গানটির সুর এখনো কানে ভেসে আসে , শিল্পী বেঁচে নেই কিন্তু তার সৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অলিতে গলিতে এখনো সুরেলা কন্ঠের যাদুতে একান্ত মধুময়। তিনি হলেন -
নীলিমা সেন
"বাচ্চু গান গাইতে বসলে ও নিজেই একটা গান হয়ে যেত!”
সুচিত্রা মিত্র বাচ্চু সম্বোধনে যাঁর গান গাওয়া নিয়ে এমন ঐশ্বরিক আবেশের কথা বলেছেন তিনি শান্তিনিকেতনের আনন্দ পাঠশালা থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন অতি প্রিয় ‘বাচ্চুদি’। ৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম যাওয়া। সেখানকার পাঠভবনে পড়ার সময় নাচ, গান ও খেলায় সকলের নজর কেড়ে নেওয়া মেয়েটিই ভবিষ্যতের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নীলিমা সেন। তবে আজীবন তাঁর ‘বাচ্চু’ নামটি কাছের মানুষদের আন্তরিক স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়নি মোটেই। সে নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন রবীন্দ্র মহলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নাটকের হাতেখড়ি হয়েছিল নীলিমার। ‘ডাকঘর’-এ অমলের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন গুরুদেব নীলিমাকে। তিনি নিজে ঠাকুরদার চরিত্রে অভিনয় করবেন। এমনই কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কবি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা আর মঞ্চস্থ হয়নি। তবে নাটক না হোক, রবীন্দ্র গান নিয়ে বাচ্চুর বহমান সঙ্গীত-জীবন ছিল বর্ণময়। ১৯৪১-এ অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে। মায়ের কাছে প্রথম শেখা গান, ‘কী গাব আমি কী শোনাব’র ‘দ্বিধা’ কাটিয়ে বালিকা নীলিমা সেখানে গাইল ‘গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝেরবেলায় এলে’। সেটাই ছিল কবির বেঁচে থাকাকালীন শেষ জন্মদিনের উৎসব।
2004 সালে, সা রে গা মা নীলিমা সেনের চারটি একক পুনরায় প্রকাশ করেন: "খেলার সাথী, বিদায়দ্বার", "রাজা (নাটক), "তোমারি মধুর রূপে ভোরেছো ভুবন" এবং "তুমি বন্ধু তুমি নাথ"।
2005 সালে, সা রে গা মা, "কি রাগিনী বাজালে" প্রকাশ করেছে - একটি সংগ্রহে তার 21টি গান।
তিনি সমগ্র ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বার্মা এবং মালয়েশিয়া জুড়ে অভিনয় করেছেন। তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, লিলি ইসলাম, বাসবী দত্ত, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, রীতা ঘোষ, প্রমিতা মল্লিক, জয়ন্তী পুরকায়স্থ, সোমা রায়, অদিতি মহসিন প্রমুখ।
ললিতমোহন গুপ্ত ও পঙ্কজিনীদেবীর মেয়ে নীলিমার জন্ম ১৯২৮ সালের ২৮ এপ্রিল। কলকাতা শহরে জন্ম হলেও তাঁর ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে যায় কবিগুরুর স্বপ্নস্থান শান্তিনিকেতন। সে জায়গা নীলিমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তাঁর অনুভূতিমাখা কথায়, “তখন এত ছোট যে কোনও কিছু অনুভব করার ক্ষমতাই জন্মায়নি। তবু এইটুকুর জন্য ভগবানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে আমার চেতনার জাগরণ হয়েছে শান্তিনিকেতনের মুক্ত প্রকৃতির পটভূমিকায়। যে দিকে দু’চোখ যেত দেখতাম সবুজ গাছপালা, নীল আকাশ, নানা রঙের ফুল, কৃষ্ণচূড়া, বেল, যূঁই, লালমাটি সব মিলিয়ে একটা স্বপ্নময়তা। অথচ এই স্বপ্নের দেশই আমাদের প্রতিদিনের জীবনের একাধারে আশ্রয়, কর্মক্ষেত্র— ধ্যানধ্যারণার পীঠস্থান সবই। যে সব বিষয় নিয়ে মানুষ কাব্য করে, যে সব বস্তুকে মানুষ অবাস্তব বলে মনে করে, আমাদের জীবনে সে সব ছিল অতিবাস্তব, অতি-স্বাভাবিক।” শান্তিনিকেতনে নীলিমা সেন থাকতেন পূর্বপল্লির সোনাঝুরিতে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সে বাড়ির ছিল অবারিত দ্বার। তাঁর ছাত্রী রেজওয়ানা যেমন মনে করতে পারেন, “বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিদেশ থেকে শান্তিনিকেতন গিয়ে থাকার জায়গার সমস্যায় পড়তেন। তবে সমস্যা না মিটে যাওয়া পর্যন্ত বাচ্চুদির বাড়িই হয়ে উঠত তাঁদের সাময়িক ঠিকানা। তিনিও আপনজনের মতোই শেষ পর্যন্ত তাঁদের পাশে থাকতেন।”
