বেণীমাধব দাস
জন্ম ২২ নভেম্বর ১৮৮৬ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার শেওড়াতলী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কৃষ্ণ চন্দ্র দাস। দর্শন শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। তাঁর হাতে এটি একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের পর তিনি ঢাকা, কটক র্যাভেনশ স্কুল, কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল ও কলকাতার স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ব্রাহ্ম নেতা মনীষী কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন, এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রকাশনা ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার ও নববিধান-এর সাথে যুক্ত ছিলেন।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা তিনি। সেই চট্টগ্রাম, যা একসময় ব্রিটিশ শক্তির মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস— এই সমস্ত নিয়েই ছিল তাঁর পাণ্ডিত্যের জগৎ। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। প্রায় একার চেষ্টায় চট্টগ্রাম কলেজকে শিখরে তুলে ধরেছিলেন। অনেকের মতো একটা সময় আকৃষ্ট হন ব্রাহ্ম ধর্মে। ‘নববিধান’ এবং ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’— ব্রাহ্মদের এই দুটো পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তিনি। ভাগ্যের ফেরে কলকাতা, চট্টগ্রাম থেকে হাজির হওয়া ওড়িশার কটকে। তখনও কি ভেবেছিলেন, জীবনের সেরা ছাত্রটিকে এখানে পাবেন…
দেশপ্রেম ও শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ বেণী মাধব ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। দর্শন ছাড়াও তিনি অর্থনীতি ও ইতিহাসে পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কাকিনাদায় (বর্তমানে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ এ ) অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া থেইস্টিক কনফারেন্সের সভাপতিত্ব করেন। সভাপতি হিসাবে তার ভাষণ পরে মডার্ন থেইস্টিক মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া নামক পুস্তিকায় প্রকাশ করা হয়। তার প্রবন্ধ সংকলন পিলগ্রিমেজ থ্রু প্রেয়ার্স (প্রার্থনার মাধ্যমে তীর্থযাত্রা) সমালোচকদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেছিল। সুভাষচন্দ্র তার ভারত পথিক গ্রন্থে তার কথা উল্লেখ করেছেন।
কটক ও কৃষ্ণনগরে বেণীমাধবের সংস্পর্শে আসা আরেকজন পণ্ডিত, নিরঞ্জন নিয়োগী লিখেছেন - here was no harshness in his administration, no pompous display surrounding it – his cool and charming behaviour used to have a remarkable impact on his students. Even those who were turbulent calmed down, became respectful towards him and were endeared to his affections. (এখানে তার প্রশাসনে কোন কঠোরতা ছিল না, এর চারপাশে কোনও আড়ম্বরপূর্ণ প্রদর্শন ছিল না - তার কোমল ও মনোমুগ্ধকর আচরণ তার শিক্ষার্থীদের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলত। এমনকি যারা অস্থির ছিল তারা শান্ত, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং তার স্নেহের পাত্রে পরিণত হয়।)"
বেণী মাধব দাসের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার। অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনের যোগ দেওয়ার কারণে তার মেজছেলে কারাবরণ করেন। পত্নী সারদা দেবী ছিলেন মধূসূদন সেনের কন্যা। মধুসূদন সেন কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক হিসাবে কাজ করার পর অবসর নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। সারদা দেবী সমাজ সেবায় সক্রিয় ছিলেন। তাদের দুই কন্যার নাম কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য) এবং বীণা দাস (ভৌমিক)। কল্যাণী দাস সমাজ সেবা ও বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি ছাত্রী সংঘের উদ্যোক্তা ছিলেন এবং ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতির জন্য কারাবরণ করেন। বীণা দাস ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবে সক্রিয় ছিলেন এবং ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সমাবর্তনে বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য ৯ বছর কারা বরণ করেন। মেয়ের বিপ্লবী কার্যকলাপে বাধাদান তো দূরস্থান, দেশপ্রেমিক বেনীমাধব রীতিমতো উৎসাহ প্রদান করেছিলেন।
শুধু কি ছাত্রদের মধ্যেই প্রভাব ফেলেছিলেন তিনি? বাড়ির ভেতরেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশাত্মবোধ। সন্তানরা যখন বিপ্লবী কাজকর্মে জড়িয়ে ফেলে নিজেদের, তখনও সম্পূর্ণ সমর্থন করে এসেছেন তিনি। মেজছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় বেণীমাধব দাসের দুই মেয়ের কথা। বড়ো মেয়ে কল্যাণী দাস তো যুক্ত ছিলেনই নানা বিপ্লবী কাজের সঙ্গে। তবে সবথেকে দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাঁর ছোটো মেয়ে বীণা দাস। ১৯৩২ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। মঞ্চে উপস্থিত তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। মঞ্চে উঠে পুরস্কার নেওয়ার সময় লুকিয়ে রাখা পিস্তল থেকে তাঁর দিকে গুলি করেন বীণা দাস। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মারা যাননি গভর্নর। বীণার ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়। শেষে বেণীমাধববাবুকেও ডেকে পাঠানো হয় মেয়েকে বোঝানোর জন্য। একটাই উদ্দেশ্য, এই পিস্তল কোথা থেকে পেল মেয়েটি। কিন্তু পুলিশ তো জানে না বেণীমাধব দাস ঠিক কেমন ধারার মানুষ! পুলিশকে সহযোগিতা তো করলেনই না; বরং মেয়েকে আরও সাহস দিলেন। বাহবা দিলেন এমন কাজ করার জন্য। বীণাও এমন ভরসার হাত পেয়ে আরও জ্বলে উঠলেন। ব্রিটিশদের প্রতিবাদে বেণীমাধব নিজেই লিখলেন ২৫ পাতার লম্বা একটি বিবৃতি। এই সাহেবদের কাছে কোনোমতেই মাথা নত করা চলবে না…
শেষ পর্যন্ত নয় বছর কারাবরণ করে বীণা ছাড়া পান। নিজের চোখে স্বাধীনতা দেখে গিয়েছিলেন বেণীমাধব দাস। কিন্তু যা দেখতে চেয়েছিলেন, তা আর দেখা হয়নি। একটা গোটা দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেই সঙ্গে বাংলার বুকে জ্বলে উঠল দাঙ্গার আগুন। ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’ নীতির জালে এত সহজে পড়ে গেলাম আমরা! নোয়াখালি, কলকাতা— সব জায়গায় পড়ে আছে একের পর এক মৃতদেহ। মানুষ মানুষকে মারছে, আর তার ওপর দিয়েই আসছে স্বাধীনতা! ১৯৫২ সালের ২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই আঘাত শরীরে-মনে নিয়ে রেখেছিলেন বেণীমাধব দাস। আর প্রিয় ছাত্রের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরের পর তাঁর প্রতিক্রিয়া? জানা যায়নি কখনও…
={{{{{{{{{{]{{]]{{∆∆∆∆∆∆∆{}}}{{}}}}}}}}}}}}===
No comments:
Post a Comment