তারাপদ রায়
দক্ষিণ কলকাতায় কালীঘাট মন্দিরের কাছেই মহিম হালদার স্ট্রিট। সেখানেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে আড্ডা মারতে আসতেন কয়েকজন তরুণ। সবার চোখে স্বপ্ন, বাংলা ভাষার সমুদ্রে তরী ভেসে আছে তাঁদের। ভরসা বলতে তাঁদের যাপন, এবং কলম। কবিতা, গল্প, আড্ডা এবং হুল্লোড়ে জমে থাকত সেই রাস্তা। সেখানেই যে ছিল আরেক ‘কৃত্তিবাসী’র বাড়ি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যিনি ছিলেন ‘টর্পেডো’। তারাপদ রায় মানে কেবল কবিতা আর রম্য রচনাই নয়, সঙ্গে তৈরি হয় অসংখ্য গল্পের…
কবিতার শব্দ আর যাপন নয় খানিক পরে আসুক। স্বয়ং তারাপদই বলেছিলেন, তাঁর জীবন কোনো কবির জীবন নয়। বরং আর পাঁচজনের মতোই সামান্য গৃহস্থের সংসার। তবে সে তো পরের কথা। ষাটের দশকে যখন বেশ কিছু তরুণ বাংলা সাহিত্য, কবিতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে, তখন সেই স্বপ্নের নদীতে ভিড়েছিলেন তিনিও। সুনীল, শক্তি, শরৎকুমার, সন্দীপনের সঙ্গে শুরু হল উত্তাল যাপন। আর সেসব হুল্লোড়ের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন তারাপদ রায় নিজে। যেমন গলার স্বর, তেমন তাঁর গল্পের ভাঁড়ার। একটা সময় তারাপদ রায়ের বাড়িতেই বসত বন্ধুদের আড্ডার আসর। তাঁদের ‘দৌরাত্ম্যে’ টেঁকা দায় হয়ে যেত পাড়ার বাকিদের।
সেই সঙ্গে চলত কবিতার চর্চাও। নিজের মধ্যেই একটা আলাদা জীবনের বৃত্ত তৈরি করেছিলেন তারাপদ। সহজ, সাবলীল সেই ভাষা; তার মধ্যেও নিজস্ব দর্শন, যাপনের ভিড়। আড্ডাছলে কাটতে কাটতেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার প্রতিমা’। তখনও মহিম হালদার স্ট্রিটেই থাকতেন তারাপদ রায়। প্রথম কবিতার বইয়ের ভেতরেই থেকে যায় মুদ্রণ প্রমাদ। ‘মহিম হালদার স্ট্রিট’-এর ‘মহিম’ বদলে যায় ‘মহিষ’-এ। যা নিয়ে পরে ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি অনেকে। এসবের ভেতর দিয়েই স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছিল তাঁর কবিতা, সেই প্রথম দিন থেকেই…
রচনাসমূহ
ক খ গ ঘ (১৯৯৬),
কাণ্ডজ্ঞান,
বিদ্যাবুদ্ধি,
জ্ঞানগম্যি,
বুদ্ধিশুদ্ধি,
শোধবোধ (১৯৯৩),
জলভাত,
এবং গঙ্গারাম,
পটললাল,
সর্বাণী এবং,
বলা বাহুল্য (২০০০),
বালিশ,
কী খবর,
ধারদেনা,
ঘুষ,
রস ও রমণী,
শেষমেষ,
সরসী,
জলাঞ্জলি,
সন্দেহজনক,
বাঁচাবার,
স্ত্রী রত্ন,
মেলামেশা,
মারাত্মক,
ভদ্রলোক,
বানরেরা মানুষ হচ্ছে,
ডোডো তাতাই পালাকাহিনী,
ছাড়াবাড়ী পোড়াবাড়ী,
টমটমপুরের গল্প,
দুই মাতালের গল্প ও অন্যান্য,
ভাগাভাগি (১৯৯৭,
সর্বনাশ (২০০১)
রম্যরচনা ৩৬৫
কবিতার বই
তোমার প্রতিমা (১৯৬০),
ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকাতে স্বাধীন (১৯৬৭),
কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু (১৯৭০),
নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক (১৯৭৪),
পাতা ও পাখিদের আলোচনা (১৯৭৫),
ভালোবাসার কবিতা (১৯৭৭),
দারিদ্র্যরেখা (১৯৮৬),
দুর্ভিক্ষের কবিতা,
জলের মত কবিতা (১৯৯২),
দিন আপনি দিন খাই (১৯৯৪),
টিউবশিশুর বাবা (১৯৯৫,
ভালো আছো গরীব মানুষ (২০০১),
কবি ও পরশিনী (২০০২)
তিনি শিরোমণি পুরস্কার ও কথা পুরস্কার (১৯৯৫) এ ভূষিত হয়েছেন।
