তিনি ছিলেন প্রধানত রিপোর্টার। দেখার চোখ ছিল অন্তর্ভেদী। একই জায়গায় দশজন যা দেখবেন,তা তিনি দেখবেন অন্যরকম। আর সেই দেখাটাই তাঁর লেখাকে দিয়েছে বাড়তি সমীহ। আর বলবেন -
‘‘যখন কোথাও যাবি, নিজের মতো করে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করবি। যাতে রিপোর্টে নিজস্ব ছাপ থাকে। অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়।’’
তাঁর সাপ্তাহিক কলাম ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’।নিজেকে এমন ভাবেই সহজ করে নিতে পারতেন গৌরকিশোর ঘোষ। বয়স বা পদের গুরু-দূরত্ব তাঁকে কোনও দিন অনুজদের কাছে অচেনা করে রাখেনি। আনন্দবাজারে চাকরি করতে এসে গৌরদাকে কাছের মানুষ ভাবতেও তাই সময় লাগেনি। হাফ পাঞ্জাবি বা ফতুয়ার মতো জামা, ধুতির কোঁচা মাটিতে ঠেকে না। ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে উজ্জ্বল দৃষ্টি, আর অবিন্যস্ত গোঁফের ফাঁকে একটু ফিচেল হাসির রেখা। সবমিলিয়ে এটাই হল গৌরদার মলাট। পাতা ওল্টালে ভরপুর গল্প, মজা, অভিজ্ঞতার নানা কাহিনিতে শিখে নেওয়ার উপকরণ।
গৌর কিশোর ঘোষ।
(20 জুন 1923 - 15 ডিসেম্বর 2000)
একজন বাঙালি লেখক এবং সাংবাদিক ছিলেন। কয়েক দশক ধরে আনন্দবাজার পত্রিকার সাথে যুক্ত । তাঁর দেশ মাটি মানুষ এবং প্রেম নেই উপন্যাসের জন্য তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন । তিনি ছিলেন আজকাল পত্রিকার প্রথম সম্পাদক।
তিনি রূপদর্শী ছদ্মনামে গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন।
১৯২৩ সালের ২০ জুন বাংলাদেশ যশোর জেলার হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক পড়াশোনা করেন শ্রীহট্ট জেলার এক চা-বাগানে। স্কুলের পাঠ নদিয়া জেলার নবদ্বীপ বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে আইএস-সি পাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত গৌরকিশোর ক্রমাগত পেশা বদলে গেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, খালাসি, রেস্তরাঁয় বয়, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, ইস্কুল মাস্টার থেকে ভ্রাম্যমাণ নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করেছেন সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের আগে পর্যন্ত।
1941 থেকে 1953 সালের মধ্যে তিনি তার পেশার বিভিন্নতা করেছিলেন। অন্যদের মধ্যে, তিনি প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিশিয়ান এবং ফিটার, নাবিক, রেস্তোরাঁয় ওয়েটার, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক, স্কুল শিক্ষক, ট্যুরিং ডান্স ট্রুপের ম্যানেজার , ল্যান্ড কাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার এবং অন্যান্য হিসাবে কাজ করেছিলেন। , সীমান্ত কাস্টমস ক্লার্ক হিসাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চাকরি থেকে তিনি একটি নতুন দৈনিক পত্রিকা, সত্যযুগে যোগদান করেন যেখানে তার স্বতন্ত্র লেখার শৈলী তাকে দুটি বৈশিষ্ট্য বিভাগের সম্পাদক পদে পদোন্নতি দেয়। এইভাবে, তিনি তার নির্বাচিত পেশায় স্থায়ী হন, একজন সাংবাদিক/সাংবাদিক।
সাহিত্য সাপ্তাহিক দেশ এবং কলকাতার বৃহত্তম স্থানীয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় কলাম লেখেন , যার মধ্যে তিনি সিনিয়র সম্পাদকও হন । তিনি 1969 থেকে 1971 সাল পর্যন্ত নকশাল আন্দোলনের সময় পশ্চিমবঙ্গের যন্ত্রণাকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ করে তাঁর "রূপদর্শীর নিউজ কমেন্টারি"-তে চিত্রিত করেছেন। তিনি প্রায়শই তার কলম নামে, রূপদর্শী লিখতেন।
1975 সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করার পর , ঘোষ তার মাথা কামিয়ে দেন এবং তার 13 বছর বয়সী ছেলের কাছে একটি প্রতীকী চিঠি লেখেন যাতে তার লেখার স্বাধীনতা হারানোর জন্য তার "শোক" আচরণ ব্যাখ্যা করে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত , একটি বাংলা মাসিক, এই চিঠিটি তার গ্রেপ্তারের কারণ হয়েছিল, ভূগর্ভস্থ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল এবং প্রতিবাদের একটি ক্লাসিক হয়ে উঠেছে। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে আরেক সাংবাদিক বরুন সেনগুপ্তের সঙ্গে । ঘোষ কারাগার থেকে স্বৈরাচারী শাসনের অপব্যবহারের জন্য আরও দুটি চিঠি পাচার করেছিলেন, এর আগে তার সেলে তিনি তৃতীয় হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
যদিও জরুরী অবস্থার অবসানের পর আনন্দ বাজার পত্রিকার সিনিয়র সম্পাদক হিসাবে পুনর্বহাল হন এবং তিনি তার অসুস্থতা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন, ঘোষ 1980 এর দশকের শুরুতে কয়েকজন সহযোগীর সাথে মিলে আজকাল (এই সময়) শুরু করেন।
আজকালের সাথে সংক্ষিপ্ত কাজ করার পরে , তিনি শেষ অবধি আনন্দবাজার পত্রিকার জন্য লিখেছেন ।
তার সাপ্তাহিক ব্যঙ্গাত্মক কলাম বিখ্যাত ছিল, পাশাপাশি হাস্যরসাত্মক গল্পের সিরিজও ছিল। তাঁর পরিপক্ক কাজ হিন্দু ও মুসলিম সমাজের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার বরং অবহেলিত ক্ষেত্র বেছে নিয়েছিল।
তার হালকা কাজগুলির মধ্যে ব্রজোদা , যদিও ফেলুদা , ঘনাদা এবং টেনিদার মতো জনপ্রিয় নয় , বাংলার তথাকথিত দাদা-সাহিত্যে তার স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখে গেছেন।
পুরষ্কার
সাহিত্যের জন্য আনন্দ পুরষ্কর (1970) [ উদ্ধৃতি প্রয়োজন ]
কো জয় ইউকে মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড (1976), দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার থেকে।
র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (1981) সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সৃজনশীল যোগাযোগ শিল্পের জন্য।
মহারাষ্ট্র সরকার পুরস্কার (1981)। [ তথ্যসূত্র প্রয়োজন ]
বঙ্কিম পুরস্কার (1982)। [ তথ্যসূত্র প্রয়োজন ]
হরদয়াল হারমনি পুরস্কার (1993)। [ তথ্যসূত্র প্রয়োজন ]
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরস্কার (1993)।
সাহিত্যকর্ম:
উপন্যাস:
জল পড়ে পাতা নড়ে
প্রেম নেই
প্রতিবেশী
এই দাহ
মনের বাঘ
একধরনের বিপন্নতা
কমলা কেমন আছে
এই কলকাতায়
সাগিনা মাহাতো
আমরা যেখানে
পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী, হাহা
ছোট গল্প সংকলনঃ
Ei কলকাতা (1952)
মন মানে না (1955)
সাগিনা মাহাতো (1969)
Poschimbongo Ek Promod Toroni, হা হা! (1969)
আমরা জেখানি (জুন 1970)
প্রেম নে
জল পোরে পাতা নরে
ব্রজোদার গোলপো সমগ্র
সগিনা মাহাতো , তাঁর রাজনৈতিক কর্মী অতীতে তাঁর সহকর্মীর স্মরণে তাঁর লেখা একটি গল্প, হিন্দি ( সগিনা ) এবং বাংলা ( সগিনা মাহাতো ) তপন সিনহার সিনেমায় সফলভাবে গৃহীত হয়েছিল , যার সাথে বিখ্যাত ছিলেন উভয় ক্ষেত্রেই নায়ক সাগিনা মাহাতোর ভূমিকায় অভিনয় করছেন থিস্পিয়ান দিলীপ কুমার ।
তিনি 15 ডিসেম্বর 2000 সালে মারা যান।
2011 সালে, একটি কলকাতা মেট্রো স্টেশন তার নামে নামকরণ করা হয়
এই কলকাতায় (১৯৫২) গল্পগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যভুবনে গৌরকিশোর ঘোষের আত্মপ্রকাশ। তাঁর সাহিত্য-দর্শন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক যে নিবিড়, এই কথাটা শুনি অন্নদাশংকর রায়ের মুখে ৩৬-৩৭ বছর আগে। … তরুণ বয়সে কথাটা শুনেছিলাম বলেই হোক কিংবা অন্নদাশঙ্কর কথাটা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন বলেই হোক, আমার কাছে ওটা লেখক জীবনের মন্ত্র হয়েই রয়ে গেল।’ (গৌরকিশোর ঘোষ, ‘জীবন, সত্য, সাহিত্য’, জিজ্ঞাসা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৯০, পৃ ১১৭)
এই কলকাতায় গল্পগ্রন্থটি নামহীন দশটি কাহিনিতে বিধৃত লেখকের কলকাতা-দর্শন। দ্বিতীয় গ্রন্থ মন মানে না (১৩৬৬); পরেরগুলো সাগিনা মাহাতো (১৯৬৯), আমরা সেখানে (১৯৭০), পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী হা হা (১৩৭৮)। সাগিনা মাহাতো গল্পগ্রন্থের ‘সাগিনা মাহাতো’ গল্পটি নিয়ে তপন সিংহের পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নামভূমিকায় দিলীপ কুমার অভিনয় করেন। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর গল্পের সঙ্গে চলচ্চিত্রটির তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘গল্পটা এত ভাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু লেখার দোষে একটা ভাল গল্প হয়ে দাঁড়াল না। অথচ এই গল্পেই আমি প্রথম আমার জীবনের অভিজ্ঞতাকে অনেকটাই মেলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। সত্যকে অনেক স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। সাগিনার চরিত্রে যে একটা ভাব ছিল, দুর্দান্ত নেতৃত্ব ছিল, যৌনতৃপ্তিতে তার কোনো বাছবিচার ছিল না, তার বিচার বিবেচনা বাহ্য জগতের শৃঙ্খলার ধার ধারেও না, মদের নেশা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত এবং মারদাঙ্গায় সে পিছপা হত না, এই সব নিয়েই সাগিনা ছিল অতিবিশ্বস্ত এবং স্নেহপরায়ণ বন্ধু এবং একটা নিটোল মানুষ; এই ব্যাপারটা আমার গল্পে যতটা গভীরতা নিয়ে ফুটে ওঠা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়েছে, আমার গল্পটায় ঠিক তেমনভাবে এই চরিত্রটা ফুটে ওঠেনি।
আমার এই গল্প নিয়ে তপন সিংহ যে ফিল্মটা করেছিলেন … অভিনেতা দিলীপকুমার আশ্চর্য দক্ষতায় আমার খামতি মিটিয়ে দিয়ে সাগিনার চরিত্র অনেকটা কাছাকাছি চিত্রিত করে তুলেছেন। মজা এই যে, সাগিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমারই ছিল। তপন বা দিলীপ তাকে চোখেও দেখেননি। সৃষ্টি যে কোথায় কেমনভাবে হয় সেটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে।’ (জিজ্ঞাসা, পূর্বোক্ত, পৃ ১১৩)
আমরা সেখানে গ্রন্থে দুটি গল্প ‘বাঘবন্দী’ ও ‘তলিয়ে যাবার আগে’। গ্রন্থের শুরুতে লেখকের বক্তব্য : এ কাহিনীর নায়িকা কলকাতা – যে কলকাতায় এখন প্রচণ্ড হিংস্রতা আর অন্ধ আতঙ্ক, এ দুটি প্রবৃত্তিই প্রবল। আর নায়ক : সময়, ১৯৬৯-৭০। বাকি সবাই পার্শ্বচরিত্র। গ্রন্থটি আরতি সেন ও গৌরী আইয়ুবকে উৎসর্গীকৃত।
পশ্চিমবঙ্গ প্রমোদ তরণী হা হা সাতটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলোতে সমকালের চিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
এছাড়া বারোটি অগ্রন্থিত গল্প রয়েছে গৌরকিশোর ঘোষের। গল্পগুলি পূর্বে উল্লিখিত গল্পের মতো নয়। অগ্রন্থিত গল্পগুলো ‘অন্তর্মুখী’, ‘ঘটনাবিরল’, ‘নিম্নকণ্ঠ’, ‘অল্প কয়েকটি রেখার সুসম্পূর্ণ’। (অলোক রায়, ভূমিকা, গল্প সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৩)
উপন্যাসের ধারায় গৌরকিশোর ঘোষের অত্যন্ত মূল্যবান রচনা দেশ মাটি মানুষ। দেশ মাটি মানুষ কোনো নির্দিষ্ট উপন্যাসের নাম নয়, তিন খণ্ডে লেখা এপিক ট্রিলজি।
জল পড়ে পাতা নড়ে (১৯৬০), প্রেম নেই (১৯৮১) আর প্রতিবেশী (১৯৯৫) তিনটি স্বতন্ত্র উপন্যাস। কিন্তু আদতে একই উপন্যাসের পৃথক খণ্ড মাত্র। তিনটিতে গৌরকিশোরের অভিপ্রায় ছিল দেশবিভাগের ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরা। ট্রিলজির প্রথম খণ্ডের কাহিনির শুরু ১৯২২-এ, তৃতীয় খণ্ড শেষ হয়েছে ১৯৪৬-এ। ২৫ বছরের সময়সীমায় এই তিনটি গ্রন্থের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। প্রথম খণ্ড জল পড়ে পাতা নড়ের কাহিনির সঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড প্রেম নেই’-এর কাহিনির কিছুটা ধারাবাহিকতা আছে, কিন্তু তৃতীয় খণ্ডের কাহিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে ‘তিনটি খণ্ডেরই মূল বিষয়টি একই, অর্থাৎ বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং পঁচিশ বছরে তার বিবর্তন। যা গোড়ায় ছিল ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাত সেটাই কী করে ক্রমে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পৌঁছে দেশকে খণ্ড খণ্ড করল তারই বস্তুনিষ্ঠ সহৃদয় চিত্রণ। ভারত-ইতিহাসের এই সুপরিচিত ট্র্যাজিডি গৌরের উপন্যাসেও দুটি মানব-মানবীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজিডিতে পরিণত হয়েছে তৃতীয় খণ্ডে এসে।’ (গৌরী আইয়ুব, ‘ভূমিকা’, প্রতিবেশী, ১৯৯৫)
গৌরকিশোরের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মনের বাঘ (১৯৬২), এই দাহ (১৯৩২), লোকটা (১৯৬৬), গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে (১৯৭২), এক ধরনের বিপন্নতা (১৯৮১), কমলা কেমন আছে (১৯৮৫)।
এই দাহ উপন্যাসে জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন গৌরকিশোর। উপন্যাসের নায়ক গোলক ছিলেন শিল্পী। ছন্নছাড়া এই শিল্পীর একদা যক্ষ্মা ধরা পড়ে। যক্ষ্মার চিকিৎসা করে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে সে নীরোগ, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপনের উপযুক্ত। কিন্তু বাদুড়ে মুখ দিলে যেমন ভালো ফলও পচে যায়, তেমনি টিবি স্যানাটোরিয়াম ফেরত মানুষ সম্পর্কে টিবিমুক্ত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি – সেই পরিপ্রেক্ষিতেই গোলকের অন্তর্দাহের উপস্থাপনা।’ (রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘এই দাহ’, বিতর্কিকা, শীত ১৩৯০, পৃ ৪৩)
গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে উপন্যাসে গৌরকিশোর ঘোষের মতে, তিনি এবং তাঁর স্ত্রীর ছায়া পড়েছে। সংসারে দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে একঘেয়েমি আসে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিত্বের টানাপড়েনে তিক্ততা আসে। বাইরের ঘটনার চাপ বা সময়ের প্রবল পীড়ন দুজনকে কাছে টানে বা দূরে ছুড়ে দেয়। নায়কের ব্যক্তিত্বের সংকট লোকটা উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এক ধরনের বিপন্নতা উপন্যাসে এক নারীর সঙ্গে প্রেমের অভিজ্ঞতা বর্ণিত। উপন্যাসে তিনটি নারী চরিত্র সৃষ্টি হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের একই সত্তা : লেখকের ভাষায় ‘আদতে তা একজনেরই চেহারা।’
সংস্কৃতি সম্পর্কে গৌরকিশোর ঘোষ বলেছেন, ‘গঙ্গা, পদ্মা এবং বাংলা ভাষা – এই তিনটি আদি প্রবাহ বাংলার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলার সংস্কৃতি আজও বাঙালি তৈরি করতে পারেনি। বাঙালি আজও নানা ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে আছে। রাজনীতির কারণে ভৌগোলিক বিভাগকে আমি কখনোই বড়ো বলে মনে করিনি। আমাদের বড় ব্যর্থতা বহুধা-বিভক্ত আমাদের মনে। আমরা আমাদের নিজস্ব ধারায় আজও সংস্কৃত হতে পারিনি।’ (‘গঙ্গা, পদ্মা, বাংলা ভাষা’, সাহিত্যমেলা, ১৯৮২)
বাঙালি সংস্কৃতিকে গড়ে তুলতে হলে সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তার মধ্যে বিয়ে একটি উত্তম পন্থা। বিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয় সম্বন্ধ বিস্তার করে। অসম সম্প্রদায়ের বিয়ে দুটি সংস্কৃতির ধারার মিলন ঘটায়। পরস্পরের ভাব বিনিময়ে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়।
সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর অবদানের জন্যে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর খ্যাতির মূলে ছিল সাংবাদিক ক্ষেত্রে তাঁর সত্যনিষ্ঠতা ও নির্ভীকতা। নববাণী পত্রিকায় যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু। পরের পত্রিকা সত্যযুগ। এরপর আনন্দবাজার। আনন্দবাজারে যুক্ত থাকাকালে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছান। পরের পত্রিকা আজকাল। এখানে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজকাল ছেড়ে দিয়ে সরাসরি কোথাও যুক্ত হননি। আনন্দবাজারে সম্পাদকীয় লিখতেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর কলকাতার দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকার খবর সংগ্রহ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দাঙ্গা-বিধ্বস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। একটা সময় দেশ পত্রিকায় গৌরকিশোর ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে নিয়মিত নকশা জাতীয় রচনা লিখতেন। কলকাতা শহরের বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য সন্ধান করতেন। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে তিনি কলামটি লিখতেন। বিমল কর তাঁকে ডেডিকেটেড সাংবাদিক বলেছেন। তাঁর মতে, গৌরকিশোরের বিদ্যাবুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা, সবই মানবিক ও আদর্শবাদী। (বিমল কর, ‘গৌরকিশোর’, দিনক্ষণ, ১৪০১, পৃ ৩২)
‘রূপদর্শী’র মতো গৌড়ানন্দ কবি ছদ্মনামে গৌরকিশোর দীর্ঘদিন একটা কলাম লিখেছিলেন। এই রচনাগুলির বিষয় রাষ্ট্রনীতি অথবা রাজনীতি, সামাজিক অসংগতির চিত্র এখানে নেই। ‘স্বভাবতই রূপদর্শীর রচনায় কৌতুকের সঙ্গে যে সহানুভূতি ও মর্মবেদনার স্পর্শ পাওয়া যেত, গৌড়ানন্দ কবির রচনায় সেটা মেলে না। তার বদলে যা পাওয়া যায় তা শানিত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ।’ (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ‘গৌরকিশোর’, দিনক্ষণ, ১৪০১, পৃ ৩৮)
গৌড়ানন্দ কবি ছাড়া গজমূর্খ, বেতালভট্ট, কনকন গৌরতান মোল্লা প্রভৃতি ছদ্মনামে নকশা লিখেছেন গৌরকিশোর ঘোষ।
আজকাল সম্পাদক গৌরকিশোর স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি একটি দলনিরপেক্ষ সংবাদপত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি সাংবাদিকতার পেশায় মেয়েদের যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। এর আগে কলকাতার পত্রিকায় নারী সাংবাদিক নিয়োগের ইতিহাস নেই। সম্পাদক হিসেবে গৌরকিশোর ঘোষ দৈনিক আজকালকে যথার্থই একটি আধুনিক নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।
২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর পরিসমাপ্ত হয় এই মানবপ্রেমিক সত্যভাষণে অকপট সাহসী সাংবাদিক ও সাহিত্যিকের গল্প-প্রতিম জীবনের। গৌরকিশোর ঘোষ যে জীবনযাপন করেছেন তা ছিল ব্যতিক্রমী ও অনাড়ম্বর। তিনি কেবল সফল সাংবাদিক ও জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সর্বব্যাপী সহানুভূতি ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের জটিল রাজনৈতিক পরিবেশে তিনি সব ধর্মের, সব পেশার মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাই ভাগলপুরের দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় বারবার ছুটে গেছেন উৎস খুঁজে বের করার জন্য এবং দাঙ্গায় আক্রান্তদের সেবাদানের উদ্দেশ্যে। সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর এই সহানুভূতি ও সহমর্মিতার জন্য বন্ধুরা তাঁকে ‘মৌলভী গৌরকিশোর’ বলে রসিকতা করতেন। বহু বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আমৃত্যু তিনি তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।
###############################
No comments:
Post a Comment