Tuesday, 11 June 2024

শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রমথনাথ বিশী। তিনি ১৯১০ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন। মেধা, প্রখর বুদ্ধিবৃত্তি, অধ্যয়ননিষ্ঠা, কবিপ্রতিভা ইত্যাদি গুণের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। রবীন্দ্রনাথের নিকট তিনি অভিনয় শেখেন এবং পরে তাঁর লেখা কয়েকটি যাত্রাপালা শান্তিনিকেতনে অভিনীতও হয়। Dt -11.06.2024. vol - 906. The blogger post in literary e magazine

খুদে পড়ুয়াটি নাকি কবিতা লেখে। শুনেই তলব। সারা দুপুর বসে চলল কবিতা লেখা। বিকেলে যিনি ডেকে পাঠিয়েছেন, তাঁর কাছে চলল ছাত্রটি। কবিতা শোনানো হল। কিন্তু প্রতিক্রিয়া মেলে না। বদলে মিলল এক প্লেট পুডিং ও এক প্লেট আনারস। খাওয়া শেষে যিনি ডেকেছিলেন, তাঁকে প্রণাম করল ছাত্রটি। আদর করে খুদেটির চুলে একটু টান মারলেন উনি। উনি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর. 



প্রমথনাথ বিশী





১৯০১ সালের ১১ জুন নাটোরের জোয়াড়ি গ্রামে জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা নলিনীনাথ বিশী ছিলেন বৃহত্তর রাজশাহী জেলার মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট এবং প্রভাবশালী জমিদার কেশবনাথ বিশীর দত্তক পুত্র।


প্রমথনাথ ১৯১৯ সালে  শান্তিনিকেতন থেকে ম্যাট্রিক পাস করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯২৭ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি  রাজশাহী কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি. (১৯২৯) এবং  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বাংলায় এমএ (১৯৩২) ডিগ্রি লাভ করেন। রামতনু লাহিড়ী গবেষণা বৃত্তি (১৯৩৩-৩৬) নিয়ে গবেষণা করার পর ১৯৩৬ সালে তিনি রিপন কলেজে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।

দীর্ঘকাল রিপন কলেজে অধ্যাপনা করার পর ১৯৫০ সালে প্রমথনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন এবং রবীন্দ্র অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হয়ে ১৯৭১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। মাঝখানে চার বছর (১৯৪৬-৫০) তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। প্রমথনাথ কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা (১৯৬২) এবং রাজ্যসভার সদস্য (১৯৭২) নির্বাচিত হন।

একজন সৃজনশীল লেখক ও মননশীল গবেষক হিসেবে প্রমথনাথ বিশীর সমান খ্যাতি আছে। গবেষণার ক্ষেত্রে প্রধানত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্র কাব্যপ্রবাহ (২ খন্ড, ১৯৩৯), রবীন্দ্র বিচিত্রা (১৯৫৫), রবীন্দ্র নাট্যপ্রবাহ (২ খন্ড, ১৯৬২), রবীন্দ্র সরণী (১৯৬৬) প্রভৃতি গবেষণাগ্রন্থ তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। তিনি মধুসূদন ও বঙ্কিম সাহিত্যেরও একজন দক্ষ সমালোচক ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৯৫৪), বঙ্কিম সরণী (১৯৬৫) ও মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৪) তাঁর এ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

নাটক

পূর্ণাঙ্গ নাটক

ঋণং কৃত্যা

ঘৃতং পিবেৎ (সানিভিলা)

ডিনামাইট

সাবিত্রীর স্বয়ম্বর

দক্ষিণপাড়ার মেয়েরা

মৌচাকে ঢিল

গভর্মেন্ট-ইন্সপেক্টর (নিকোলাই গোগোল রচিত একই নামের একটি নাটকের অনুবাদ[১])

