ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী
"কাকু আজীবন আমাদের সাহিত্য, সংগীত এবং চিত্রকলা শেখার জন্য উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন। তার শেষ জীবনের প্রান্ত ভাগে এসে সেই চিত্রকলাকে প্রাণপণের আঁকড়ে ধরেন নিজস্ব চিন্তাধারা দিয়ে। চিত্রকলার কিছু আদিরূপ অংকনে তিনি আমাদের নিয়োজিত করে গেছেন."
ইন্দিরা দেবী ঠাকুর পরিবারে মেয়েদের মধ্যে ছিলেন প্রথম বিএ পাস করা কন্যা। ১৮৯২ সালে বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘পদ্মাবতী’ পদক লাভ করেন।
ইন্দিরা দেবী পিয়ানো, বেহালা, সেতারবাদন এবং রবীন্দ্রসংগীতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সুরকার এবং গীতিকার। রবীঠাকুরের ‘স্বরলিপি’ রচনা তার এক অমর কীর্তি। তাছাড়াও ‘কালমৃগয়া’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতিসহ আরও দুশো রবীন্দ্র সঙ্গীত তিনি রচনা করেছেন। এছাড়াও চাচার বহু স্বরলিপি গ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন ইন্দিরা দেবী।
তার দেওয়া সুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক সংগীত রচনা করেছেন। নারীদের সংগীতসংঘের মুখপাত্র ‘আনন্দ সংগীত’ পত্রিকার তিনি ছিলেন অন্যতম যুগ্ম সম্পাদিকা। রবী ঠাকুরের মৃত্যুর পর তিনি শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে সেখানে নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাদান করতেন
১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ভুবনমোহিনী’ স্বর্ণপদক, ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ এবং ডি-লিট ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৫৯ সালে রবীন্দ্রভারতী সমিতি প্রথমবারের মতো ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’-এ ভূষিত করে।
মৌলিক রচনা
শ্রুতি স্মৃতি,
রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম (১৯৫৪)
রবীন্দ্রস্মৃতি (৫ খন্ড, ১৯৫৯)।
তার সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:-
নারীর উক্তি (১৯২০),
বাংলার স্ত্রী-আচার (১৯৫৬),
স্মৃতিকথা,
পুরাতনী (১৯৫৭)
গীতপঞ্চশতী।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মেয়ে। ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৭৩ সালে ইন্দিরা দেবীর জন্ম তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশের কারোয়ারে (বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যে)। পৈতৃক নিবাস কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। তাঁর মাতা জ্ঞানদানন্দিনীও ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী, বিদুষী ও প্রগতিশীল মহিলা। একমাত্র দাদা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চেয়ে দেড় বছরের বড়। ইন্দিরা দেবী ১৮৯৯ সালে তিনি তাঁর স্বনির্বাচিত পাত্র প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
১৮৮১ সালে প্রথমে সিমলার অকল্যান্ড হাউজে এবং পরে কলকাতার লরেটো হাউজে পড়াশোনা করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি এন্ট্রান্স ও পরে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে তিনি ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
বাদ্রিদাস মুকুলের নিকট উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিছুদিন সেতার বাজানও শিখেছিলেন। অনুবাদক হিসেবে ইন্দিরা দেবী অল্পবয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। কৈশোরে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত ও মাতা জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত বালক পত্রিকায় রাস্কিনের রচনার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরে ফরাসি শিখে তিনি রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ, পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাশ্রম এবং মাদাম লেভির ভারতভ্রমণ কাহিনী অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধসহ জাপানযাত্রীর ডায়রী-র ইংরেজি অনুবাদও তিনি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত ও সাহিত্যবিষয়ে তার অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। বঙ্গনারীর শুভাশুভ বিষয়ে তার মতামত নারীর উক্তি নামক প্রবন্ধটি ছাপানো হয়।
শান্তিনিকেতনে ইন্দিরা দেবী ‘আলাপনী মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা ও তার মুখপত্র ঘরোয়া প্রকাশ করেন। মহিলা কল্যাণে গঠিত ‘বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশন লীগ’, ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’, ‘হিরণ্ময়ী বিধবা আশ্রম’ ইত্যাদি সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন।
অনুবাদক হিসেবে ইন্দিরা দেবী অল্পবয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। কৈশোরে তিনি রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ও মাতা জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত বালক পত্রিকায় রাস্কিনের রচনার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরে ফরাসি শিখে তিনি রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ, পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাশ্রম এবং মাদাম লেভির ভারতভ্রমণ কাহিনী অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধসহ জাপানযাত্রীর ডায়রী-র ইংরেজি অনুবাদও তিনি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত ও সাহিত্যবিষয়ে তাঁর অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। বঙ্গনারীর শুভাশুভ বিষয়ে তাঁর মতামত ‘নারীর উক্তি’ নামক প্রবন্ধে বিধৃত হয়েছে। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতে এবং পিয়ানো, বেহালা ও সেতারবাদনে পারদর্শিনী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা তাঁর এক অমর কীর্তি। ‘মায়ার খেলা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘কালমৃগয়া’ প্রভৃতিসহ আরও দুশো রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু স্বরলিপি গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবী
সেই শৈশব থেকেই ইন্দিরা দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল এক অটুট বন্ধনে গাঁথা। ভাতিজীকে রবীন্দ্রনাথ কতটা স্নেহ করতেন তা বোঝা যেত ইন্দিরাকে পাঠানো তার চিঠিগুলো দেখলেই!
