বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
"তুমি মাটির দিকে তাকাও প্রতীক্ষা করছে
তুমি মানুষের হাত ধরো সে কিছু বলতে চায়."
৪০ এর শক্তিমান কবি সমাজ ও সময়ের স্রোতে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পেয়েছেন বাস্তবের পলি মাটি, নির্মাণ করেছেন অতি বিরল বিদ্রোহের প্রতিবাদের আক্রশের রোমান্টিকতার কবিতা- তথা তাঁর কাব্য ভুবন। গর্জে উঠেছেন ফুটপাতে ন্যাংটো ছেলেদের অনাহার ক্লিষ্ট অবস্থা দেখে আবার কখনো সহজাত জীবনকে ভালোবেসে রচনা করেছেন তিন পাহাড়ের স্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ ।ভুখা মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিবাদে প্রতিসরে চিৎকার করে উঠেছেন জ্বলুক সহস্র চিতা এ পাড়ায় ও পাড়ায় আবার কখনো তিনি বলে উঠেছেন খাদ্য সংকটের হাহাকারে - ৭৬ এর মন্বন্তরের অবস্থা দেখে - মুন্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে। ধর্ম ও অধর্মের পাশা খেলায় মানুষের জীবন যখন বিপন্ন অসহায় ধর্মান্ধতার গলিতে মাথা খুঁড়ে মরে সাধারণ মানুষের বোধ বুদ্ধি জীবনচরিত তখনও কবি কে বলতে শুনি- রাস্তা কারুর একার নয়।। অথচ ভারতবর্ষ তাদের এমনও কবি র স্লোগান যেন মিছিলের মুখ হয়ে ওঠে । আবার কারুকার্যময় শিল্প ময়তায় কবির কাব্য ভাষা আঙ্গিক একটি নতুন মাত্রা এনে দেয়। যেখানে চল্লিশের দশকের কবিদের দুটো ধর্মই প্রধান -এক) সমাজ বাস্তবতা এবং দুই) উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তিরিশের কবিদের প্রতি মন ও মেজাজ। মূলত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমাজ বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে মানুষ স্বদেশ ও মানবিকতাকে তার কাব্য কবিতায় প্রধান গুরুত্ব দিয়েছেন। আজীবন তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন সেইসব মানুষের সুখ দুঃখময় ইতিহাস বিশেষ করে শোষিত মানুষ অমল মানুষ স্রষ্টাশীল মানুষ তার কবিতায় জায়গা পেয়েছে নতুন মাত্রা নিয়ে। আবার তিনি রোমান্টিকতায় যেমন ভালোবেসে নারীকে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছেন তেমনি সহজাত প্রকৃতির অপূর্ব মায়ায় সাঁওতাল জীবনকে একাত্ম করে নিয়েছেন প্রকৃতিকে দেখেছেন তিনি কখনো আশ্রয় কখনো প্রতিরোধে কখনো সৌন্দর্য বোধে কখনো বিশ্বাসে আবার কখনো নির্জনতায়। এমনতর কবির আজ মহাপ্রয়াণ দিবস। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি দোসরা সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন যেমন সাড়ম্বরে পালন করেন আজকের দিনটিও ঘরোয়া ভাবে হলেও তারা পালন করেন বিশেষ করে জামাতা অমিত রায়। এবং ছোট কন্যা মিত্রা চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে অনেক গুণমুগ্ধ সহৃদয় পাঠক কবি বন্ধুরাও যুক্ত থাকেন। চট্টোপাধ্যায় একটা বিশেষ বাংলা সাহিত্যে ঘরা না এই ঘরানা মূলত মানুষের মূল্যবোধ ও স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সৃষ্টির মহিমায় গড়ে তোলে রচনার অমরাবতী। শুদ্ধ কবিতা গুলোর প্রতি একটু নজর দেব -
ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে
ঘর ফুটপাথ
আহার বাতাস,
ন্যাংটো ছেলেটা
দেখছে আকাশ ।
সেখানে এখন
টেক্কা সাহেব
বিবি ও গোলাম—
রাজ্যের তাস
সবাই ব্যস্ত ;
সবাই করছে
চাঁদ-সূর্য ও
তারাদের চাষ ;
সবাই চাইছে
রাজত্ব, আর
সবাই লিখেছে
দারুণ গল্প ।
সেই শুধু ফুট-
পাথের ন্যাংটো
ছেলে, তাই তার
বুদ্ধি অল্প—
দূর থেকে তাই
দেখেছে দৃশ্য,
দেখছে এবং
দিচ্ছে সাবাস!
রাস্তা কারও একার নয়
ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে বলে রাস্তা ছাড়াে!’ বিজ্ঞান কি রাস্তা ছেড়ে দেয়?
পােপের ভয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। সারাদিন
একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতেন গ্যালিলিও গ্যালিলেই ;
তাঁকে পাহাড়া দেবার জন্য বসে থাকতাে একজন ধর্মের পেয়াদা, যার
চোখের পাতা বাতাসেও নড়তাে না।
বিজ্ঞান কি তখন থেমে ছিল? তীর্থের পাণ্ডাদের হই হই, তাদের লাল
চোখ কি পেরেছিল পৃথিকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে, সূর্যকে
তার চারদিকে ওঠবােস করাতে?
ধর্ম যতদিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস দেয়, ততদিন
রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না। রাস্তা কারও
একার নয়।
বরং তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়, যার স্পর্ধা আকাশ
ছুঁয়ে যায়।
বিজ্ঞান যখন প্রেমের গান ভুলে ভাড়াটে জল্লাদের পােশাক গায়ে চাপায়, আর
রাজনীতির বাদশারা পয়সা দিয়ে তার ইজ্জত কিনে নেয়,
আর তার গলা থেকেও ধর্মের ষাঁড়েদের মতােই কর্কশ
আদেশ শােনা যায় : ‘রাস্তা ছাড়াে! নইলে –
পৃথিবীর কালাে সাদা হলুদ মানুষের গান, তাদের স্বপ্ন
এক মুহূর্ত সেই চিঙ্কার শুনে থমকে তাকায়।
তারপর যার যেদিকে রাস্তা, সেদিকে মুখ করেই তারা সামনে,
আরও সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কেউ কারােকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না, যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে,
গানের মানুষ থাকে, স্বপ্ন থাকে..
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধ’রে
একটা বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটা গাছ জন্মাতে পারতাম
যেই গাছ ফুল হয়, ছায়া দেয়
যার ফুলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে পাখিদের
ক্ষুধা মেটে ;
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম !
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজও ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর, আমরা সারা রাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে
প্রার্থনায়, সারা রাত।
রচনা কর্ম :
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ ঘটে কবির বাইশ বছর বয়সে। কাব্যটির নাম 'গ্রহচ্যুত' (১৯৪২)। এরপর থেকে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত অনেকগুলি কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর কাব্যগুলির নাম যথাক্রমে- 'গ্রহচ্যুত' (১৯৪২), 'রাণুর জন্য' (১৯৫১), 'উলুখড়ের কবিতা' (১৯৫৪), 'মৃত্যুত্তীর্ণ' (১৯৫৫), 'লখিন্দর' (১৯৫৩), 'জাতক' (১৯৫৮), 'তিন পাহাড়ের স্বপ্ন' (১৯৬৩), 'সভা ভেঙে গেলে' (১৯৬৪), 'মুখে যদি রক্ত ওঠে' (১৯৬৪), 'ভিসা অফিসের সামনে', 'মহাদেবের দুয়ার' (১৯৬৭), 'ওরা যতই চক্ষু রাঙায়' (১৯৬৮), 'নভেম্বর-ডিসেম্বরের কবিতা' (১৯৬৮), 'মানুষের মুখ’ (১৯৬৯), 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৭০), 'মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে' (১৯৭১), 'আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা' (১৯৭২), 'রাস্তায় যে হেঁটে যায়' (১৯৭২), 'মানুষ-খেকো বাঘেরা লাফায়' (১৯৭৩), 'এই জন্ম, জন্মভূমি', 'জ্বলুক সহস্র চিতা অহােরাত্র এপাড়া ও-পাড়ায়' (১৯৭৩), 'ভিয়েৎনাম ও ভারতবর্ষ' (১৯৭৪), 