মহান আল্লাহর দয়া সম্পর্কে খৈয়াম প্রার্থনাসূচক রুবাইয়ে লিখেছেন,
“ দয়া যদি কৃপা তব
সত্য যদি তুমি দয়াবান
কেন তবে তব স্বর্গে
পাপী কভু নাহি পায় স্থান?
পাপীদেরই দয়া করা
সেই তো দয়ার পরিচয়
পূণ্যফলে দয়া লাভ
সে তো ঠিক দয়া তব নয়।"
এবং
আল্লাহকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানা প্রয়োজন এমন ইসলামী বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
“ বিশ্ব-দেখা জামশেদিয়া
পেয়ালা খুঁজি জীবন-ভর
ফিরনু বৃথাই সাগর গিরি
কান্তার বন আকাশ-ক্রোড়।
জানলাম শেষ জিজ্ঞাসিয়া
দরবেশ এক মুর্শিদে জামশেদের
এই জাম-বাটি এই আমার
দেহ আত্মা মোর।"
গিয়াসউদিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি (Ghiyāth ad-Dīn Abu'l-Fatḥ ʿUmar ibn Ibrāhīm al-Khayyām Nīshāpūrī (/ˈoʊmɑːr kaɪˈjɑːm, -ˈjæm, ˈoʊmər/; ফার্সি: غیاث الدین ابوالفتح عمر ابراهیم خیام نیشابورﻯ,
ওমর খৈয়াম
(জন্ম- মে ১৮ ১০৪৮ - মৃত্যু - ডিসেম্বর ৪, ১১৩১)
একজন ইরানের কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ।।।।
ওমর খৈয়াম রুবাই :
মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে "চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মনিমুক্তা "বলে অভিহিত করেছেন। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চারপংক্তির কবিতাগুলো প্রথমবারের মত ইংরেজিতে অনূদিত হয় খৃষ্টীয় ১৮৫৯ সালে। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের এই অনূবাদের সুবাদেই ওমর খৈয়াম বিশ্বব্যাপী কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। এ অনুবাদের মাধ্যমে ফিটজেরাল্ড নিজেও খ্যাতিমান হয়েছেন। তার এই অনুবাদ গ্রন্থ দশ বার মুদ্রিত হয়েছে এবং ওমর খৈয়াম সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রবন্ধ ও বই লিখিত হয়েছে।
ফার্সি কাব্য-জগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্বদৃষ্টির পথিকৃৎ। তিনি এমন সব চিন্তাবিদ ও নীরব কবিদের মনের কথা বলেছেন যারা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তা চেপে গেছেন। কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার নামে বা তার কবিতার অনুবাদের নামে নিজেদের কথাই প্রচার করেছেন। আবার কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার মধ্যে নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন।
অসাধারণ জ্ঞানী ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের অনেক কঠিন রহস্য বা প্রশ্নের সমাধান দিয়ে গেলেও অনেক অজানা বা রহস্যময় বিষয়গুলোর সমাধান জানতে না পারায় আক্ষেপ করে গেছেন। তাই তিনি জীবন এবং জগতের ও পারলৌকিক জীবনের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এসব প্রশ্ন শুধু তার মনেই নয়, যুগে যুগে জ্ঞান-তৃষ্ণার্ত বা অনুসন্ধানী মানুষের মনের প্রশান্ত সাগরেও তুলেছে অশান্ত ঝড়। দার্শনিকরা এ ধরনের প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। দর্শনের যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব হলেও তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। দর্শন বা বিজ্ঞান দিয়ে যে ভাব তুলে ধরা যায় না খৈয়াম তা কবিতার অবয়বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর তাই যুক্তি ও আবেগের করুণ রসের প্রভাবে ওমর খৈয়ামের চার-লাইন বিশিষ্ট কবিতাগুলো কবিতা জগতে হয়ে উঠেছে অনন্য। দার্শনিকরা একটি বই লিখেও যে ভাব পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী করতে পারেন না, গভীর অর্থবহ চার-লাইনের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ওমর খৈয়াম তা সহজেই তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,
“
اسرار ازل را نه تو دانی و نه من
وین حرف معما نه تو خوانی و نه من
هست از پس پرده گفتگوی من و تو
چون پرده بر افتد ، نه تو مانی و نه من
”
“ সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি
এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।
”
অর্থাৎ সৃষ্টির রহস্যকে আমাদের কাছে রহস্যময় ও পর্দাবৃত মনে হয়। কিন্তু মনের চোখ বা আসল চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব হলে এ পর্দা থাকে না।
আল্লাহকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানা প্রয়োজন এমন ইসলামী বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
“ বিশ্ব-দেখা জামশেদিয়া পেয়ালা খুঁজি জীবন-ভর
ফিরনু বৃথাই সাগর গিরি কান্তার বন আকাশ-ক্রোড়।
জানলাম শেষ জিজ্ঞাসিয়া দরবেশ এক মুর্শিদে
জামশেদের এই জাম-বাটি এই আমার দেহ আত্মা মোর।
”
মহান আল্লাহর দয়া সম্পর্কে খৈয়াম প্রার্থনাসূচক রুবাইয়ে লিখেছেন,
“ দয়া যদি কৃপা তব সত্য যদি তুমি দয়াবান
কেন তবে তব স্বর্গে পাপী কভু নাহি পায় স্থান?
