সারাজীবনে অনেক নাটক, গল্প ও সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি। তাঁর রচিত কিছু বিখ্যাত বই ‘স্টোরিস অফ মিস্টার কেউনার’, ‘টু দোজ বর্ন আফটার’, ‘লাভ পোয়েমস’, ‘টেলস ফ্রম দ্য ক্যালেন্ডার’ প্রভৃতি। ব্রেখটের গল্প থেকে তৈরি হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র, যেমন ‘গ্যালিলিও’, ‘দ্য মাদার’, ‘দ্য শেমলেস ওল্ড লেডি’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা কিছু বিখ্যাত কবিতা হল, ‘আ ব্যাড টাইম ফর পোয়েট্রি’, ‘চিলড্রেন’স ক্রুসেড’, ‘ফ্রম আ জার্মান ওয়ার প্রাইমার’, ‘জার্মানি’ ইত্যাদি। মৃত্যুর সময় তাঁর অনেক নাটক অসমাপ্ত ছিল ও অনেক সমাপ্ত নাটকও অভিনীত হয়নি।
সাহিত্যকর্ম
(১৯২৮) ডি দ্রাইগ্রোশেন্ওপার (Die Dreigroschenoper, বাংলায় "তিন পেনির অপেরা")
(১৯৩০) আউফষ্টিগ উন্ট ফাল ডের ষ্টাট মাহাগোনি (Aufstieg und Fall der Stadt Mahagonny, বাংলায় "মাহাগোনি শহরের উত্থান ও পতন")
(১৯৪১) মুটার কুরাগে উন্ট ইরে কিন্ডার (Mutter Courage und ihre Kinder, বাংলায় "মা সাহস ও তার সন্তানেরা")
(১৯৪৩) লেবেন ডেস গালিলাই (Leben des Galilei, বাংলায় "গ্যালিলিওর জীবন")
(১৯৪৮) ডের কাউকাজিশে ক্রাইডেক্রাইস (Der kaukasische Kreidekreis, বাংলায় "ককেশীয় চকবৃত্ত")
রচনাবলি
The Threepenny Opera
Life of Galileo
Mother Courage and Her Children
The Good Person of Szechwan
The Caucasian Chalk Circle
Mr Puntila and his Man Matti
The Resistible Rise of Arturo Ui
১৮৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জার্মানির অগসবার্গ (Augsburg) শহরে ব্রেখট-এর জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ছিল ইউগেন বার্থোল্ড ফ্রেডরিখ ব্রেখট (Eugen Berthold Friedrich Brecht)। তাঁর বাবার নাম বার্থোল্ড ফ্রেডরিখ ব্রেখট এবং মায়ের নাম ছিল সোফি। তাঁরা উভয়েই খ্রীস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হলেও সোফি ছিলেন ধার্মিক প্রটেস্ট্যান্ট এবং ফ্রেডরিখ ছিলেন রোমান ক্যাথলিক। তিনি একটি কাগজের কলে কাজ করে জীবিকানির্বাহ করতেন। পরবর্তীকালে কিশোর ব্রেখটের সাথে পাওলা বানহোলজার (Paula Banholzar) নামে এক মহিলার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাঁদের ফ্রাঙ্ক ব্রেখট নামে একটি পুত্রসন্তানও জন্ম নেয়। কিন্তু এই সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। মারিয়ানি জোফ (Marianne Zoff) নামে এক মহিলাকে ব্রেখট বিবাহ করেন। এই দম্পতির হ্যানি হাইওব (Hanne Hiob) নামে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছিল। তবে এই বিবাহও স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। অভিনেত্রী হেলেন ওয়েগেল (Helen Weigel)-এর সঙ্গে ব্রেখটের পুনরায় বিবাহ হয়। হেলেন ও ব্রেখটের স্টিফান ব্রেখট (Stefan Brecht) নামে এক পুত্র ও বারবারা মেরি ব্রেখট (Barbara Marie Brecht) নামে এক কন্যা ছিল।
তাঁর মায়ের কথায় ছোটবেলায় ব্রেখট বাইবেল শিখেছিলেন যা সারাজীবন ধরে তাঁর লেখায় প্রভাব ফেলেছিল। অগসবার্গের বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ব্রেখটের পরিচয় হয় ক্যাসপার নেহার (Caspar Neher)-এর সাথে। এই বন্ধুত্ব আজীবন ছিল। পরবর্তীকালে নেহার তাঁর অনেক নাটকের সেট আঁকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে নানাভাবে ব্রেখটকে সাহায্য করেন।
