Tuesday, 9 August 2022

বিশেষ প্রতিবেদন। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন : বাংলা সাহিত্য। Vol - 823. Dt -10.08.2022. ২৪ শা শ্রাবণ, ১৪২৯. বুধবার। The blogger in literature e-magazine

ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও 

স্বদেশী আন্দোলন :  বাংলা সাহিত্য। 


"বাংলার মাটি বাংলার জল

 বাংলার বায়ু বাংলার ফল 

পূর্ণ হ‌উক পূর্ণ হ‌উক পূর্ণ হ‌উক হে ভগবান। "


১৯৪২ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক আন্দোলন (Quit India Movement, 1942)। ক্রিপস মিশন এর অস্পষ্ট প্রস্তাবাবলি- যেমন, যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন মর্যাদা প্রদান, প্রাদেশিক আইনসভা ও দেশীয় রাজ্যগুলির দ্বারা সংবিধান প্রণয়ন কমিটি নির্বাচন, প্রদেশগুলির এতে যোগদান করা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ধারা, যুদ্ধে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আশু অংশগ্রহণ কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাখা প্রভৃতি কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে নি। বরং এ প্রেক্ষিতে বলকান উপদ্বীপের মতো ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দেয়। মালয়, বার্মা ও সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশদের কলঙ্কজনক পলায়নের ফলে তাদের অধীনস্থ ভারতীয়দের নিজেদেরকেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হয়। এসব ভারতীয়ের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অবর্ণনীয় দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা, ভারতের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদের দ্বারা ভারতীয়দের ওপর জাতিগত বিদ্বেষমূলক আচরণ, সকল প্রকারের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যুদ্ধের কাজে লাগানোর কারণে সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বাংলায় অনুসৃত ‘পোড়ামাটি নীতি’, যুদ্ধকালীন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারী এবং মুনাফাখোরদের দৌরাত্মে সবকিছুই শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী উত্তেজনা সৃষ্টি করতে বিশেষ অবদান রাখে। সর্বোপরি, যুদ্ধের শুরু থেকেই ১৯৩২ সালের আদলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের ব্যাপক কঠোর নীতি গ্রহণ করার প্রয়াস ছিল।


৯ আগস্ট ভোরে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার দেশব্যাপী এক নজিরবিহীন গণরোষের সৃষ্টি করে, যা বাংলার শহরগুলিতে, বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।


ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান তিনটি পর্ব দেখা যায়। প্রথম পর্বে এ আন্দোলন প্রধানত শহর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এ পর্যায়ে প্রধান শহরগুলিতে হরতাল, ধর্মঘট, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ছিল লক্ষণীয় বিষয়। এ পর্বের আন্দোলন ছিল খুবই ব্যাপক এবং সহিংস। কিন্তু দ্রুততার সাথেই এ আন্দোলনকে দমন করা হয়।

আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় আগস্টের মধ্যভাগ থেকে। এ পর্যায়ে জঙ্গী ছাত্ররা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয় এবং একই সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিম বিহার, উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল, বাংলার মেদিনীপুর জেলা এবং মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এ সময় বেশ কয়েকটি অঞ্চলে স্বল্প স্থায়ী আঞ্চলিক ‘জাতীয় সরকার’ও গঠিত হয়।


সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব শুরু হয়। এ পর্বের বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষিত যুবক সম্প্রদায় ও কৃষক দলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা এবং গেরিলা যুদ্ধ। এ সময়ে মেদিনীপুরের তমলুক, মহারাষ্ট্রের সাতারা, উড়িষ্যার তালচের অঞ্চলে এই জাতীয় সরকার কাজ করছিল। তিনটি পর্বের আন্দোলনকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে দমন করা হয়। আন্দোলন দমন করতে সরকার আকাশ থেকে মেশিনগানও ব্যবহার করেছিল।


ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে বেশ মতবিরোধ আছে। এ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এটা কি কোন স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব, নাকি একটি সুসংগঠিত বিদ্রোহ। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির (বোম্বাইর) অধিবেশনে বিখ্যাত ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয় এবং পরপরই যতদূর সম্ভব ব্যাপকভাবে অহিংস পথে গান্ধীর নেতৃত্বে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। প্রস্তাবের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ একটি অতিরিক্ত ধারা সংযোজিত হয় এবং তা হলো- কংগ্রেস নেতৃত্বকে যদি গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেক ভারতবাসী যিনি স্বাধীনতা চান এবং তার জন্য সংগ্রাম করেন তিনি নিজেই তার পথপ্রদর্শক হবেন। ১৪ জুলাইর ওয়াদা ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবেও সামাজিক র‌্যাডিক্যালিজমের বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলি উল্লিখিত হয়। ২৭ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে গান্ধীর কড়া নীতিকে একযোগে সমর্থন করেন ডানপন্থী প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কৃপালনী এবং সমাজতন্ত্রী অচ্যুত পাটওয়াবর্ধন ও নরেন্দ্রদেব। জওহরলাল প্রথমদিকে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও পরিশেষে গান্ধীর নীতিকেই সমর্থন করেন এবং একমাত্র কমিউনিস্টরাই ভারত ছাড় প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।



ভারতের  স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্নি ফুলিঙ্গ- স্বদেশী আন্দোলন। পরাধীন দেশে শাসকের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি মানেই বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া কিংবা রাজদ্রোহির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া। 

 ফলে লেখককে যে কোনো ধরনের মূল্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো। ফলে অন্য যে কোনো সাধারণ সময়ের চেয়ে এ সময়ের সাহিত্য যেমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এসব সাহিত্যিকরাও জাতির কাছে চির সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হন।

পরাধীনতার যন্ত্রণার বিষাক্ত ছোবলে নানামাত্রিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, অগ্নিফসলের মতো, যা বুলেটের চেয়েও ভয়ংকর ছিল। বাংলার প্রায় সব প্রধান লেখকই সে অগ্নিকালকে ধারণ করে সাহিত্যে আগুনের ফসল ফলিয়েছেন, আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত করেছেন দৃঢ় প্রত্যয়, অপ্রতিরোধ্য জাগরণ। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে সে সত্য প্রতিষ্ঠিত। তবে সে সময়ে আন্দোলনের ধারা একরৈখিক ছিল না।


একদিকে অহিংস বা আপসকামিতা, অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পরাধীনতা থেকে মুক্তির পন্থা সুনির্দিষ্ট। ধারা দুটি স্পষ্ট। সাহিত্য সৃষ্টিতেও তা লক্ষণীয়। কবিতা, নাটক বা প্রবন্ধে অথবা গল্পে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যেভাবে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে, সে তুলনায় উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। তখনকার প্রধান লেখকদের মধ্যে এক্ষেত্রে উদাসীনতা বা নীরবতার ব্যাপারটিও সহজেই অনুমানযোগ্য।


স্বদেশী আন্দোলন মূলত গড়ে উঠেছিল আত্মশক্তির ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। এ আন্দোলন ব্রিটিশশাসিত ভারতের প্রথম ব্যাপক জাতীয় আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সেসময়ের কবি-সাহিত্যিকরাও কলমের মাধ্যমে এ আন্দোলনকে আরও তীব্র এবং গতিশীল করেছিল। ফলে সেসব সৃষ্টি অগ্নিময়তাকে ধারণ করে নির্মিতি পায়। সব দেশেরই যে কোনো ক্রান্তিকাল-দুঃসময়-যুদ্ধ-বিগ্রহ-পরাধীনতার যন্ত্রণা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। সেই যন্ত্রণাই তাদের সৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্পকর্মে রূপ নেয়।


আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। সাহিত্যে এসেছিল নতুন রূপ ও ভিন্নতর গতি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী আন্দোলনও সাহিত্যের একটি বিরাট অধ্যায় হয়ে উঠেছিল। অসংখ্য কবিতা-গল্প-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ রচিত হয়েছে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।


পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে এ আন্দোলনকে ধারণ করে। ফলে স্বদেশী আন্দোলন সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বদলিয়ে নতুন এক অধ্যায় ও ধারা তৈরি করেছিল। স্বদেশী আন্দোলনে প্রবল গতি সৃষ্টি করেছিল বঙ্গভঙ্গ। ব


ঙ্গভঙ্গ বাঙালির জীবনে বিরাট এক আঘাত, যা সাহিত্যিকের চিন্তা-জগতেও বিশাল এক পরিবর্তন ঘটায়। জাতির সংকট তাদের ভাবিত করে। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরাও অনুধাবন করেন জাতির এ সংকটে বিপ্লব ঘটানো অনিবার্য ও অপরিহার্য। এ ভাবনা থেকেই লেখকরা তাদের সাহিত্যকর্মে বিপ্লবী মনোভাব সৃষ্টি করে সাধারণ যুবকদের চেতনায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।


তাদের সাহিত্যকর্মে সুনির্দিষ্ট একটা ম্যাসেজ ছিল। সেসময় গতানুগতিক সাহিত্যকর্ম পাঠকের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে যে সাহিত্য অগ্নিবারুদের মতো কাজ করে, সেই সাহিত্যই তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত ও আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। কারণ এটা ছিল সময়ের প্রয়োজন।


এসব সাহিত্য বিপ্লবীদের যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল, তেমনি ইতিহাসের স্বাক্ষর হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ অগ্নিসময়ে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাহিত্যকর্ম করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমৃতলাল বসু, রজনীকান্ত সেন, গোবিন্দচন্দ্র রায়, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


তাদের সাহিত্য সৃষ্টি যুবসমাজের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। ফলে যুবসমাজ ব্যাপকভাবে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ভারতকে মুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র প্রতিজ্ঞা।


ভারতমুক্তির জন্য তারা হাসতে হাসতে মৃত্যুর সোপানে জীবন লিখে দিয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে বাংলাসাহিত্যে কালজয়ী বেশকিছু উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে। সেসব উপন্যাস বিপ্লবীর কাছে ‘ধর্মগ্রন্থে’র মতো পবিত্রতা পেয়েছিল।


স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ রাজনৈতিক উপন্যাস না হলেও কালের যাত্রায় রাজনৈতিক উপন্যাসের তিলকটিই এ উপন্যাসের কপালে লেগে গেছে। বঙ্কিমচন্দ্র সচেতনভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ কোনো উপন্যাস রচনা করেননি। উপন্যাসের নাম ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪)।


স্বদেশী প্রেক্ষাপটে রচিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ একদিকে সাহিত্যিক-চিত্তে যেমন আলোড়ন তৈরি করেছিল, তেমনি বিপ্লবীদের বিপ্লবী-দীক্ষা নিতেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ উপন্যাসের মাধ্যমেই বঙ্কিমচন্দ্র নিজেকে ‘জাতিসংগঠক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এ উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।


ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ১৮৯৬ সালে সর্বপ্রথম ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থান পায়। এছাড়া ১৯০৫ সালে সংগঠিত স্বদেশী আন্দোলনকে ‘বন্দেমাতরম্’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’এ ব্যবহৃত গান ‘বন্দেমাতরম্’-এর অনুসারে। দেশকে মা বলে মনে করে স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে এ গানটির অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুহেলিকা’- এ তিনটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের নানামাত্রিক আন্দোলন ও ইংরেজদের দুঃশাসন সেসময় অনেক লেখকের রক্ত-কালিতে ফণা হয়ে ফুটে উঠেছিল।


