Saturday, 27 April 2024

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রখ্যাত বাঙালি ছান্দসিক, রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক । ঊনিশ শতকের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক ছিলেন তিনি।। প্রবোধ চন্দ্র সেন। DT - 27.04.2024. Vol - 861. The blogger post in literary e magazine

প্রবোধচন্দ্র সেন 


প্রবোধচন্দ্র সেনের ছন্দবিষয়ক এ প্রবন্ধ পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ‘ছান্দসিক’ বলে অভিহিত করেন। পরে এ বিষয়ে প্রবোধচন্দ্র চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের স্বীকৃতি লাভ করেন। বাংলা ছন্দ বিষয়ক তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের দান (১৯৩১), ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ (১৯৪৫), ছন্দ পরিক্রমা (১৯৬৫), ছন্দ-জিজ্ঞাসা (১৯৭৩), বাংলা ছন্দচিন্তার ক্রমবিকাশ (১৯৭৮), ছন্দ সোপান (১৯৮০), আধুনিক বাংলা ছন্দ-সাহিত্য (১৯৮০), বাংলা ছন্দে রূপকার রবীন্দ্রনাথ (১৯৮১), নূতন ছন্দ পরিক্রমা (১৯৮৫) প্রধান। দীর্ঘ চৌষট্টি বছর প্রবোধচন্দ্র সেন ছন্দ-চর্চায় নিবিষ্ট ছিলেন এবং বাংলা ছন্দের আদ্যন্ত ইতিহাস বিজ্ঞানসম্মতরূপে রচনা করেন। বার বার তাঁকে বাংলা ছন্দের পরিভাষা পরিবর্তন করতে দেখা যায়। এর কারণ, তিনি বাংলা ছন্দের তিনটি রীতির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যকে চূড়ান্তভাবে ধরে দিতে চেয়েছেন। জীবনের একটা বৃহৎ সময় তিনি ছন্দ-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিতর্ক-আলোচনা শেষে বাংলা ছন্দের তিন রীতির নামকরণ করেন মিশ্রবৃত্ত, কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত।


বাংলা সাহিত্যে ছন্দবিশেষজ্ঞরূপে পরিচিত প্রবোধচন্দ্র সেন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির ছাত্র ছিলেন। এমএ পাশ করার পর তিনি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা আরম্ভ বা### করেন প্রথমে ঐতিহাসিক রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর এবং পরে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে তাঁর আগ্রহের মূলে ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রচারিত স্বদেশপ্রীতি এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ‘স্বদেশী আন্দোলন’। তাঁর ইতিহাসপ্রীতির মূলে ছিল স্বদেশপ্রীতি। এ সূত্রে তিনি আকর্ষণবোধ করেন বাংলার ভৌগোলিক ইতিহাসের প্রতি। তাঁর ‘বাংলার জনপদ পরিচয়’ পর্যায়ের বেশ কিছু প্রবন্ধ এ আকর্ষণের ফল। বাংলার ইতিহাস সাধনা (১৯৯২) গ্রন্থটি তাঁর ইতিহাস রচনার ইতিহাস (হিস্টরিয়োগ্রাফি) হিসেবে বিশেষ মূল্যবান বিবেচিত হয়েছে। তাঁর অপর গ্রন্থ তিনটি- বাংলায় হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগ (১৯৩০), ধর্মবিজয়ী অশোক (১৯৪৭), ধম্মপদ-পরিচয় (১৯৫৩) এ বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল সম্রাট অশোক ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি। শেষোক্ত গ্রন্থ দুটি এর প্রমাণ। প্রথম জীবনে তাঁকে বৈদিক ধর্মের প্রতি আগ্রহী দেখা গেলেও পরে তিনি বৌদ্ধধর্মে আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। প্রাচীন ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে রচিত দুটি গ্রন্থ রামায়ণ ও ভারত সংস্কৃতি (১৯৬২), ভারতাত্মা কবি কালিদাস (১৯৭৩) বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত হতে পারে।