পারমিট

ভূতপূর্ব স্বামী

হিন্দী উইদাউট টিয়ার্স

জাতীয় উন্মাদাশ্রম

একাঙ্ক নাটক

পশ্চাতের আমি

পরিহাস-বিজল্পিতম্

বেনিফিট অব ডাউট

কে লিখিল মেঘনাদবধ কাব্য

অসম্পূর্ণ নাটক

স্বর্গ

আফিঙের ফুল

গবেষণাগ্রন্থ ছাড়াও গল্প,  উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা এবং ব্যঙ্গ রচনার ক্ষেত্রেও প্রমথনাথ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কমলাকান্ত, বিষ্ণুশর্মা, অমিত রায়, মাধব্য ও স্কট টমসন ছদ্মনামে তিনি এসব লিখতেন। তাঁর রচিত উপন্যাস ও গল্পের মধ্যে কয়েকখানি প্রধান গ্রন্থ হলো: জোড়াদিঘির চৌধুরী পরিবার (১৯৩৮), কেশবতী (১৯৪১), গল্পের মতো গল্প (১৯৪৫), ডাকিনী (১৯৪৫), ব্রহ্মার হাসি (১৯৪৮), সিন্ধুদেশের প্রহরী (১৯৫৫), চলন বিল (১৯৫৭), অলৌকিক (১৯৫৭), কেরী সাহেবের মুন্সী (১৯৫৮), স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৬০), লালকেল্লা (১৯৬৩) ইত্যাদি। দেওয়ালী (১৯২৩) তাঁর প্রথম কবিতার গ্রন্থ। এছাড়া আছে বসন্তসেনা ও অন্যান্য কবিতা (১৯২৭), হংসমিথুন (১৯৫০), উত্তরমেঘ (১৯৫৩), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৬১) ইত্যাদি। ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব (১৯৫১), বিচিত্র উপল (১৯৫১) তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ।

কেরী সাহেবের মুন্সী ও লালকেল্লা তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। প্রথমটিতে ব্রিটিশ যুগের এবং দ্বিতীয়টিতে মুগল যুগের পটভূমিতে ব্যক্তি, সমাজ ও ইতিহাসের বিচিত্র বর্ণনা আছে। মানবচরিত্রের সূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহ সরস ভাষায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি বর্ণনা করেছেন। নেহেরু: ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব নামে তিনি একটি রাজনৈতিক গ্রন্থও রচনা করেন। সাহিত্যচর্চা এবং গবেষণায় কৃতিত্বের জন্য প্রমথনাথ রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬০), বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২) ও জগত্তারিণী পুরস্কার (১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৮৫ সালের ১০ মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। 


রবীন্দ্র-সঙ্গ এখানেই শেষ নয়। কখনও দেখা যায়, সে দিনের শিশুটির যৌবনের একের পর এক রচনা সমালোচনার আঘাতে ‘তছনছ’ করছেন কবি, তা-ও বিদেশি পণ্ডিত মরিস ভিন্টারনিৎস ও ভিক্তর লেসনির সামনে। আবার কখনও দেখা যাবে সেই শিশুর পরবর্তী কালে প্রথম উপন্যাস ‘পদ্মা’ পড়ে আচার্য রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়া দেবেন, ‘আর কিছু দিন পরে তোকে নিয়ে আমরা গৌরব করতে পারবো।’ তা শুনে ছাত্রের জবাব, ‘এখনি গৌরব করতে পারেন, ঠকবেন না।’ না, ঠকেননি রবীন্দ্রনাথ। ঠকেনি বাঙালি। কারণ, সে দিনের সেই শিশুটির নাম প্রমথনাথ বিশী, বাঙালির ‘প্রনাবি।’

নীহাররঞ্জন রায় ও প্রমথনাথ বিশী

এমএ পরীক্ষায় নজরকাড়া সাফল্যের জন্য বিশী ডাক পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার। কিন্তু সেই সময়ে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণে তিনি কলকাতায় ফিরলেন। যোগ দিলেন রামতনু লাহিড়ী গবেষক হিসেবে। গবেষণার ফসল, ‘রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ’। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা ‘ডক্টরেট’ তকমার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হল না। কিন্তু এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না তাঁর। তাঁর বক্তব্য, ‘আমি যা বই লিখেছি, তার ওজন এক মণ হবে। ভারেই কেটে যাবে।’


মাস্টারমশাই প্রমথনাথ কেমন? প্রায়ই দেখা যায়, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, খাদির ধুতি, পাঞ্জাবি, পায়ে পাম্পশু পরা প্রমথনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন। সঙ্গে হাতঘড়ি বা কলম, কোনওটাই নেই। পরে অবশ্য মেয়ের দেওয়া একটি ঘড়ি তাঁর কব্জিতে শোভা পেত।


