: সাহসিক সাহিত্য চর্চার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন, তার জন্য শৈলবালা ঘোষজায়াকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। অনেকটা আড়ালে চলে গেলেও তিনি চিরজীবী হয়ে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।"
সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ---
"আমি নামের পরে ঘোষজায়া কেন লিখি জান? শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে, আমিই ওদের নতুন বউ শৈলবালা ঘোষ। ওসব লেখাটেখার ওরা ধার ধারত না, খবরও রাখত না। এই সাক্ষাৎকার ধরেই আমরা যদি পিছনে হেঁটে যাই, দেখতে পাবো কি অসম্ভব প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে গৃহবধূ শৈলবালা ঘোষ থেকে লেখিকা শৈলবালা ঘোষজায়া'য় উত্তরণ ঘটেছিল তাঁর? ফিরে যাই তাঁর সেই সংগ্রামী জীবনে। ..."
জন্ম ২ রা মার্চ ১৮৯৪. কক্সবাজার, বাংলাদেশ।পিতার কর্মস্থল বাংলাদেশের কক্সবাজারে
জন্মগ্রহণ করেন। পরে পিতা, ডাক্তার কুঞ্জবিহারী নন্দী অবসর গ্রহণ করে বর্ধমান জেলায় চলে আসেন। তার বাল্যকাল বর্ধমানে অতিবাহিত হয়। ১৯০৭ সালে বর্ধমানের মেমারী গ্রামের নরেন্দ্রমোহন ঘোষের সাথে তার বাল্য বিবাহ হয়। তিনি বর্ধমান রাজ বালিকা বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী ছিলেন। পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা পান। বিবাহের পরে লেখাপড়ার পরিবেশ ছিলনা কিন্তু তিনি লুকিয়ে রাত জেগে পড়তেন ও লিখতেন। সংসারের সব কাজ শেষে রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে লণ্ঠনের আলোয় চলতো শৈলবালার সাহিত্য সাধনা। এভাবেই ১৮ বছর বয়সে শৈলবালা লিখলেন তাঁর প্রথম গল্প---"বীণার সমাধি।" সে লেখার জন্য একটি পুরস্কারও পান তিনি। এরপর ২০/২১ বছর বয়সে লিখলেন আন্দু নামে এক মুসলিম যুবকের সঙ্গে জ্যোস্না নামের এক হিন্দু তরুণীর প্রেম নিয়ে প্রথম উপন্যাস---"শেখ আন্দু।" এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তাঁর স্বামী নিজে পাঠিয়ে দেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত "প্রবাসী" পত্রিকার দফতরে। উপন্যাসটি মাসিক "প্রবাসী" পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে ফাল্গুন সংখ্যা পর্যন্ত ১১টি কিস্তিতে ৩২টি পরিচ্ছেদে প্রকাশিত হয়। প্রথমে উপন্যাসটির নামের বানান ছিল--- "সেখ আন্দু", লেখিকা---শৈলবালা ঘোষ। পরে পাল্টে হয়---"শেখ আন্দু" এবং জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে লেখিকার নাম --শৈলবালা ঘোষজায়া।
শেখ আন্দু উপন্যাসটি লিখে স্বামীর হাত দিয়ে তিনি প্রবাসী পত্রিকায় পাঠান। এই রচনাটিই তাকে খ্যাতি এনে দেয়। বাংলা নারী প্রগতিশীল সাহিত্যে শৈলবালা ঘোষজায়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন।
১৩২১ বঙ্গাব্দে শৈলবালা শেখ আন্দু উপন্যাসটি লিখে প্রবাসী (পত্রিকা) তে পাঠালে সেটি পরের বছর প্রকাশিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যজগতে আলোড়ন তোলে। এই আধুনিক চিন্তার উপন্যাসের নায়ক দরিদ্র মুসলিম ও নায়িকা হিন্দু। এই উপন্যাসের পর তিনি রক্ষণশীল সমাজের আক্রমণ ও সমালোচনার সম্মুখীন হন। কবিকঙ্কন চন্ডীর ওপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে সরস্বতী উপাধি পান তিনি। শৈলবালা ঘোষজায়ার প্রকাশিত ৩৮ টি গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন মাসিকপত্রে উপন্যাস, আত্মজীবনী ছোটগল্প ইত্যাদি প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে। শিশুদের জন্যে রহস্য উপন্যাসও লিখেছেন তিনি।
এরপর তিনি কয়েকটি গল্প-উপন্যাস লেখেন, যেগুলি "বঙ্গশ্রী" পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পরে বই আকারে বের হয়। লেখালেখি করে তাঁর আয়ও হতে থাকে। সংসারে দু'একজন দেওর ও ভাসুরপো ছাড়া সবাই তাঁর সাহিত্য চর্চার বিরোধিতা করতে থাকে। ইতিমধ্যে উপার্জনহীন স্বামী কলকাতায় আসেন হোমিওপ্যাথি পড়তে এবং পাশাপাশি শেখেন শর্টহ্যাণ্ড টাইপ রাইটিং আর লেখালেখি করে সে সবের খরচ যোগান শৈলবালা। এরপর তাঁর স্বামী রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যান। শৈলবালার বয়স তখন ২৬ বছর। তবুও অদম্য উৎসাহে শৈলবালা নিজের লেখালেখি চালিয়ে যান। এই সময় শৈলবালার চরম দু: খের দিন শুরু হয়। পাগল স্বামী মারধোর করতে থাকেন।
শৈলবালার ভাষায়, ---
১৩২৭ সাল আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বৎসর। স্বামী ঘোর উন্মাদ---দুর্দান্ত। সেই সুযোগে আত্মীয়রা সম্পত্তির ভাগ ঠকিয়ে নিচ্ছে। আমার ওপর চলছে অমানুষিক অত্যাচার। আমার স্বামী মাথায় এমনকি জোরে আঘাত করলেন যে, মনে হল চোখ দুটি বুঝি ঠিকরে বেরিয়ে এল। ক্ষীণ হয়ে গেল দৃষ্টিশক্তি, উ: মাথায় কী যন্ত্রণা!
এই ঘটনার পর তাঁর দাদা মেজর অশ্বিনী কুমার নন্দী পুলিশের সাহায্যে উদ্ধার করে নিজের বর্ধমানের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর ১৩৩৩ সালে শাশুড়ির মারা যাবার পর তিনি ফের শ্বশুরবাড়ি মেমারিতে ফিরে যান। এর ৩ বছর পর ১৩৩৬ সালে তাঁর পাগল স্বামীর মৃত্যু হয়। এরপর শ্বশুরবাড়িতেও চলে অত্যাচার। শেষে সংসার ছেড়ে আশ্রয় নেন রামচন্দ্রপুরে বিজয়কৃষ্ণ আশ্রমে।
নানান্ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও শৈলবালা যে সব গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, তা হলো--- "শেখ আন্দু", "মঙ্গল ঘট", "আড়াই চাল", "শান্তি", "মনীষা", "নমিতা", "ইমানদার", "বিভ্রাট", অবাক", "স্নিগ্ধা", "বিনীতাদি", "চৌকো চোয়াল", "রঙিন ফানুস", "জয় পতাকা", "তেজস্বতী", "অন্তরের পথে", "বিপত্তি" ও "অভিশপ্ত সাধনা।" পেয়েছেন "সরস্বতী", "রত্নপ্রভা", "সাহিত্য-ভারতী" উপাধি।
শ্বশুরগৃহে সাহিত্যচর্চা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, তার স্বামী নরেন্দ্রমোহন তার সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নরেন্দ্রমোহন উন্মাদ রোগাক্রান্ত হয়ে যান ও তার আক্রমনে শৈলবালা নিজে এক চোখের দৃষ্টি হারান। স্বামী মারা গেলে তিনি একটি আশ্রমে থেকে লেখালিখি চালিয়ে গিয়েছিলেন দীর্ঘকাল অবধি। তার সাহিত্যসেবার জন্যে নদীয়ার মানদ মন্ডলী তাকে 'সাহিত্য ভারতী' ও 'রত্নপ্রভা' উপাধি প্রদান করে। কলকাতার স্নাতক মহিলা সংস্থা ও সাহিত্যকার যৌথ উদ্যোগে লীলা মজুমদার এবং মহাশ্বেতা দেবীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সাহিত্যিক সম্বর্ধনা সভায় তাকে সম্মানিত করা হয়।
শেষ জীবন তিনি পুরুলিয়া জেলার মুরারডির নিকট রামচন্দ্রপুর শ্মশানে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামাঙ্কিত আশ্রমে কাটান। বিপ্লবী অন্নদাপ্রসাদ বা স্বামী অসীমানন্দের তৈরী এই আশ্রমে তিনি থাকতেন। ১৯৭৪ সালে মারা যান শৈলবালা ঘোষজায়া।
বাংলা ১৩২২ সনে মুসলিম যুবকের সঙ্গে হিন্দু যুবতীর দু: সাহসিক প্রেম নিয়ে লেখা "শেখ আন্দু" উপন্যাসের লেখিকা শৈলবালা যে কতটা সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়! তবুও "বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা" নামক ৫৭৭ পৃষ্ঠার ভারি বইয়ের পাতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক লেখক শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় "স্ত্রী-ঔপন্যাসিক" হিসেবে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী ও শৈলবালা ঘোষজায়া সম্পর্কে তিনটি বাক্যে মূল্যায়ণ করেছেন।
তিনি লিখছেন, ---
"প্রভাবতী দেবী সরস্বতী ও শৈলবালা ঘোষজায়া অনেকগুলি উপন্যাস রচনা করিয়াছেন। কিন্তু ইহাদের মধ্যে নূতন ধারা প্রবর্তনের বিশেষ কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। মোটের উপর ইহারা সকলেই কম বেশী পুরাতন আদর্শ-সংঘর্ষের যুগে পুরাতনেরই পোষকতা করেন।"---বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-২৮৪: শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়।
======{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}====
No comments:
Post a Comment