তিনি গিরিধারী পাঠশালা ও ইউসুফ হাই ইংলিশ স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। তিনি কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২০ সালে আইএ, সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে ইতিহাসে অনার্সসহ বিএ এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্রাবস্থায় প্রবোধচন্দ্র সেন বিপ্লব-প্রয়াসী অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। রাজদ্রোহী সন্দেহে তিনি ১৯১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে অন্যান্য তরুণ কারাবন্দীর সঙ্গে তিনি মুক্তি (১৯১৮) পান। এ সময় কুমিল্লায় ‘ন্যাশনাল স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি বিনাবেতনে এ প্রতিষ্ঠানে ছাত্র স্বেচ্ছাসেবকরূপে চার বছর কাজ করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় খুলনার দৌলতপুর হিন্দু একাডেমীতে (বর্তমান দৌলতপুর কলেজে) ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিযুক্তি (১৯৩২-৪২) লাভের মধ্য দিয়ে। ১৯৪২ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহবানে তিনি বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনে রবীন্দ্র-অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৫১ সালে  বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলে প্রবোধচন্দ্র সেন বাংলা বিভাগের প্রধান হন (১৯৫২-৬২) এবং রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিক উৎসবকালে পুনর্গঠিত রবীন্দ্রভবনের প্রথম রবীন্দ্র-অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ (১৯৬২-৬৫) পদ লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করলে তাঁকে বিশ্বভারতীর প্রফেসর ইমেরিটাস করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র দৃষ্টিতে অশোক (১৯৫১), রবীন্দ্র দৃষ্টিতে কালিদাস (১৯৬১) এবং ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ (১৯৬২) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা (১৯৬১), ইচ্ছামন্ত্রের দীক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৮) এবং সম্পাদিত গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ (১৯৬২)। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা গ্রন্থটি প্রবোধচন্দ্র সেনের রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ক আলোচনায় একটি বিশেষ উলে­খযোগ্য অবদান।


প্রবোধচন্দ্র সেনের ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের ফলেই ভারতবর্ষের জাতীয়সঙ্গীত ‘জনগণমন’ গানটি সম্বন্ধে প্রচলিত ভ্রান্তির নিরসন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত (১৯৪৯) ও Indian’s National Anthem (১৯৪৯) গ্রন্থ দুটির কথা উলে­খ করা যায়।


উনিশ শতকের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং বাংলার সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক প্রবোধচন্দ্র সেন মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে একটি ‘ইচ্ছাপত্র’ লেখেন, যাতে তাঁর বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি কেবল প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন তাই নয়, প্রচলিত সামাজিক আচারের প্রতিও তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি তাঁর মৃত্যুতে শ্রাদ্ধ, উপাসনা, প্রার্থনা, স্মরণসভা এবং তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন না করতে নির্দেশ দেন। তবে উল্লিখিত পত্রে তিনি তাঁর শ্মশানযাত্রায় ধর্মীয় গানের পরিবর্তে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’র মতো দেশাত্মবোধক গান গাওয়া এবং ললাটে চন্দনের পরিবর্তে দেশের মাটি লেপে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি তাঁর বৃহৎ গ্রন্থাগার এবং স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব সন্তানদের ওপর দিয়ে তাঁর আবাসভূমি বিশ্বভারতীকে দান করেন।


সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রবোধচন্দ্র সেন বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলি পুরস্কার লাভ করেন। তার মধ্যে প্রফুল­স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৯), বঙ্কিমস্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), কেশবচন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৮), ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি (১৯৮০), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ডিলিট. (১৯৮৩), উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কৃর্তক প্রদত্ত ডিলিট. (১৯৮৩) এবং এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে মরণোত্তর রবীন্দ্রশতবার্ষিকী স্মারক পদক (১৯৮৭) উল্লেখযোগ্য। 

মৃত্যু - শান্তিনিকেতনে, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬।


বাংলা ছন্দ সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -

'ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ'(১৯৪৫)

'ছন্দপরিক্রমা'(১৯৬৫)

'ছন্দজিজ্ঞাসা'(১৯৭৪)

'বাংলাছন্দ চিন্তার ক্রমবিকাশ'(১৯৭৮)

'ছন্দ সোপান'(১৯৮০)

'বাংলা ছন্দে রূপকার রবীন্দ্রনাথ'(১৯৮১)

'নতুন ছন্দ পরিক্রমা'(১৯৮১) প্রভৃতি। 

ইতিহাসের পটভূমিতে রবীন্দ্র সাহিত্যের আলোচনা করে এক নতুন দৃষ্টি ভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। বইগুলি হল -

'ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ'(১৯৬২)

'রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা'

'ইচ্ছামন্ত্রের শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ' (১৯৭৮)

'ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত' (১৯৪৯)

ত্রজীবনে প্রবোধচন্দ্র প্রসিদ্ধ বৌদ্ধশাস্ত্রবিদ ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার সান্নিধ্যে আসেন। তার ফলে গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধা জন্মেছিল। তার প্রকাশ নিম্নোক্ত বইদুটিতে পাওয়া যায়-

ধর্মজয়ী অশোক' (১৯৪৭)

'ধম্মপদ-পরিচয়'

###############################

No comments: