জোশুয়া মার্শম্যান
১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ওয়েস্টবারি লী-তে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক ইতিহাস সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না, শুধু এই তথ্যটুকু পাওয়া গেছে যে তার কোনো এক পূর্বপুরুষ সম্ভবত অলিভার ক্রমওয়েলের সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন এবং ইনি ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিবেক দংশনের কারণে সমস্ত ঐহিক উচ্চাকাংক্ষা ত্যাগ করে স্বদেশের এক গ্রামে অল্প সম্বল নিয়ে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন।
তার বাবা জন মার্শম্যান নাবিক ছিলেন এবং ক্যাপ্টেন বণ্ডের নেতৃত্বে কুইবেক অধিকারের যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মারি কুজেনারকে বিয়ে করেন। মারি ছিলেন জন্মসূত্রে ফরাসি, তার পরিবার ফ্রান্সে নান্তেস অনুশাসন রদ হওয়ার পর ইংল্যাণ্ডে আশ্রয় নেন। বিয়ের পর জন উইল্টশায়ার জেলার ওয়েস্টবারি লী-তে তাঁতির কাজ নেন।
এই পেশায় জনের পসার ভালো হয়নি, ফলে তিনি ছেলে জোশুয়াকে গ্রামের স্কুলের বাইরে কোনো উচ্চতর শিক্ষা দিতে পারেননি।
১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে জোশুয়া ও হ্যানা মার্শম্যানের বিয়ে হয় এবং তারা ১৭৯৪ খ্রিঃ ব্রিস্টল শহরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে ব্রোডমীড ব্যাপটিস্ট গির্জার সদস্য হিসেবে জোশুয়া মার্শম্যান ঐ গির্জার অধীনস্থ একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি ব্রিস্টল ব্যাপটিস্ট কলেজে তিনি ছাত্র হিসেবেও যোগ দেন।
১৭৯৯ খ্রিঃ ২৭শে মে জোশুয়া, হ্যানা ও তাদের দুই সন্তান পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে "ক্রাইটেরিয়ন" নামক জাহাজে চড়ে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে ফরাসি নৌবাহিনীর তরফ থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি এবং মার্শম্যান পরিবার ১৩ই অক্টোবর কলকাতার কয়েক মাইল উত্তরে শ্রীরামপুরের ড্যানিশ উপনিবেশে নিরাপদে অবতরণ করেন।
শ্রীরামপুরে আসার পর মার্শম্যান দম্পতির আরও দশটি সন্তান হয়, যদিও তাদের পিতা মৃত্যুকালে বারো ভাইবোনের মাত্র পাঁচজনকেই জীবিত অবস্থায় দেখে যান। সর্বকনিষ্ঠ কন্যা হ্যানা হেনরি হ্যাভলককে বিয়ে করেন; হেনরি পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ভারতে একজন সেনানায়কের পদ লাভ করেন। লণ্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে তার মূর্তি রয়েছে।
সহবাসী: হ্যানা মার্শম্যান
বই:
Elements of chinese grammar: with a preliminary dissertation on the characters and the colloquial medium of the Chinese, an an appendix containing the Ta-hyoh of Confucius with a translation.
সন্তান: জন ক্লার্ক মার্শম্যান, হান্নাহ শেফার্ড মার্শম্যান
নাতি ও নাতনি: unknown daughter Havelock, Ettrick Havelock, জর্জ ব্রডফুট হ্যাভলক, আরও বেশি
প্রপৌত্র ও প্রপৌত্রী: জর্জ এরিক হ্যাভলক, হেনরি হ্যাভলক, Beresford Arthur Jardine Havelock
তার বিশিষ্ট বন্ধু ও সহকর্মী উইলিয়াম কেরির মতোই মার্শম্যানও একজন মেধাবী ও বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। মার্শম্যান ও কেরি যুগ্মভাবে বাইবেল গ্রন্থটি অনেকগুলো ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ধ্রুপদী ভারতীয় সাহিত্যের প্রচুর বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
এই সময়ে মার্শম্যান বাইবেলের একটি চীনা অনুবাদও সম্পন্ন করেন এবং প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোর উন্নতিতেও বিশেষ ভূমিকা নেন। শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবনের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন তিনি, এবং স্থানীয় অধিবাসীদের স্কুলে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, যদিও তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের সমর্থন ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের দিকে ঝুঁকছিল।