রবী ঠাকুরের সাহিত্যকর্মের অন্যতম এক শাখা হলো তার পত্র সাহিত্য। প্রায় ২২টি জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি এই পত্রগুলো লিখেছিলেন। সবচেয়ে বেশি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে। আর সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখতেন ভাতিজি ইন্দিরাকে। রবীন্দ্রনাথের সেসব চিঠির খণ্ডাংশ নিচে তুলে ধরলে বোঝা যাবে ইন্দিরা দেবীর আসন তার চাচার কাছে কতটা অতুলনীয় ছিল!
তিনি লিখেছিলেন,
‘অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছে…যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই।…বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের—বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর— সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। …কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।…আমার এই, সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। ’
এই সকল চিঠিতে উপস্থিত থাকত তার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের) কল্পনা, ভাবনা, ব্যাকুলতা, আকাঙ্ক্ষা, ধ্যানধারণা, মানুষজন, নদনদী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক সাবলীল উপস্থাপন।
জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা শিক্ষা অর্থনীতি বিনোদন লাইফস্টাইল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রবাস মতামত।
প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক
প্রমথ চৌধুরী তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারি পাস করে প্র্যাক্টিস শুরু করেছেন। তার পান্ডিত্য এবং সাহিত্যপ্রীতির কথা জানতে পারেন ঠাকুরবাড়ির লোকেরা। অপরদিকে তার অগ্রজ আশুতোষ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্যানুরাগী হওয়ায় পরবর্তীতে প্রমথ চৌধুরীর সাথে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
আর এভাবেই তিনি আইনজীবী প্রমথ চৌধুরী থেকে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধরীতে পরিণত হলেন। ইন্দিরা দেবী যাকে ১৮৯৯ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। উনিবিংশ শতাব্দীর মতো গোঁড়া একটি সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেও তিনি (ইন্দিরা দেবী) নিজ পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। বিখ্যাত ‘সবুজপত্র’ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক এই প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার স্বনির্বাচিত বর, যাকে আমরা রবীন্দ্রনাথের জামাতা বলে চিনি।
রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবী
সেই শৈশব থেকেই ইন্দিরা দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল এক অটুট বন্ধনে গাঁথা। ভাতিজীকে রবীন্দ্রনাথ কতটা স্নেহ করতেন তা বোঝা যেত ইন্দিরাকে পাঠানো তার চিঠিগুলো দেখলেই!
রবী ঠাকুরের সাহিত্যকর্মের অন্যতম এক শাখা হলো তার পত্র সাহিত্য। প্রায় ২২টি জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি এই পত্রগুলো লিখেছিলেন। সবচেয়ে বেশি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে। আর সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখতেন ভাতিজি ইন্দিরাকে। রবীন্দ্রনাথের সেসব চিঠির খণ্ডাংশ নিচে তুলে ধরলে বোঝা যাবে ইন্দিরা দেবীর আসন তার চাচার কাছে কতটা অতুলনীয় ছিল!
তিনি লিখেছিলেন,
‘অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছে…যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই।…বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের—বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর— সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। …কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।…আমার এই, সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। ’
এই সকল চিঠিতে উপস্থিত থাকত তার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের) কল্পনা, ভাবনা, ব্যাকুলতা, আকাঙ্ক্ষা, ধ্যানধারণা, মানুষজন, নদনদী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক সাবলীল উপস্থাপন।
রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লিখছেন,
‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি। …তোকে আমি যখন লিখি, তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।’
চিন্তা চেতনা, ভাব-আদর্শের দিক থেকে রবিঠাকুরের সাথে তার এতটাই মিল ছিল যে তাকে রবিঠাকুরের ভাবশিষ্যা বলা হতো। রবী ঠাকুর তাকে ভালোও বাসতেন খুব। উপরে বর্ণিত ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অংশটুকুতে তিনি তার আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নিজের মনের অনুভূতি যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তা থেকে উপলব্ধি করা যায় ইন্দিরা দেবী শুধু আদরের ভাতুষ্পুত্রী নয় তার মানসসঙ্গীও ছিলেন।
No comments:
Post a Comment