জন্ম ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে অবিভক্ত বাংলায় বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। সেখানকার বিন্দুবাসিনী হাই ইংলিশ স্কুল হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় কলেজে পড়তে আসেন। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে পড়াশোনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে স্নাতক উপাধি লাভ করেন। ওই সময়েই কলকাতার কৃত্তিবাস পত্রিকাগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কবি হিসাবে পরিচিতির সাথে অজস্র গদ্য রচনাও লিখেছেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কিছুদিন উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায় শিক্ষকতা করেন। তারপরে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধিকর্তার পদ থেকে অবসর নেন। সম্পাদনা করেছেন দুটি লিটল ম্যাগাজিন- 'পূর্ব মেঘ' ও 'কয়েকজন'।
বাল্য অবস্থা থেকেই কবিতা রচনা করে গেছেন তিনি। তার প্রথম কবিতার বই 'তোমার প্রতিমা' প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার প্রকাশিত কবিতা সহস্রাধিক। কবিতার পাশাপাশি লিখতেন রম্যরচনা। তাছাড়াও লিখেছেন অজস্র গল্প, ছোট উপন্যাস ও শিশু সাহিত্য। তিনি রসসাহিত্যে ও শিশু সাহিত্যে বেশ গতিশীল ছিলেন। তার 'ডোডো-তাতাই' বিখ্যাত শিশু চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে সার্থক রম্যরচয়িতাদের মধ্যে পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি নক্ষত্র রায় এবং 'গ্রন্থকীট ছদ্মনামেও লিখতেন। সরকারি অতিথি হয়ে ঘুরেছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বহু দেশে। শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
ভেতরে ভেতরে বেশ মজার মানুষ ছিলেন তিনি। তা না হলে অমন দুর্দান্ত রম্য রচনাগুলো লিখতে পারতেন! বন্ধুদের লেখা চিঠির ভেতরেও ভরে দিতেন মজার কথা। সেই লেখাও হয়ে উঠত পড়ার মতো। হাসির মধ্যেও কেমন একটা কাব্যময়তা ছড়িয়ে আছে সেখানে। ১৯৬৫ সালে টাঙ্গাইল থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতেই মেলে তার ইঙ্গিত। আগে তারাপদ রায় বেশ অসুস্থ ছিলেন, চিঠি থেকে সেসব বোঝা যায়। তিনি সুনীলকে লিখছেন ‘এখন দুএকটা নীরস সংবাদ দিতে পারি। মধ্যে চৌদ্দদিন যাকে বলে মনে হচ্ছিল সারা শরীরে যেন পঁচিশটা মৌমাছির চাক বসেছে। বর্তমানে ভালো হয়ে গেছি তবে একেবারে চিতাবাঘের মতো, পাকা কাঁঠালের মতো চিত্রবিচিত্র হয়ে গেছি। ইচ্ছে হলে নিজেকে এখন সচিত্র তারাপদ রায় বলে বিজ্ঞাপিত করতে পারি।’ নিজের শরীরের অবস্থার এমন ‘সচিত্র’ বর্ণনা দিতে একমাত্র তারাপদই পারতেন…
দিনের শেষে সমস্ত জায়গায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল ‘কৃত্তিবাস’। ‘কয়েকজন’ নামে তারাপদ’র নিজেরও একটি পত্রিকা ছিল; কিন্তু কৃত্তিবাসের জায়গা যেন অন্য কোনো খানে। এমনকি নিজের সন্তানের নামও রেখেছিলেন ‘কৃত্তিবাস’। আর রম্য সত্তার পাশে নির্জন পাহাড়ি নদীর মতো বয়ে যেত কবিতা। নিজের জীবন দিয়ে যা বুঝতেন, যা দেখতেন তাকেই সহজ ভাষায় হাজির করতেন। ‘এক জন্ম’-এর মতো এক অদ্ভুত জীবনদর্শনের পাশাপাশি রাখা যায় ‘কাঁসার গেলাস’ কবিতাটি। যেখানে অতীতের দিকে ফিরে দেখা নিজেকে; তার সঙ্গেই মিলিয়ে দেখা বর্তমান ‘আমি’-কে। কবিতার হাত ধরেই যেন নিজেকে খুঁজতেন তিনি। জোর করে কাঠিন্য নয়; বরং নিজের সাধারণ জীবনের মতোই আনন্দ করে লেখা প্রতিটি লাইন। সেই পথেই হাজির হন আরও একজন— মিনতি রায়।
==============={{{{{{{{{{{{{={=========
No comments:
Post a Comment