রবীন্দ্রনাথের গল্পে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কখনও কখনও জায়গা করে নিলেও উপন্যাস হিসেবে পাওয়া যায় ‘ঘরে-বাইরে’। স্বদেশী আন্দোলনকে ঘিরে এ উপন্যাস রচিত হলেও রাজনৈতিক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসেবে এটিকে অভিহিত করা যায় না। কারণ স্বদেশী আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ এ উপন্যাসে ধরা পড়েনি। সন্দ্বীপের ভেতর দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন বরং এখানে বিকৃত রূপ লাভ করেছে।


স্বদেশী আন্দোলনকে ব্যবহার করে নিজে নেতা হয়ে উঠতে চেয়েছেন- যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের চরিত্রের সঙ্গে যা কোনোভাবেই যায় না। কারণ তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ তো দূরে থাক, নিজের জীবনের চেয়েও দেশের স্বাধীনতালাভ তাদের কাছে বড়। সন্দ্বীপে আমরা তা লক্ষ করি না।


অনুমান করা হয় সন্দ্বীপ চরিত্রটি অরবিন্দর ছায়া অবলম্বনে তৈরি। কিন্তু বাস্তবে অরবিন্দর সঙ্গে সন্দ্বীপের আদর্শিক মিলের পার্থক্য অনেক। যদি সন্দ্বীপ অরবিন্দর ছায়ায় তৈরি ধারণা করি, তাহলে অরবিন্দ এখানে বিকৃত হয়েছে।


বিমলা চরিত্রের ভেতর দিয়েই বোঝা যায় সেসময়ের নারীরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কতটা উদগ্রীব ছিল। দেশের মুক্তির স্বার্থে তারা কতটা নিবেদিত ছিল। নিখিলেশ চরিত্রে উঠে এসেছে সেসময়ের আর এক বাস্তবতা- ব্যবসা বাণিজ্য ও ধীরস্থির আপসকামিতা। অগ্নিযুগের পুরোপুরি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে ‘ঘরে-বাইরে’ মান্য করা যায় না। 

শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ রাজনৈতিক উপন্যাস। শরৎচন্দ্র নিজেও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু খাঁটি রাজনৈতিক উপন্যাস তিনি একটিই লিখেছেন-‘পথের দাবি’। কিন্তু একটিমাত্র কেন- এ প্রশ্নের উত্তর মেলানো ভারি মুশকিল। ‘পথের দাবি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সব্যসাচী বাস্তবতা থেকেই গৃহীত হয়েছিল।


স্বদেশী আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা এমএন রায়ের চরিত্র অবলম্বনে তিনি সব্যসাচী চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। এমএন রায় জার্মানি থেকে অস্ত্র-বারুদের সাহায্য নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ব্রিটিশ বিতাড়িত করে ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। ‘পথের দাবি’র মূল চরিত্র সব্যসাচী তৈরি হয়েছে এমএন রায়কে কেন্দ্র করে। ‘পথের দাবি’ বিপ্লবীদের কাছে আদর্শগ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছিল।


নজরুল অগ্নিযুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপুর্ণ। কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। অনশন করেছেন। কবিতার মতো তার উপন্যাসেও সেই অগ্নি-বারুদ ফুটে উঠেছিল। সেই সময়কালই ছিল অগ্নি-বারুদের ওপর দাঁড়ানো। নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস ‘পথের দাবি’ প্রভাবিত বলেই স্বীকৃত। এ উপন্যাসের প্রমত্ত দা ও বজ্রপাণি মূলত এমএন রায় ও বিপ্লবী বাঘা যতীন চরিত্র অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে।


সতীনাথ ভাদুড়ী’র ‘জাগরী’ (১৯৪৫) উপন্যাসটিও বিপ্লবী-ধারার উপন্যাস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সতীনাথ ভাদুড়ী একজন সাহিত্যিক হিসেবে যেমন প্রতিষ্ঠিত তেমনি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন।