যখন ব্রেখটের বয়স ১৬ বছর, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে উৎসাহী হলেও সেনাবাহিনীর হাতে তাঁর সহপাঠীদের নিগৃহীত হতে দেখে তিনি মন পরিবর্তন করেন। ১৯১৫ সালে বিখ্যাত রোমান কবি হোরাসে (Horace)-এর একটি বিখ্যাত কবিতার লাইন “Dulce et decorum est pro patrika mori” (দেশের জন্য জীবন বিসর্জন মধুর ও গৌরবময়)-এর প্রতিবাদে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর মতে এটি ছিল “একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সস্তা প্রচার” (Zweckpropaganda) এবং একজন বুদ্ধিহীন ব্যক্তিকেই এইভাবে দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করতে প্ররোচিত করা যেতে পারে। এই প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রোষনজরে পড়েন এবং তাঁকে বিদ্যালয় থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যালয়ের সহশিক্ষক পাদ্রী রোমুয়াল্ড সাওর (Romuald Sauer)-এর হস্তক্ষেপে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারেনি।
তাঁর বাবার সুপারিশে ব্রেখট নানা অজুহাত দিয়ে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করা এড়িয়ে যান। পরবর্তীকালে ১৯১৭ সালে ব্রেখট মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মেডিক্যাল কোর্সে ভর্তি হন। এখানে তিনি আর্থার কুচার (Arthur Kutscher)-এর কাছে নাটক শিক্ষা করেন। কুচার তরুণ ব্রেখটকে ব্যতিক্রমী নাট্যকার ও ক্যাবারে তারকা ফ্রাঙ্ক ওয়েডকাইন্ড (Frank Wedekind)-এর প্রশংসায় অনুপ্রাণিত করেন।
তার আগে থেকেই ‘বার্ট ব্রেখট’ নাম নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ব্রেখট প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ১৯১৮ সালের শরৎকালে একমাত্র জন্মভূমি অগসবার্গে ফিরে আসার জন্যই তিনি সামরিক জীবনে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। তিনি সামরিক যৌনস্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় চিকিৎসাকেন্দ্র (vd clinic)-এ একজন কর্মী হিসেবে অগসবার্গে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর এক মাস পরেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়য়।
১৯১৮ সালে ব্রেখট তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের নাটক ‘বাল’ লেখা শেষ করেন। তিনি বলতেন, “যে কেউই সৃজনশীল হতে পারে।” এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সম্পূর্ণ হয় তাঁর দ্বিতীয় নাটক ‘ড্রামস ইন দ্য নাইট’। ১৯২০ অথবা ১৯২১ সালের কোনো এক সময় ব্রেখট মিউনিখের কৌতুকাভিনেতা কার্ল ভ্যালেন্টিন (Karl Valentin)-এর রাজনৈতিক দলের একটি ছোট অংশ হয়েছিলেন। তিনি এরপর ভ্যালেন্টিনের অনেক অনুষ্ঠান দেখছিলেন এবং ভ্যালেন্টিনকে তুলনা করেছিলেন সর্বকালের সেরা কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন-এর সঙ্গে।
১৯২১ সালের নভেম্বর থেকে ১৯২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে ব্রেখট অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচিত হন। নাট্যকার আর্নল্ট ব্রনেন (Arnolt Bronen)-এর সাথে যুগ্মভাবে তিনি ‘আর্নল্ট ব্রনেন/বার্টল্ট ব্রেখট কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এইসময় ব্রেখট তাঁর নামের প্রথম অংশ পরিবর্তন করেন ও ‘আর্নল্ট’ নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন ‘বার্টল্ট’। এরপর থেকে তিনি সর্বত্র এই নামে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯২২ সালে মিউনিখে থাকাকালীন ব্রেখট বার্লিনের প্রভাবশালী সমালোচক হারবার্ট ইহারিং (Herbert Iharing)-এর সংস্পর্শে আসেন। হারবার্ট তাঁর নাটকগুলির সমালোচনা করেন, যা ব্রেখটকে প্রভাবিত করে। ১৯২৩ সালে একটি ছোট কৌতুক বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘মিস্ট্রিজ অফ এ বারবারশপ’-এর জন্য ব্রেখট চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। এটি পরিচালনা করেছিলেন এরিক এঙ্গেল (Erich Engel) এবং অভিনয় করেছিলেন কার্ল ভ্যালেন্টিন। প্রস্তাবিত সাফল্য না পেলেও এই ছবিটি সমালোচকদের মন জয় করেছিল। তাই জার্মানির চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি হিসেবে এটি জায়গা করে নেয়। এই বছরেই অভিনীত হয়েছিল ব্রেখটের রচিত প্রথম নাটক ‘বাল’। মে মাসে মিউনিখে অভিনীত হয় তাঁর আরও একটি নাটক ‘ইন দ্য জাঙ্গল’। পরিচালনা করেছিলেন এরিক এঙ্গেল।
১৯২৪ সালে ব্রেখট ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার লায়ন ফুটওয়াঙ্গার (Lion Feuchtwanger)-এর সাথে যৌথ সাহিত্য রচনা নিয়ে কাজ করেছিলেন। এইসময় রচিত হয় ‘এডওয়ার্ড ২’, যা ছিল ব্রেখটের অন্যতম জনপ্রিয় কাজ। সেই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যশালা ডয়েচ (Deutsches) থিয়েটারে সহযোগী নাট্যকারের কাজ নিয়ে ব্রেখট বার্লিনে চলে যান।
এই ভূমিকা গ্রহণ করে ব্রেখট অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজের কাজ অনেক কম ছিল। নভেম্বর মাসে এই মঞ্চেই অভিনীত হয়েছিল ব্রেখটের তৃতীয় নাটকের নতুন সংস্করণ ‘জাঙ্গল: ডেক্লাইন অফ আ ফ্যামিলি’। কিন্তু এটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯২৫ সালে তিনি দুটি সিনেমা দেখেছিলেন, যেগুলি তাঁর নাট্যজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এগুলি হল চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গোল্ড রাশ’ এবং আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’। ১৯২৬ সালে ব্রেখটের নামে প্রকাশিত হয় একগুচ্ছ ছোটগল্প, যদিও এগুলি লিখতে অনেকেই তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সেই বছরই ডয়েচ থিয়েটারে অভিনীত হয় তাঁর নাটক ‘ম্যান ইকুয়ালস ম্যান’। বিগত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক ঘটনার উপর ভিত্তি করে এই নাটকটি লিখেছিলেন তিনি। এরপর মার্ক্সবাদ ও সমাজবাদ নিয়ে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন।
১৯২৮ সালে কার্ট ওয়েল (Kurt Weill) ও ক্যাসপার নেহারের সঙ্গে যৌথভাবে ব্রেখট তৈরি করেন তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘দ্য থ্রিপেনি অপেরা’। এটিকে গীতিনাট্যও বলা যায়। জন গে রচিত ‘দ্য বেগার’স অপেরা’-র এলিজাবেথ হপম্যান কর্তৃক অনুবাদকে ভিত্তি করে এটি রচিত হয়েছিল। ১৯৩০ সালে কার্ল ওয়েলের কম্পোজিশনে মঞ্চস্থ হয় ব্রেখটের নাটক ‘রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য সিটি অফ মহাগনি’। এটি ছিল এটি রাজনৈতিক কৌতুকনাট্য। ১৯৩২ সালে ব্রেখট জার্মান চলচ্চিত্র ‘কুহলে ওয়াম্পে’ (Khule Wampe)-এর জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। এই চলচ্চিত্রটিতে তৎকালীন সমাজের বেকারত্ব ও বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।
১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে তিনি ‘লাইফ অফ গ্যালিলিও’ নাটকটি রচনা করেন। কিন্তু ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটি অভিনীত হয়নি। বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই-এর জীবনের অন্তিম দিকের কিছু ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই নাটক। ১৯৩৯ সালে মার্গারেট স্টেফিনের সাথে ব্রেখট সহ-রচিত ‘মাদার কারেজ এন্ড হার চিলড্রেন’ নাটকটিকে অনেকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ নাটক মনে করেন। পরবর্তীতে এই নাটকটি অনেকবার চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা হয়েছিল।
১৯৪১ সালে তিনি তাঁর জীবনের একমাত্র হলিউড চলচ্চিত্র ‘হ্যাংম্যান অলসো ডাই!’-এর জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। ‘দ্য হ্যাংম্যান অফ প্রাগ’ রেনহার্ড হেড্রিক (Reinhard Heydrich)-এর মৃত্যু নিয়ে কাহিনীটি রচিত হয়েছিল।
ব্রেখট এরউইন পিসকেটর (Erwin Piscator) ও ভি মায়ারহল্ড (Vsevolod Mayerhold)-এর গবেষণার উপর ভিত্তি করে ব্রেখট ‘এপিক থিয়েটার’-এর তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই তত্ত্ব বলে যে একটি নাটক দর্শককে তার সামনে চরিত্র বা কর্মের সাথে আবেগগত ভাবে চিহ্নিত করতে পারে না, বরং এর পরিবর্তে যুক্তিসঙ্গত আত্ম-প্রতিফলন এবং সমালোচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পারে।
No comments:
Post a Comment