সুকুমার রায়।
"সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে
আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে।
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে-
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে."
রচনাবলি
আবোল তাবোল
পাগলা দাশু
হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি
খাই-খাই
অবাক জলপান
লক্ষ্মণের শক্তিশেল
ঝালাপালা ও অনান্য নাটক
হ য ব র ল
শব্দ কল্প দ্রুম
চলচ্চিত্তচঞ্চরী
বহুরুপী
ভাষার অত্যাচার।
সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর কলকাতার এক দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশীয়[৬] ব্রাহ্ম পরিবারে। সুকুমার ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। তার আদিনিবাস বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামে। মসূয়াতে বসবাসের আগে তাঁর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত চাকদহে৷[৭] সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তার দুই ভাই। এ ছাড়াও তার তিন বোন ছিল, তারা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।
সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যানুরাগী, যা তার মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।
তিনি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি. (অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান।[৯] সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন।
সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তার ছোটভাই এই কাজে তার সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনেক সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাদের পাশে দাড়ান।
সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন তার লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তার বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তার প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।
প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব (ইংরেজি ভাষা: Monday Club) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মনডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ' পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি।
ইংলান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/প্রচ্ছদশিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে।
সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় 'অতীতের কথা' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে - ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ছিলেন, তার ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা সুকুমার করেছিলেন।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুকুমারের নাটকের শখ বাড়ে। ছেলেবেলায় অন্যের লেখা কবিতা বা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে ভাইবোন, আত্মীয়, বন্ধুদের নিয়ে অভিনয় করা হত, এ বার নিজে নাটিকা লেখা ধরলেন। শেখাতে লাগলেন অভিনয়ও। ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়েই দিব্যি তৈরি হয়ে গেল প্রপ— কম্বলের ধারের ঝালর, ছেঁড়া মোজা, ধোপার পুঁটলি, খড়ি, গোমাটি, চুনকালি ইত্যাদি। আর নাটিকার বিষয়? কৈশোরে রচিত ‘রামধন-বধ’ নাটকের বিষয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। ‘নেটিভ নিগার’ দেখলেই নাক সিঁটকানো র্যাম্প্ডেন সাহেবকে কী করে পাড়ার ছেলেরা জব্দ করল, সে গল্পই হল ‘রামধন-বধ’। তাকে দেখলেই ছেলেরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দেয়, আর সাহেব তেড়ে মারতে আসে, বিদ্ঘুটে গালি দেয়, পুলিশ ডাকে। আবার স্বদেশি জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়িতেও ঠাট্টা করতে ছাড়েননি সুকুমার। ভাই সুবিনয় যখন অলিগলি, বাজার খুঁজে জাপানি বা বিলিতি দ্রব্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে দেশি জিনিস কিনছে, তখন দাদা গান বাঁধলেন— “আমরা দিশি পাগলার দল,/ দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল!/ (যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি,/ (তা হক না) তাতে দেশের-ই মঙ্গল!”