পাপীদেরই দয়া করা সেই তো দয়ার পরিচয়
পূণ্যফলে দয়া লাভ সে তো ঠিক দয়া তব নয়।
জন্ম গ্রহণ করেছিলেন হিজরী পঞ্চম শতকের শেষের দিকে সেলজুক যুগে মে ১৮ ১০৪৮ সালে। তিনি ছিলেন মালিক শাহ সেলজুকের সমসাময়িক। অনেক ইতিহাসবিদের মতে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছু আগে ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এখনকার ইরানের পুরাতন নাম ছিল পারস্য আর তার রাজধানী ছিল খোরাসান।
ইরানের নিশাপুর শহরে ওমরের জন্ম। তার পিতা ছিলেন তাঁবুর কারিগর ও মৃৎশিল্পী। ছোটবেলায় তিনি বালি শহরে সে সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত শেখ মুহাম্মদ মানসুরীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। যৌবনে তিনি ইমাম মোআফ্ফাক-এর অধীনে পড়াশোনা করেন।
ওমর খৈয়ামের শৈশবের কিছু সময় কেটেছে অধুনা আফগানিস্তানের বালক্ শহরে। সেখানে তিনি বিখ্যাত মনীষী মহাম্মদ মনসুরীর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে তিনি খোরাসানের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত ইমাম মোয়াফ্ফেক নিশাপুরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের পুরো সময় জুড়ে ওমর তার সব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। দিনের বেলায় জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়ানো, সন্ধ্যায় মালিক-শাহ-এর দরবারে পরামর্শ প্রদান এবং রাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চার পাশাপাশি জালালি বর্ষপঞ্জি সংশোধন! সবটাতে তার নিষ্ঠার কোন কমতি ছিল না।
ইসফাহান শহরে ওমরের দিনগুলি খুবই কার্যকর ছিল। কিন্তু আততায়ীর হাতে সুলতান মালিক শাহ-এর মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নী ওমরের ওপর রুষ্ঠ হলে ওমর হজ্ব করার জন্য মক্কা ও মদীনায় চলে যান।পরে তাকে নিশাপুরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। নিশাপুরে ওমর গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিষয়ক তার বিখ্যাত কাজগুলো সম্পন্ন করেন।
জীবদ্দশায় ওমরের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসাবে। ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে তথা এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে বীজগণিতের যেসব উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গণিতবিদ এবং মহাকাশ গবেষক বা জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি পরাবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। এছাড়া তিনি দ্বি-পদী রাশিমালার বিস্তার করেন। ওমরের আর একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে।
১০৭০ খ্রিস্টাব্দে তার পুস্তক মাকালাত ফি আল জাবর্ আল মুকাবিলা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকে তিনি ঘাত হিসাবে সমীকরণের শ্রেণীকরণ করেন এবং দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেন। এই পুস্তকে তিনি কোনিক সেকশনের বিভিন্ন ছেদকের সাহায্যে নানারকম ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধান করেন। অর্থাৎ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বাস্তব মূর আছে এমন ত্রিঘাত সমীকরণ প্রথম সমাধান করেন। তিনি বর্তমানে প্যাসকেলের ত্রিভুজ নামে পরিচিত দ্বিপদী সহগের ত্রিভুজাকার এরেও লিখেছিলেন।
জ্যোতির্বিদ হিসাবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। সেলজুকের বাদশাহ মালিক শাহ ১০৭৩ সালে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে ওমরকেও আমন্ত্রণ জানান একটি মানমিন্দর নির্মাণের জন্য। ওমর তখন অত্যন্ত সফলভাবে (দশমিকের পর ছয় ঘর পর্যন্ত) সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন। তার হিসাবে এটি ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন। এই ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতি ৫,৫০০ বছরে এক ঘণ্টার গড়মিল হয়ে থাকে। আমরা যে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করি তাতে প্রতি ৩,৩০০বছরে একদিন গোলমাল হয়ে থাকে। কীভাবে পারস্য পঞ্জিকা সংশোধন করতে হবে তাও তিনি হিসাব করেন। ১০৭৯ সালের ১৫ মার্চ সুলতান জালাল আল-দিন মালিক শাহ সালজুক ওমরের সংশোধিত বর্ষপঞ্জী চালু করেন। ওমর একটি তারাচিত্র বা খন্ড চিত্রও তৈরি করেন তবে সেটি এখন আর পাওয়া যায় না।
মৃত্যু - ডিসেম্বর ৪, ১১৩১ সাল।
নিশাপুরে ওমরের সমাধি দেখতে অনেকটা তাঁবুর মতো। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত রুবাই সেখানে উৎকীর্ণ করা আছে।
তথ্য ঋণ
উইকিপিডিয়া
বাংলা পিডিয়া।
###############################
No comments:
Post a Comment