'বাহবা সময় তাের সার্কাসের খেলা' (১৯৭৪), 'পৃথিবী ঘুরছে' (১৯৭৫), 'শীত বসন্তের গল্প' (১৯৭৬), 'বেঁচে থাকার কবিতা' (১৯৭৭), 'ন্যাংটো ছেলের সূর্য নেই' (১৯৭৭), 'সায়েরী' (১৯৮০) 'ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে’ (১৯৭৮), 'নীলকমল-লালকমল' (১৯৭৮), 'দিবস রজনীর কবিতা' (১৯৭৮), 'আমাদের ইতিহাসের স্যার এবং তাপ্পি আর ওভারকোটের গান' (১৯৭৮), 'আমার কবিতা' (১৯৮৫), 'অফুরন্ত জীবনের গান' (কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত, ১৯৮৬)।
জীবনে অনেক কবিতা রচনা করেছেন, কাব্যও প্রকাশিত হয়েছে অনেক। কিন্তু সম্বর্ধনা ও পুরস্কার খুব বেশি জোটেনি। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেছিলেন। কবি তার কবিতার সম্ভার নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে যেভাবে চেয়েছিলেন, সেভাবে তিনি হয়তাে পৌঁছুতে পারেননি-তবে এতে তার ক্ষোভ ছিল না। তিনি এজন্য দায়ী করেছেন স্বার্থপর মানুষদের সমাজব্যবস্থাকে—সাধারণ মানুষকে নয়।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় কবির বাইশ বছর বয়সে। তখনাে কবির কাব্য-প্রতিভার সম্যক বিকাশ ঘটেনি। কবির প্রথমদিকের রচনাগুলিতে কবি বিষ্ণু দের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কবি নিজেও একাধিক প্রসঙ্গে কবি বিষ্ণু দের নিকট তার ঋণ স্বীকার করেছেন—তবে তিনি সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠেছেন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'লখিন্দর' কাব্য থেকে। এই কাব্যে কবির কবি-প্রতিভার স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষিত হয়।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাস্তববাদী কবি ; বাস্তব জীবনের প্রতি আকর্ষণ তাকে কল্পনার জগতের দুরধিগম্যতা থেকে নামিয়ে এনেছে মাটির কাছাকাছি। তিনি প্রজাপতির পাখির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হতে চাননি-তিনি মগ্ন হতে চেয়েছেন কৃষক-শ্রমিকের দারিদ্র লাঞ্ছিত কুটিরের উঠোনে জন্মানাে আগাছার রূপে। বিশ্বসংসারের নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা মানুষের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়--কবি ছুটে চলেছে সেই বেদনা-খিল্প জীবনের রূপ আবিষ্কারে। তাই তাঁর কবিতায় বেদনার ছবি-হতাশার দীর্ঘশ্বাস।
কবি মানুষের ব্যথা-বেদনার রূপকার ; তিনি তাঁর কবিতায় ব্যথার ছবি এঁকেছেন—ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত মনকে প্রবােধ দিয়েছেন। কিন্তু ব্যথা-বেদনার নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। এবং গড়ে তুলতে চেয়েছেন নতুন আশার পৃথিবী। 'লখিন্দর' কাব্যের ‘বেহুলা' কবিতায় বেহুলার আশার পৃথিবীকে কবি তুলে ধরেছেন—
‘সে জাগবে। জাগবেই। আমি তাকে কোলে নিয়ে
বসে আছি রক্ত-পুঁজে মাখামাখি রাত্রি
ভেলায় ভাসিয়ে।'
লখিন্দরের মৃতদেহ তাে আজকের পৃথিবীর আশাহত মানুষের রূপক—স্বার্থান্ধ মানুষের অত্যাচার-অবিচারে প্রাণ দিতে হয় যে লখিন্দরদের, তাকে বাঁচিয়ে আনতে হবে বেহুলাকে। বেহুলার বুকের আশায় কবি ভাষা দিয়েছেন—তাই কবি বীরেন্দ্র দুঃখবাদী হয়েও আশাবাদী।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরাণের নতুন মূল্যায়নের ওপর মাত্রা আরােপ করেছে। পুরাণ কাহিনির মধ্যে তিনি লক্ষ করেছেন জীবনের সনাতন সত্যকে ; সেই সত্যকে তিনি রূপায়িত করতে চেয়েছেন বর্তমান জীবনের পটভূমিকায়। তিনি আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেননি ; জীবনের যন্ত্রণা ও তার উপশমের উপায়কে বিশ্বাস করেছেন। কবি তাই তার অধিকাংশ কবিতায় জীবনের যন্ত্রণাকে প্রতিফলিত করেছেন। 'লখিন্দর', 'জাতক' প্রভৃতি কাব্যে এই জীবনযন্ত্রণার রূপায়ণ ঘটেছে। সেইসঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে ব্যথাদীর্ণ মানুষের কাছে কবির আশা ও আকাঙ্কার বাণী যে বাণী মানুষকে আকৃষ্ট করবে ভবিষ্যতের স্বপ্নের পৃথিবীর কল্পনায়।