গান শিখেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, ইন্দিরা দেবীচৌধুরানি (বিবিদি), কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (মোহরদি), ইন্দুলেখা ঘোষ ও অমিতা ঠাকুরের কাছে। অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এস্রাজ, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভিভি ওয়াঝেলওয়ারের কাছে শিখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নীলিমার সঙ্গে এস্রাজ বাজিয়েছেন শান্তিদেব ঘোষ ও অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সুরঙ্গমা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। অল্প কয়েকদিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নীলিমা যুক্ত ছিলেন। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁকে প্রথম নিয়ে যান আকাশবাণীতে। কলকাতার আকাশবাণীতে নীলিমা সেন সঙ্গীতশিক্ষার আসরও করেছেন। দুঃখের এবং বিষাদের গানে তাঁর কণ্ঠ ছিল অতুলনীয়। মজার কথা, দীর্ঘ দিন ‘বড় বিস্ময় লাগে’ গানটি বাচ্চুদির গান বলেই জানত আশ্রমের ছেলেমেয়েরা।
রবীন্দ্রনাথের গানের একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন নীলিমা। ১৯৪৪-এ প্রথম রেকর্ডের পর ১৯৪৭-এ কলম্বিয়া থেকে তাঁর গান ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ ও ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’ প্রকাশ পায়। এর পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ‘গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ ও ‘বাজাও রে মোহন বাঁশি’। মে মাসে ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়’ ও ‘না বলে যায় পাছে সে’। সেপ্টেম্বরে ‘ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে’ ও ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে’— মোট ৬টি গান বের হয়। প্রথম যুগে তাঁর জনপ্রিয় রবীন্দ্র গান— ‘শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে’ ও ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, সেটা ১৯৫০ সাল। শৈলজারঞ্জনের তত্ত্বাবধানে মেগাফোন, হিন্দুস্থান, এইচএমভি থেকেও রেকর্ড বের হতে থাকে।
শান্তিনিকেতনের সাহিত্যসভায় ‘অন্ধজনে দেহো আলো’, ‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি’, গানগুলি গাওয়ার পরে শ্রীআবু সৈয়দ আয়ুবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তাঁর সঙ্গীতজীবনে প্রেরণা জুগিয়েছে। আবু সৈয়দ আয়ুব তাঁর বিখ্যাত ‘রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান’ প্রবন্ধের শিরোনামে ‘কল্যাণীয়া নীলিমা সেন’কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন।
গাঁধীজি তখন শেষ বারের মতো শান্তিনিকেতনে এসেছেন। কবিগুরু এক বার যে গানটি শুনিয়ে গাঁধিজীর অনশন ভাঙিয়েছিলেন নীলিমা তাঁকে শোনালেন সেই গান— ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’।
নীলিমায় উদ্ভাসিত রবীন্দ্র গান
তখনও আম্রকুঞ্জে বসন্তোৎসব হয়। সে বারের অনুষ্ঠানে খুব ভিড় হয়েছিল। বাঁধানো বেদীতে বসে মেয়েরা সবাই গান গাইছে। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কিছু বহিরাগত ছেলে একেবারে মঞ্চের কাছাকাছি চলে এসে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছিল। আবির ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল মেয়েদের দিকে। তিনি ছিলেন মেয়েদের পিছন দিকেই। হঠাত্ কোথা থেকে একটা আমগাছের ছোট ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে রীতিমতো ছেলেদের দিকে এগিয়ে গেলেন ধমক দিতে দিতে। নরম ও উদাসীন মনের মানুষটির এমন রণমূর্তি দেখে তো সবাই অবাক! মিত ও মিষ্টভাষী সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নীলিমা সেন এ বার অতীতের তাঁরায়।
ছোটবেলা থেকেই নীলিমার গীতবিতান থেকে গান মুখস্থ করার অভ্যেস ছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে পাঠভবন থেকে সঙ্গীতভবনে গেলেন। ওখানে চার বছরের কোর্স সম্পূর্ণ করে আবার পাঠভবনে ফেরা। সেখান থেকেই ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক, তার পর একে একে আইএ ও বিএ পাশ করেন। ম্যাট্রিক দেওয়ার দু’বছর আগে অর্থাত্ ১৯৪৪-এ তাঁর প্রথম রেকর্ড— ভারত কোম্পানি থেকে ‘বুঝি বেলা বয়ে যায়’ এবং ‘আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে ১৯৭২ সালে প্রথমে লেকচারার-এর পদে নিযুক্ত হন, ক্রমে সেখানেই বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যক্ষ হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ তে সঙ্গীতভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন নীলিমা সেন।
১৯৫০ সালে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিয়কুমার সেনের সঙ্গে নীলিমা গুপ্তের বিবাহ হয়। তাঁদের কন্যার নাম নীলাঞ্জনা। বিয়ের পরের বছরই স্বামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান নীলিমা। সেখানে নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল সায়েন্স ও রেড ক্রস আয়োজিত ফাস্ট এইড-এ সার্টিফিকেট পান। ভয়েস অফ আমেরিকা ও বিবিসি থেকে তখন সঙ্গীত সম্প্রচার হত। বিদেশে স্বামী অমিয়কুমার সেনের অনুরোধে ‘এসো শরতের অমল মহিমা’ সুরপ্রধান গানটি গেয়ে শুধু আমেরিকা নয়, লন্ডন, ফ্রান্স, জার্মানির বহু শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন। অমিয়বাবু বুঝেছিলেন বিদেশে ছন্দের দোলা প্রতিনিয়ত। তাই ওখানে ছন্দের গানের থেকে সুরপ্রধান গান মানুষের মন ছুঁয়ে যাবে বেশি। ঘটলও তাই। পরে নীলিমা সেন স্বামীর সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ ‘সুরের গুরু’।
আবার, শুভ গুহঠাকুরতা তখন ‘দক্ষিণী’ প্রতিষ্ঠার পরে ফান্ড করার জন্য টাকা তুলছেন। আর সে উদ্দেশ্যেই নিউ এম্পায়ারে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিলেন তিনি। অমলের চরিত্রে যাঁকে ভেবেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সেই নীলিমাই এ বার তাতে অমরের চরিত্রে অভিনয় করলেন।
১৯৬১ সালে রেঙ্গুন সরকারের আয়োজনে কন্যা নীলাঞ্জনা ও শৈলজদা-সহ নীলিমা ও শান্তিনিকেতনের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ওখানে ‘চিত্রাঙ্গদা’ পরিবেশন করেন। ১৯৭৪-এ বাংলাদেশে ‘সৎ সঙ্গীত প্রসার সমিতি’র আয়োজনে পরিবারের সকলে ও শৈলজারঞ্জন বাংলাদেশে যান। এর প্রায় দশ বছর পর ১৯৮৪ সালে ফের বাংলাদেশ গিয়েছিলেন নীলিমা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে প্রধান অতিথি হয়ে। সেখানকার রবীন্দ্রমেলাতে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ ও সঙ্গীত’ বিষয়ে পেপারও পড়েছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মশতবর্ষে বিশ্বভারতীর একটি প্রতিনিধিমূলক সাংস্কৃতিক দলের নেত্রী হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর, জাকার্তা-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় নানা অনুষ্ঠান করেন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের আমন্ত্রণে ‘ছায়ানট’ আয়োজিত একটি কর্মশালায় যোগ দিতে যাওয়া ছিল তাঁর কাছে এক অনন্য অনুভূতি। সে কথা শিল্পী নিজেই জানিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ মহলে।
শান্তিনিকেতনে সেই সময় মাছ পাওয়া যেত না। কখনও কখনও বোলপুরের হাট থেকে কিনে আনতে হত। প্রচণ্ড গরমের দুপুরে গুরুপল্লির লালমাটির রাস্তায় দেখা যেত রোগা একটি বালিকা একপাল কুকুর-বিড়াল সঙ্গী করে চলেছে। খোঁজ চলত কারওর বাড়িতে মাছ রান্না হলে তার কাঁটাগুলো ওদের খাওয়াবে। এমনই অপরিমেয় মমতা নীলিমার আমৃত্যু ছিল। ১৯৯৫ সালের ১৩ মে রবীন্দ্রসদনে তাঁর পরিচালনায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ নীলিমার শেষ অনুষ্ঠান। কেন না ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ২৮ জুন নীলিমা সেন তাঁর চিরপরিচিত রবীন্দ্রজগৎ ছেড়ে চলে গেলেন অমৃতলোকে। অগণিত পরম ভক্তরা চোখের জলে সেই গান গাইতে গাইতে চির বিদায় জানালেন।
.........কি গাবো আমি কি শোনাবো ....
§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§§
No comments:
Post a Comment