সতীনাথ ভাদুড়ী ‘আগস্ট আন্দোলন’কে কেন্দ্র করে রচনা করেন- ‘জাগরী’। ১৯৪২ সালে ৯ আগস্ট ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়’ গান্ধীজির এ অগ্নিগর্ভ উদাত্ত আহ্বানে অসংখ্য মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে এসে আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।


পরিণতিতে তাদের কারাবরণ করতে হয়েছিল। ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল। এসব নিয়েই ‘জাগরী’ সৃষ্টি। গঙ্গাচরণ নাগের মতো প্রাজ্ঞ লেখক স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন কলম-যুদ্ধ করেছেন। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন ‘রাখী-কঙ্কন’ উপন্যাস। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে গ্রন্থকার কর্তৃক এটি প্রকাশিত হয়।


অবশ্য উপন্যাসটি সম্পূর্ণ নয়, প্রথম খণ্ড মাত্র। তখন বরিশালে থেকে নীরবে নিভৃতে বসে এ ধরনের উপন্যাস লেখা হয়তো সম্ভব ছিল; কিন্তু সেখান থেকেই এটি প্রকাশ করা কতটা অসাধ্যকে সাধন করার মতো ব্যাপার ছিল, তা ভাবাও কঠিন। নিঃসন্দেহে লেখক একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছেন।

কারণ সেসময় বরিশালের স্বদেশী-আন্দোলনের সঙ্গে যেসব তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়েছিল, স্বদেশদ্রোহী আত্মীয়স্বজনের কাছে তাদের ভয়ংকরভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ‘রাখী-কঙ্কন’ লেখা হয়েছিল। ফলে বরিশালে উপন্যাসটি প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌঁছানো ব্যাপারটি সহজসাধ্য ছিল না। এও এক বিপ্লব সাধন করেছিলেন গঙ্গাচরণ নাগ।


নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্যও স্বদেশী আন্দোলনকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। তার উপন্যাসের নাম ‘নববিধান’। এ উপন্যাসের প্রধান দিক হল উপন্যাসটিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং ব্রিটিশদের অত্যাচারের জবাব দেয়ার জন্য জনগণের মধ্যে আন্দোলন গড়ে তোলা। সে বিবেচনায় উপন্যাসটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়কালে এ উপন্যাসটি ‘সুলিখিত উপন্যাস’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি মূলত গল্পকার ছিলেন।


এসব কীর্তিমান লেখক ছাড়া আরও অনেক লেখক অগ্নিযুগ বিশেষ করে স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এসব লেখকও সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রমণীমোহন ঘোষ, রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গাচরণ দাশগুপ্ত, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ।


এদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। মূলত এদের অধিকাংশই কবিতার মাধ্যমেই স্বদেশী আন্দোলনকে জনগণের মধ্যে চেতনার অগ্নিবারুদ করে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তবে এখানে নজরুলের নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন।


কারণ নজরুলের মতো করে আর কেউ ব্রিটিশ মসনদ তছনছ করা কবিতা লিখতে পারেননি। কবিতায় তিনিই সবচেয়ে বেশি আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতা লিখে তিনি জেল খেটেছেন। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য বাজেয়াপ্ত হয়েছে।


বিপ্লবী বাঘা যতীনকে নিয়ে লেখা ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ কবিতার জন্য ‘প্রলয়-শিখা’র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’সহ অসংখ্য বিদ্রোহাত্মক ও প্রতিবাদী কবিতা লিখে ব্রিটিশদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। নজরুলকেও এজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।


অগ্নিযুগে আগুনভরা অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। স্বদেশী আন্দোলনকারীদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গানের সুর ও ছন্দ হয়ে তরুণদের রক্তে আগুন জ্বালিয়েছে।


কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যবিশারদ, কামিনীকুমার ভট্টাচার্য, অশ্বিনীকুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস, গোবিন্দচন্দ্র দাস, মনোমোহন চক্রবর্তী, প্রমথনাথ দত্ত, বরদাচরণ মিত্র, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, করালী (ছদ্মনাম) এবং রাজকৃষ্ণ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। স্বদেশী আন্দোলনে এদের রচিত দেশাত্মবোধক গান স্বদেশ প্রেমে বিপ্লবীদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।


সেই প্রবল সংকটকালীন ছয়টি সংগীত সংকলন- রজনীকান্ত পণ্ডিতের ‘স্বদেশী পল্লী-সংগীত’, যোগেন্দ্রনাথ শর্মার ‘স্বদেশী-সংগীত’, যোগেন্দ্রনাথ সরকারের ‘বন্দেমাতরম্’, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ‘স্বদেশ-গাথা’, হীরালাল সেনগুপ্তের ‘হুঙ্কার’, ও নলিনীরঞ্জন সরকারের ‘বন্দনা’ প্রকাশিত হয়েছিল। এটি সহজসাধ্য কোনো ব্যাপার ছিল না।


বাংলা নাটকেও স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব সুস্পষ্ট। স্বদেশী আন্দোলন নাট্যকারের চিত্তে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল। নাট্যকাররা কল্পনাপ্রসূত নাটক লেখা থেকে সরে এসে ভারতে পরাধীনতার যন্ত্রণা ও স্বদেশী আন্দোলনকে নাটকের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেন।


গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘মীরকাসিম’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘প্রতাপসিংহ’, ‘দুর্গাদাস’, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘প্রতাপ-আদিত্য’, ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ বা Partition of Bengal’, কুমুদনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ যজ্ঞ’-এসব নাটক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গল্পও রচিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার ‘দেশী ও বিলাতী’ গল্পগ্রন্থের তিনটি গল্পে স্বদেশী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। গল্পগুলো ‘উকিলের বুদ্ধি’, ‘খালাস’ এবং ‘হাতে হাতে ফল’। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেই সময়কালে উল্লেযোগ্যভাবে প্রবন্ধ রচিত হয়নি।


এটা খুব স্বাভাবিক যে, আন্দোলনের সময় যে আবেগ আর উত্তেজনা সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করে, সেসময় চিন্তানিষ্ঠ সাহিত্য পাঠককে খুব বেশি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় না। ফলে লেখকের আগ্রহও সেদিকে কম থাকে।


তারপরও সেসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সখারাম গণেশ দেউস্কর, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী, নিখিলনাথ রায় ও ধীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী প্রমুখ স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক প্রবন্ধ রচনা করে প্রায় একরকম অসাধ্যই সাধন করেছিলেন।


অগ্নিযুগে সৃষ্ট সাহিত্য বহুমাত্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব সাহিত্য বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছে, দেশপ্রেমে অগ্নিস্পৃহা শক্তি জুগিয়েছে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। ফলে এসব সাহিত্য শুধু সৃজনশীলতায় বন্দি নয়- ইতিহাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষর হিসেবে সেই সময়ের পুরো ছবিটাও বহন করে।

.....ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা. "


==================================

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। রুনা লায়লা । খ্যাতনামা বাংলাদেশী কণ্ঠশিল্পী। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সংগীতের জন্য বিখ্যাত। তবে বাংলাদেশের বাইরে গজল শিল্পী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তাঁর সুনাম আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় এবং পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের অনেক গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। রুনা লায়লা বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, হিন্দি, সিন্ধি, গুজরাটি, বেলুচি, পশতু, ফার্সি, আরবি, মালয়, নেপালি, জাপানি, স্পেনীয়, ফরাসি, লাতিন ও ইংরেজি ভাষাসহ মোট ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন। Dt - 17.11.2024. Vol -1055. Sunday. The blogger post in literary e magazine.

রুনা লায়লা  (জন্ম: ১৭ নভেম্বর ১৯৫২ ----) একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশী কণ্ঠশিল্পী। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সংগীতের জন্য বিখ্যাত। ত...