কবি সমকালীন জীবনের চিত্র অঙ্কন করেছেন ; এই চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন পৃথিবীর মানুষের ক্ষুধার রূপ। অগণিত মানুষের ক্ষুধার জ্বালা আজ পৃথিবীর বুকে হাহাকার ছড়িয়ে দিচ্ছে—ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতে মানুষকে আজ যন্ত্রের শিকারে পরিণত হতে হয়। স্বার্থান্ধ ক্ষমতালােভী মানুষেরা গ্রাস করছে পৃথিবীর শাস্তির মাটি মানুষকে তারা টাকার বিনিময়ে পণ্যের মত কিনে নেয়। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উচ্চকণ্ঠে তাঁর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবি যদিও জানেন, তাঁর এই প্রতিবাদ মদগর্বিত মানুষদের কানে গিয়ে পৌঁছবে না-তবু কবি বিশ্বাস করেন একদিন পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তির মন্দাকিনী। তবে তা সাধিত হবে ক্ষয়-মৃত্যু-ধ্বংসের মধ্য দিয়ে—জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে সূচিত হবে নবজন্মের উন্মেষ।
পৃথিবীকে বড় বেশি ‘অবাক’ যেমন মনে হয়েছিল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবনধারণ করে বেঁচে থাকাটাই কবি বীরেন্দ্রবাবুর কাছে ‘অদ্ভুত’ বলে মনে হয়। এ কারণেই কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রেমের প্রকাশভঙ্গি বদলে যায়, ছাপ পড়ে চারপাশের চলমান জীবনের ছবি—
মাঝে মাঝে মালটানা গাড়ির শব্দ,
কুকুরের কান্না!
তোমার রাতের ঘুমের পাশে আমার রাত্রি জাগরণ।
অদ্ভুত এই পৃথিবীতে জীবনধারণ।
‘অকাল’ কবিতাতে কবি বীরেন্দ্র সময়-সঙ্কটকালের যে অবক্ষয়ের মূল্যবোধহীন সমাজের চালচিত্র তুলে এনেছেন তার জবাব নেই। বলতে কুণ্ঠা নেই এভাবে সমাজের ধ্বস্ত সময়ের ছবি তার মতোন সহজ-সরলভাবে তাঁর যুগে কোনো কবি অঙ্কন করেছেন কিনা সন্দেহ। শিক্ষকদের করুণ অবস্থার চিত্রণ তুলে ধরে কবি এ কবিতাটিতে সমাজের বিকৃত রূপটিকেই আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছেন, আবার একইসঙ্গে কবি যেন মাতৃভূমির নাম-এ শপথের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য নিজে যেমন নীরবে বেদনায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছেন, তেমনি খোঁচাও দিয়েছেন গলিত সমাজব্যবস্থার বসবাসকারি আমাদের ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে।
“গ্রহচ্যুত” কাব্যগ্রন্থের ‘কেয়া ঝড়' কবিতাটিতে আবার লক্ষ্য করা যায় কবি এলিয়টের মতোন বন্ধ্যাসময়ের ছবি এঁকেছেন। কবিতাটিতে এসেছে এলিয়টীয় গন্ধ। কবি বীরেন্দ্র কিন্তু তার সমসাময়িক কবিদের মতোন শুধু বন্ধ্যাসময়ের জন্য হতাশায় নিমজ্জিত ও বিষাদগ্রস্ততায় আচ্ছন্নতায় কেবল একাকী আর বেদনার ছবি এঁকে কবি কলমকে দূষিত করেননি। এ কারণে তিনি বদলালেন নিজেকে, নিজের কবিমানসের অভিজ্ঞানকে। প্রাণের গতিপ্রবাহকে তিনি চলমান দেখতে পছন্দ করেন, জনজাগরণকেই তিনি তাঁর কবিতায় মুখ্য বিষয়বস্তু করে নেন।
গ্রহচ্যুত” কাব্যগ্রন্থের সমকালেই কবি এ কবিতাটি রচনা করেন। বসন্তকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যৌবনের দূত।' একথা মনে রেখেই কবি বীরেন্দ্র যাত্রা করেন যুগের অন্ধকার সরাতে যৌবনশক্তিকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নিফুলিঙ্গের মতোন জ্বলে উঠতে। কবির আশাবাদের সুর এখানেই শোনা যায়। চারপাশের যান্ত্রিক ক্লিষ্ট নষ্ট সময়ের ধ্বস্ত ছবিগুলিয়ে সরিয়ে দিয়ে একক পাখির গান তাঁর কাছে নতুন গতিময় সময়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। কবি বীরেন্দ্র তাই কোনো ভণিতা না করেই তার মনের আশাবাদকে স্পষ্ট করতে ছাড়েন না এই কবিতাটির অপর কটি পংক্তিতে—
কানাকানি, দীর্ঘশ্বাস আর সতর্কতাকে এড়িয়ে
পাখির গান এগিয়েই চলেছে;
অদ্ভুত মিষ্টি ওর সেই ডাক
যেন আহ্বান প্রিয়াকে”
'পৃথিবী ঘুরছে' (১৯৭৫) কাব্যে কবি পৃথিবীকে ক্ষুধার রুটি রূপে দেখেছেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে 'চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটি', কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পৃথিবীটাও তেমনি গােল একখানা রুটি—যে রুটির জন্য মানুষ পাগল হয় ; সে রুটি কামড়ে খেতে চায় মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে অনাহারগ্রস্ত মানুষের দল। কবি বলেন—
'অনাহারে মৃত্যু নয়। অনাহারে মৃত্যু নয়।
কাল সারারাত তুমি
পৃথিবীকে ইচ্ছেমতাে কামড়ে ছিড়ে খেয়েছ।
সমস্ত রাত।
তার শান্তি...শান্তি!..শান্তি।'
অথবা,
'আমার ভারতবর্ষ চেনে না তাদের
মানে না তাদের পরােয়ানা ;
তার সন্তানেরা ক্ষুধায় জ্বালায়,
শীতে চারদিকে প্রচণ্ড মারের মধ্যে,
আরাে ঈশ্বরের শিশু, পরস্পরের সহােদর।'
কবি ষাটের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শরিক হয়েছেন—ফলে যাট ও সত্তরের দশকে রচিত অনেকগুলি কবিতায় তার রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় ধরা পড়েছে। রাজনৈতিক চেতনা বিষয়ক কবিতাগুলি কোথাও কোথাও উগ্র প্রচারধর্মী হয়ে উঠেছে- শাণিত বক্তব্যে ঋজু ও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। কবির ভাব যখন প্রচারের বাহন হয়ে উঠতে চায়, তখন তার মধ্যে হৃদয়ধর্মিতার ভাটা পড়ে কবিতা হিসেবে তার আকর্ষণ কমে যায়। ইস্তাহারের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা কখনাে এক হয় না। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংগঠনের তাগিদে কখনাে প্রচারের কবিতা লিখেছেন ; কিন্তু সেগুলির রসগ্রাহিতা ক্ষুন্ন হয়েছে, সন্দেহ নেই। সেগুলি প্যাময্লেটের গুণ লাভ করেছে। রাজনৈতিক প্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ কবির কাব্য রচিত হয়েছে—কিন্তু প্রত্যয়কে কাব্যরূপ দেবার জন্য যে অনুভূতির রস নির্বেদ প্রয়ােজন, তা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে অনুপস্থিত।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অগ্রজ কবিদের ন্যায় এলিয়টকেই কাব্যগুরু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এলিয়ট মানুষের জীবনের রিক্তৃতার ছবি এঁকেছেন, Wasteland-এর প্রস্তরকঠিন রূপ মানুষের সমাজে দেখেছেন। তিনি তার চারপাশে দেখেছিলেন Hollow Man দের। এই Hollow Man-রা ফাপা বুলি দিয়ে মানুষকে ভােলাতে চায়মানুষকে শুষে নিতে চায়। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তেমনি দেখেছেন তার চারপাশে স্বার্থান্ধ মানুষদের, যারা মিথ্যার ফাঁপা বুলি দিয়ে মানুষকে গ্রাস করতে চায়। কবি এঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছেনবিদ্রপের কশাঘাতে এঁদের জর্জরিত করতে চেয়েছেন। তাই কবি বীরেন্দ্রর অধিকাংশ কবিতায় বিদ্রপের ঝাজ, বেদনাহত জীবনের রূপ অঙ্কন করতে গিয়ে বিপকেই তিনি প্রধান হাতিয়ার করে নিয়েছেন।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার রূপশিল্প:
