নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত একজন বাঙালি আইনজীবী, অধ্যাপক এবং প্রগতিশীল সাহিত্যিক ছিলেন। জন্ম বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ৩ রা মে ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দে। তাঁর মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল টাঙ্গাইলের বাঁশীতে। তাঁর পিতার নাম মহেশচন্দ্র। মহেশচন্দ্র ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে নরেশচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এম এ পাস করেন। তারপর তিনি নিও-জার্মান অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ফিলোজফির উপরে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণা করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওকালতি পাস করে তিনি হাইকোর্টে যোগ দেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। তিনি প্রাচীন ভারতের ব্যবহার এবং সমাজনীতি নিয়ে গবেষণা করে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ডিএল উপাধি পান। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা আইন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল নিযু্ক্ত হন। ১৯২০ থেকে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন। আইন উপদেষ্টা হিসাবে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি এই সময়ে ডিন অফ দ্য ফ্যাকাল্টি অফ ল হন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাকুর আইন অধ্যাপক হন। ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় আইন কমিশনের সদস্য হন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে রিপন কলেজ এবং সিটি কলেজের সাথেও যুক্ত ছিলেন। আইন সংক্রান্ত কিছু গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে ইভোলিউশন অফ ল বিখ্যাত। নরেশ চন্দ্র সেন-গুপ্ত লাবণ্য প্রভা বক্সীকে বিয়ে করেন এবং ছয় কন্যা ও দুই পুত্রের জন্ম দেন। তাঁর দ্বিতীয় কন্যা, সুষমা সেনগুপ্ত ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, নারী শিক্ষার প্রথম দিকে অগ্রগামী এবং কলকাতায় মেয়েদের জন্য লেক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা, পূর্ণিমা সিনহা ছিলেন প্রথম বাঙালি নারী যিনি পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট পান। তার অন্যান্য সন্তানের পাশাপাশি তার নাতি-নাতনিরা বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল, পারফর্মিং আর্টস এবং সাহিত্যে তাদের শিক্ষা এবং কর্মজীবন অনুসরণ করে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভারত, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ক্ষেত্রে সুপরিচিত। ব্রিটিশ-ভারতীয় অভিনেত্রী সুনেত্রা সরকার তার নাতনি, যেমনটি বিবিসি সিরিজের 2017 এপিসোডে প্রকাশিত হয়েছিল আপনি কে মনে করেন আপনি আর? তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম প্রধান ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রোভস্ট।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানের পূর্বে তিনি ঢাকা কলেজের সহঅধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিনি নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের গুরুত্ব তুলে ধরেন ও পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দাবি করেন। তার উৎসাহে জগন্নাথ হলের বার্ষিক পত্রিকা "বাসন্তিকা" প্রকাশিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফরে এলে তিনি বাসন্তিকার জন্য তার বিখ্যাত গান "এই কথাটি মনে রেখ" লিখেছিলেন। সফল আইনজীবীর পাশাপাশি তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি বহু প্রবন্ধ, গল্প, নাটক ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে জীবনধর্মী উপন্যাস রচনার পথিকৃৎ। তাকে নিয়ে এক সময় বাংলা সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা এবং নীতি ও দুর্নীতির বিতর্ক হয়েছিল। তিনি ছিলেন সুষ্ঠ যৌন আবেগমূলক রোচক সাহিত্যের গুরু। তার উপন্যাসে যৌন এবং অপরাধ তত্ত্ববিশ্লেষণ প্রাধান্য পেয়েছিল। তিনি নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে তথাকথিত বিশুদ্ধ সতীত্বের থেকে বেশি মর্যাদা দিয়েছিলেন। তার দীর্ঘ ওকালতি জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে মানবমনের নানা কুটিল গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করেছিল। তার একাধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছিল। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০টি। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অ্যাবে অফ ব্লিস নামে অনুবাদ করেন। তার প্রথম উপন্যাস শুভায় (১৯২০) নায়িকার স্বামীর গৃহ ত্যাগ এবং স্বাধীন জীবনযাপনের ইচ্ছার সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। পাপের ছাপ-এ (১৯২২) দুঃসাহসিকতার পরিচয় আরো স্পষ্ট। যৌনভাবাশ্রিত ক্রিমিনাল মনোবৃত্তির চিত্রণ বাংলা উপন্যাসে এই প্রথম। মেঘনাদ-এ দেখা যায় নায়িকার চরিত্রে জন্মগত অপরাধীর স্বাভাবিক পাপপ্রবণতার চিত্র। লুপ্তশিখায় পতিতা নারীর জীবনের ক্লেদাক্ত গ্লানিময় দিকটিকে আদর্শবাদের আবরণে গোপন করে রাখবার কোন চেষ্টা করা হয় নি। সর্বহারায় পাওয়া যায় বেপরোয়া নাস্তিকের ছবি। বিপর্যয়ে দেখানো হয়েছে বৈপরীত্যের চিত্র। মনোরমার কঠোর বৈধব্য ব্রত পালন, আত্মনিগ্রহের ভিতর দিয়ে যৌবন চঞ্চলতার অনুভব ও এই নবজাত আকাঙ্খার বিবাহে পরিতৃপ্তি সাধন। আর অনীতার ভোগ এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ জীবনের কঠোর বৈরাগ্য ও কোমল বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্ব উপলব্ধির মধ্যে পরিসমাপ্তি - এই দুটি চিত্র পরিবর্তন সম্ভাবনার দুই বিপরীত সীমা স্পর্শ করেছে। কিন্তু এই চরিত্রগুলিতে প্রাণ সঞ্চারের অক্ষমতা, ঘটনা সমাবেশের আকস্মিকতা এবং তাদের অবিশ্বাস্য দ্রুত নাটকীয় পরিবর্তন, ভাব গভীরতার অভাব প্রভৃতির জন্য তার উপন্যাসগুলিতে নূতনত্বের প্রতিশ্রুতি যতটা আছে পূর্ণতা ততটা নেই। আধুনিক বাংলা উপন্যাসে তার গুরুত্ব সম্পর্কে ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন: "বর্তমানে তিনি কেবল কতকগুলি নূতন ঈঙ্গিত ও পথ নির্দেশের কৃতিত্ব দাবী করিতে পারিবেন। তথাপি এই নূতন ধারা প্রবর্তনের দ্বারা তিনি যে উপন্যাসের সীমা প্রসারিত করিয়াছেন তাহা সর্বোতোভাবে স্বীকার্য।" প্রথম জীবনে তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি কংগ্রেস কর্মী হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯২৫-২৬ খ্রিষ্টাব্দে নবগঠিত ওয়ার্কাস অ্যান্ড পেজ্যান্টস্ পার্টির প্রেসিডেন্ট হন। পরে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে লেবার পার্টি অফ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২১ জুন ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুতে কলকাতায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়েছিল তিনি তারও সভাপতি হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রগতিশীল চিন্তা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই সঙ্ঘের বিশেষ অবদান ছিল। রচিত গ্রন্থ শুভা (১৯২০) পাপের ছাপ (১৯২২) অগ্নি সংস্কার (১৯১৯) লুপ্তশিখা (১৯৩০) অভয়ের বিয়ে রূপের অভিশাপ (গল্পগ্রন্থ) ঠানদিনি (গল্পগ্রন্থ) আনন্দ মন্দির (১৯২৩ নাটক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের কনফারেন্স কক্ষটির নাম নরেশচন্দ্রের সম্মানে ‘অধ্যাপক ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত কনফারেন্স কক্ষ’ নামকরণ করা হয়। |
&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&
No comments:
Post a Comment