এক এক দিন ক্লাসে পড়ুয়াদের ‘যেন আকাশে উড়িয়ে নিতেন তিনি’, অভিজ্ঞতা ছাত্র পবিত্র সরকারের। তবে প্রমথনাথের ক্লাস নিয়ে ভারী মজার অভিজ্ঞতাও রয়েছে পবিত্রবাবুর। ছাত্রাবস্থায় বোলপুর স্টেশনে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে স্বাগত জানান প্রমথনাথ। সেখান থেকেই আজীবন কংগ্রেসপন্থী, গাঁধীভক্ত। প্রমথনাথ তখন রাষ্ট্রপতি মনোনীত রাজ্যসভার সাংসদ। বিস্তর ছোটাছুটি সে সূত্রে। ক্লাসে একটু কম সময় দেওয়া হচ্ছে। এমনই এক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত প্রমথনাথ। সেই সময়ে পবিত্রবাবুরা চেপে ধরলেন, আজ ক্লাস নিতেই হবে।


স্পেশ্যাল পেপার ছোটগল্প আর উপন্যাসের ক্লাস। প্রমথবাবু এসেই জানতে চাইলেন, ছাত্ররা ওয়াল্টার স্কট, ডিকেন্স, টলস্টয়, বালজাক, উগো, রিচার্ডসন প্রমুখের লেখা পড়েছে কি না। উত্তর, ‘না’।

তা শুনে প্রমথবাবু বললেন, ‘কিছুই তো পড়নি তোমরা, তবে আর তোমাদের কী ক্লাস নেব?’

এর পরে ফের এক দিন মাস্টারমশাইকে ক্লাসে টেনে এনেছেন ছাত্ররা। ফের সেই একই প্রশ্ন। তত দিনে পড়ুয়ারা অবশ্য কিছু পড়ে ফেলেছেন। আর তা শুনেই গম্ভীর মুখে প্রমথনাথ বললেন, ‘তোমরা তো সবই পড়েছ দেখছি, তবে আর কী ক্লাস নেব তোমাদের?’ বলেই বেরিয়ে গেলেন রেজিস্টার খাতা হাতে। 

শান্তিনিকেতনে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের সঙ্গে 


এমন দরদ না থাকলে বোধহয় কৃতী সাহিত্যিকও হওয়াটা সম্ভব নয়। তাই তাঁর কাব্য সংগ্রহে ‘হংসমিথুন’, ‘যুক্তবেণী’, ‘বসন্তসেনা ও অন্যান্য কবিতা’ যেমন রয়েছে, তেমনই নাটকে ‘ঘৃতং পিবেৎ’, ‘ঋণং কৃত্বা’, উপন্যাসে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’, ‘কোপবতী’, ‘পনেরোই আগস্ট’, গল্পগ্রন্থে ‘ব্রহ্মার হাসি’, ‘গল্পের মতো’, ‘অলৌকিক’ প্রভৃতিও রয়েছে। রয়েছে, ‘রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’, ‘বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য’, ‘কমলাকান্তের জল্পনা’, ‘বঙ্কিম সরণী’র মতো গদ্যগ্রন্থ। কিন্তু এত লিখলেন কী ভাবে? এ বিষয়ে চিরশ্রীদেবীর সাক্ষ্য, ফি দিন ভোর থেকে ১০টা পর্যন্ত লিখতেন বাবা। সেই সঙ্গে বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন হয় লিখতেন, নয় পড়তেন। না হয় চুরুট ধরিয়ে এক মনে চিন্তা করতেন। ছাত্র অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যও দেখেছেন, ঘাটশিলায় প্রতি দিন সকালে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে লিখছেন মাস্টারমশাই। বিরাট এই সাহিত্যকীর্তির জন্য টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দীর্ঘদিনের সভাপতির পদ, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, আনন্দ পুরস্কার-সহ বহু সম্মানই পেয়েছেন প্রমথনাথ।

মৃত্যু- ১০মে, ১৯৮৫ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।





********************************************














No comments: