হেরাসিম লেবেদেফ
জুলাই ১৫, ১৮১৭সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে তিনি মারা যান।
একজন রুশ অভিযাত্রী, ভাষাবিদ, অনুবাদক, সংগীতজ্ঞ এবং লেখক।এছাড়াও তিনি ছিলেন ভারতবিদ্যা বিষয়ের পণ্ডিত। এবং বেঙ্গলি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা।
জন্ম রাশিয়ার ইউক্রেনের এক যাজক পরিবারে। পিতা স্তেফান লিয়েবেদেফ এবং মাতা পারাস্কোভিয়া লিয়েবেদেফ। সংগীতে দক্ষতার জন্য তিনি যৌবনে এক রাজপুরুষের সংস্পর্শে আসেন এবং তার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে প্যারিস হয়ে লন্ডনে পৌঁছান। সেখানে তিনি ভারতীয় পণ্যসম্ভারে পূর্ণ দোকান দেখেন। এখান থেকেই এক যাত্রীবাহী জাহাজে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট মাদ্রাজ বর্তমানে চেন্নাই পৌঁছান। এখানকার মেয়র কর্তৃক তিনি সংবর্ধিত হন এবং কয়েকটি আসরে সংগীত পরিবেশন করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করেন। কিন্তু এখানে রক্ষণশীল সমাজে প্রবেশাধিকার না পেয়ে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় আসেন। এই শহরের একমাত্র রুশ চিকিৎসকের সাহায্যে স্থানীয় সমাজে সংগীতজ্ঞরূপে প্রতিষ্ঠা পান। তার আসরের টিকিট মূল্য ছিল বারো টাকা। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য যন্ত্রে ভারতীয় সুর বাজিয়ে শোনান।
প্রথম বাংলা নাটকের রচয়িতা ও পরিচালক গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ কলকাতায় "দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার" নামে একটি থিয়েটার গড়ে তোলেন। ২৫ নম্বর ডোমতলায় (এজরা স্ট্রীট) একটি বাড়িতে গড়ে উঠে এই থিয়েটার। দ্য ডিজগুয়িজ (The disguise) এর অনুবাদে প্রথম অনুদিত বাংলা নাটকটির নাম "সংবদল"। এটি ১৭৯৫ সালের ২৭ শে নভেম্বর প্রথম প্রদর্শিত হয়। এই সময় বিশিষ্ট ইংরেজদের জন্য মূল্যবান আসনের দু-টি থিয়েটার ছিল। লেবেডেফের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত ইংরেজগণ প্রত্যক্ষভাবে জোসেফ ব্যাটেল নামে সিন পেন্টার ও মি হে নামে এক রাজকর্মচারীর সাহায্যে লেবেডেফের থিয়েটারে আগুন লাগিয়ে নষ্ট করে দেয়।
কলকাতায় থাকাকালীন তিনি পণ্ডিত গোলক নাথ দাসের নিকট এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেন, বিশেষত বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা ও ভারতচন্দ্র রায়ের কাব্যের সংস্পর্শে আসেন। এদেশে আসার আগেই অবশ্য তিনি কালিদাসের রচনার সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনিই প্রথম বাংলার ব্যাকরণ নিয়ে প্রথম চিন্তাভাবনা করেন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তিনি ভালো ভায়োলিন বাজাতে পারতেন।
একজন ইংরেজ মহিলার সঙ্গে প্রণয় ও ব্যর্থতা লেবেডেফের জীবনের অন্যতম বিপর্যয়। ঋণের দায়ে তাঁকে আদালতে যেতে হয়। সবশেষে ব্রিটিশ কোম্পানির কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলকাতা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। শেষজীবনে স্বদেশে ফিরে পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করেন। রুশদেশে ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্য তিনি সম্রাটকে পত্র দিয়েছিলেন।
তার জীবনী নিয়ে মামুনুর রশীদ লেবেদেফ নামের একটি নাটক রচনা করেছেন.