১৮১৮ খ্রিঃ ৫ই জুলাই উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড (ধর্মপ্রচারক দলের আরও একজন সদস্য) একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। এই বিবৃতিতে "প্রাচ্য সাহিত্য ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান বিষয়ে এশীয়, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য যুবকদের শিক্ষাদানের জন্য একটি নতুন কলেজ" প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। বিবৃতিটির লেখক ছিলেন মার্শম্যান স্বয়ং। এই বিবৃতির উপর ভিত্তি করেই শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও সক্রিয় আছে।
কলেজে অর্থ সরবরাহ প্রায়ই যথেষ্ট হত না। বিশেষ করে এক সময় কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অর্থের অপব্যবহারের মিথ্যা অভিযোগ ওঠার ফলে ওয়ার্ডের মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত অর্থ সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে কেরি লেখেন, "ডঃ মার্শম্যান আমার মতোই গরীব, আর য়ুরোপে কয়েকজন দুঃস্থ আত্মীয়ের সাহায্যের জন্য ন্যূনতম অর্থ পাঠানোও আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। আমি অনেক সম্পত্তির মালিক হতে পারতাম, কিন্তু অন্ন-বস্ত্রের বাইরে সমস্ত কিছুই ধর্মপ্রচারণার কাজে দান করে দিয়েছি, আর ডঃ মার্শম্যানও তাই করেছেন, আর শ্রীযুক্ত ওয়ার্ডও তাই করেছেন।"
১৮০০ খ্রিঃ কেরির সাথে মার্শম্যানের প্রথম সাক্ষাতের সময় কেরির চার ছেলের বয়স ছিল ৪, ৭, ১২ ও ১৫ বছর। কেরি তার পুত্রসন্তানদের নিতান্ত অবহেলায় রাখতেন দেখে মার্শম্যান ব্যথিত হন। তারা ছিল অমার্জিত, বিশৃঙ্খল, এমনকি অশিক্ষিত। কেরি যখন তার বাগান পরিচর্যা করতেন, নানা ধর্মপ্রচারণা কাজে ব্যস্ত থাকতেন বা ফোর্ট উইলিয়ামে পড়াতে কলকাতায় যেতেন, তখন মার্শম্যান, তার স্ত্রী হ্যানা ও উইলিয়াম ওয়ার্ড ছেলেগুলির দেখাশোনা করতে থাকেন। তাদের অভিভাবকত্বের সার্থকতার প্রমাণস্বরূপ কেরির চার ছেলের প্রত্যেকেই পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন।
জোশুয়ার ছেলে জন ক্লার্ক মার্শম্যান পরবর্তীকালে শ্রীরামপুর কলেজের ধর্মপ্রচারণা কর্মকাণ্ডে বিশিষ্ট ভূমিকা নেন। এছাড়া তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষার অনুবাদের কাজেও যুক্ত ছিলেন। তার প্রকাশিত নাগরিক আইনের নির্দেশিকাটি মেকলের কাজের আগে পর্যন্ত ভারতীয় আইনের প্রধান নথি হিসেবে ব্যবহৃত হত। জন ১৮৪২ খ্রিঃ ভারতের ইতিহাসের একটি বইও লিখেছিলেন। তার লেখা বই কেরি, মার্শম্যান অ্যাণ্ড ওয়ার্ড -এ জন মার্শম্যান বলেন যে তার পিতা মৃত্যুকাল অবধি নিজের অর্থের প্রায় চার লক্ষ পাউণ্ড ভারতে ধর্মপ্রচারণা কাজে খরচ করে গিয়েছিলেন।
জোশুয়া মার্শম্যান ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর হুগলির শ্রীরামপুরে মারা যান।
একনজরে
প্র : জোশুয়া মার্শম্যান-এর জন্ম তারিখ কথ ?
উ : ২০শে এপ্রিল, ১৭৬০।
প্র : তিনি কোথায় জন্ম গ্রহণ করেন?
উ : ওয়েস্টবেরিলি, উইলট শায়ার লন্ডন।
প্র : তাঁর কী কী ভাষায় দক্ষতা ছিল?
উ : ভারতীয় ভাষা ছাড়া গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু ও সিরিয়াক ইত্যাদি।
প্র : তিনি প্রথম কোথায় কর্মরত ছিলেন?
উ : লন্ডনের পুস্তক ব্যবসায়ীর দোকানে।
প্র : তিনি যাজকতায় দীক্ষিত হন কত সালে?
উ : ১৭৯১-এ।
প্র : তিনি কখন মিশনারির কাজে ভারতে আসেন?
উ : ১৭৯৯-এ। শ্রীরামপুরের মিশনে কাজে নিযুক্ত হন।
প্র : তিনি কোন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন?
উ : চিনা ভাষায়।
প্র : তিনি কেরির সহযোগিতায় কী অনুবাদ করেন?
উ : সংস্কৃত রামায়ণ।
প্র : তিনি কোন কোন পত্রিকার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন?
উ : সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পন’, ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’ ও ‘দিগদর্শন’ পত্রিকা।
প্র : ‘দিগদর্শন’-এর সম্পাদনা সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘দিগদর্শন’ (১৮১৮) শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত এবং জোশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান কর্তৃক সম্পাদিত। এখানে ছাত্রদের জন্য ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হতো।
প্র : তাঁর মৃত্যু সাল কত?
উ : ৫ই ডিসেম্বর, ১৮৩৭।
=================================
No comments:
Post a Comment