কবির বেশিরভাগ কবিতা স্বল্পাকৃতির একটি মুহূর্তের আবেগকে রূপায়িত করতে গিয়ে স্বল্পকথায় তাকে প্রকাশ করতে হয়েছে। অনেকগুলি কবিতা সনেটধর্মী ; অথচ সেগুলি সনেটের লক্ষণ বহন করে না। কেউ কেউ মনে করেন, অনেক সময় লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের অনুরােধে তাকে ছােটো ছােটো কবিতা লিখতে হয়েছে। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার প্রয়ােজনে Pamphlet জাতীয় কাব্য রচনা করতে হয়েছে, তবে সেগুলিতে টুকরাে কথার চালচিত্র রচিত হলেও তার মধ্যে চিরকালের মানবহৃদয়ের ব্যথা-বেদনার সংগীত ও কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। জীবনসংগ্রামের ছবি এবং সমাজের অবক্ষয়ের রূপটি যেন তার এই শ্রেণির কবিতার ফ্রেমে ধরা আছে।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু বড়া কবিতা আছে, আবার মাঝারি ধরনের কবিতা আছে। চিরকালের সমাজসমস্যার রূপ, মানুষের অন্তরজগতের রহস্য, পুরাণ কাহিনীর নবরূপায়ণ। প্রভৃতি মূলত এই শ্রেণির কবিতার উপজীব্য বিষয়। কিছু রাজনৈতিক কবিতাও ইস্তাহারের ভঙ্গিতে রচিত হয়েছে। তবে এই জাতীয় কবিতায় কবির ভাবপ্রকাশের স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশিত না। হলেও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে তার নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন,—
"মনের সারস হাঁটে
মন্থর সন্ধ্যায় একাকী।"
তানপ্রধান ও ধ্বনিপ্রধান ছন্দেই তিনি তার বেশিরভাগ কবিতা রচনা করেছেন। কিছু ছােটো সাইজের কবিতায় শ্বাসাঘাতপ্রধান বা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রয়ােগ লক্ষিত হয়। লঘুচালের ছন্দ মূলত তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যঙ্গের শাণিত তরবারির প্রয়ােজনে। এ-জাতীয় কবিতা যতটা শ্রতিমধুর, ততটা যে ভাবগভীর নয়, তা সহজেই বােঝা যায়।
সময়ের/গায়ে জ্বর/
ফাটা ভিজে/ছাই চাপা/ঠোট দুটি/চাটছে।
মনের সারস/তবু হাঁটছে
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবির ভাবগাম্ভীর্য যেমন, প্রকাশভঙ্গিতে তেমনি অনবদ্যতা কোথাও কোথাও রস-সংবেদ্য হয়ে উঠেছে। চিন্তার গভীরতা কবির বাক্-প্রতিমাকে কত সহজ ও স্বচ্ছন্দ করেছে, তার উদাহরণ অনেকগুলি কবিতাতেই প্রকট। যেমন,—
'কত রাজ্য আসে যায় ইতিহাসে, ঈর্ষা আর দ্বেষ
আকাশ বিষাক্ত করে
জল কালাে করে, বাতাস ধোঁয়ায় কুয়াশায়
ক্রমে অন্ধকার হয়.....।'
অথবা,
'একটি পাখীর বাসা গড়ে তােলার মতাে সামান্য আশ্রয়
একটি ঘাসের দাঁড়িয়ে থাকার মাটি
আজ আমাদের অতীত ইতিহাসের স্বপ্ন, ঠাকুরমার মুখের রূপকথা।'
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় যতিচিহ্নের প্রয়ােগ অপেক্ষাকৃত কম ; আবেগপ্রবণ কবিতাগুলিতে কবির আবেগ ঝর্ণার মুক্তগতির মতাে ছুটে চলেছে বলেই যতিচিহ্ন দিয়ে তার গতিকে ব্যহত করতে চাননি কবি। কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের কবিতার ভঙ্গীতে যেন অনেকটা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
=========[[[[[[[[[[[[[[[[∆∆∆∆]]]]]]]]]]]]]]]=====
No comments:
Post a Comment