ছাত্রাবস্থাতেই লিখছেন ‘ঝালাপালা’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। অভিনয়ের লোক জোগাড় করতে হবে, অতএব বন্ধুবান্ধব নিয়ে তৈরি হয়ে গেল ‘ননসেন্স ক্লাব’। সাদাসিধে অনাড়ম্বর ভাবে আয়োজিত নাটকগুলি স্রেফ নাটকের গুণেই উতরে যেত। প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেরই কেন্দ্রে থাকত কিঞ্চিৎ হাঁদা-প্রকৃতির একটি চরিত্র, যে আসলে নাটকের খুঁটি। ওই ভূমিকায় সুকুমার নিজেই অভিনয় করতেন। ‘তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকা’র বিমলাংশুপ্রকাশ রায়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, “তাঁর দল গড়ে উঠেছিল অতি সহজ, স্বাভাবিকভাবে, যেমন জলাশয়ের মধ্যেকার একটা খুঁটিকে আশ্রয় করে ভাসমান পানার দল গিয়ে জমাট বাঁধে। সত্যই তিনি খুঁটিস্বরূপ, আমাদের অনেকের আশ্রয়।”
পুণ্যলতার খুদে গল্পগুলি মাতিয়ে রাখত খুদে পাঠকদের। পরের ভাই সুবিনয় (মণি) কয়েক বছর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। মজার গল্প লিখতেন, খেলাধুলো আর ধাঁধা নিয়ে বই প্রকাশ করেন। ছোট ভাই সুবিমলও লেখক। তাঁর ‘বেড়ালের হারমোনিয়াম’ তো সবার মন ভাল করা একখানা গল্প। সবচেয়ে ছোট বোন শান্তিলতাও (টুনী) ছোটবেলায় ‘সন্দেশ’-এ কবিতা লিখেছিলেন। তবে বলতেই হয়, এঁদের সকলের চেয়ে প্রতিভায় আলাদা ছিলেন সুকুমার।
প্রবল চঞ্চল, ফুর্তিবাজ। সব কিছুতে উৎসাহ, খেলাধুলোর পাণ্ডা। কলের খেলনা ঠুকে ঠুকে দেখত সে, কী করে চলে। বাজনা ভেঙে দেখত, কোথা থেকে আওয়াজ বেরোয়। অসীম কৌতূহল যে! ও দিকে, ছোট লাঠি হাতে ছাদময় তাড়া করে বেড়াত বোর্ডিংয়ের মেয়েদের। বিশাল তিনতলার ছাদের উঁচুতে একটা গোল ফুটো ছিল, এক বার সেটা গলে কার্নিসে নামার চেষ্টা করেছিল! সেই বয়সেই চমৎকার গল্প বলতে পারত তাতা। উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাণ্ড একটি বই থেকে জীবজন্তুর ছবি দেখিয়ে টুনি, মণি আর খুসীকে আশ্চর্য মজার গল্প বলত। বই শেষ হয়ে গেলে জীবজন্তুর গল্প বানাত— মোটা ভবন্দোলা কেমন দুলে থপথপিয়ে চলে, ‘মন্তু পাইন’ তার সরু গলাটা কেমন গিঁট পাকিয়ে রাখে, গোলমুখে ভ্যাবাচোখ কম্পু অন্ধকার বারান্দার কোণে দেওয়ালের পেরেকে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে ইত্যাদি। হেমন্তকুমার আঢ্য লিখছেন, “অসূয়াশূন্য, আঘাতশূন্য, উজ্জ্বল হাস্যরস সৃষ্টিতে আপামর বাঙালীকে যিনি মুগ্ধ করেছেন বাল্যকালের একটি নির্দোষ ক্রীড়া-কৌতুকের মধ্যে তাঁর ভাবী পরিচয় ফুটে ওঠে।”
‘রাগ বানাই’ বলে একটা খেলা ছিল তাতার। তার নিজেরই তৈরি। হয়তো কারও উপরে রাগ হয়েছে, কিন্তু শোধ নেওয়ারও উপায় নেই। তখন সে ‘আয়, রাগ বানাই’ বলে সেই লোকটার সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প বানিয়ে বলতে থাকত। তার মধ্যে বিদ্বেষ বা হিংস্রভাব থাকত না, অনিষ্ট করার কথাও থাকত না, কেবল মজার কথা। তার মধ্য দিয়েই রাগটাগ জল হয়ে যেত। ‘হ য ব র ল’র হিজিবিজবিজের কথা মনে পড়তে পারে। উদ্ভট সব কল্পনা করে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ত হিজিবিজবিজ!
মজা করতে যেমন পারত, তেমনই নানা বিষয়ের— বিশেষত ভাষার উপরে অসামান্য দখল ছিল ছোটবেলা থেকেই। ‘কবিতায় গল্প বলা’ নামে এক খেলা চলত তাদের বাড়িতে। বড়রাও যোগ দিতেন। কোনও একটা জানা গল্প কেউ কবিতায় বলবে, শুধু প্রথম লাইনটা। পরের জন দ্বিতীয় লাইন। এ রকম ভাবে চলতে থাকবে। না পারলে ‘পাস’। এক দিন হচ্ছে ‘বাঘ ও বক-এর গল্প’— “একদা এক বাঘের গলায় ফুটিয়াছিল অস্থি।/ যন্ত্রণায় কিছুতেই নাহি তার স্বস্তি।/ তিনদিন তিন রাত নাহি তার নিদ্রা।/ সেঁক দেয় তেল মাখে লাগায় হরিদ্রা।” কিন্তু সুন্দরকাকা মুক্তিদারঞ্জন রায় যেই বললেন ‘ভিতরে ঢুকায়ে দিল দীর্ঘ তার চঞ্চু’, অমনি সবাই চুপ। চঞ্চুর সঙ্গে মিল দিয়ে কী শব্দ হয়? ‘পাস’ হতে হতে তাতার পালা আসতেই সে বলল, “বক সে চালাক অতি চিকিৎসক চুঞ্চু।” ভাইবোনরা রাগারাগি করল, ভাবল তাতা শব্দ বানাচ্ছে। কাকা ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, “চুঞ্চু মানে ওস্তাদ, এক্সপার্ট।”
প্রবোধচন্দ্র সেনের মত, “কবি মধুসূদনের পর বাংলার প্রধান ছন্দশিল্পী তিনজন— রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩) এবং সত্যেন্দ্রনাথ (১৮৮২-১৯২২)। এই তিন ছন্দ শিল্পী কবির পরেই উল্লেখ করতে হয় কবি সুকুমার রায়ের (১৮৮৭-১৯২৩) নাম।” মাত্র আট বছর বয়সে শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’ পত্রিকায় তাতার ‘নদী’ কবিতা প্রকাশিত হয়। পরের বছর দ্বিতীয় কবিতা ‘টিক্ টিক্ টং’ (মুকুল, জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৪)।
শিবনাথ শাস্ত্রীর পরিকল্পনা করা ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে ১২ বছর বয়স অবধি পড়তে পারত ছেলেরাও। সব ভাইবোনের মতো তাতাও ওখানেই পড়ত। পুণ্যলতা লিখছেন— “বাড়ির মধ্যেই স্কুল। এ দরজা দিয়ে বেরিয়ে ও দরজা দিয়ে ঢুকলেই হল।” সে কেমন স্কুল? শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাবনায়— “ব্রাহ্ম পাড়ায় ছোট ছেলেমেয়েদিগকে সর্বদা সমাজের মাঠে খেলিতে দেখিয়া মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম, ইহাদিগকে বেথুন স্কুল প্রভৃতি বিদ্যালয়ে না পাঠাইয়া এদের জন্য একটি ছোটো স্কুল করা যাক্।” দ্বারকানাথের পুত্র তথা সাংবাদিক প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (জংলী গাঙ্গুলী), দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, বিজ্ঞানী তথা বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রমুখ এই স্কুল থেকে পাশ করেছেন।
লাল গানে নীল সুর
১৮৯৫-এ উপেন্দ্রকিশোরেরা সপরিবার বাড়ি বদল করে ৩৮/১ শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে চলে এলে তাতা ভর্তি হল সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। তাতা বড় হল, ‘সুকুমার’ নামটা পরিচিত হতে শুরু করল। লীলা মজুমদার লিখছেন, “তাই বলে যে তিনি হাঁড়িমুখো গম্ভীর হয়ে উঠবেন, সে-আশা করলে ভুল হবে। বরং তাঁর রসবোধ আরও পাকাপোক্ত সুদূরব্যাপী হতে থাকল।” পণ্ডিত বলতেই যে ভারিক্কি বোঝায় তা তো নয়, তা নির্ভর করে জ্ঞান-বুদ্ধির উপরে। এ সময় থেকেই সুচিন্তিত মতামত তৈরি হল সুকুমারের।
তাঁর এক মাস্টারমশাই ছিলেন বড় ভাল মানুষ, কিন্তু কড়া বায়োস্কোপ-বিরোধী। একদিনের ক্লাসে সে বিষয়ে নিজের যুক্তি সাজানোর পরে প্রিয় ছাত্র সুকুমারকেও কিছু বলতে অনুরোধ করেন মাস্টারমশাই। সুকুমার বলেন, কিছু ছবি খারাপ, সেগুলো না দেখাই ভাল, কিন্তু ভাল ছবিও আছে, আর সে সব দেখলে অনেক কিছু শেখা যায়। মাস্টারমশাই মনঃক্ষুণ্ণ হন। সুকুমার জানতে চান, আপনি বায়োস্কোপ দেখেছেন? “আমি ওসব দেখি না”— কড়া জবাব। জোর করে মাস্টারমশাইকে নিয়ে একটা ভাল ছবি দেখতে যান সুকুমার। ছবিশেষে মাস্টারমশাই জানান, “তুমি আমার একটা মস্ত ভুল ভাঙিয়ে দিলে।”
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুকুমারের নাটকের শখ বাড়ে। ছেলেবেলায় অন্যের লেখা কবিতা বা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে ভাইবোন, আত্মীয়, বন্ধুদের নিয়ে অভিনয় করা হত, এ বার নিজে নাটিকা লেখা ধরলেন। শেখাতে লাগলেন অভিনয়ও। ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়েই দিব্যি তৈরি হয়ে গেল প্রপ— কম্বলের ধারের ঝালর, ছেঁড়া মোজা, ধোপার পুঁটলি, খড়ি, গোমাটি, চুনকালি ইত্যাদি। আর নাটিকার বিষয়? কৈশোরে রচিত ‘রামধন-বধ’ নাটকের বিষয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। ‘নেটিভ নিগার’ দেখলেই নাক সিঁটকানো র্যাম্প্ডেন সাহেবকে কী করে পাড়ার ছেলেরা জব্দ করল, সে গল্পই হল ‘রামধন-বধ’। তাকে দেখলেই ছেলেরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দেয়, আর সাহেব তেড়ে মারতে আসে, বিদ্ঘুটে গালি দেয়, পুলিশ ডাকে। আবার স্বদেশি জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়িতেও ঠাট্টা করতে ছাড়েননি সুকুমার। ভাই সুবিনয় যখন অলিগলি, বাজার খুঁজে জাপানি বা বিলিতি দ্রব্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে দেশি জিনিস কিনছে, তখন দাদা গান বাঁধলেন— “আমরা দিশি পাগলার দল,/ দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল!/ (যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি,/ (তা হক না) তাতে দেশের-ই মঙ্গল!”
ছাত্রাবস্থাতেই লিখছেন ‘ঝালাপালা’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। অভিনয়ের লোক জোগাড় করতে হবে, অতএব বন্ধুবান্ধব নিয়ে তৈরি হয়ে গেল ‘ননসেন্স ক্লাব’। সাদাসিধে অনাড়ম্বর ভাবে আয়োজিত নাটকগুলি স্রেফ নাটকের গুণেই উতরে যেত। প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেরই কেন্দ্রে থাকত কিঞ্চিৎ হাঁদা-প্রকৃতির একটি চরিত্র, যে আসলে নাটকের খুঁটি। ওই ভূমিকায় সুকুমার নিজেই অভিনয় করতেন। ‘তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকা’র বিমলাংশুপ্রকাশ রায়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, “তাঁর দল গড়ে উঠেছিল অতি সহজ, স্বাভাবিকভাবে, যেমন জলাশয়ের মধ্যেকার একটা খুঁটিকে আশ্রয় করে ভাসমান পানার দল গিয়ে জমাট বাঁধে। সত্যই তিনি খুঁটিস্বরূপ, আমাদের অনেকের আশ্রয়।”
ক্লাবের একটি হাতে লেখা পত্রিকাও বার করেছিলেন সুকুমার: ‘সাড়ে-বত্রিশ ভাজা’। বত্রিশ রকমের ভাজাভুজি আর তার উপরে আধখানা লঙ্কা বসানো, তাই সাড়ে বত্রিশ। অতি উপাদেয়। সম্পাদক সুকুমার, মলাট ও অধিকাংশ অলঙ্করণ তাঁর, বেশির ভাগ লেখাও। সম্পাদকের পাতা ‘পঞ্চতিক্তপাঁচন’ বড়রাও আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। ঠাট্টা থাকত, তবে খোঁচা নয়। মজা আর নির্মল আনন্দ।
ও দিকে, সিটি স্কুল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন সুকুমার। গম্ভীর লেখাতেও হাত দিলেন। বাঁধলেন দেশপ্রেমের গান: ‘টুটিল কি আজি ঘুমের ঘোর’। ১৯১০ সালে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম যুবসমিতির মুখপত্র ‘আলোক’ প্রকাশ করলেন। কিন্তু বেশি দূর এগোনোর আগেই জীবন অন্য দিকে বাঁক নিয়ে নিল। ফিজ়িক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করার পরের বছর গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি পেলেন সুকুমার। ফোটোগ্রাফি ও ছাপাখানার প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতযাত্রা করলেন। ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ‘এরেবিয়া’ স্টিমারে চড়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হলেন সুকুমার।
এর আগে বাড়ি বদলের কথা বলা হল। তার প্রধান কারণ ছিল উপেন্দ্রকিশোরের ফোটোগ্রাফি ও ছাপাখানার প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহ। বঙ্গদেশে তিনিই প্রথম হাফটোন প্রযুক্তিতে ছবি ছাপার ব্যবস্থা করেন। তার সরঞ্জাম সাজানো এবং তা নিয়ে কাজকর্মের মতো করেই বাড়িটার পরিকল্পনা ছিল। তবে শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতেও পাঁচ বছরের বেশি থাকা হয়নি তাঁদের। ১৯০০ সালে উঠে যান ২২ নং সুকিয়া স্ট্রিটে। ১৩ বছর পরে আবার ১০০ নং গড়পার রোডে।
এ সময়ে লন্ডন থেকে নিয়মিত চিঠি লিখছেন সুকুমার। বোঝা যায়, তাঁর ভাবনাচিন্তার ধারা তখনও পাল্টায়নি। দু’-একটি চিঠির দিকে চোখ রাখতে হয়। মাকে লিখছেন— “এখানে মাঘোৎসব হয়ে গেল। শুক্রবার ওয়ালডর্ফ হোটেলে মস্ত পার্টি হল। প্রায় ২৫০ লোক হয়েছিল। আমি চোগা চাপকান পরে গিয়েছিলাম। তাই দেখে অনেকে আমাকে পাদ্রি মনে করেছিল।” দিদি সুখলতাকে লিখছেন— “গত দু’বার মেল ভেতে আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়ম দেখতে বেরিয়েছিলাম।... খ্রীস্টমাসের ছুটিতে খুব ফুর্তি করা গেল।” আরও অনেককে লিখছেন কাজের কথা, পড়াশোনার কথা, কলেজের কথা, নতুন কাজ শেখার কথা। বাড়ির সকলের কুশল নিচ্ছেন। সে কালে বাঙালি ছেলেরা ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে কেমন জীবন যাপন করতেন, সুকুমারের চিঠিগুলিতে তার একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়।
বিলেতে গিয়ে ছাপার প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেন সুকুমার। ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ফেলো অব দ্য রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’ উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন। এমনই চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। সুকুমার বাংলা সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন, সে আমরা জানি। কিন্তু বাংলা মুদ্রণ জগৎকেও অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিলেত থেকে তাঁর অর্জিত পাঠ।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
বিলেত থেকে ফেরার পরে ১৯১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকানিবাসী সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় সুকুমারের। ফের কলকাতায় থিতু হয়ে বসা। ১০০ নং গড়পার রোডে জমে ওঠে আড্ডার ঠেক। কখনও রসের আলাপ, কখনও গম্ভীর কথাবার্তা। তবে বাধ্যতামূলক ছিল ভাল খাওয়াদাওয়া। সোমবারে আসর বসত তাই নাম ‘মান্ডে ক্লাব’। খাওয়ার বাহার দেখে কেউ একটু বেঁকিয়ে বলতেন ‘মণ্ডা ক্লাব’। কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়— “Monday Club নামে তিনি এক সাহিত্য-আসর প্রতিষ্ঠা করেন। বহু গণ্যমান্য লোক এই ক্লাবের সভ্য ছিলেন। যেমন: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, জীবনময় রায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায়, ইত্যাদি।” মান্ডে ক্লাব নিয়ে লীলা মজুমদার লিখছেন, “একটা প্রবাদ আছে যে যারা সবচাইতে বেশি কাজ করে, তাদেরই হাতে বাড়তি ফালতু কাজ করার সবচাইতে বেশি সময়ও থাকে। এ-কথাটি যে কত সত্যি, সুকুমারের জীবনই তার প্রমাণ।”
====={{{=={}={}={{}=}=}=}=}={{}=}{}=}{===
No comments:
Post a Comment