লেবেডেফের নিত্য সঙ্গী ছিলেন গোলকনাথ দাস। তাঁরই সহযোগিতায় তিনি নাটকে মহিলা চরিত্রে বাঙালি অভিনেত্রী নিয়োগে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সাহেবি থিয়েটারে ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতী ব্রিস্টোর আবির্ভাবের পূর্বে পুরুষরাই স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করতেন। সুতরাং লেবেডেফের অভিনয়ে স্ত্রী লোকের ভূমিকায় স্ত্রীলোক গ্রহণ অবশ্যই অভিনয়ের একটি আকর্ষণীয় দিক। গোলকনাথ দাস শুধু বাঙালি অভিনেতা ও অভিনেত্রী সংগ্রহ করে দেননি—তিনি তাঁদের অভিনয়—শিক্ষাও দিয়েছিলেন। খিদিরপুর ডক অঞ্চলের বারবনিতারাই তখন অভিনেত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করত। কিন্তু যাত্রা রসরসিক গোলকনাথ দাস, যারা তখন ঝুমুরগান গাইত, সারিগান, জারিগান গাইত এবং কীর্তনাদি গাইত তাদের মধ্যে থেকেই অভিনেত্রী নির্বাচন করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
লেবেডেফের ইচ্ছা ছিল শুধু কলকাতা নয়, গ্রামাঞ্চলেও তাঁর নাটকের অভিনয় করেন, এবং এইমর্মে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তাঁর অভিনয়ের জনপ্রিয়তায় ইংরেজি থিয়েটারের কর্তৃপক্ষেরা খুশি হতে পারেননি। তৎকালীন সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট বিলেতি থিয়েটারের কর্তৃপক্ষরা নানাভাবে তাঁরই ক্ষতিসাধন করতে চেষ্টা করেন। লেবেডেফ তাঁর অভিনয়ে জোসেফ ব্যাটল নামে একজন ইংরেজ দৃশ্যপট শিল্পীর সাহায্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু জোসেফ বন্ধুভাবে তাঁর দলে যোগ দিলেও লেবেডেফের দল থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের ভাঙাতে এসেছিলেন। তাঁকে বন্ধুর বেশে এই শত্রুতা করতে পাঠিয়েছিলেন লেবেডেফের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী টমাস রোয়ার্থ। তাঁরই চক্রান্তে একে একে প্রায় সকলেই লেবেডেফের দল ছেড়ে চলে যায়। লেবেডেফ আইনের সাহায্য নিতে গিয়ে দেখেন যে টমাস রোয়ার্থের প্রভাবে কোনো আইনজীবীই তাঁকে সাহায্যে করতে অনিচ্ছুক। শেষে তিনি থিয়েটারের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম বিক্রি করে দিয়ে লন্ডন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।লণ্ডনে অবস্থানকালে তিনি Grammar of the Pure and Mixed East Indian Languages গ্রন্থটি প্রকাশ করেন
।১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অবদান :
১। পরবর্তী বাংলা নাট্যশালার ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাঁর অভিনয়ের স্পষ্ট যোগ না থাকলেও তৎকালীন যাত্রার ওপর তাঁর অভিনয় রীতি কিছু প্রভাব বিস্তার করেছিল।
২। সামাজিক ও রসাত্মক বিষয় অবলম্বনের মধ্যে দিয়েই বাংলার নাট্যশালা যে একদিন প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এ ইঙ্গিত তাঁর প্রচেষ্টায় আভাসিত হয়ে উঠেছিল।
৩। নাচ ও গান বাংলা নাট্যশালায় যে দীর্ঘকাল আধিপত্য বিস্তার করে আসছে তা লেবেডেফেরই অবদান।
। যাত্রার মধ্যে দৃশ্যবিভাগ ও গর্ভাঙ্ক রচনার মূলেও লেবেডেফের নাটকের প্রভাবের কথা অনুমান করা হয়।
৫। সর্বোপরি, বাংলা রঙ্গালয়ের আজ এই যে রমরমা ভাব তা মূলত লেবেডেফের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে একথা ভুললে চলবে না।
তই বলতে হয়, বাংলায় ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দর্শক থেকে যেসব যাত্রার অভিনয় হয়েছে, সেগুলি নানা বিষয়ে নৃতনত্বের জন্যে ‘নূতন যাত্রা’ নামে অভিহিত হয়েছে। লেবেডেফের যুগান্তকারী অভিনয়ের পরেই যাত্রার মধ্যে এইসব পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন যে,
‘The Disguise-এর বাংলা অনূদিত নাটকের অভিনয়-প্রভাবেই এই পরিবর্তন। অতএব তিনিই যে বাংলা রঙ্গমঞ্চের ক্ষেত্রে কিংবদন্তী পুরুষ সেকথা অত্যুক্তি নয়।==============={{{{{{{{{}}}}}}}}}}}}}{{{{{{{{{
No comments:
Post a Comment